মযহারুল ইসলাম বাবলা
আগস্ট মাসটি আমাদের জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক ও তাৎপর্যপূর্ণ একটি মাস। আমাদের ভূখণ্ডে এই আগস্টে ঘটেছে ইতিহাসের নানা ঘটনা-দুর্ঘটনা। কিশোর বয়সে ১৪ আগস্টে আমরা উদ্যাপন করতাম পাকিস্তান রাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবস। বাড়ির ছাদে পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়ে এবং কাগজের পতাকা রশিতে লাগিয়ে, পতাকাদণ্ডের চারপাশে লাগিয়ে, দণ্ডের মাথায় লাইট জ্বালিয়ে কারটি বেশি আকর্ষণীয় হয়েছে, সেটা নিয়ে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতাম। সরকারি ছুটির পরও স্কুলের মিলাদে অংশ নিতাম, স্কুল কর্তৃক নির্দেশিত পায়জামা, পাঞ্জাবি ও টুপি পরে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের সংহতি ও অখণ্ডতা রক্ষার জন্য মোনাজাত করতেন মৌলভি স্যার এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য রাখতেন মোনাজাতে! ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে শত্রুরাষ্ট্র হিসেবে সর্বক্ষেত্রে প্রচার-প্রচারণা করা হতো। আমাদের অংশগ্রহণের মূল আকর্ষণ ছিল মিষ্টির ঠোঙার প্রতি। মোনাজাত শেষে ওটি পাবার আশায় দলবেঁধে যেতাম এবং মিষ্টির ঠোঙা হাতে নিয়ে ফিরতাম। ওই দিন হাইকোর্ট, কার্জন হলসহ বিভিন্ন স্থাপনার আলোকসজ্জা দেখতে যেতাম রাতে ঘোড়ার গাড়িতে চেপে। দিনটি উৎসব হিসেবে দেশের সর্বত্র পালিত হতো রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়।
১৯৪৭-এর ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের এবং ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা এসেছিল ভ্রাতৃপ্রতিম দুই সম্প্রদায়ের রক্তাক্ত দাঙ্গায়। ভারতবর্ষকে দ্বিখণ্ডিত করে অনুগত কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের কাছে ডমিনিয়ন স্ট্যাটাসের স্বাধীনতা দিয়ে নিরাপদে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ বিদায় নিয়েছিল ১৯০ বছরের শোষণ, লুণ্ঠন, নৃশংস দৃষ্টান্তে বিনা বিচারে দাতার বেশে। সাতচল্লিশের স্বাধীনতা প্রকৃত অর্থে দেশ দুটির সমষ্টিগত মানুষকে যেমন দিতে পারেনি স্বাধীনতা, তেমনি মুক্তিও।
১৯৪৬-এর ১৬ আগস্ট মুসলিম লীগের আহ্বানে ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে পালনকে কেন্দ্র করে কলকাতায় দাঙ্গার সূত্রপাত ঘটে। ওই দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে ভারতব্যাপী। তখনকার বাংলার প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী ওই দিন রাজ্যজুড়ে ছুটি ঘোষণা করেন। ফলে দাঙ্গার সমস্ত দায় বর্তায় সোহরাওয়ার্দীর ওপর। কলকাতা দাঙ্গাই দেশভাগকে অনিবার্য করে তুলেছিল। প্রত্যক্ষদর্শী আমার বাবার কাছে শুনেছি কলকাতা দাঙ্গায় বাঙালি হিন্দু ও মুসলমান তেমন অংশ নেয়নি। বরং একে অপরকে রক্ষায় তারা তৎপর ছিল। হিন্দুদের পক্ষে পাঞ্জাবি শিখ এবং মুসলমানের পক্ষে বিহারি মুসলমানরাই দাঙ্গায় সর্বাধিক ভূমিকা পালন করেছিল। অপরদিকে খাজা নাজিমুদ্দিন বলেছিলেন, ‘আমাদের লড়াই হিন্দুদের বিরুদ্ধে, ব্রিটিশের বিরুদ্ধে নয়।’ হিন্দু মহাসভা প্রধান শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বাংলা প্রদেশে (৫২ শতাংশ মুসলিম এবং ৪৮ শতাংশ হিন্দু) সংখ্যালঘু হিন্দুদের অস্তিত্ব বিপন্নের অভিযোগ তুলে বাংলা ভাগকে নিশ্চিত করেছিলেন। দেশভাগের পেছনে কলকাঠি নেড়েছিল ব্রিটিশ শাসকেরা এবং তাদের ক্রীড়নক হিসেবে ভূমিকা পালন করেছিল হিন্দু ও মুসলিম জাতীয়তাবাদী লীগ ও কংগ্রেসের নেতারা।
আমাদের ইতিহাসের কলঙ্কিত ও নিষ্ঠুরতার এবং শোকের মাস হিসেবেও খ্যাত আগস্ট। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপ্রধানসহ তাঁর পরিবার-পরিজনদের নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটে। এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত আওয়ামী লীগ সরকারের দক্ষিণপন্থী কতিপয় সেনাবাহিনীর একটি অংশ ছিল। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র যে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেনি, সেটাও মিথ্যা নয়। এরূপ নৃশংস হত্যাকাণ্ড জাতির ইতিহাসে কখনো ঘটেনি। এই হত্যাকাণ্ড ও ক্ষমতার হাতবদলে মুক্তিযুদ্ধের অর্জনগুলো একে একে বিলুপ্ত করা হয়। রাষ্ট্রক্ষমতার হাতবদল হয় নির্বাচিত সরকারের পরিবর্তে সামরিক সরকারের কাছে। রাষ্ট্রের অনেক মূলনীতির পরিবর্তন ঘটে। নিষিদ্ধ ধর্মভিত্তিক রাজনীতির দুয়ার উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। আমাদের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মৌলিকত্বকেও বিসর্জন দেওয়া হয়। আগস্ট মাসকে শোকের মাস হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছিল। মাসব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হতো। কিন্তু বিগত সরকারের বিদায়ের পর অন্তর্বর্তী সরকারের শাসনামলে দিবসটিকে গুরুত্বহীন করা হয়েছে। যার ধারাবাহিকতা এবারও দেখা যাচ্ছে। অথচ দেশের সমষ্টিগত মানুষ এই নৃশংস ঘটনাকে মেনে নিতে পারেনি। নিয়েছে কেবল মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত স্বাধীনতাবিরোধী চক্র। যাদের পক্ষে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট।
বিএনপি সরকারের শাসনামলে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঘটে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার নৃশংস ঘটনা। বিরোধীদলীয় নেত্রী প্রাণে বেঁচে গেলেও দলটির শীর্ষস্থানীয় নেত্রী আইভি রহমানসহ অগণিত নেতা-কর্মী নিহত ও আহত হন। অনেকে প্রাণে বেঁচে গেলেও পঙ্গুত্ববরণ করেন। আগস্টে এই দুটি নৃশংস ঘটনা আমাদের ইতিহাসে কলঙ্কজনক হিসেবে জাতির মননে স্থায়ী হয়ে আছে এবং থাকবে।
চব্বিশের ৫ আগস্ট আন্দোলনে পতন ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের। সরকারপ্রধানকে সেনাবাহিনী দেশত্যাগে বাধ্য করে বিমানবাহিনীর বিমানে করে দিল্লিতে পাঠিয়ে দেয়। এই গণ-অভ্যুত্থানে অজস্র মানুষের মৃত্যু ঘটে। পুলিশের গুলিতে যেমন, তেমনি মেটিকুলাস ডিজাইনের বাতাবরণে সশস্ত্র জঙ্গিদের দ্বারাও। যেটি পরবর্তী সময়ে প্রকাশ পেয়েছে। আন্দোলনটি ছিল সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে একটি অরাজনৈতিক আন্দোলন। এই আন্দোলনকে পুঁজি করেই মেটিকুলাস ডিজাইন বাস্তবায়নকারীরা জনসমর্থনে এবং জনগণের অংশগ্রহণে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে অগ্রসর হয়। আন্দোলনের ব্যাপকতা বৃদ্ধিতে সরকার কঠোর পন্থা অবলম্বনের ফলে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে আন্দোলনটি গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হয়। সরকারের গর্হিত সিদ্ধান্তে পুলিশের পাশাপাশি ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দেওয়ার ফলে আন্দোলনে শামিল হয় দেশের সর্বস্তরের মানুষ।
সরকার পুলিশের পাশাপাশি বিজেপি ও সেনাবাহিনী নামিয়ে দমনাভিযানের সিদ্ধান্ত নেয়। সরকারের এইসব হঠকারী সিদ্ধান্ত সরকারের জন্যই বুমেরাং হয়ে দাঁড়ায়। সেনাবাহিনী সরকারের নির্দেশ অমান্য করে নিজ জনগণের ওপর গুলি চালাতে অস্বীকার করার ফলে সরকারের শেষরক্ষার আর উপায় থাকেনি। সর্বস্তরের মানুষ এই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লে সরকারের বিদায় ঘণ্টা বেজে ওঠে। সরকার পতনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল সেনাবাহিনী। যেটি ১৯৯০-এর অনিবার্য ধারাবাহিকতা। সরকারপ্রধানের দেশত্যাগের পূর্বেই তাঁর আত্মীয়-পরিজনেরা দেশত্যাগ করে। প্রায় ১৬ বছরের আর্থিক লুণ্ঠনকারী তাঁর আত্মীয়স্বজনেরা দেশত্যাগের ফলে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের একজন সদস্যও ধরা পড়েননি। মন্ত্রী, এমপিদের অনেকে দেশত্যাগ করলেও কেউ কেউ পারেননি। দেশের খ্যাতিমানদেরও বাদ দেওয়া হয়নি। আওয়ামী লীগের ট্যাগ লাগিয়ে আটক করা হয়েছে। বয়স্ক এবং অসুস্থদের পর্যন্ত রেহাই দেওয়া হয়নি। গণগ্রেপ্তারে দেশের কারাগারগুলো এখন পরিপূর্ণ। আটক ও পলাতক ব্যক্তিদের বিচারকার্য চলছে। শেখ হাসিনার পরিবারের সংসদ সদস্য, মেয়র, মন্ত্রীদের সরকার পতনের পূর্বে দেশত্যাগের ঘটনা নজিরবিহীন বটে। অথচ এরাই দুর্নীতি, লুণ্ঠনে নানাবিধ অনাচারের শিরোমণি হিসেবে খ্যাতিমান হয়ে উঠেছিলেন। আগাম সতর্কবার্তায় তাঁদের দেশত্যাগ নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
স্বীকার করতে হবে ৫ আগস্টের পর থেকে গত এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকারের শাসনামলে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেনি। দেশ বরং অরাজকতার কবলে। আইনশৃঙ্খলার অবনতি, মব সন্ত্রাস ইত্যাকার নানা ঘটনাপ্রবাহে আশাজাগানিয়া কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন সূচিত হয়নি। বরং মেটিকুলাস ডিজাইনের অংশীদারদের চাঁদাবাজি, মাস্তানিতে তাঁদের প্রতি মানুষের সমর্থন, সহানুভূতি অনেকটাই কমে এসেছে, মানুষ আস্থা হারিয়েছে। রাজনৈতিক দল গঠন এবং সেনাবাহিনীর কঠোর নিরাপত্তা নিয়ে তাঁদের রাজনৈতিক কার্যক্রম চালানো দেশবাসী সুনজরে দেখছে না। তাঁদের সমাবেশকে কেন্দ্র করে অনভিপ্রেত ঘটনাও ঘটেছে। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণে প্রাণ হারিয়েছে তাঁদের প্রতিহত করতে যাওয়া মানুষ। নবীন ও অনিবন্ধিত দলটির কার্যক্রম চালাতে কেন সেনাবাহিনী তাঁদের সশস্ত্রভাবে পাহারা দিয়ে যাচ্ছে? দেশের ইতিহাসে এটিও নজিরবিহীন বটে!
সামগ্রিক বিবেচনায় ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানে ক্ষমতার হাতবদল ব্যতীত দেশবাসীর কোনো আশা-আকাঙ্ক্ষার তেমন বাস্তবায়ন ঘটেনি। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার এবং সমতার সুযোগ আসেনি। বরং মানুষ ক্রমাগত হতাশায় বধির হয়ে পড়েছে।
আগস্ট মাস আমাদের ভূখণ্ডে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি মাস। নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার জন্য মাসটি নিশ্চয়ই স্মরণীয় হয়ে থাকবে। যত দিন বাংলাদেশ থাকবে, থাকবে এই ভূখণ্ডের মানুষ ও তাদের এসব ইতিহাস।
মযহারুল ইসলাম বাবলা, লেখক ও কলামিস্ট
আগস্ট মাসটি আমাদের জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক ও তাৎপর্যপূর্ণ একটি মাস। আমাদের ভূখণ্ডে এই আগস্টে ঘটেছে ইতিহাসের নানা ঘটনা-দুর্ঘটনা। কিশোর বয়সে ১৪ আগস্টে আমরা উদ্যাপন করতাম পাকিস্তান রাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবস। বাড়ির ছাদে পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়ে এবং কাগজের পতাকা রশিতে লাগিয়ে, পতাকাদণ্ডের চারপাশে লাগিয়ে, দণ্ডের মাথায় লাইট জ্বালিয়ে কারটি বেশি আকর্ষণীয় হয়েছে, সেটা নিয়ে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতাম। সরকারি ছুটির পরও স্কুলের মিলাদে অংশ নিতাম, স্কুল কর্তৃক নির্দেশিত পায়জামা, পাঞ্জাবি ও টুপি পরে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের সংহতি ও অখণ্ডতা রক্ষার জন্য মোনাজাত করতেন মৌলভি স্যার এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য রাখতেন মোনাজাতে! ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে শত্রুরাষ্ট্র হিসেবে সর্বক্ষেত্রে প্রচার-প্রচারণা করা হতো। আমাদের অংশগ্রহণের মূল আকর্ষণ ছিল মিষ্টির ঠোঙার প্রতি। মোনাজাত শেষে ওটি পাবার আশায় দলবেঁধে যেতাম এবং মিষ্টির ঠোঙা হাতে নিয়ে ফিরতাম। ওই দিন হাইকোর্ট, কার্জন হলসহ বিভিন্ন স্থাপনার আলোকসজ্জা দেখতে যেতাম রাতে ঘোড়ার গাড়িতে চেপে। দিনটি উৎসব হিসেবে দেশের সর্বত্র পালিত হতো রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়।
১৯৪৭-এর ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের এবং ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা এসেছিল ভ্রাতৃপ্রতিম দুই সম্প্রদায়ের রক্তাক্ত দাঙ্গায়। ভারতবর্ষকে দ্বিখণ্ডিত করে অনুগত কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের কাছে ডমিনিয়ন স্ট্যাটাসের স্বাধীনতা দিয়ে নিরাপদে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ বিদায় নিয়েছিল ১৯০ বছরের শোষণ, লুণ্ঠন, নৃশংস দৃষ্টান্তে বিনা বিচারে দাতার বেশে। সাতচল্লিশের স্বাধীনতা প্রকৃত অর্থে দেশ দুটির সমষ্টিগত মানুষকে যেমন দিতে পারেনি স্বাধীনতা, তেমনি মুক্তিও।
১৯৪৬-এর ১৬ আগস্ট মুসলিম লীগের আহ্বানে ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে পালনকে কেন্দ্র করে কলকাতায় দাঙ্গার সূত্রপাত ঘটে। ওই দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে ভারতব্যাপী। তখনকার বাংলার প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী ওই দিন রাজ্যজুড়ে ছুটি ঘোষণা করেন। ফলে দাঙ্গার সমস্ত দায় বর্তায় সোহরাওয়ার্দীর ওপর। কলকাতা দাঙ্গাই দেশভাগকে অনিবার্য করে তুলেছিল। প্রত্যক্ষদর্শী আমার বাবার কাছে শুনেছি কলকাতা দাঙ্গায় বাঙালি হিন্দু ও মুসলমান তেমন অংশ নেয়নি। বরং একে অপরকে রক্ষায় তারা তৎপর ছিল। হিন্দুদের পক্ষে পাঞ্জাবি শিখ এবং মুসলমানের পক্ষে বিহারি মুসলমানরাই দাঙ্গায় সর্বাধিক ভূমিকা পালন করেছিল। অপরদিকে খাজা নাজিমুদ্দিন বলেছিলেন, ‘আমাদের লড়াই হিন্দুদের বিরুদ্ধে, ব্রিটিশের বিরুদ্ধে নয়।’ হিন্দু মহাসভা প্রধান শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বাংলা প্রদেশে (৫২ শতাংশ মুসলিম এবং ৪৮ শতাংশ হিন্দু) সংখ্যালঘু হিন্দুদের অস্তিত্ব বিপন্নের অভিযোগ তুলে বাংলা ভাগকে নিশ্চিত করেছিলেন। দেশভাগের পেছনে কলকাঠি নেড়েছিল ব্রিটিশ শাসকেরা এবং তাদের ক্রীড়নক হিসেবে ভূমিকা পালন করেছিল হিন্দু ও মুসলিম জাতীয়তাবাদী লীগ ও কংগ্রেসের নেতারা।
আমাদের ইতিহাসের কলঙ্কিত ও নিষ্ঠুরতার এবং শোকের মাস হিসেবেও খ্যাত আগস্ট। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপ্রধানসহ তাঁর পরিবার-পরিজনদের নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটে। এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত আওয়ামী লীগ সরকারের দক্ষিণপন্থী কতিপয় সেনাবাহিনীর একটি অংশ ছিল। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র যে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেনি, সেটাও মিথ্যা নয়। এরূপ নৃশংস হত্যাকাণ্ড জাতির ইতিহাসে কখনো ঘটেনি। এই হত্যাকাণ্ড ও ক্ষমতার হাতবদলে মুক্তিযুদ্ধের অর্জনগুলো একে একে বিলুপ্ত করা হয়। রাষ্ট্রক্ষমতার হাতবদল হয় নির্বাচিত সরকারের পরিবর্তে সামরিক সরকারের কাছে। রাষ্ট্রের অনেক মূলনীতির পরিবর্তন ঘটে। নিষিদ্ধ ধর্মভিত্তিক রাজনীতির দুয়ার উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। আমাদের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মৌলিকত্বকেও বিসর্জন দেওয়া হয়। আগস্ট মাসকে শোকের মাস হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছিল। মাসব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হতো। কিন্তু বিগত সরকারের বিদায়ের পর অন্তর্বর্তী সরকারের শাসনামলে দিবসটিকে গুরুত্বহীন করা হয়েছে। যার ধারাবাহিকতা এবারও দেখা যাচ্ছে। অথচ দেশের সমষ্টিগত মানুষ এই নৃশংস ঘটনাকে মেনে নিতে পারেনি। নিয়েছে কেবল মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত স্বাধীনতাবিরোধী চক্র। যাদের পক্ষে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট।
বিএনপি সরকারের শাসনামলে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঘটে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার নৃশংস ঘটনা। বিরোধীদলীয় নেত্রী প্রাণে বেঁচে গেলেও দলটির শীর্ষস্থানীয় নেত্রী আইভি রহমানসহ অগণিত নেতা-কর্মী নিহত ও আহত হন। অনেকে প্রাণে বেঁচে গেলেও পঙ্গুত্ববরণ করেন। আগস্টে এই দুটি নৃশংস ঘটনা আমাদের ইতিহাসে কলঙ্কজনক হিসেবে জাতির মননে স্থায়ী হয়ে আছে এবং থাকবে।
চব্বিশের ৫ আগস্ট আন্দোলনে পতন ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের। সরকারপ্রধানকে সেনাবাহিনী দেশত্যাগে বাধ্য করে বিমানবাহিনীর বিমানে করে দিল্লিতে পাঠিয়ে দেয়। এই গণ-অভ্যুত্থানে অজস্র মানুষের মৃত্যু ঘটে। পুলিশের গুলিতে যেমন, তেমনি মেটিকুলাস ডিজাইনের বাতাবরণে সশস্ত্র জঙ্গিদের দ্বারাও। যেটি পরবর্তী সময়ে প্রকাশ পেয়েছে। আন্দোলনটি ছিল সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে একটি অরাজনৈতিক আন্দোলন। এই আন্দোলনকে পুঁজি করেই মেটিকুলাস ডিজাইন বাস্তবায়নকারীরা জনসমর্থনে এবং জনগণের অংশগ্রহণে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে অগ্রসর হয়। আন্দোলনের ব্যাপকতা বৃদ্ধিতে সরকার কঠোর পন্থা অবলম্বনের ফলে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে আন্দোলনটি গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হয়। সরকারের গর্হিত সিদ্ধান্তে পুলিশের পাশাপাশি ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দেওয়ার ফলে আন্দোলনে শামিল হয় দেশের সর্বস্তরের মানুষ।
সরকার পুলিশের পাশাপাশি বিজেপি ও সেনাবাহিনী নামিয়ে দমনাভিযানের সিদ্ধান্ত নেয়। সরকারের এইসব হঠকারী সিদ্ধান্ত সরকারের জন্যই বুমেরাং হয়ে দাঁড়ায়। সেনাবাহিনী সরকারের নির্দেশ অমান্য করে নিজ জনগণের ওপর গুলি চালাতে অস্বীকার করার ফলে সরকারের শেষরক্ষার আর উপায় থাকেনি। সর্বস্তরের মানুষ এই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লে সরকারের বিদায় ঘণ্টা বেজে ওঠে। সরকার পতনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল সেনাবাহিনী। যেটি ১৯৯০-এর অনিবার্য ধারাবাহিকতা। সরকারপ্রধানের দেশত্যাগের পূর্বেই তাঁর আত্মীয়-পরিজনেরা দেশত্যাগ করে। প্রায় ১৬ বছরের আর্থিক লুণ্ঠনকারী তাঁর আত্মীয়স্বজনেরা দেশত্যাগের ফলে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের একজন সদস্যও ধরা পড়েননি। মন্ত্রী, এমপিদের অনেকে দেশত্যাগ করলেও কেউ কেউ পারেননি। দেশের খ্যাতিমানদেরও বাদ দেওয়া হয়নি। আওয়ামী লীগের ট্যাগ লাগিয়ে আটক করা হয়েছে। বয়স্ক এবং অসুস্থদের পর্যন্ত রেহাই দেওয়া হয়নি। গণগ্রেপ্তারে দেশের কারাগারগুলো এখন পরিপূর্ণ। আটক ও পলাতক ব্যক্তিদের বিচারকার্য চলছে। শেখ হাসিনার পরিবারের সংসদ সদস্য, মেয়র, মন্ত্রীদের সরকার পতনের পূর্বে দেশত্যাগের ঘটনা নজিরবিহীন বটে। অথচ এরাই দুর্নীতি, লুণ্ঠনে নানাবিধ অনাচারের শিরোমণি হিসেবে খ্যাতিমান হয়ে উঠেছিলেন। আগাম সতর্কবার্তায় তাঁদের দেশত্যাগ নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
স্বীকার করতে হবে ৫ আগস্টের পর থেকে গত এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকারের শাসনামলে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেনি। দেশ বরং অরাজকতার কবলে। আইনশৃঙ্খলার অবনতি, মব সন্ত্রাস ইত্যাকার নানা ঘটনাপ্রবাহে আশাজাগানিয়া কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন সূচিত হয়নি। বরং মেটিকুলাস ডিজাইনের অংশীদারদের চাঁদাবাজি, মাস্তানিতে তাঁদের প্রতি মানুষের সমর্থন, সহানুভূতি অনেকটাই কমে এসেছে, মানুষ আস্থা হারিয়েছে। রাজনৈতিক দল গঠন এবং সেনাবাহিনীর কঠোর নিরাপত্তা নিয়ে তাঁদের রাজনৈতিক কার্যক্রম চালানো দেশবাসী সুনজরে দেখছে না। তাঁদের সমাবেশকে কেন্দ্র করে অনভিপ্রেত ঘটনাও ঘটেছে। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণে প্রাণ হারিয়েছে তাঁদের প্রতিহত করতে যাওয়া মানুষ। নবীন ও অনিবন্ধিত দলটির কার্যক্রম চালাতে কেন সেনাবাহিনী তাঁদের সশস্ত্রভাবে পাহারা দিয়ে যাচ্ছে? দেশের ইতিহাসে এটিও নজিরবিহীন বটে!
সামগ্রিক বিবেচনায় ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানে ক্ষমতার হাতবদল ব্যতীত দেশবাসীর কোনো আশা-আকাঙ্ক্ষার তেমন বাস্তবায়ন ঘটেনি। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার এবং সমতার সুযোগ আসেনি। বরং মানুষ ক্রমাগত হতাশায় বধির হয়ে পড়েছে।
আগস্ট মাস আমাদের ভূখণ্ডে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি মাস। নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার জন্য মাসটি নিশ্চয়ই স্মরণীয় হয়ে থাকবে। যত দিন বাংলাদেশ থাকবে, থাকবে এই ভূখণ্ডের মানুষ ও তাদের এসব ইতিহাস।
মযহারুল ইসলাম বাবলা, লেখক ও কলামিস্ট
২২শে শ্রাবণ (৬ আগস্ট) ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৮৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। ওই দিন বাংলা একাডেমি ও ছায়ানট কর্তৃক রবীন্দ্রনাথ স্মরণে আয়োজিত আলোচনা সভা ও সংগীতানুষ্ঠানের খবর পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এ ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য ওই দুই প্রতিষ্ঠানকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।
৯ ঘণ্টা আগেখবরটা শুনে হাসব না কাঁদব, বুঝতে পারছি না। বসুন্ধরা শপিং মলে যুথী নামে যে চোর ধরা পড়েছেন, তিনি নাকি আন্তজেলা পকেটমার চক্রের নেতৃত্বে আছেন! তার মানে পকেটমারদেরও সংগঠন রয়েছে এবং তাতে নেতা ও কর্মীও রয়েছেন।
৯ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিবেশ ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এক গভীর রূপান্তরের ভেতর দিয়ে গেছে। শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনামলের পরিণতিতে যখন দেশে একধরনের দমন-পীড়ন ও এককেন্দ্রিক ক্ষমতার গঠন স্পষ্ট হয়ে উঠছিল, তখন নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থী ও নাগরিক সমাজ মিলে গড়ে তোলে এক অভাবিত প্রতিরোধ,
১ দিন আগেজুলাই অভ্যুত্থানের বছর পূর্তিতে আমাদের অর্জন কী, সে প্রশ্ন আজ সবার। জুলাই আন্দোলনের সময় কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক বক্তব্য না থাকলেও শেখ হাসিনার পতনের পর মানুষের মধ্যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল—রাষ্ট্রের যে পদ্ধতি শাসককে কর্তৃত্বপরায়ণ, স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিস্টে পরিণত করে, সেই ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে।
১ দিন আগে