Ajker Patrika

স্বপ্নকে ছাড়িয়ে গেছেন যিনি

মইনুল হাসান, ফ্রান্স
আপডেট : ১১ জানুয়ারি ২০২৩, ১৫: ৪৯
স্বপ্নকে ছাড়িয়ে গেছেন যিনি

প্রার্থীর সংখ্যা প্রায় ২৩ হাজার। এর মধ্য থেকে চূড়ান্ত পর্যায়ে মাত্র পাঁচজনকে বাছাই করা হয়েছে। ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা (ইসা) কর্তৃক বাছাই করা সবাই মানসিক ও শারীরিক উৎকর্ষে প্রায় ত্রুটিহীন মানুষ। পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে অবস্থিত স্থায়ী আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে ২০২৬ সাল থেকে যে নভোচারী দলটি অবস্থান করবে, এই পাঁচজন হচ্ছেন সেই দলের সদস্য। তাঁদেরই একজন সোফি আদেনো, ফরাসি নারী। বাকি চারজন পুরুষ এবং তাঁরা স্পেন, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড ও যুক্তরাজ্যের নাগরিক।  

সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করলেন, নারী বলেই সোফি আদেনোকে কোনো রকম ছাড় দেওয়া হয়েছে কি না? ‘না, তা মোটেই নয়।’ বাছাই কমিটির প্রধানের সাফ জবাব। বললেন, সোফি মাত্র চার দশকের জীবনের প্রতিটি পর্যায় সাজিয়েছেন অনন্য সাফল্যে। ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ার সঙ্গে খেলাধুলায়ও সমান পারদর্শী ছিলেন। ছিলেন আত্মবিশ্বাসী এবং সাহসী একজন মানুষ। সহকর্মীদের সঙ্গে সব সময়ই সদ্ভাব বজায় রেখেছেন, যা অনেকের জন্যই খুব কঠিন। প্রায় ২৩ হাজার প্রার্থীকে পেছনে ফেলে সাফল্য এবং স্বপ্নের চূড়ায় পৌঁছাতে পেরেছেন তিনি।

সোফি আদেনোর জন্ম ১৯৮২ সালের ৫ জুলাই। বয়স ৪০ বছর এবং তিনি একজন সেনা কর্মকর্তা। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিবাহিত এবং দুই সন্তানের গর্বিত মা। কয়েক দিন আগেও তিনি ছিলেন অপরিচিত—আর দশজন সাধারণ মানুষের মতো।

২৩ নভেম্বর, বুধবার থেকে ইউরোপের সংবাদমাধ্যমে তাঁর কথা ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে। বিশ্বকাপ ফুটবলের ডামাডোলে সেই খবর অনেকের কানে পৌঁছায়নি। কিন্তু যাঁরা মহাকাশ নিয়ে ভাবতে ও জানতে পছন্দ করেন, তাঁরা ঠিকই জেনে গেছেন যে সোফি আদেনো দ্বিতীয় ফরাসি নারী মহাকাশচারী হতে যাচ্ছেন। এর প্রায় ২০ বছর আগে ক্লোডি এনুরে প্রথম ফরাসি নারী নভোচারী হিসেবে দীর্ঘদিন পৃথিবীর আলো-বাতাস ছেড়ে আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে কাটিয়েছেন।

সোফি তাঁর পিতামহের কথা বলেন। ছোটবেলায় আদরের সোফিকে কাছে বসিয়ে রাতের আকাশে বহু আলোকবর্ষ দূরের নক্ষত্র দেখতে দেখতে দাদু নিজের তারুণ্যের সোনালি স্মৃতির কথা শোনাতেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় সোফির দাদু ছিলেন ফরাসি সেনাবাহিনীর একজন বিমান মেরামতকারী। নিজের হাতে মেরামত করেছেন বহু যুদ্ধবিমান। মেরামত শেষে সেসব উড়ন্ত যন্ত্রদানব প্রচণ্ড শব্দ করে দ্রুতগতিতে যখন আকাশের দূর সীমানায় মিলিয়ে যেত, তখন গর্বে বুক স্ফীত হতো তাঁর।

পিতামহের গল্পে জাদু ছিল। সোফি সেই জাদুর মোহ এড়াতে পারেননি। সেই থেকে পাইলট, নভোচারী হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন ছোট্ট সোফি। সেই স্বপ্ন আলিঙ্গন করতে কল্পনার হাতে নিজেকে সমর্পণ করেননি মোটেও। নিজেকে ধাপে ধাপে তৈরি করেছেন এবং একান্ত অধ্যবসায়ে নিজেকে গড়ে তুলতে শুরু করেন। প্রথমে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং এরপর বিমান প্রকৌশলে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। এর সঙ্গে খেলাধুলা এবং শরীর গঠনে হেলা করেননি কখনোই। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে ঘুরেফিরে দাদুর কথা বলেছেন। ফরাসি নারী বিজ্ঞানী মারি ক্যুরি ছিলেন তাঁর অনুপ্রেরণা, সে কথাও বলেছেন।

সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নারীদের কী করা উচিত? সাংবাদিকের এমন প্রশ্নে চটজলদি উত্তরে সোফি বলেন, নারীকে যেমন অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে হবে, তেমনি বুদ্ধিভিত্তিক অবস্থানকে সংহত করতে হবে। তিনি নিজেই তাঁর প্রমাণ। নিজ দক্ষতায় তিনি ফরাসি বিমান ও মহাকাশ বাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে উত্তীর্ণ হতে পেরেছেন। হেলিকপ্টার চালিয়ে আফগানিস্তানের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আহত সৈন্য উদ্ধারে চরম নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছেন। সোফির ভাষায়, ‘এ পর্যন্ত পৌঁছাতে প্রতিটি সোপান গড়তে এক-একটি ইট খুব যত্ন করে গেঁথেছি। কাজে, দায়িত্বে অবহেলা বা ফাঁকি দেওয়ার কথা কখনোই মাথায় আসেনি।’ সোফি মনে করেন, কর্মক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার যে মনোভাব থাকবে এবং এটাই স্বাভাবিক। তবে তাঁর পুরুষ সহকর্মীরা তাঁকে নারী হিসেবে অবজ্ঞা করতে চাইলে, তিনি উষ্মা প্রকাশের পরিবর্তে নিজের যোগ্যতা প্রমাণে আরও বেশি মনোযোগী হয়েছেন। বিশালসংখ্যক প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে অচিরেই তাঁর নভোচারী হওয়ার স্বপ্ন সার্থক হতে চলেছে। আজ তিনি তাঁর পুরুষ সহকর্মীদের ধন্যবাদ দিচ্ছেন এ জন্যই যে তাঁদের এমন আচরণ তাঁর কর্মদক্ষতা এবং আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধিতে অনেক ক্ষেত্রেই অনুঘটকের কাজ করেছে।  

স্বপ্ন শুধু ধারণ করলেই হয় না, তা বাস্তবায়ন করতে নিজেকে তৈরি করতে হয়। সোফি আদেনো তা করে দেখিয়েছেন। 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত