রাজীব কুমার সাহা
বাংলা ভাষায় বহুল পরিচিত একটি শব্দ হলো কালাজ্বর। শব্দটি কমবেশি আমরা সবাই শুনেছি। এমনকি কেউ কেউ কালাজ্বরে আক্রান্তও হয়েছি। কিন্তু এই জ্বরকে কালাজ্বর কেন বলা হয়? কালো রঙের সঙ্গে এর কি কোনো সম্পর্ক রয়েছে? জ্বরের প্রকারভেদে রঙের কি আদৌ কোনো ভূমিকা রয়েছে? যদি না থাকে তাহলে প্রশ্ন হলো, কেন এ জ্বরকে কালাজ্বর বলা হয়? কালাজ্বর আসলে কোন ভাষার শব্দ? তবে চলুন আজ জানব কালাজ্বরের আদ্যোপান্ত।
অসমীয় শব্দ ‘কাল’ ও ফারসি শব্দ ‘আজার’ (ব্যাধি) মিলে গঠিত মূল শব্দটি ছিল ‘কালজার’। এর মূল অর্থ ছিল ব্যাধিকাল বা রোগাক্রান্ত সময় যাপন। ‘কালজার’ শব্দের পরিবর্তিত রূপ হলো ‘কালাজ্বর’। এটি বিশেষ্য পদ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই ‘কালজার’ শব্দটি ‘কালাজ্বর’ শব্দে রূপান্তরিত হলো কী করে? ভাষাবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এই পরিবর্তনটি সাধিত হয়েছে ‘লোকনিরুক্তি’ নামক রূপতাত্ত্বিক একটি পদ্ধতির মাধ্যমে। কালজার শব্দটি লোকনিরুক্তি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের মুখে এসে ‘কালাজ্বর’ হয়ে গেছে। আভিধানিকভাবে কালাজ্বর শব্দের মানে হলো ক্রান্তীয় ও উপক্রান্তীয় অঞ্চলে মানবদেহে মাছিবাহিত জীবাণু সংক্রমণের ফলে সৃষ্ট জ্বর, যা থেকে রক্তশূন্যতা, গায়ের চামড়া কালো হয়ে যাওয়া এবং যকৃৎ ও প্লীহার স্ফীতি প্রভৃতি উপসর্গ দেখা দেয়। এটি প্রাণঘাতী রোগ হিসেবে বিবেচিত। ইংরেজিতে শব্দটি হলো ‘kala-ayar’।
প্রাসঙ্গিকভাবেই প্রশ্ন আসে, তাহলে লোকনিরুক্তি কী? খুব ছোট করে বললে বলতে হয়, আমাদের একটি সাধারণ ভাষিক প্রবণতা হলো আমরা চিরকালই কোনো অচেনা শব্দকে চেনা ছকে আবদ্ধ করতে ক্রমাগত চেষ্টা বা পছন্দ করি। কোনো অপরিচিত বা স্বল্প ব্যবহৃত শব্দ যখন ধ্বনিগত সাদৃশ্য আছে এমন একটি পরিচিত শব্দের রূপ পরিগ্রহ করে তখন তাকে লোকনিরুক্তি বলে। প্রকৃতপক্ষে, দীর্ঘ সময় ধরে ভিন্ন ভাষাভাষী সমাজের সংযোগ এবং পারিপার্শ্বিক সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের ফলে যখন কোনো একটি শব্দ অন্য একটি শব্দের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়, ফলে নতুন শব্দটি আমাদের কাছে অধিক পরিচিত ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, তাকেই লোকনিরুক্তি বলে। কয়েকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। যেমন: পর্তুগিজ শব্দ ‘আর্মারিও’ ও ‘আনানাস’ থেকে লোকনিরুক্তির মাধ্যমে যথাক্রমে ‘আলমারি’ ও ‘আনারস’ শব্দদ্বয় রূপান্তরিত হয়েছে। আবার ইংরেজি শব্দ আর্ম চেয়ার লোকনিরুক্তির ফলে আরাম চেয়ার বা আরাম কেদারা হয়েছে। যেহেতু চেয়ারে বসলে আরাম হয়, তাই ‘আর্ম চেয়ার’ শব্দটি খুব সহজেই লোকনিরুক্তির ফলে ‘আরাম চেয়ার’ হয়ে গেছে। অনুরূপ কালজার শব্দটিও আমাদের বাঙালি সমাজে জুতসই কোনো অর্থ তৈরি করতে পারছিল না। যদিও সবাই এ জ্বরের লক্ষণ সম্পর্কে অবগত ছিল। তারা খেয়াল করল এ রোগ হলে প্রচণ্ড তাপে মুখমণ্ডলসহ শরীরের চামড়া ধীরে ধীরে কালো হতে শুরু করে। এখান থেকেই লোকনিরুক্তির পর্যায়টি সম্পন্ন হয়। সামগ্রিক উপসর্গ বিচারে তারা ধরে নেয় ঠিক শব্দটি কালজার নয়, হবে কালাজ্বর। আর এভাবেই ‘কালজার’ শব্দটি লোকনিরুক্তির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মুখে এসে ‘কালাজ্বর’ হয়ে গেছে।
উনিশ শতকের চল্লিশের দশক থেকে কালাজ্বর বাংলাদেশে আঞ্চলিক রোগ হিসেবে অন্যতম জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়। শিশুরাই এ রোগে অধিক আক্রান্ত হয়। কালাজ্বরের জীবাণুবাহী স্ত্রী বেলে মাছির দংশনে এর সংক্রমণ ঘটে। রোগের সুপ্তিকাল সাধারণত ২ থেকে ৬ মাস। এ রোগের জীবাণু শরীরে প্রবেশের পর থেকে রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেতে দুই মাস থেকে ছয় মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। এ রোগে যকৃৎ ও প্লীহার তন্ত্রে প্রদাহ সৃষ্টি হয় এবং প্রায়ই রোগী মারা যায়। ম্যালেরিয়ার পরে এটিই পরজীবীঘটিত রোগগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রাণঘাতী। সময়মতো এবং সঠিকভাবে চিকিৎসা না করলে কালাজ্বরে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। কালাজ্বর নিয়ন্ত্রণে বাহকের বংশবিস্তারের উৎপত্তিস্থল ধ্বংসই সর্বোত্তম উপায়।
বর্তমান সময়ে কালাজ্বরের মতো এমন অনেক শব্দবন্ধ আমাদের ভাষাভাষী সমাজে লোকনিরুক্তি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গঠিত
হচ্ছে। এমন শব্দগুলো আমাদের বাগর্থবিজ্ঞানে নতুন নতুন ব্যঞ্জনায় ধরা দিয়ে ভাষাকে নিরন্তর সমৃদ্ধ করে চলেছে।
লেখক: রাজীব কুমার সাহা
আভিধানিক ও প্রাবন্ধিক
বাংলা ভাষায় বহুল পরিচিত একটি শব্দ হলো কালাজ্বর। শব্দটি কমবেশি আমরা সবাই শুনেছি। এমনকি কেউ কেউ কালাজ্বরে আক্রান্তও হয়েছি। কিন্তু এই জ্বরকে কালাজ্বর কেন বলা হয়? কালো রঙের সঙ্গে এর কি কোনো সম্পর্ক রয়েছে? জ্বরের প্রকারভেদে রঙের কি আদৌ কোনো ভূমিকা রয়েছে? যদি না থাকে তাহলে প্রশ্ন হলো, কেন এ জ্বরকে কালাজ্বর বলা হয়? কালাজ্বর আসলে কোন ভাষার শব্দ? তবে চলুন আজ জানব কালাজ্বরের আদ্যোপান্ত।
অসমীয় শব্দ ‘কাল’ ও ফারসি শব্দ ‘আজার’ (ব্যাধি) মিলে গঠিত মূল শব্দটি ছিল ‘কালজার’। এর মূল অর্থ ছিল ব্যাধিকাল বা রোগাক্রান্ত সময় যাপন। ‘কালজার’ শব্দের পরিবর্তিত রূপ হলো ‘কালাজ্বর’। এটি বিশেষ্য পদ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই ‘কালজার’ শব্দটি ‘কালাজ্বর’ শব্দে রূপান্তরিত হলো কী করে? ভাষাবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এই পরিবর্তনটি সাধিত হয়েছে ‘লোকনিরুক্তি’ নামক রূপতাত্ত্বিক একটি পদ্ধতির মাধ্যমে। কালজার শব্দটি লোকনিরুক্তি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের মুখে এসে ‘কালাজ্বর’ হয়ে গেছে। আভিধানিকভাবে কালাজ্বর শব্দের মানে হলো ক্রান্তীয় ও উপক্রান্তীয় অঞ্চলে মানবদেহে মাছিবাহিত জীবাণু সংক্রমণের ফলে সৃষ্ট জ্বর, যা থেকে রক্তশূন্যতা, গায়ের চামড়া কালো হয়ে যাওয়া এবং যকৃৎ ও প্লীহার স্ফীতি প্রভৃতি উপসর্গ দেখা দেয়। এটি প্রাণঘাতী রোগ হিসেবে বিবেচিত। ইংরেজিতে শব্দটি হলো ‘kala-ayar’।
প্রাসঙ্গিকভাবেই প্রশ্ন আসে, তাহলে লোকনিরুক্তি কী? খুব ছোট করে বললে বলতে হয়, আমাদের একটি সাধারণ ভাষিক প্রবণতা হলো আমরা চিরকালই কোনো অচেনা শব্দকে চেনা ছকে আবদ্ধ করতে ক্রমাগত চেষ্টা বা পছন্দ করি। কোনো অপরিচিত বা স্বল্প ব্যবহৃত শব্দ যখন ধ্বনিগত সাদৃশ্য আছে এমন একটি পরিচিত শব্দের রূপ পরিগ্রহ করে তখন তাকে লোকনিরুক্তি বলে। প্রকৃতপক্ষে, দীর্ঘ সময় ধরে ভিন্ন ভাষাভাষী সমাজের সংযোগ এবং পারিপার্শ্বিক সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের ফলে যখন কোনো একটি শব্দ অন্য একটি শব্দের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়, ফলে নতুন শব্দটি আমাদের কাছে অধিক পরিচিত ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, তাকেই লোকনিরুক্তি বলে। কয়েকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। যেমন: পর্তুগিজ শব্দ ‘আর্মারিও’ ও ‘আনানাস’ থেকে লোকনিরুক্তির মাধ্যমে যথাক্রমে ‘আলমারি’ ও ‘আনারস’ শব্দদ্বয় রূপান্তরিত হয়েছে। আবার ইংরেজি শব্দ আর্ম চেয়ার লোকনিরুক্তির ফলে আরাম চেয়ার বা আরাম কেদারা হয়েছে। যেহেতু চেয়ারে বসলে আরাম হয়, তাই ‘আর্ম চেয়ার’ শব্দটি খুব সহজেই লোকনিরুক্তির ফলে ‘আরাম চেয়ার’ হয়ে গেছে। অনুরূপ কালজার শব্দটিও আমাদের বাঙালি সমাজে জুতসই কোনো অর্থ তৈরি করতে পারছিল না। যদিও সবাই এ জ্বরের লক্ষণ সম্পর্কে অবগত ছিল। তারা খেয়াল করল এ রোগ হলে প্রচণ্ড তাপে মুখমণ্ডলসহ শরীরের চামড়া ধীরে ধীরে কালো হতে শুরু করে। এখান থেকেই লোকনিরুক্তির পর্যায়টি সম্পন্ন হয়। সামগ্রিক উপসর্গ বিচারে তারা ধরে নেয় ঠিক শব্দটি কালজার নয়, হবে কালাজ্বর। আর এভাবেই ‘কালজার’ শব্দটি লোকনিরুক্তির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মুখে এসে ‘কালাজ্বর’ হয়ে গেছে।
উনিশ শতকের চল্লিশের দশক থেকে কালাজ্বর বাংলাদেশে আঞ্চলিক রোগ হিসেবে অন্যতম জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়। শিশুরাই এ রোগে অধিক আক্রান্ত হয়। কালাজ্বরের জীবাণুবাহী স্ত্রী বেলে মাছির দংশনে এর সংক্রমণ ঘটে। রোগের সুপ্তিকাল সাধারণত ২ থেকে ৬ মাস। এ রোগের জীবাণু শরীরে প্রবেশের পর থেকে রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেতে দুই মাস থেকে ছয় মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। এ রোগে যকৃৎ ও প্লীহার তন্ত্রে প্রদাহ সৃষ্টি হয় এবং প্রায়ই রোগী মারা যায়। ম্যালেরিয়ার পরে এটিই পরজীবীঘটিত রোগগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রাণঘাতী। সময়মতো এবং সঠিকভাবে চিকিৎসা না করলে কালাজ্বরে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। কালাজ্বর নিয়ন্ত্রণে বাহকের বংশবিস্তারের উৎপত্তিস্থল ধ্বংসই সর্বোত্তম উপায়।
বর্তমান সময়ে কালাজ্বরের মতো এমন অনেক শব্দবন্ধ আমাদের ভাষাভাষী সমাজে লোকনিরুক্তি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গঠিত
হচ্ছে। এমন শব্দগুলো আমাদের বাগর্থবিজ্ঞানে নতুন নতুন ব্যঞ্জনায় ধরা দিয়ে ভাষাকে নিরন্তর সমৃদ্ধ করে চলেছে।
লেখক: রাজীব কুমার সাহা
আভিধানিক ও প্রাবন্ধিক
কাশ্মীরের বুক চিরে বয়ে চলেছে ঝিলাম নদী। কাশ্মীর উপত্যকা হলো ঝিলামের উত্তর ভাগের অংশ। উপত্যকাটি ১৩৭ কিলোমিটার লম্বা এবং ৩০ থেকে ৪০ কিমি চওড়া। নৈসর্গিক সৌন্দর্যের কারণে কাশ্মীরকে বলা হয় ভূস্বর্গ। এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আকর্ষণে সেখানে অনেকে বেড়াতে যান। ১৯৪৭ সালের আগে কেউ ভাবতে পারেননি যে কাশ্মীর হয়ে
১ ঘণ্টা আগেসমাজের ধনী গরিব বৈষম্যের দূরত্বটাকে কমিয়ে, সম্পদের অধিকতর সুষম বণ্টন নিশ্চিত করে, একটি সুখী বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে মানুষের মৌলিক চাহিদা সম্পন্ন পণ্যের মূল্য নির্ধারণে একটি নতুন প্রস্তাবনা পেশ করছি। প্রথমেই বলে রাখি, এই উদ্যোগটি হবে সীমিত আকারের এবং এর সাফল্যের ভিত্তিতে এটি সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে
২ ঘণ্টা আগেরাখাইনে মানবিক করিডরের প্রস্তাব বাংলাদেশের জন্য একদিকে মানবিক দায়িত্ব পালনের সুযোগ, অন্যদিকে চরম ভূ-রাজনৈতিক ঝুঁকি। মিয়ানমারের জান্তা, বিদ্রোহী গোষ্ঠী ও ভারত-চীনের প্রতিক্রিয়া না বুঝে করিডর চালু করলে তা ‘প্রক্সি যুদ্ধের ফাঁদে’ পরিণত হতে পারে। ভারতের কালাদান প্রকল্প ও চীনের ২১ বিলিয়ন ডলারের
৪ ঘণ্টা আগেসহজ কথা বলা যেমন সহজ নয়, তেমনি সহজ নয় আমাদের দেশে রাজনৈতিক বিষয়ে একমত হওয়া। আমাদের দেশে যত মাথা, তত মত—যে যার মতে অটল, নিজের বক্তব্যে অনড়। ফলে এখানে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানোই যেন যুদ্ধ জয়ের সমান। রাজনীতি তো আর গণিতের সূত্র নয়, যেখানে সবাই একই জবাব মেনে নেবে; এখানে আবেগ, স্বার্থ, বিশ্বাস আর...
১৩ ঘণ্টা আগে