Ajker Patrika

বিশ্বজুড়ে নারী নির্যাতন: ঘনিষ্ঠজনের হাতেই শঙ্কিত যে জীবন

কাশফিয়া আলম ঝিলিক, ঢাকা 
আপডেট : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১: ৩২
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলায় পারিবারিক কলহের জেরে ছোট ভাইয়ের স্ত্রীকে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনার পর অভিযুক্ত ব্যক্তি গত ৩ আগস্ট নিজেই রক্তমাখা ছুরিসহ থানায় আত্মসমর্পণ করেন। ১৩ আগস্ট পশ্চিম শেওড়াপাড়ায় চার সন্তানের মা এক নারীর রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সেই ঘটনার প্রতিবেদনে দেখা যায় নিহতের পরিবারের আহাজারি। পরিবারের দাবি, শ্বাসরোধে হত্যা করে তা আত্মহত্যা দেখানোর চেষ্টা ছিল নিহতের স্বামীর। ঘটনার পর থেকে যিনি পলাতক।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে দেশে ৩৬৩টি পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ৩২২ জনের। বেশি হত্যার ঘটনা ঘটেছে স্বামীর হাতে। খুন হয়েছেন ১৩৩ জন নারী। স্বামীর পরিবারের সদস্যদের হাতে হত্যার শিকার হয়েছেন ৪২ জন। আর ৩৩ জন হত্যার শিকার হয়েছেন নিজ পরিবারের সদস্যদের হাতে।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জাতীয় নারী সুরক্ষা হেল্পলাইন ১০৯-এর তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের শিকার নারীর জন্য সহায়তা চেয়ে কল এসেছিল ৪৮ হাজার ৭৪৫টি! জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত সাড়ে ৮ মাসে নারী নির্যাতনের ঘটনায় ১৭ হাজার ৩৪১টি কল এসেছিল। এগুলোর মধ্যে পারিবারিক নির্যাতনের অভিযোগে কল এসেছিল ৯ হাজার ৭৪৬টি। এসব কলের মধ্যে শুধু স্বামীর বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ ছিল ৯ হাজার ৩৯৪টি। কিন্তু এটাই কি শেষ?

যে ঘটনায় কোনো মামলা করা হয় না, সেটি কোনো হিসাবের আওতায় আসে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক তানিয়া হক বলেন, ‘আমাদের থানাগুলোও হিউম্যান ফ্রেন্ডলি নয়। তারা সেই আস্থার জায়গাটা এখনো অর্জন করতে পারেনি সাধারণ মানুষের কাছে।’ এর ফলেই তৈরি হয় রিপোর্টিং গ্যাপ, যা এই ধরনের অন্যায়কে সমাজে স্বাভাবিক করে তুলছে দিনের পর দিন।

ভয়, সামাজিক কলঙ্ক, আর্থিক অসংগতি এবং বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা; ভুক্তভোগীদের মামলা না করার প্রধান কারণ বলে উল্লেখ করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইফফাত গিয়াস আরেফিন। তিনি বলেন, ‘এই রিপোর্টিং গ্যাপ কমাতে প্রথমত, আইনগতভাবে ভুক্তভোগীর পরিচয় গোপন রাখা এবং দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা জরুরি। দ্বিতীয়ত, ভুক্তভোগী সুরক্ষা আইন কার্যকর করে তাঁদের নিরাপত্তা ও আর্থিক সহায়তা দিতে হবে। সামাজিকভাবে সচেতনতা বৃদ্ধি, পরামর্শক সেবা ও কমিউনিটি লিগ্যাল এইড কার্যক্রম শক্তিশালী করা দরকার।’

এই চিত্র যে শুধু বাংলাদেশেই, বাস্তবে তা নয়। এ বিষয়ে সারা বিশ্বের চিত্র খুবই ভয়াবহ। অস্ট্রেলিয়ার নারী অ্যালিসিয়া লিটল চার বছর ধরে সহিংস সম্পর্কে ছিলেন। ২০১৭ সালে তিনি আলাদা হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু সেদিনই তাঁর মদ্যপ বাগ্‌দত্তা চার্লস ইভান্স গাড়িতে পিষে হত্যা করেন। এ ঘটনায় মাত্র ২ বছর ৮ মাস জেলে ছিলেন। এরপর ছাড়া পান ইভান্স। অ্যালিসিয়ার মা লিটল তাঁর মেয়ের হয়ে ন্যায়বিচারের দাবি জানিয়ে একটি জাতীয় সহিংসতা অপরাধী ডেটাবেইস গঠনের জন্য আন্দোলন করছেন।

সাইবার সিকিউরিটি এবং ডিজিটাল অধিকারবিষয়ক বিশ্লেষক তানভীর হাসান জোহা বলেন, ‘বহু দেশে সহিংসতা ন্যায়সংগত বা সাংস্কৃতিকভাবে স্বীকৃত। সেখানে আইনি ও সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা শক্তিশালী নয়।’ নির্যাতন কিংবা সহিংসতার মতো ফেমিসাইডের ক্ষেত্রেও পরিবার কিংবা কাছের লোকজনের সম্পৃক্ততার পরিসংখ্যান বর্তমানে একটি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। জাতিসংঘের নারীদের ওপর সহিংসতাবিষয়ক নতুন বৈশ্বিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে প্রতিদিন আনুমানিক ১৪০ জন নারী ও কন্যাশিশু তাদের সঙ্গী কিংবা পরিবারের সদস্যের হাতে প্রাণ হারায়। জাতিসংঘের নারীবিষয়ক সংস্থা ইউএন উইমেন জানিয়েছে, ২০২৩ সালে প্রায় ৮৫ হাজার নারী ও কন্যাশিশু ইচ্ছাকৃতভাবে পুরুষদের হাতে খুন হয়েছে; তাদের মধ্যে ৬০ শতাংশ হত্যাকারী ছিল ভিকটিমের ঘনিষ্ঠ কেউ!

ডব্লিউএইচও এবং কিছু সহযোগী সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে বিশ্বজুড়ে প্রতি ৩ জন নারীর মধ্যে ১ জন আজীবন শারীরিক বা যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন। পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বে ৬৪১ মিলিয়ন নারী তাঁদের ঘনিষ্ঠ সঙ্গীর নির্যাতনের শিকার। ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের একটি জরিপে উঠে এসেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের এক-তৃতীয়াংশ নারী নির্যাতনের শিকার।

পরিবারে একে অন্যকে সময় না দেওয়া, প্রযুক্তিনির্ভর যান্ত্রিক জীবন যাপন করা পারিবারিক সহিংসতা এবং হত্যাকাণ্ডের অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক তানিয়া হক। তিনি বলেন, ‘পরিবার, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রে ঘটা কোনো কিছুরই ভাষা সহিংসতা হতে পারে না। আমরা একটা করপোরেট লাইফ লিড করি; তাতে ভালোবাসা, ধৈর্য, সময়—এগুলো কম। কম্পিটিটিভ জীবনধারা মানুষকে অস্থির করে তুলছে। এ কারণে সহিংসতা দিন দিন বাড়ছে।’ সমাজের মানুষের মধ্যে মূল্যবোধ তৈরি না হওয়ায় একজন শিক্ষিত ও অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল নারীকেও সহিংসতার শিকার হতে হয়। এসব ক্ষেত্রে একটি রাষ্ট্রের অবস্থানকে আরও শক্ত হতে হবে বলে উল্লেখ করেন তানিয়া হক।

নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ার একটি বড় কারণ প্রযুক্তি। সাইবার সিকিউরিটি ও ডিজিটাল অধিকারবিষয়ক বিশ্লেষক তানভীর হাসান জোহা বলেন, ‘প্রযুক্তির মাধ্যমে সাইবার নির্যাতনের ঘটনা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। যেমন ডিপফেক, সেক্সটরশন, অনলাইনে নিপীড়ন বা ডক্সিং ইত্যাদি। সাইবার স্টকিং, পাসওয়ার্ড ধরে রেখে নিয়ন্ত্রণ, মেসেজ বোম্বিং, ডিপফেক, ডক্সিং—এ সবকিছু প্রযুক্তিযুক্ত নির্যাতনের একেকটি ধরন।’

২০১৭ সালে নিহত অ্যালিসিয়ার মা কিংবা গত ১৩ আগস্ট নিহত নারীর পরিবার—সবাই জানতেন তাঁদের মেয়ে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এরপরেও তাঁদের মেয়েরা সংসার চালিয়ে গেছেন। এই ধরনের সিদ্ধান্ত তাঁদের একার নয়। এর সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে ভুক্তভোগীর পরিবারও জড়িত ছিল। এসব ঘটনা প্রমাণ করে, আমাদের সমাজ এবং পরিবারব্যবস্থা এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ও সহিংসতার জন্য দায়ী।

সহিংসতা আজ অপরাধ নয়, যেন সমাজব্যবস্থা হয়ে উঠেছে। নারীর প্রতি সহিংসতা শুধু ব্যক্তি নয়, সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্মিলিত

নয় কি? আইন, নীতি, অর্থায়ন ও সচেতনতা—সব দিক থেকেই সমন্বিত পদক্ষেপ ছাড়া এ সমস্যা থেকে মুক্তি সম্ভব নয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত