রেজা করিম ও তানিম আহমেদ, ঢাকা
সংবিধান সংস্কার, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া ও সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর দূরত্ব কমছেই না। প্রধান এই তিন ইস্যুতে বিএনপির বিপরীত অবস্থান বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি)। কোনো পক্ষই ছাড় দিতে রাজি নয়। দলগুলোর এই অনড় অবস্থানে অনৈক্যের জালে জড়িয়ে যাচ্ছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, সভা, সমাবেশ, আলোচনায় এই তিন ইস্যুতে দূরত্ব-অনৈক্য বোঝা গেলেও ভেতরে-ভেতরে রয়েছে অন্য হিসাব-নিকাশ। জামায়াত ও এনসিপির একাংশ মনে করছে, আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হলে বিএনপি পুরো ফায়দা পাবে। বর্তমানে প্রশাসনসহ বড় সব জায়গায় জামায়াত ও এনসিপির মতাদর্শীরা আছেন। কিন্তু বিএনপি ক্ষমতায় এলে সবকিছু বদলে দেবে। এই আশঙ্কা থেকে দল দুটি সংস্কার, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও পিআর পদ্ধতি নিশ্চিত করতে চাইছে। এতে নির্বাচন বিলম্বিত হলেও সমস্যা নেই। কিন্তু মাঠের পরিস্থিতি বুঝে বিএনপি যেকোনোভাবে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন চায়। বিলম্বের আশঙ্কাকে তারা ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছে। এই তিন দলের এমন অবস্থানে মাঠে নামতে পারে জাতীয় পার্টির (জাপা) দুই অংশ।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন হবে। ইসি আজ বৃহস্পতিবার এই নির্বাচনের জন্য রোডম্যাপ ঘোষণা করবে। নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতিও সারছে। সব মিলিয়ে নির্বাচনের একটি আবহ তৈরির অবস্থা। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর দূরত্ব-অনৈক্য সব সম্ভাবনাকে অনিশ্চয়তার পথে নিয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকেরা।
রাজনৈতিক দলগুলোর অনৈক্য দূর করার চেষ্টা করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনও। তারা দফায় দফায় সংলাপ করেছেন দলগুলোর সঙ্গে। দূরত্ব কমিয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় আবারও সংলাপে বসবে।
রাজনৈতিক দলগুলোকে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বজায় রেখে এক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, ‘পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল হোন। আন্দোলন-সংগ্রামে একত্রে থেকেছেন, এটা অব্যাহত রাখুন।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখন আমরা একটা অন্তর্বর্তী ব্যবস্থায় আছি। সেটা শুধু সরকার হিসেবে না, সবাই। বাংলাদেশে রাজনীতির একটি অন্তর্বর্তী পরিস্থিতিতে ঐক্য, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সহনশীলতার জায়গাটা ধরে রাখা দরকার। কেননা পরাজিত শক্তিরা সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করবে, সেটা যেন না নিতে পারে, সে জন্য রাজনীতিবিদদের সজাগ ও সক্রিয় থাকতে হবে।’
জামায়াতের দ্বিধা, সংশয়: জামায়াতে ইসলামী স্পষ্টই বলেছে, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি এবং পিআর পদ্ধতির সিদ্ধান্ত না হলে তারা নির্বাচনে যাবে না। দলটি ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরির দাবিও জানাচ্ছে। এগুলোসহ সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে দলটি মিছিল, সমাবেশও করছে। রাজপথে এসব কর্মসূচির মাধ্যমে তারা নিজেদের অবস্থান জানান দিচ্ছে। পাশাপাশি সরকার, বিএনপিসহ সংশ্লিষ্টদের বার্তা দিচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, গত বছরের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে জামায়াত। প্রশাসন, বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে জামায়াত-সমর্থিত ব্যক্তিরা ভালো অবস্থায় রয়েছেন। ১৬টির মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের সমর্থিত ব্যক্তি উপাচার্য হয়েছেন। প্রশাসনের উচ্চপর্যায়েও একই অবস্থা। দলটির আশঙ্কা, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হলে বিএনপি বেশি আসন পাবে। বিএনপি ক্ষমতায় এলে তাদের এই ‘শক্তি’ ভেঙে দেবে। অভ্যুত্থানের সব অর্জন নষ্ট করে দেবে। এ কারণে দলটি বুঝে-শুনে নির্বাচনে যেতে চায়।
অবশ্য জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের আজকের পত্রিকাকে বলেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনে জামায়াতের আপত্তি নেই। তবে নির্বাচনের বড় প্রস্তুতিমূলক কাজ সংস্কার। সেটিকে চূড়ান্ত করতে হবে, সংস্কারের আইনি ভিত্তি দিতে হবে। তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টার প্রতিশ্রুতি ছিল সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন করার। নির্বাচনের ঘোষণা তিনি দিয়েছেন, তার আগে তো সংস্কার হতে হবে। সেটি এখনো সম্পূর্ণ হয়নি।
এনসিপি সংস্কারের পক্ষে অনড়: সূত্র বলছে, জুলাই অভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্বের গড়া দল এনসিপি সংস্কারের পক্ষে অনড় অবস্থানে রয়েছে। প্রতিষ্ঠার মাত্র ছয় মাসে দলটি খুব গুছিয়েও উঠতে পারেনি। দলটির বেশির ভাগ নেতাই গণপরিষদ নির্বাচন ছাড়া সংসদ নির্বাচন চান না। তাঁরা পিআর পদ্ধতি ও নির্বাচনের আগে জুলাই সনদের আইন ভিত্তি দেওয়ার পক্ষে। এসব দাবি পূরণ হলে তাঁরা নির্বাচনে যাওয়ার কথা বলছেন। সব শর্ত পূরণ না হলে নির্বাচনের পর পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারে বলে তাঁদের আশঙ্কা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, এনসিপি এখনো গোছাতে পারেনি। ফেব্রুয়ারির নির্বাচন নিয়ে এনসিপির মধ্যে একাধিক ধারা রয়েছে। বিভিন্ন দল থেকে আসা নেতাদের একটি অংশ নির্বাচনের পক্ষে। তাঁরা রাজনীতিতে অবস্থান তৈরি করতে নির্বাচনে যেতে চান। তবে দলের বেশির ভাগ নেতাই প্রথমে জাতীয় নির্বাচনের বিপক্ষে।
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘গণপরিষদ নির্বাচন ও নতুন সংবিধান না হলে আমরা নির্বাচনে যাব না। আমাদের দাবি জনগণের দাবি। সেটা নিয়েই জনগণের কাছে যাব। নতুন সংবিধান, সংস্কার ও বিচারের দাবির সঙ্গে মানুষকে সম্পৃক্ত করে একটি বৃহত্তর আন্দোলনের দিকে আমরা এগিয়ে যাব।’ তিনি বলেন, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের দোসরদের নিয়ে যদি কোনো পক্ষ কিংবা সরকারও কোনো চিন্তাভাবনা করে, জনগণ তা রুখে দেবে।
জি এম কাদের ও আনিসুল ইসলাম মাহমুদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির দুই অংশের কার্যক্রমকেই সন্দেহের চোখে দেখছে জামায়াত ও এনসিপি। দল দুটি মনে করছে, সংস্কার, জুলাই সনদ ও পিআর পদ্ধতি নিয়ে তাদের অনড় অবস্থানের সুযোগ নিয়ে একটি পক্ষ নিজেদের পাল্লা ভারী করতে জাপার দুই অংশকে মাঠে নামাতে পারে। জাপা এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নির্বাচনেও নামতে পারে। কারণ, অতীতে দলটি বিএনপি, জামায়াতসহ অধিকাংশ দলের বর্জন করা নির্বাচনে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের আমলের নির্বাচনকে সাংবিধানিক বৈধতা দিয়েছিল।
জামায়াত ও এনসিপির নেতাদের আশঙ্কা, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হলেও তিন ইস্যুতে তাঁরা অনড় থাকলে জাপা আবার তুরুপের তাস হতে পারে। যাতে এবার লাভবান হবে বিএনপি। এ জন্য তাদের ওপর চাপ সৃষ্টির কৌশল হিসেবে পর্দার অন্তরালে জাপাকে একটি পক্ষ বানানোর আয়োজন চলছে বলে তাঁরা সন্দেহ ও আশঙ্কা করছেন।
বিএনপির সামনে চাপ: দীর্ঘ দেড় দশকের ক্ষমতার খরা কাটাতে চায় বিএনপি। দলের তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত এ ব্যাপারে চাপ রয়েছে। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে যে সুযোগ তৈরি হয়েছে, তা কোনোভাবেই হারাতে চায় না বিএনপি; যে কারণে সাবধানে পা ফেলে অগ্রসর হচ্ছে দলটি। বিএনপি মনে করে, তাদের চাপে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের ঘোষণা এসেছে। আজ ওই নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করতে যাচ্ছে ইসি। কিন্তু এরপরও নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটছে না বিএনপিতে। এর কারণ আরেক পক্ষের অনড় অবস্থান।
বিএনপি স্পষ্টই বলছে, তারা পিআর পদ্ধতিতে নেই। উচ্চকক্ষের বিরোধিতা করছে, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের প্রস্তাবকে সংবিধানবহির্ভূত বলছে। এসব ক্ষেত্রে জামায়াত-এনসিপির অবস্থান বিএনপিকে কঠিন সমীকরণে নিয়ে যাচ্ছে।
ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে বিএনপির অনিশ্চয়তার কথা এসেছে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্যেও। গতকাল বুধবার এক আলোচনা সভায় তিনি বলেন, ‘আজকে কিছুসংখ্যক রাজনৈতিক মহল অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে নির্বাচনকে বানচাল করার জন্য, নির্বাচনকে ব্যাহত করার জন্য নিত্যনতুন দাবি তুলে চলেছে। এগুলো নিয়ে তারা হুমকি দিচ্ছে, কথা বলছেন, অত্যন্ত জোরেশোরে হুমকি দিচ্ছেন। আমার প্রশ্নটা হচ্ছে, কেন করছেন এটা?’ তিনি বলেন, ‘সরকারের ভেতরে একটা মহল, তারা অত্যন্ত সচেতনভাবে চেষ্টা করছে, যারা গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তি, তারা যেন আসতে না পারে।’
মির্জা ফখরুল বলেন, এখনো সময় আছে। জুলাই সনদ, সংস্কার এসব নিয়ে জটিলতা না বাড়িয়ে সরকার যেন কার্যকর ব্যবস্থা নেয়; যাতে দলগুলো নির্বাচনমুখী হয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, নির্বাচনের প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে হলে বিএনপিকেই এগিয়ে এসে অন্য দলগুলোকে ভরসা দিতে হবে, আস্থায় আনতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান বলেন, বিএনপির উচিত আন্তরিকতার সঙ্গে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের উদ্বেগ চিহ্নিত করা এবং তাদের আশ্বস্ত করা যে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এলে তারা কোনো অবিচার করবে না কিংবা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা কায়েম করবে না। দলগুলোকে আস্থা ও নিশ্চয়তা দেওয়া গেলে অন্যরা বিএনপিকে বিশ্বাস করতে পারবে। তবে তিনি বলেন, কিছু দল যদি ভিন্ন উদ্দেশ্যে নির্বাচন ঠেকাতে চায়, সে ক্ষেত্রে বিএনপির পক্ষে সমন্বয় করা সম্ভব নয়। সেটা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়।
নির্বাচনের চেষ্টায় সরকার: দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য থাকলেও অন্তর্বর্তী সরকার চেষ্টা করছে ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করতে। এ জন্য প্রকাশ্য ও অন্তরালে বৈঠক চলছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সক্রিয় করার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার বদলে এখন শর্ত মুখ্য হয়ে উঠেছে।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (জাতীয় ঐকমত্য) মনির হায়দার আজকের পত্রিকাকে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থানকে কাছাকাছি নিয়ে আসার জন্য কমিশনের বিভিন্ন রকম চেষ্টা ও তৎপরতা চলমান আছে।
পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, নির্বাচন না হলে শুধু বিএনপি নয়, জামায়াত ও এনসিপিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। রাজনৈতিক অচলাবস্থা দীর্ঘ হলে জনগণের মধ্যে হতাশা জন্মাবে।
দলগুলো পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের মাধ্যমে দলীয় অবস্থান তুলে ধরছে বলে মনে করেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ও সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘গণতান্ত্রিক উত্তরণের লক্ষ্যে সবাই একমত হয়ে প্রস্তাবিত জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করবে; যার মাধ্যমে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথ সুগম হবে এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথ প্রশস্ত হবে।’
সংবিধান সংস্কার, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া ও সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর দূরত্ব কমছেই না। প্রধান এই তিন ইস্যুতে বিএনপির বিপরীত অবস্থান বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি)। কোনো পক্ষই ছাড় দিতে রাজি নয়। দলগুলোর এই অনড় অবস্থানে অনৈক্যের জালে জড়িয়ে যাচ্ছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, সভা, সমাবেশ, আলোচনায় এই তিন ইস্যুতে দূরত্ব-অনৈক্য বোঝা গেলেও ভেতরে-ভেতরে রয়েছে অন্য হিসাব-নিকাশ। জামায়াত ও এনসিপির একাংশ মনে করছে, আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হলে বিএনপি পুরো ফায়দা পাবে। বর্তমানে প্রশাসনসহ বড় সব জায়গায় জামায়াত ও এনসিপির মতাদর্শীরা আছেন। কিন্তু বিএনপি ক্ষমতায় এলে সবকিছু বদলে দেবে। এই আশঙ্কা থেকে দল দুটি সংস্কার, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও পিআর পদ্ধতি নিশ্চিত করতে চাইছে। এতে নির্বাচন বিলম্বিত হলেও সমস্যা নেই। কিন্তু মাঠের পরিস্থিতি বুঝে বিএনপি যেকোনোভাবে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন চায়। বিলম্বের আশঙ্কাকে তারা ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছে। এই তিন দলের এমন অবস্থানে মাঠে নামতে পারে জাতীয় পার্টির (জাপা) দুই অংশ।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন হবে। ইসি আজ বৃহস্পতিবার এই নির্বাচনের জন্য রোডম্যাপ ঘোষণা করবে। নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতিও সারছে। সব মিলিয়ে নির্বাচনের একটি আবহ তৈরির অবস্থা। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর দূরত্ব-অনৈক্য সব সম্ভাবনাকে অনিশ্চয়তার পথে নিয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকেরা।
রাজনৈতিক দলগুলোর অনৈক্য দূর করার চেষ্টা করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনও। তারা দফায় দফায় সংলাপ করেছেন দলগুলোর সঙ্গে। দূরত্ব কমিয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় আবারও সংলাপে বসবে।
রাজনৈতিক দলগুলোকে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বজায় রেখে এক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, ‘পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল হোন। আন্দোলন-সংগ্রামে একত্রে থেকেছেন, এটা অব্যাহত রাখুন।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখন আমরা একটা অন্তর্বর্তী ব্যবস্থায় আছি। সেটা শুধু সরকার হিসেবে না, সবাই। বাংলাদেশে রাজনীতির একটি অন্তর্বর্তী পরিস্থিতিতে ঐক্য, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সহনশীলতার জায়গাটা ধরে রাখা দরকার। কেননা পরাজিত শক্তিরা সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করবে, সেটা যেন না নিতে পারে, সে জন্য রাজনীতিবিদদের সজাগ ও সক্রিয় থাকতে হবে।’
জামায়াতের দ্বিধা, সংশয়: জামায়াতে ইসলামী স্পষ্টই বলেছে, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি এবং পিআর পদ্ধতির সিদ্ধান্ত না হলে তারা নির্বাচনে যাবে না। দলটি ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরির দাবিও জানাচ্ছে। এগুলোসহ সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে দলটি মিছিল, সমাবেশও করছে। রাজপথে এসব কর্মসূচির মাধ্যমে তারা নিজেদের অবস্থান জানান দিচ্ছে। পাশাপাশি সরকার, বিএনপিসহ সংশ্লিষ্টদের বার্তা দিচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, গত বছরের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে জামায়াত। প্রশাসন, বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে জামায়াত-সমর্থিত ব্যক্তিরা ভালো অবস্থায় রয়েছেন। ১৬টির মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের সমর্থিত ব্যক্তি উপাচার্য হয়েছেন। প্রশাসনের উচ্চপর্যায়েও একই অবস্থা। দলটির আশঙ্কা, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হলে বিএনপি বেশি আসন পাবে। বিএনপি ক্ষমতায় এলে তাদের এই ‘শক্তি’ ভেঙে দেবে। অভ্যুত্থানের সব অর্জন নষ্ট করে দেবে। এ কারণে দলটি বুঝে-শুনে নির্বাচনে যেতে চায়।
অবশ্য জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের আজকের পত্রিকাকে বলেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনে জামায়াতের আপত্তি নেই। তবে নির্বাচনের বড় প্রস্তুতিমূলক কাজ সংস্কার। সেটিকে চূড়ান্ত করতে হবে, সংস্কারের আইনি ভিত্তি দিতে হবে। তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টার প্রতিশ্রুতি ছিল সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন করার। নির্বাচনের ঘোষণা তিনি দিয়েছেন, তার আগে তো সংস্কার হতে হবে। সেটি এখনো সম্পূর্ণ হয়নি।
এনসিপি সংস্কারের পক্ষে অনড়: সূত্র বলছে, জুলাই অভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্বের গড়া দল এনসিপি সংস্কারের পক্ষে অনড় অবস্থানে রয়েছে। প্রতিষ্ঠার মাত্র ছয় মাসে দলটি খুব গুছিয়েও উঠতে পারেনি। দলটির বেশির ভাগ নেতাই গণপরিষদ নির্বাচন ছাড়া সংসদ নির্বাচন চান না। তাঁরা পিআর পদ্ধতি ও নির্বাচনের আগে জুলাই সনদের আইন ভিত্তি দেওয়ার পক্ষে। এসব দাবি পূরণ হলে তাঁরা নির্বাচনে যাওয়ার কথা বলছেন। সব শর্ত পূরণ না হলে নির্বাচনের পর পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারে বলে তাঁদের আশঙ্কা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, এনসিপি এখনো গোছাতে পারেনি। ফেব্রুয়ারির নির্বাচন নিয়ে এনসিপির মধ্যে একাধিক ধারা রয়েছে। বিভিন্ন দল থেকে আসা নেতাদের একটি অংশ নির্বাচনের পক্ষে। তাঁরা রাজনীতিতে অবস্থান তৈরি করতে নির্বাচনে যেতে চান। তবে দলের বেশির ভাগ নেতাই প্রথমে জাতীয় নির্বাচনের বিপক্ষে।
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘গণপরিষদ নির্বাচন ও নতুন সংবিধান না হলে আমরা নির্বাচনে যাব না। আমাদের দাবি জনগণের দাবি। সেটা নিয়েই জনগণের কাছে যাব। নতুন সংবিধান, সংস্কার ও বিচারের দাবির সঙ্গে মানুষকে সম্পৃক্ত করে একটি বৃহত্তর আন্দোলনের দিকে আমরা এগিয়ে যাব।’ তিনি বলেন, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের দোসরদের নিয়ে যদি কোনো পক্ষ কিংবা সরকারও কোনো চিন্তাভাবনা করে, জনগণ তা রুখে দেবে।
জি এম কাদের ও আনিসুল ইসলাম মাহমুদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির দুই অংশের কার্যক্রমকেই সন্দেহের চোখে দেখছে জামায়াত ও এনসিপি। দল দুটি মনে করছে, সংস্কার, জুলাই সনদ ও পিআর পদ্ধতি নিয়ে তাদের অনড় অবস্থানের সুযোগ নিয়ে একটি পক্ষ নিজেদের পাল্লা ভারী করতে জাপার দুই অংশকে মাঠে নামাতে পারে। জাপা এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নির্বাচনেও নামতে পারে। কারণ, অতীতে দলটি বিএনপি, জামায়াতসহ অধিকাংশ দলের বর্জন করা নির্বাচনে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের আমলের নির্বাচনকে সাংবিধানিক বৈধতা দিয়েছিল।
জামায়াত ও এনসিপির নেতাদের আশঙ্কা, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হলেও তিন ইস্যুতে তাঁরা অনড় থাকলে জাপা আবার তুরুপের তাস হতে পারে। যাতে এবার লাভবান হবে বিএনপি। এ জন্য তাদের ওপর চাপ সৃষ্টির কৌশল হিসেবে পর্দার অন্তরালে জাপাকে একটি পক্ষ বানানোর আয়োজন চলছে বলে তাঁরা সন্দেহ ও আশঙ্কা করছেন।
বিএনপির সামনে চাপ: দীর্ঘ দেড় দশকের ক্ষমতার খরা কাটাতে চায় বিএনপি। দলের তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত এ ব্যাপারে চাপ রয়েছে। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে যে সুযোগ তৈরি হয়েছে, তা কোনোভাবেই হারাতে চায় না বিএনপি; যে কারণে সাবধানে পা ফেলে অগ্রসর হচ্ছে দলটি। বিএনপি মনে করে, তাদের চাপে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের ঘোষণা এসেছে। আজ ওই নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করতে যাচ্ছে ইসি। কিন্তু এরপরও নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটছে না বিএনপিতে। এর কারণ আরেক পক্ষের অনড় অবস্থান।
বিএনপি স্পষ্টই বলছে, তারা পিআর পদ্ধতিতে নেই। উচ্চকক্ষের বিরোধিতা করছে, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের প্রস্তাবকে সংবিধানবহির্ভূত বলছে। এসব ক্ষেত্রে জামায়াত-এনসিপির অবস্থান বিএনপিকে কঠিন সমীকরণে নিয়ে যাচ্ছে।
ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে বিএনপির অনিশ্চয়তার কথা এসেছে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্যেও। গতকাল বুধবার এক আলোচনা সভায় তিনি বলেন, ‘আজকে কিছুসংখ্যক রাজনৈতিক মহল অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে নির্বাচনকে বানচাল করার জন্য, নির্বাচনকে ব্যাহত করার জন্য নিত্যনতুন দাবি তুলে চলেছে। এগুলো নিয়ে তারা হুমকি দিচ্ছে, কথা বলছেন, অত্যন্ত জোরেশোরে হুমকি দিচ্ছেন। আমার প্রশ্নটা হচ্ছে, কেন করছেন এটা?’ তিনি বলেন, ‘সরকারের ভেতরে একটা মহল, তারা অত্যন্ত সচেতনভাবে চেষ্টা করছে, যারা গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তি, তারা যেন আসতে না পারে।’
মির্জা ফখরুল বলেন, এখনো সময় আছে। জুলাই সনদ, সংস্কার এসব নিয়ে জটিলতা না বাড়িয়ে সরকার যেন কার্যকর ব্যবস্থা নেয়; যাতে দলগুলো নির্বাচনমুখী হয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, নির্বাচনের প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে হলে বিএনপিকেই এগিয়ে এসে অন্য দলগুলোকে ভরসা দিতে হবে, আস্থায় আনতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান বলেন, বিএনপির উচিত আন্তরিকতার সঙ্গে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের উদ্বেগ চিহ্নিত করা এবং তাদের আশ্বস্ত করা যে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এলে তারা কোনো অবিচার করবে না কিংবা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা কায়েম করবে না। দলগুলোকে আস্থা ও নিশ্চয়তা দেওয়া গেলে অন্যরা বিএনপিকে বিশ্বাস করতে পারবে। তবে তিনি বলেন, কিছু দল যদি ভিন্ন উদ্দেশ্যে নির্বাচন ঠেকাতে চায়, সে ক্ষেত্রে বিএনপির পক্ষে সমন্বয় করা সম্ভব নয়। সেটা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়।
নির্বাচনের চেষ্টায় সরকার: দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য থাকলেও অন্তর্বর্তী সরকার চেষ্টা করছে ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করতে। এ জন্য প্রকাশ্য ও অন্তরালে বৈঠক চলছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সক্রিয় করার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার বদলে এখন শর্ত মুখ্য হয়ে উঠেছে।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (জাতীয় ঐকমত্য) মনির হায়দার আজকের পত্রিকাকে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থানকে কাছাকাছি নিয়ে আসার জন্য কমিশনের বিভিন্ন রকম চেষ্টা ও তৎপরতা চলমান আছে।
পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, নির্বাচন না হলে শুধু বিএনপি নয়, জামায়াত ও এনসিপিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। রাজনৈতিক অচলাবস্থা দীর্ঘ হলে জনগণের মধ্যে হতাশা জন্মাবে।
দলগুলো পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের মাধ্যমে দলীয় অবস্থান তুলে ধরছে বলে মনে করেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ও সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘গণতান্ত্রিক উত্তরণের লক্ষ্যে সবাই একমত হয়ে প্রস্তাবিত জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করবে; যার মাধ্যমে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথ সুগম হবে এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথ প্রশস্ত হবে।’
চীন সফরের প্রথম দিনে হুয়াওয়ের এক্সিবিশন সেন্টার পরিদর্শন করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) প্রতিনিধিদল। সেখানে তাঁরা প্রযুক্তি ও জ্ঞান বিনিময় নিয়ে আলোচনা করেন। আজ বুধবার (২৭ আগস্ট) সন্ধ্যায় এনসিপির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এ তথ্য জানানো হয়।
৬ ঘণ্টা আগেতারেক রহমান যাতে আগামীতে প্রধানমন্ত্রী হতে না পারেন, সে জন্য জামায়াত ষড়যন্ত্র শুরু করেছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লা বুলু। তিনি বলেন, একাত্তরে স্বাধীনতাবিরোধী এ দল আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়েও ষড়যন্ত্র শুরু করেছে।
৮ ঘণ্টা আগেবিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের চেতনা ধারণ করেই বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সংগ্রাম চালিয়ে এসেছেন। তিনি বলেছেন, গণ-অভ্যুত্থানসহ জাতীয় আন্দোলন-সংগ্রামের অনুপ্রেরণাও ছিলেন তিনি।
৯ ঘণ্টা আগেসরকারের ভেতরে একটি মহল গণতন্ত্রকামী শক্তির বিরুদ্ধে কাজ করছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এ ব্যাপারে সবাইকে সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি...
১৪ ঘণ্টা আগে