নাসুমের চড়-কাণ্ডে আসলে কী লেখা হয়েছে বিসিবির তদন্ত রিপোর্টে
নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
প্রকাশ : ০৬ জুন ২০২৫, ১৬: ২৪

ছবি: সংগৃহীত
২০২৩ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ব্যর্থতার তদন্ত রিপোর্ট সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশের পর হৈচৈ পড়ে যায়। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন প্রকাশের পরই অন্যতম আলোচিত বিষয় হয়ে দাঁড়ায় নাসুম আহমেদকে তৎকালীন প্রধান কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের ‘চড়-কাণ্ডে’র ঘটনা। বিসিবির তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন এখন তুলে ধরা হলো আপনাদের সামনে।
২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপ ব্যর্থতার তদন্ত প্রতিবেদন
- প্রধান কোচ (চন্ডিকা হাথুরুসিংহে) ও সাপোর্ট স্টাফদের মধ্যে টানাপোড়েনের বিষয় ছিল স্পষ্ট। সে যা-ই হোক, প্রধান কোচের সঙ্গে অধিকাংশ ক্রিকেটারের সম্পর্ক ভালো ছিল।
- চেন্নাইয়ে বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ড ম্যাচে প্রধান কোচের সঙ্গে নাসুম আহমেদের ঘটনা অধিকাংশ ক্রিকেটার শুনেছেন। কিন্তু ক্রিকেটারদের মধ্যে কেউ প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন না। নাসুম তখন ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে থাকা কারও সঙ্গে ঘটনা শেয়ার করেননি। সাধারণত যেটা বোঝা গেছে, ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এমনটা হওয়াতে দলের সদস্যরা এই ইস্যুকে বড় করে দেখেননি। দলের ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব পড়েনি। স্টেন্থ ও কন্ডিশনিং কোচ নিকোলাস লি ছিলেন একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী। লি-এর দাবি, হেড কোচ তখন নাসুমের ঘাড়ে আঘাত করেছিলেন। নাসুম নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে খেলেছেন বদলি ফিল্ডার হিসেবে। সে সময় নাসুম দেরি করায় প্রধান কোচ খেপে গিয়েছিলেন। নাসুমের শার্টের কোলার ধরে টেনে তাঁকে (নাসুম) আঘাত করেছিলেন হাথুরু। কী ঘটেছে, তৎকালীন নির্বাচক প্যানেলের দায়িত্বে থাকা হাবিবুল বাশার সুমনকে জানিয়েছিলেন নাসুম। তবে নাসুমের সঙ্গে এমন কোনো ঘটনা ঘটেছে বলে হাথুরু স্মরণ করতে পারছেন না বলে দাবি করেছেন। টিম পরিচালককে নাসুম জানিয়েছিলেন যে হাথুরুর তাঁর (নাসুম) প্রতি আচরণ ছিল শত্রুভাবাপন্ন।
- নেদারল্যান্ডসের কাছে হারের পরই বাংলাদেশের মোরাল অনেকটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
- ব্যাটিংবান্ধব উইকেটে ব্যর্থতার বড় কারণ দলের বাজে পারফরম্যান্স। প্রধান কোচের আন্তরিকতা, অনুশীলনে সুযোগ-সুবিধার বিষয়—কোনো ব্যাপারেই বিন্দুমাত্র অভিযোগ ছিল না। ক্রিকেটারদের সঙ্গে কোচিং স্টাফের অন্যান্য সদস্যদের সম্পর্ক ভালো ছিল।
- ক্রিকেটারদের মধ্যে বন্ধন ভালো ছিল। তবে কোচিং গ্রুপে বিভেদ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। এক পর্যায়ে হাথুরু নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। হাথুরু ও তৎকালীন বোলিং কোচ অ্যালান ডোনাল্ড দলের পরিকল্পনা নিয়ে সরাসরি কথা বলতে নাখোশ ছিলেন। ফিল্ডিং কোচ শেন ম্যাকডারমট জানতে পেরেছিলেন যে বিশ্বকাপের পর তাঁর চুক্তি নবায়ন নাও করা হতে পারে। হাথুরুর ব্যাপারে খুবই অখুশি ছিলেন ম্যাকডারমট। হাথুরু ব্যাপারটার সমাধান করেননি, এমনকি কোচদের মধ্যে ঐক্য আনতে পারেননি। তাতে হাথুরুর ম্যানেজমেন্ট স্কিল নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। অন্যান্য কোচ ও শ্রীধরন শ্রীরাম নিরপেক্ষ থাকতে চেয়েছেন। কোচদের মধ্যে দ্বন্দ্ব নেতিবাচক প্রভাব ফেলে দলের সদস্যদের মধ্যে। বিশেষ করে, নিকোলাস লি, শেন ম্যাকডারমট কঠোর পরিশ্রমী ছিলেন ও ক্রিকেটারদের সাহায্য করতে যখন প্রয়োজন, তখনই ঝাঁপিয়ে পড়তেন। কিন্তু ভেতরের দ্বন্দ্বের কারণে কাজের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন তাঁরা।
- কোচেরা সব সময় ক্রিকেটারদের উৎসাহ দিতেন। হাথুরু কঠোর ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলতে কয়েক জন ক্রিকেটার ভয় পেতেন। ভাষাগত ব্যাপারেও হয়তোবা এটা হতে পারে। তাঁর (হাথুরু) ধরন ছিল আক্রমণাত্মক। তবে পরিকল্পনা যুক্তি দিয়ে বোঝাতে পারতেন।
- একাদশ নির্বাচনসহ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যর্থতা, নানা সমস্যা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। প্রথম ম্যাচ জেতার পর উইনিং কম্বিনেশন ভেঙে যায় পরের ম্যাচেই। কলকাতার পিচ বাংলাদেশের অনুকূলে থাকা সত্ত্বেও নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে সঠিক একাদশ বাছতে পারেনি বাংলাদেশ। ৪৭ দিনের সফরে মাত্র ৮-১০ দিন অনুশীলন করা হয়েছে। পাকিস্তান ম্যাচের আগের দিন বাংলাদেশ একাদশ ঘোষণা করেছে। কিন্তু ম্যাচের দিন সেটা বদলে যায়। বেশিরভাগ ম্যাচের দিনও ক্রিকেটাররা জানতেন না যে তারা একাদশে থাকবেন কিনা।
- টিম পরিচালক বলেছেন যে দলের পরিকল্পনায় তিনি হস্তক্ষেপ করবেন না। কারণ, বোর্ডের থেকে এমন কিছু করার অধিকার তাঁকে দেওয়া হয়নি। কমিটি ও গণমাধ্যমে তিনি তাঁর অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। বিশ্বকাপে এই দায়িত্ব তাঁর ভালো লাগেনি বলে অভিযোগ করেছিলেন।
- ওয়ানডে অধিনায়ক তামিম ইকবালের বিশ্বকাপের ঠিক আগে আগে হঠাৎ অবসরে বেকায়দায় পড়ে বাংলাদেশ। তাঁর পরিবর্তে একজন ওপেনার খুঁজতে তখন গলদঘর্ম অবস্থা। প্রধান কোচসহ দলের সদস্যরা বলেছিলেন, তামিমের অবসরের কারণ তাঁরা জানতেন না। হাথুরু দাবি করেছিলেন, তামিমের সঙ্গে তাঁর (হাথুরু) সম্পর্ক ভালো ছিল।
সাকিবের কাছ থেকে তদন্ত কমিটি যা জানতে পেরেছে
- ২০২৩ বিশ্বকাপে নাসুমের ‘চড়-কাণ্ডে’র তদন্ত কমিটি কথা বলেছিলেন ওই সময়ের অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের সঙ্গে। সাকিবের মনে হয়েছে, নাসুমের সঙ্গে যদি কিছু হয়ে থাকে, সেটা সংবাদমাধ্যমে ফাঁস করেছেন বিসিবির ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের তৎকালীন প্রধান জালাল ইউনুস আর তামিম ইকবাল।
- সাকিবের জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব নিতে অনীহা ছিল।
- ব্যাটিং অর্ডারে বারবার পরিবর্তন বিশ্বকাপে দলের ভরাডুবির জন্য দায়ী।
- দলে সহকারী হিসেবে কাউকে নিয়োগ দেওয়ার আগে সতর্ক থাকা উচিত। সেক্ষেত্রে দলের গোপন তথ্য ফাঁস হতে পারে।
- প্রধান কোচ (হাথুরু) তাঁর দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করতে পারেননি। কারণ, বিশ্বকাপের আগে প্রস্তুতির জন্য যথেষ্ট সময় পাওয়া যায়নি।