Ajker Patrika

শ্রেষ্ঠত্বের কেন্দ্র

মামুনুর রশীদ
শিক্ষার্থীদের সঠিক ও প্রকৃত শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে প্রাথমিকেই। ছবি: আজকের পত্রিকা
শিক্ষার্থীদের সঠিক ও প্রকৃত শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে প্রাথমিকেই। ছবি: আজকের পত্রিকা

আমার এক অধ্যাপক বন্ধু আছেন, যিনি সংক্ষেপে কোনো কথা বলতে পারেন না। তাঁকে ঠাট্টা করে আমি ‘বচনজীবী অধ্যাপক’ বলে ডাকি। সম্প্রতি ফেসবুকে তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ছবি দিয়ে ক্যাপশন লিখেছেন, ‘আমি কোথাও এখন আর ছাত্র খুঁজে পাই না, সবাই পরীক্ষার্থী।’ তাঁর দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনের নির্যাসটুকু যেন ওই দুটি বাক্যে স্পষ্ট হয়েছে। কথাটা যে খুব নতুন, তা নয়। কিন্তু কেন যেন বড় গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো। সম্প্রতি ছাত্ররা আবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, সেই সঙ্গে পরীক্ষাও।

হাজার হাজার ছাত্র পরীক্ষা দেয় না, কিন্তু তাদের আশা অটোপাস মিলবে, তা মিলেও যায়! বিষয়টা শিক্ষার নিম্নতম পর্যায় থেকে একেবারে উচ্চপর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত। শিক্ষার ব্যাপারে বেশি কিছু বলার আর অবকাশ নেই। দীর্ঘদিনের অপচর্চায় শিক্ষা এখন শুধু পরীক্ষার্থী এবং চাকরি লভ্যতার প্রয়োজন। শিক্ষার সঙ্গে মানবিকতা, মনুষ্যত্ব—সবই গেছে! এর সঙ্গে আবার জড়িত সবাই, কেউ দায় এড়াতে পারবে না—শিক্ষাব্যবস্থাপনায় সরকার, রাষ্ট্র, শিক্ষক, অভিভাবক—সবাই মিলেই বিষয়টি ঘটেছে।

যখন থেকে শিক্ষায় অর্থের আমদানি, তখন থেকেই এর সর্বনাশ। কোচিং ব্যবসা, শিক্ষা উন্নয়নে সরকারি অর্থ, নিয়োগ- বাণিজ্য—সবাই একসঙ্গে কোমর বেঁধে নেমেছে। এখন আর দু-চারজন হতভাগা শিক্ষক ছাড়া কারও চেহারায় কোনো উদ্বেগ, কোনো গ্লানি দেখা যায় না। এসব কথা বলতে গেলে লোকে বিরক্ত হবে। কিন্তু বহু বছর ধরে, ধরা যাক প্রাথমিক স্কুলে পড়ার সময় থেকে, মানে ৭২ বছর ধরেই একটি উদ্বেগ আমি বয়ে বেড়াচ্ছি। আমি গ্রামের ছেলে। কখনো ধানের খেতে আলপথে, স্রোতস্বিনী স্বচ্ছ অথবা অস্বচ্ছ পানিতে পা ডুবিয়ে স্কুলে যাওয়া, গরমের দিনে কাঁচা আমটি পেড়ে খেতে খেতে স্কুলে যাওয়া হতো আমার। আমাদের দরিদ্র শিক্ষকের মনোযোগী চোখ দুটি তখন ছাত্রদের দিকে থাকত। অধিকাংশ স্কুল তখন সরকারি হয়নি। সব ছাত্রেরও বেতন দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না। কিন্তু শীত, গ্রীষ্ম সব ঋতুতেই স্কুল চলত। স্কুলঘরের বেড়া ছিল না। ওপরের টিনের চালাটাও পড়ো পড়ো। সময়টা ১৯৫০-এর দশকের গোড়ার দিক থেকে অনেক দিন চলেছে। কিন্তু স্কুলের শিক্ষার আনন্দটা যেন শেষ হয়নি। উৎসব, পূজা-পার্বণে স্কুলের চেহারাটা অন্য রকম হয়ে যেত।

তখনকার মধ্যবিত্তের জীবন নিম্নবিত্তের চেয়েও করুণ! কিন্তু তাদের আনন্দের উৎসটা কোথায়? অনুসন্ধানটি কঠিন, তবে অনুমান করতে দোষ নেই। মানুষ আর প্রকৃতি মিলে নবজীবনের উৎসমুখ দেখার এক অনাবিল আনন্দ ছিল তখন। শিক্ষকদের বেতন ছিল ১৫ থেকে ২০ টাকা। পাকিস্তান সরকার বছরের পর বছর সে টাকা আটকে রাখত। ১৯৪৭ সাল থেকেই এই অবস্থা ছিল। অনাহারক্লিষ্ট শিক্ষকদের এই অবস্থায় কাজে কখনোই বিঘ্ন ঘটতে দেখিনি। মাধ্যমিকের অবস্থা কিঞ্চিৎ ভালো ছিল কোথাও কোথাও। তবে ব্রিটিশ আমল থেকে চলে আসা সরকারি স্কুলগুলোর শিক্ষকেরা এদিক থেকে একটু ভালো ছিলেন।

যাহোক, আমি প্রাথমিক স্কুলের দিকেই মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করব। একটু বড় হয়ে বুঝতে পেরেছি, শিক্ষার সূচনাকালটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মাধ্যমিকে এসেই বুঝতে পারলাম, কিছু কিছু পড়ার বিষয় একটু-আধটু কাঁচাই রয়ে গেছে। শিক্ষকেরা সেসব শোধরাবার চেষ্টাও করছেন। পড়ালেখার চাপটা আজকের মতো না থাকায় সেসব ঠিকঠাক করার একটা সুযোগ ছিল। বিশেষ করে ইংরেজি। ওই সময় ইংরেজি শিক্ষকের বেশ অভাব ছিল। আর উচ্চতর ক্লাসে গণিত এবং বিজ্ঞান শিক্ষকের। প্রধান শিক্ষকের চেয়ে বেশি বেতন দিয়ে বিজ্ঞান শিক্ষক আনতে হতো। তারপরও ওই সব স্কুল থেকে প্রবেশিকা বা এসএসসিতে ভালো করার নজির ছিল প্রচুর। গ্রামের স্কুলগুলোতে আবার বেশ কিছু কিংবদন্তিতুল্য শিক্ষক ছিলেন, যাঁরা প্রতিটি ছাত্রের পরিচর্যার ক্ষমতা রাখতেন। স্কুলে খেলাধুলা, গান, নাটক, ছবি আঁকা এসবের চর্চাও চলত। ওই বয়সে ক্রীড়ায় বা যেকোনো ক্ষেত্রে টিনের তৈরি একটা মেডেল পেলে তা স্বর্ণপদকই মনে হতো। সেই সব ছাত্রই ১৯৬০-এর দশকের ছাত্র আন্দোলন, গণ-আন্দোলন এবং সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটা নতুন দেশ এনেছিল।

কিন্তু স্বাধীনতার পর সবটাই পাল্টে যেতে লাগল। শুদ্ধ শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্কটাই পাল্টে যেতে লাগল। নকল প্রবণতা, শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম, শিক্ষাদানে শৈথিল্য প্রকট আকার ধারণ করল। নতুন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হচ্ছিল এবং প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন সরকারি অফিসের পিয়নের কাছাকাছি হতে শুরু করল। কিন্তু শিক্ষা বিভাগে নতুন ধরনের নিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি হলো। দালান-কোটা হতে শুরু করল। শিক্ষা উপকরণের কেনাকাটাও বাড়তে থাকে। পঁচাত্তরের পর মধ্যবিত্ত আবার পাল্টে যেতে লাগল। সরকারি প্রাথমিকে তাদের কোনো আগ্রহ নেই, একটা ইংরেজি স্কুল খোঁজে; তেমন ভালো নয়, মোটামুটি হলেই চলবে। আর এই সময় যাঁরা রাজনীতি করেন, তাঁদের ছেলেমেয়েদের জন্য বাংলা স্কুলে নয়, ইংরেজি স্কুল চাই-ই চাই। না হলে প্রতিবেশী দেশে কনভেন্ট বা ওই ধরনের স্কুলে তো দিতে হবেই। আমলা-ব্যবসায়ীদের জন্য অবৈধ অর্থের আনাগোনা বাড়ছে। তাই অর্থ কোনো ব্যাপারই নয়।

১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি আমি একটি কাজে মুম্বাই ছিলাম বেশ কিছুদিন। এই সময় বাংলাদেশ বিমান অফিস ছিল আমার অবসর কাটানোর জায়গা। বিমানের ম্যানেজার সর্বক্ষণ অস্থির হয়ে থাকতেন, কারণ প্রতিটি ফ্লাইটেই প্রচুর ভিআইপি তাঁদের শিশুসন্তান নিয়ে আসতেন। এইসব ভিআইপি আবার সত্যিকার ভিআইপি নয়—উপসচিব থেকে সচিব, কখনো মন্ত্রীর পিএস অথবা এপিএস। মুম্বাইতে টাকাপয়সা দিয়ে তাঁদের যথাস্থানে পাঠানোর দায়িত্ব ছিল ওই ম্যানেজার সাহেবের। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও অশান্ত। মাঝে মাঝে বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকে। কিন্তু বিদেশে পড়ালেখা করা ছাত্রদের কোনো অসুবিধা নেই।

একসময় সত্যি মনে হলো দেশের শিক্ষাব্যবস্থা গোল্লায় যাক, তাতে কিছু আসে-যায় না। স্বৈরাচারের অবসানে গণতান্ত্রিক সরকার এল, পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হলো না। বরং বহুগুণে তা বেড়ে গেল। শেষ পরিণতি তো দেখলামই। এর মধ্যে কোথায় সেই প্রাথমিক বিদ্যালয়—হাতেখড়ির জায়গাটা? সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় পাস ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষক হয়ে এসেছেন। তাঁরা সবাই এলাকারই সন্তান। শিক্ষা বিভাগের আমলা, স্থানীয় রাজনীতিক, ম্যানেজিং কমিটি—সবই আছে। কিন্তু কোথায় সেই আনন্দময় শিক্ষা, হৃদয়ের গভীরে আশ্রয় নেওয়া অক্ষরমালা? পুরো শিক্ষাব্যবস্থা প্রায়ই যখন দুষ্ট রাজনীতির ক্ষতে পরিণত হয়, তখন প্রাথমিক শিক্ষাটাকে এর বাইরে ভাববার অবকাশ নেই।

শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তারা আসেন দয়া করে, অভিভাবকেরা খবরই নেন না। শিক্ষকদের বড় একটা অংশ কোচিং-বাণিজ্যে নিমজ্জিত। যাঁরা শিক্ষক তাঁরাও ঋণে জর্জরিত। লাখ লাখ টাকা দিয়ে চাকরিটা নিতে হয়। একজন দুর্নীতিপরায়ণ অদক্ষ শিক্ষকের কাছে ছাত্ররা কী শিখবে? এ ব্যাপারে পত্রপত্রিকা, টক শোতে, আমলা-মন্ত্রীদের দরবারে নানা কথা বললেও কিছু হবে না। তবে আবার রাজনীতিক সাহেবের ওই স্কুলের নিয়ন্ত্রণটি চাই।

বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার বিষয় বাদ দিয়ে কেন প্রাথমিকের কথাটাই বলছি? ওই জায়গাটা ঠিক করে ছাত্রটিকে যদি মাধ্যমিকে পাঠানো যায়, তাহলে শিক্ষকেরা একটু নড়েচড়ে বসতে পারতেন। প্রাথমিকে টাকা খরচ করতেও নীতিনির্ধারকেরা খুবই কৃপণ। এত অপচয় চারদিকে, সেখানে একজন শিক্ষকের বেতন মাধ্যমিকের হেডমাস্টারের সমান হলে অসুবিধা কী? আবার মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের বেতন কয়েক গুণ বেশি হলেই-বা অসুবিধা কী? আমলারা মনে করেন, তাঁরা কখনোই প্রাথমিকে পড়েননি, ওটার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন যেখানে শুধু পরীক্ষার্থী তৈরি করা, তাই বিশ্ববিদ্যালয়টাই যথেষ্ট। ‘শিক্ষা শিক্ষা’ বলে সবাই গলা ফাটায় কিন্তু আসল জায়গাটা হচ্ছে সঠিক ও প্রকৃত শিক্ষা, যেখান থেকে ছাত্রই তৈরি হবে, পরীক্ষার্থী নয়।

প্রাথমিক নিয়ে আমার মাথাব্যথার কারণ পরে একদিন ব্যাখ্যা করব। যেখানে বলতে চাই, প্রাথমিক স্কুলগুলো হওয়া উচিত ছিল শ্রেষ্ঠত্বের কেন্দ্র। ইংরেজিতে ‘সেন্টার অব এক্সিলেন্স’।

লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ডে গেছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ

‘ফের ধর্ষণচেষ্টার ক্ষোভে’ বাবাকে খুন, ৯৯৯-এ কল দিয়ে আটকের অনুরোধ মেয়ের

আদালতের বিচারকাজে বাধা দেওয়ায় আইনজীবীর দণ্ড, ক্ষমা চেয়ে পার

আ. লীগের ক্লিন ইমেজের ব্যক্তিদের বিএনপির সদস্য হতে বাধা নেই: রিজভী

১৫ স্থাপনায় পাকিস্তানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, আকাশেই ধ্বংসের দাবি ভারতের

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত