বিভুরঞ্জন সরকার
মিটফোর্ড এলাকায় একজন ব্যবসায়ীকে জনসম্মুখে পাথর দিয়ে থেঁতলে হত্যা করা হলো। ঘটনাটি যেমন নির্মম, তেমনই মর্মান্তিক। কিন্তু সবচেয়ে বেশি যেটি আঘাত করে, তা হলো—ঘটনার সময় আশপাশে থাকা মানুষের নীরবতা ও নিষ্ক্রিয় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। কেউ বাধা দিল না, কেউ ‘থামো’ বলল না, কেউ ওই বিপন্ন মানুষটার জীবন রক্ষার শেষ চেষ্টা করল না। স্রেফ তাকিয়ে থাকা, ভিডিও করা, হয়তো পরে শেয়ার করা—এই ছিল সমাজের প্রতিক্রিয়া। আর এই নিস্পৃহতা, এই ভয়ভীতির নিঃসাড় চেহারাটিই এখন বাংলাদেশের নাগরিক বাস্তবতার একটি নির্মম প্রতীক। অথচ এই দেশেই এক বছর আগে মানুষ রাস্তায় নেমেছিল, ভয়কে তুচ্ছ করে, চোখে সাহসের দীপ্তি নিয়ে, বুকের ভেতর বিপ্লবের চেতনা নিয়ে। ২০২৪ সালের জুলাই মাসের গণ-অভ্যুত্থানে দেশের শহর থেকে মফস্বল পর্যন্ত নেমেছিল হাজার হাজার মানুষ, ছাত্র, শিক্ষক, তরুণ, বয়স্ক। রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্মমতা, গুলি, জলকামান, মামলা, গ্রেপ্তার—সবকিছুকে উপেক্ষা করেও তারা বলেছিল, ‘ভয় করব না’। তারা এক নতুন ইতিহাসের বীজ বপন করেছিল। সে সময় স্লোগান ছিল—‘ভয়ভীতি উপেক্ষা করে, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করব’। কিন্তু মাত্র এক বছরের ব্যবধানে কী এমন ঘটল যে সাহসী মানুষগুলো আজ ভয়গ্রস্ত, নিশ্চুপ, আত্মরক্ষায় ব্যস্ত? এই পরিবর্তনের কারণ নিছক পরিস্থিতি নাকি এর গভীরে রয়েছে আরও বিস্তৃত রাজনৈতিক-সামাজিক ব্যাখ্যা?
বাংলাদেশে ভয় নতুন কোনো বিষয় নয়। ভয় ছিল পাকিস্তান আমলেও, ছিল সামরিক শাসনামলেও। প্রতিবারই এই দেশের মানুষ সেই ভয়কে ছাপিয়ে গেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই ভয় যেন আরও চতুর, আরও কাঠামোগত, আরও সাংগঠনিক। এখন আর শুধু পুলিশি হুমকি বা রাজনৈতিক দমনই নয়, ভয় চলে এসেছে ঘরে ঘরে, মনে মনে। মানুষ এখন কথা বলার আগেও ভাবে, ‘আমি এটা বললে কী হবে? মামলা হবে? কেউ ফলো করছে না তো? মব লেলিয়ে দেওয়া হবে না তো?’ এই আতঙ্ক এমন এক বাস্তবতা তৈরি করেছে, যেখানে প্রতিবাদ নয়, চুপ থাকা হয়ে উঠেছে বুদ্ধিমানের পরিচয়। একসময় যারা বুক টান করে রাজপথে স্লোগান দিত, আজ তারা ফেসবুকে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার স্ট্যাটাস দিয়ে দায় সারে। এই মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন হঠাৎ আসেনি। এর পেছনে আছে দীর্ঘদিনের বিচারহীনতা, প্রাতিষ্ঠানিক নিপীড়ন ও ভয়কে কৌশলে ব্যবস্থাপনার অস্ত্র বানিয়ে তোলা এক রাষ্ট্রীয় কাঠামো।
মিটফোর্ডে যে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, সেটি নিছক একটি ব্যবসায়িক বিরোধ থেকে জন্ম নেওয়া সহিংসতা নয়। বরং এটি একধরনের ক্ষমতার প্রদর্শন, যেখানে অপরাধী জানে—তার কিছুই হবে না। সে জানে, ‘ক্যামেরা থাকলেও আমি পার পেয়ে যাব, দলীয় পরিচয় থাকলে কেউ ছুঁতে পারবে না।‘ এই আত্মবিশ্বাস তখনই আসে, যখন আইনের শাসন ব্যর্থ হয়, যখন বিচারপ্রক্রিয়া পক্ষপাতদুষ্ট হয়, যখন অপরাধীদের শাস্তির দৃষ্টান্ত সমাজে অনুপস্থিত থাকে। এর সঙ্গে যদি যুক্ত হয় স্থানীয় রাজনীতির দাপট, দলীয় ছত্রছায়া ও প্রশাসনের নীরবতা—তাহলে অপরাধ আর নিছক অপরাধ থাকে না, তা পরিণত হয় একপ্রকার ঘোষিত কর্তৃত্বে। সেই কর্তৃত্ব তখন সমাজের প্রতিটি স্তরে আতঙ্ক ছড়ায়। মানুষ জানে, প্রতিবাদ করলে বিপদ আসবেই। ভিডিও করলে হয়তো পরে পুলিশ ডাকবে, কিন্তু বাধা দিলে উল্টো মামলা খেতে হবে। এমনকি যে রিকশাচালক ঘটনাস্থলে ছিল, সে পরে সাংবাদিককে বলেছে, ‘ভাই, এগিয়ে যেতে তো পারতামই, কিন্তু ওদের চিনি—তারা এক ডাকে ২০ জন আনতে পারে। তারপর আমাকে চিনে রাখলে পরে সামাল দেবে কে?’ এই ‘চিনে’ ফেলার ভয়টাই এখন সবচেয়ে শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ।
বিচারহীনতার সংস্কৃতি ধীরে ধীরে বাংলাদেশে বেড়ে উঠে স্থায়ী রূপ পেয়েছে। রাজনৈতিক পরিচয় অনুযায়ী মামলার গতি নির্ধারিত হয়, ভিকটিম নয়, অপরাধীর পরিচয় গুরুত্ব পায়। এই যে বিচারব্যবস্থার অসমতা—এটি একসময় রাষ্ট্রের ওপর মানুষের আস্থাকে উপড়ে ফেলে, তারা বুঝে যায়—প্রতিবাদ করা অর্থহীনই নয়, বরং পরবর্তী সময়ে বিড়ম্বনার কারণ হতে পারে।
এভাবেই এক ভয়গ্রস্ত সমাজ তৈরি হয়, যেখানে অন্যায় দেখেও মানুষ চোখ বন্ধ রাখে। শুধু রাষ্ট্র নয়, এই ভয়কে টিকিয়ে রাখার কাজে ভূমিকা রেখেছে নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যম। একসময় যে নাগরিক সমাজ সাহসী প্রতিবাদের জন্য পরিচিত ছিল, এখন তার বড় অংশই ‘দেখিয়া শুনিয়া খেপিয়া’ না গিয়ে নিশ্চুপ থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে বুঝে নিয়েছে। প্রতিবাদের ভাষা আজ বিবৃতিতে সীমাবদ্ধ, আন্দোলন আর চোখে পড়ে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা যাঁরা একসময় রাস্তায় নেমে যেতেন, এখন শুধু ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। মিডিয়া কেবল ঘটনাটি ঘটেছে—এইটুকু বলেই দায়িত্ব শেষ করে, পারলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু কাঠামোগত বিশ্লেষণ, রাষ্ট্রীয় সহনশীলতা, আইনের শাসনের চিত্র—এসব প্রশ্ন কেউ তোলে না। বরং মিডিয়া একটি নিরাপদ অঞ্চলে থেকে ‘ব্যালেন্সড’ থাকার চেষ্টা করে, যাতে কেউ ‘দোষী’ না হয়। অথচ মিডিয়ার কাজ তো স্রেফ ঘটনার বিবরণ দেওয়া নয়, বরং ঘটনা বিশ্লেষণ করে সমাজকে জাগিয়ে তোলা।
রাজনৈতিক মেরুকরণও এই ভয় ও নীরবতার সংস্কৃতিকে আরও পোক্ত করেছে। আজ কেউ একটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বললেও তাকে প্রশ্ন করা হয়—‘তুমি কোন দলে?’ রাজনৈতিক লেবেল একদিকে অপরাধের মাত্রা নির্ধারণ করে, অন্যদিকে এই দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিবাদকে দুর্বল করে দেয়। সাধারণ নাগরিক দ্বিধায় পড়ে যায়—‘আমি যদি প্রতিবাদ করি, তাহলে হয়তো আমাকে ওদের দলে ভাবা হবে।’ ফলে বহু সচেতন মানুষও নিজেকে আড়ালে রাখে, চুপ থাকে। অপরদিকে যারা একসময় রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল, তাদের অনেকেই এখন নিজের নিরাপত্তার জন্য নীরব থাকাকেই বেছে নিচ্ছে। কিন্তু এই নিরবতা দীর্ঘ মেয়াদে ভয়কেই আরও শক্তিশালী করে।
এখন প্রশ্ন হলো, এই ভয়ের সমাজে ভবিষ্যৎ কী? মিটফোর্ডে একজনকে পাথর দিয়ে মেরে ফেলা হলো, কেউ বাধা দিল না—এ ঘটনা ব্যতিক্রম নাকি এটাই ভবিষ্যতের বাংলাদেশ? যেখানে রাস্তায় কেউ সাহায্যের জন্য চিৎকার করলে মানুষ দূরে সরে দাঁড়াবে। যেখানে গণপিটুনিতে কেউ মারা গেলেও কেউ এগিয়ে আসবে না। যেখানে মেয়েদের হয়রানির ভিডিও ভাইরাল হবে, কিন্তু কেউ তাদের বাঁচাতে হাত বাড়াবে না। আমরা কি এমন এক সমাজে প্রবেশ করছি, যেখানে অন্যায় হবে এবং সেটাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নেওয়া হবে? ভয় যখন সামাজিক নর্ম হয়ে দাঁড়ায়, তখন কোনো দেশ, কোনো সমাজের নৈতিক অবস্থান বলে কিছু থাকে না।
এই পরিস্থিতিতে করণীয় কী? প্রথমত, আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে। বিচারব্যবস্থাকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে, যাতে অপরাধী কোনো পরিচয়ে ছাড় না পায়। দ্বিতীয়ত, ভয় দূর করার জন্য রাষ্ট্রীয় নীতিমালায় পরিবর্তন আনতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, রাষ্ট্রদ্রোহ আইন—এসবকে সংস্কার করতে হবে, যাতে মানুষ মুক্তভাবে মত প্রকাশ করতে পারে। তৃতীয়ত, মিডিয়াকে দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে হবে। শুধু সংবাদ পরিবেশন নয়, সংবেদনশীল, ন্যায়ের পক্ষে স্পষ্ট অবস্থান নিতে হবে। চতুর্থত, নাগরিক সমাজকে আবারও সচল করতে হবে। শিক্ষক, লেখক, সাংবাদিক, ছাত্র, নাগরিক সমাজ—সবাইকে আবারও ভয়ের বিরুদ্ধে কণ্ঠ তুলতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—সাধারণ মানুষকে বোঝাতে হবে, প্রতিবাদ একা করার বিষয় নয়, সম্মিলিত হওয়ার প্রয়োজন। একজন এগিয়ে এলে দশজন এগিয়ে আসবে, তখনই অপরাধী ভয় পাবে।
এই সমাজ একদিন ‘ভয় করব না’ বলে ইতিহাস তৈরি করেছিল। আজ সেই সমাজ নীরব। কিন্তু ইতিহাস বলে, এই নীরবতা দীর্ঘ বা চিরস্থায়ী নয়। আবারও কোনো ইস্যুতে জেগে উঠবে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। কেউ হয়তো আবার বলবে—‘ভয় করব না’ এবং তখন অন্যরাও সেই কণ্ঠে কণ্ঠ মেলাবে। হয়তো তখনই প্রশস্ত হবে ন্যায়বিচারের পথ, রাতের আঁধার কেটে আসবে এক আলোকিত নতুন ভোর।
আরও খবর পড়ুন:
মিটফোর্ড এলাকায় একজন ব্যবসায়ীকে জনসম্মুখে পাথর দিয়ে থেঁতলে হত্যা করা হলো। ঘটনাটি যেমন নির্মম, তেমনই মর্মান্তিক। কিন্তু সবচেয়ে বেশি যেটি আঘাত করে, তা হলো—ঘটনার সময় আশপাশে থাকা মানুষের নীরবতা ও নিষ্ক্রিয় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। কেউ বাধা দিল না, কেউ ‘থামো’ বলল না, কেউ ওই বিপন্ন মানুষটার জীবন রক্ষার শেষ চেষ্টা করল না। স্রেফ তাকিয়ে থাকা, ভিডিও করা, হয়তো পরে শেয়ার করা—এই ছিল সমাজের প্রতিক্রিয়া। আর এই নিস্পৃহতা, এই ভয়ভীতির নিঃসাড় চেহারাটিই এখন বাংলাদেশের নাগরিক বাস্তবতার একটি নির্মম প্রতীক। অথচ এই দেশেই এক বছর আগে মানুষ রাস্তায় নেমেছিল, ভয়কে তুচ্ছ করে, চোখে সাহসের দীপ্তি নিয়ে, বুকের ভেতর বিপ্লবের চেতনা নিয়ে। ২০২৪ সালের জুলাই মাসের গণ-অভ্যুত্থানে দেশের শহর থেকে মফস্বল পর্যন্ত নেমেছিল হাজার হাজার মানুষ, ছাত্র, শিক্ষক, তরুণ, বয়স্ক। রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্মমতা, গুলি, জলকামান, মামলা, গ্রেপ্তার—সবকিছুকে উপেক্ষা করেও তারা বলেছিল, ‘ভয় করব না’। তারা এক নতুন ইতিহাসের বীজ বপন করেছিল। সে সময় স্লোগান ছিল—‘ভয়ভীতি উপেক্ষা করে, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করব’। কিন্তু মাত্র এক বছরের ব্যবধানে কী এমন ঘটল যে সাহসী মানুষগুলো আজ ভয়গ্রস্ত, নিশ্চুপ, আত্মরক্ষায় ব্যস্ত? এই পরিবর্তনের কারণ নিছক পরিস্থিতি নাকি এর গভীরে রয়েছে আরও বিস্তৃত রাজনৈতিক-সামাজিক ব্যাখ্যা?
বাংলাদেশে ভয় নতুন কোনো বিষয় নয়। ভয় ছিল পাকিস্তান আমলেও, ছিল সামরিক শাসনামলেও। প্রতিবারই এই দেশের মানুষ সেই ভয়কে ছাপিয়ে গেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই ভয় যেন আরও চতুর, আরও কাঠামোগত, আরও সাংগঠনিক। এখন আর শুধু পুলিশি হুমকি বা রাজনৈতিক দমনই নয়, ভয় চলে এসেছে ঘরে ঘরে, মনে মনে। মানুষ এখন কথা বলার আগেও ভাবে, ‘আমি এটা বললে কী হবে? মামলা হবে? কেউ ফলো করছে না তো? মব লেলিয়ে দেওয়া হবে না তো?’ এই আতঙ্ক এমন এক বাস্তবতা তৈরি করেছে, যেখানে প্রতিবাদ নয়, চুপ থাকা হয়ে উঠেছে বুদ্ধিমানের পরিচয়। একসময় যারা বুক টান করে রাজপথে স্লোগান দিত, আজ তারা ফেসবুকে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার স্ট্যাটাস দিয়ে দায় সারে। এই মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন হঠাৎ আসেনি। এর পেছনে আছে দীর্ঘদিনের বিচারহীনতা, প্রাতিষ্ঠানিক নিপীড়ন ও ভয়কে কৌশলে ব্যবস্থাপনার অস্ত্র বানিয়ে তোলা এক রাষ্ট্রীয় কাঠামো।
মিটফোর্ডে যে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, সেটি নিছক একটি ব্যবসায়িক বিরোধ থেকে জন্ম নেওয়া সহিংসতা নয়। বরং এটি একধরনের ক্ষমতার প্রদর্শন, যেখানে অপরাধী জানে—তার কিছুই হবে না। সে জানে, ‘ক্যামেরা থাকলেও আমি পার পেয়ে যাব, দলীয় পরিচয় থাকলে কেউ ছুঁতে পারবে না।‘ এই আত্মবিশ্বাস তখনই আসে, যখন আইনের শাসন ব্যর্থ হয়, যখন বিচারপ্রক্রিয়া পক্ষপাতদুষ্ট হয়, যখন অপরাধীদের শাস্তির দৃষ্টান্ত সমাজে অনুপস্থিত থাকে। এর সঙ্গে যদি যুক্ত হয় স্থানীয় রাজনীতির দাপট, দলীয় ছত্রছায়া ও প্রশাসনের নীরবতা—তাহলে অপরাধ আর নিছক অপরাধ থাকে না, তা পরিণত হয় একপ্রকার ঘোষিত কর্তৃত্বে। সেই কর্তৃত্ব তখন সমাজের প্রতিটি স্তরে আতঙ্ক ছড়ায়। মানুষ জানে, প্রতিবাদ করলে বিপদ আসবেই। ভিডিও করলে হয়তো পরে পুলিশ ডাকবে, কিন্তু বাধা দিলে উল্টো মামলা খেতে হবে। এমনকি যে রিকশাচালক ঘটনাস্থলে ছিল, সে পরে সাংবাদিককে বলেছে, ‘ভাই, এগিয়ে যেতে তো পারতামই, কিন্তু ওদের চিনি—তারা এক ডাকে ২০ জন আনতে পারে। তারপর আমাকে চিনে রাখলে পরে সামাল দেবে কে?’ এই ‘চিনে’ ফেলার ভয়টাই এখন সবচেয়ে শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ।
বিচারহীনতার সংস্কৃতি ধীরে ধীরে বাংলাদেশে বেড়ে উঠে স্থায়ী রূপ পেয়েছে। রাজনৈতিক পরিচয় অনুযায়ী মামলার গতি নির্ধারিত হয়, ভিকটিম নয়, অপরাধীর পরিচয় গুরুত্ব পায়। এই যে বিচারব্যবস্থার অসমতা—এটি একসময় রাষ্ট্রের ওপর মানুষের আস্থাকে উপড়ে ফেলে, তারা বুঝে যায়—প্রতিবাদ করা অর্থহীনই নয়, বরং পরবর্তী সময়ে বিড়ম্বনার কারণ হতে পারে।
এভাবেই এক ভয়গ্রস্ত সমাজ তৈরি হয়, যেখানে অন্যায় দেখেও মানুষ চোখ বন্ধ রাখে। শুধু রাষ্ট্র নয়, এই ভয়কে টিকিয়ে রাখার কাজে ভূমিকা রেখেছে নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যম। একসময় যে নাগরিক সমাজ সাহসী প্রতিবাদের জন্য পরিচিত ছিল, এখন তার বড় অংশই ‘দেখিয়া শুনিয়া খেপিয়া’ না গিয়ে নিশ্চুপ থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে বুঝে নিয়েছে। প্রতিবাদের ভাষা আজ বিবৃতিতে সীমাবদ্ধ, আন্দোলন আর চোখে পড়ে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা যাঁরা একসময় রাস্তায় নেমে যেতেন, এখন শুধু ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। মিডিয়া কেবল ঘটনাটি ঘটেছে—এইটুকু বলেই দায়িত্ব শেষ করে, পারলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু কাঠামোগত বিশ্লেষণ, রাষ্ট্রীয় সহনশীলতা, আইনের শাসনের চিত্র—এসব প্রশ্ন কেউ তোলে না। বরং মিডিয়া একটি নিরাপদ অঞ্চলে থেকে ‘ব্যালেন্সড’ থাকার চেষ্টা করে, যাতে কেউ ‘দোষী’ না হয়। অথচ মিডিয়ার কাজ তো স্রেফ ঘটনার বিবরণ দেওয়া নয়, বরং ঘটনা বিশ্লেষণ করে সমাজকে জাগিয়ে তোলা।
রাজনৈতিক মেরুকরণও এই ভয় ও নীরবতার সংস্কৃতিকে আরও পোক্ত করেছে। আজ কেউ একটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বললেও তাকে প্রশ্ন করা হয়—‘তুমি কোন দলে?’ রাজনৈতিক লেবেল একদিকে অপরাধের মাত্রা নির্ধারণ করে, অন্যদিকে এই দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিবাদকে দুর্বল করে দেয়। সাধারণ নাগরিক দ্বিধায় পড়ে যায়—‘আমি যদি প্রতিবাদ করি, তাহলে হয়তো আমাকে ওদের দলে ভাবা হবে।’ ফলে বহু সচেতন মানুষও নিজেকে আড়ালে রাখে, চুপ থাকে। অপরদিকে যারা একসময় রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল, তাদের অনেকেই এখন নিজের নিরাপত্তার জন্য নীরব থাকাকেই বেছে নিচ্ছে। কিন্তু এই নিরবতা দীর্ঘ মেয়াদে ভয়কেই আরও শক্তিশালী করে।
এখন প্রশ্ন হলো, এই ভয়ের সমাজে ভবিষ্যৎ কী? মিটফোর্ডে একজনকে পাথর দিয়ে মেরে ফেলা হলো, কেউ বাধা দিল না—এ ঘটনা ব্যতিক্রম নাকি এটাই ভবিষ্যতের বাংলাদেশ? যেখানে রাস্তায় কেউ সাহায্যের জন্য চিৎকার করলে মানুষ দূরে সরে দাঁড়াবে। যেখানে গণপিটুনিতে কেউ মারা গেলেও কেউ এগিয়ে আসবে না। যেখানে মেয়েদের হয়রানির ভিডিও ভাইরাল হবে, কিন্তু কেউ তাদের বাঁচাতে হাত বাড়াবে না। আমরা কি এমন এক সমাজে প্রবেশ করছি, যেখানে অন্যায় হবে এবং সেটাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নেওয়া হবে? ভয় যখন সামাজিক নর্ম হয়ে দাঁড়ায়, তখন কোনো দেশ, কোনো সমাজের নৈতিক অবস্থান বলে কিছু থাকে না।
এই পরিস্থিতিতে করণীয় কী? প্রথমত, আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে। বিচারব্যবস্থাকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে, যাতে অপরাধী কোনো পরিচয়ে ছাড় না পায়। দ্বিতীয়ত, ভয় দূর করার জন্য রাষ্ট্রীয় নীতিমালায় পরিবর্তন আনতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, রাষ্ট্রদ্রোহ আইন—এসবকে সংস্কার করতে হবে, যাতে মানুষ মুক্তভাবে মত প্রকাশ করতে পারে। তৃতীয়ত, মিডিয়াকে দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে হবে। শুধু সংবাদ পরিবেশন নয়, সংবেদনশীল, ন্যায়ের পক্ষে স্পষ্ট অবস্থান নিতে হবে। চতুর্থত, নাগরিক সমাজকে আবারও সচল করতে হবে। শিক্ষক, লেখক, সাংবাদিক, ছাত্র, নাগরিক সমাজ—সবাইকে আবারও ভয়ের বিরুদ্ধে কণ্ঠ তুলতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—সাধারণ মানুষকে বোঝাতে হবে, প্রতিবাদ একা করার বিষয় নয়, সম্মিলিত হওয়ার প্রয়োজন। একজন এগিয়ে এলে দশজন এগিয়ে আসবে, তখনই অপরাধী ভয় পাবে।
এই সমাজ একদিন ‘ভয় করব না’ বলে ইতিহাস তৈরি করেছিল। আজ সেই সমাজ নীরব। কিন্তু ইতিহাস বলে, এই নীরবতা দীর্ঘ বা চিরস্থায়ী নয়। আবারও কোনো ইস্যুতে জেগে উঠবে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। কেউ হয়তো আবার বলবে—‘ভয় করব না’ এবং তখন অন্যরাও সেই কণ্ঠে কণ্ঠ মেলাবে। হয়তো তখনই প্রশস্ত হবে ন্যায়বিচারের পথ, রাতের আঁধার কেটে আসবে এক আলোকিত নতুন ভোর।
আরও খবর পড়ুন:
গত বছরের ৮ আগস্ট বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনার গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করেছিল। তাদের শাসন আমলে একটি নতুন অর্থবছরেরও সূচনা হয়েছে। আজ বছর পেরিয়ে অনেকেই পেছন ফিরে তাকাচ্ছেন—অর্জন কতটুকু, ব্যর্থতা কোথায় এবং অন্তরায় কী কী? এমন একটি হিসাব-নিকাশ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অগ্রযাত্রায় দিকনির্দেশনা দি
২ ঘণ্টা আগেআমরা যেন এক কদম সামনে বাড়লে পিছিয়ে পড়ি আরও দশ কদম। তখন সেই এক কদম এগিয়ে যাওয়াকে বড্ড ম্লান মনে হয়। গত প্রায় এক দশক ধরেই ঢাকার বায়ু ও পরিবেশ দূষণের শিকার। এখনো আমরা শীর্ষ বা এর আশপাশে অবস্থান করছি। এত সংস্কার কমিটি হলো, শুনেছি পরিবেশ উন্নয়নের জন্যও নাকি কমিটি গঠিত হয়েছে। কাজের ক্ষেত্রে কোনোটিরই কি কো
২ ঘণ্টা আগেবাসটা ধাক্কা দিয়েছে এক শিক্ষার্থীকে, শিক্ষার্থী করেছে তার প্রতিবাদ। তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে বাসের চালক, চালকের সহকারী ও অন্য কর্মীরা শিক্ষার্থীকে তুলে নিয়েছে বাসে। ‘চোর’ আখ্যা দিয়ে পিটিয়েছে। বাসের যাত্রীরা প্রশ্ন করেছে, কিন্তু ‘চোর’কে পেটানো হচ্ছে বলা হলে তারা নির্বিকার বসে থেকেছে আসনে। চোর হলেও যে তাকে পু
২ ঘণ্টা আগেযে রকম পরিস্থিতিতে দেশ চলছে, তাতে দেশের জনগণের স্বস্তিতে থাকার কোনো কারণ নেই। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ৫ আগস্ট নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়ায় সেই অস্বস্তি থেকে বের হয়ে আসার আপাতত একটা পথের দিশা পাওয়া গেল। জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা এই ভাষণ দেওয়ার আগে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা থেকে...
১ দিন আগে