Ajker Patrika

ছিলেন রাষ্ট্রপ্রধান, হলেন কয়েদি

মইনুল হাসান
পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে সাবেক ফরাসি প্রেসিডেন্ট নিকোলা সারকোজিকে। ছবি: এএফপি
পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে সাবেক ফরাসি প্রেসিডেন্ট নিকোলা সারকোজিকে। ছবি: এএফপি

২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫। প্যারিসের একটি ফৌজদারি আদালতের চারপাশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সতর্ক চৌকস সদস্যরা কৌতূহলী জনতা, সংবাদকর্মীদের সামলাতে এবং একই সঙ্গে সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রাণান্ত। আশপাশের রাজপথে যানবাহনগুলোকে অন্য পথে ঘুরিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেদ করে কাউকে প্রয়োজন ছাড়া আদালতের ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে দেওয়া হচ্ছে না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উৎসুক দর্শক-শ্রোতাদের কৌতূহল মেটাতে সংবাদকর্মীরা তাঁদের ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে সরাসরি নানা ভাষায় ধারাবিবরণী শুরু করে দিয়েছেন। ক্যামেরা আর অ্যান্টেনার ঘন জঙ্গলে ঢাকা পড়েছে আদালত প্রাঙ্গণ। ‘স্বাধীনতা, ভ্রাতৃত্ব এবং সাম্য’—এই তিন মূলমন্ত্রে দীক্ষিত ফরাসি জাতি একটি ঐতিহাসিক এবং অতি চাঞ্চল্যকর রায়ের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছেন। সব জল্পনার অবসান ঘটতে চলেছে।

আদালতের কাঠগড়ায় ‘অসাধারণ’ এক আসামি উপস্থিত আছেন। দেশের সবাই তাঁকে চেনেন। কারণ, একসময় এমন একটি দিন ছিল না যে তাঁকে সংবাদমাধ্যমগুলো ভুলে থেকেছে। সংবাদপত্রের প্রথম পাতার আকর্ষণীয় সব খবর ছিল তাঁকে নিয়ে। আজও তিনি রাজনীতির মাঠে সরব। তথাপি আদালতের নিয়ম মেনে, বিচারকদের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে বেশ খানিকক্ষণ নীরব থাকলেন। একবার নিজের চারপাশে তাকালেন। তাকালেন আদালতে উপস্থিত তাঁর সুন্দরী তৃতীয় ভার্যা, ৫৭ বছর বয়সের ক্লারা ব্রুনির দিকে। দেখলেন নিজের উদ্বেগাকুল ছেলেকে। তারপর শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে জনাকীর্ণ আদালতকক্ষে কাকে যেন খুঁজলেন। এই প্রথম তাঁকে অনেকটা অসহায় দেখাল। চিরচেনা তাঁর তেজদীপ্ত চেহারা একটু ম্লান হলো। ভরাট কণ্ঠে নিজের পরিচয় ব্যক্ত করলেন।

নাম নিকোলা সারকোজি, অন্য কোনো নাম নেই। বয়স ৭০ বছর। ফরাসি নাগরিক, বিবাহিত। পেশায় আইনজীবী। তবে যে পরিচয় তিনি ঊহ্য রাখলেন, তা হলো তিনি পরাশক্তি ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট। ২০০৭ থেকে ২০১২ সাল—পাঁচ বছর এলিজি প্রাসাদের স্বর্ণকক্ষে বসে দেশ চালিয়েছেন দোর্দণ্ডপ্রতাপে। শেষের এই পরিচয়ে বিচারকদের তেমন কোনো আগ্রহ নেই। তাঁরা আজ একজন অভিযুক্ত আসামির বিচার চূড়ান্ত করবেন, এর বেশি কিছু নয়।

আদালতে বাদীপক্ষের আনা অভিযোগ আসামিকে পড়ে শোনানো হলো। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল দুর্নীতি, অর্থ আত্মসাৎ, লিবিয়ার প্রয়াত সুপ্রিম গাইড মুয়াম্মার গাদ্দাফির কাছ থেকে নিজের নির্বাচনী প্রচারের জন্য মোটা অঙ্কের অর্থ গ্রহণ, নির্বাচনী প্রচারণার সময় অবৈধভাবে অতিরিক্ত ব্যয়। অভিযোগ আমলে নিয়ে বিচারের স্বচ্ছতার জন্য দীর্ঘ ১০ বছর ধরে চলে তদন্ত, অনুসন্ধান। পুরো ৭৩ কার্যদিবস ধরে বাদী-বিবাদীপক্ষের আইনজীবীদের যুক্তি, পাল্টা যুক্তি, উত্তপ্ত বাদানুবাদে আদালত কক্ষ সরগরম হয়েছে। ৫৪ বার খানাতল্লাশ চালানো হয়েছে বিভিন্ন স্থানে, বাড়িতে, দপ্তরে। মোট ২০টি দেশের কাছে আবেদন করা হয় আন্তর্জাতিক সহায়তার। পাহাড়সমান নথি জমা হয়েছে আদালতে।

অবশেষে বহুপ্রতীক্ষিত মামলার রায় অর্থাৎ নাটকের শেষ দৃশ্য মঞ্চস্থ হলো বৃহস্পতিবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫। দুর্নীতি, অর্থ আত্মসাৎ, মুয়াম্মার গাদ্দাফির কাছ থেকে অনৈতিকভাবে অর্থ গ্রহণ এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বিধিমালা লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত ব্যয়ের অভিযোগ থেকে তাঁকে খালাস দিলেও, ‘দুর্বৃত্তদের সঙ্গে যোগসাজশের’ অভিযোগে প্যারিসের ফৌজদারি আদালতে তিনি দোষী সাব্যস্ত হন। এই অপরাধে আদালত তাঁকে পাঁচ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে আটকাদেশ দেন। সেই সঙ্গে তাঁকে ১ লাখ ইউরো জরিমানা করা হয়। মুহূর্তেই সে খবর ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। ‘ব্রেকিং নিউজ’ শিরোনামে দেশব্যাপী প্রচার হতে থাকে এই খবর। অনেকে তুলনা করেন সুনামির সঙ্গে।

কে এই নিকোলা সারকোজি? অভিবাসী বাবার সন্তান, মাত্র ২০ বছর বয়সে ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত হন। সাহসী, মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুল, উজ্জ্বল চোখের চমৎকার বক্তা, সহজেই তিনি স্থানীয় নেতাদের দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হন। মাত্র ২৮ বছর বয়সে নিজের শহরের মেয়র নির্বাচিত হন। এরপর তিনি জাতীয় নেতাদের সুদৃষ্টি, আনুকূল্য অর্জনে সুনিপুণ দক্ষতার পরিচয় দেন। রাষ্ট্রক্ষমতার সোনার হরিণের পেছনে ছুটতে গিয়ে নিজের ছায়াকেও অনেক পেছনে ফেলে দ্রুত এগিয়ে যান তিনি। তবে তাঁর সম্পর্কে একটা কথা চালু আছে, তা হলো, যাঁদেরকে তিনি ক্ষমতায় পৌঁছবার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করেছেন, ক্ষমতার ধাপে ধাপে পৌঁছে তাঁদের থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেন।

অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি ভালো না বুঝলেও দেশটির বাজেটমন্ত্রী থাকাকালে তিনি এসব কথা ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলেন, অর্থের ‘আলাদা ক্ষমতা’ আছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে ২০০৫ সালের ৬ অক্টোবর রাষ্ট্রীয় সফরে লিবিয়ায় অবস্থানকালে প্রয়াত সুপ্রিম গাইড মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে একান্তে জানান, ২০০৭ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে যাচ্ছেন। আর সে কারণে নির্বাচনী প্রচারণার জন্য অর্থ সাহায্য প্রয়োজন। কথিত আছে, কয়েক কিস্তিতে তিনি গাদ্দাফির কাছ থেকে ৫ কোটি ইউরো নিয়েছিলেন। বিনিময়ে তিনি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে গাদ্দাফির ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরতে সহায়তা করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। সেই সঙ্গে পারমাণবিক স্থাপনা সহায়তা এবং আধুনিক সমরাস্ত্র বিক্রির আকর্ষণীয় প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ২০০৭ সালে নিকোলা সারকোজি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এর সাত মাস পর গাদ্দাফির প্যারিস সফরকালে এ ব্যাপারে বেশ কিছু চুক্তিও স্বাক্ষর হয়েছিল।

মুয়াম্মার গাদ্দাফির স্বপ্ন ছিল আফ্রিকার দেশগুলো নিয়ে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের আদলে একটি ‘ইউনাইটেড স্টেটস অব আফ্রিকা’ গড়ে তুলবেন এবং তিনি তাঁর নেতৃত্ব দেবেন। এদিকে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর, নিকোলা সারকোজি আফ্রিকার রাষ্ট্রগুলোর নেতৃত্ব দেওয়ার একান্ত অভিলাষ ব্যক্ত করেন। তাতে করে গাদ্দাফির স্বপ্ন ফিকে হতে শুরু করে। তিনি সারকোজিকে তাঁর অর্থ সাহায্যের কথা আকারে-ইঙ্গিতে মনে করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। সে সময় রাজনীতির আকাশে উজ্জ্বল সারকোজি এতে বিব্রত বোধ করেন। ২০১১ সালে আরব বসন্তে লিবিয়ায় গণ-অভ্যুত্থান ঘটলে, সারকোজি সেই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলেন না। প্রভাব খাটিয়ে জাতিসংঘকে হাত করে গাদ্দাফির প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য ফরাসি যুদ্ধবিমান ব্যবহারের আদেশ দেন। আক্রমণ এড়াতে পলায়নরত গাদ্দাফির গাড়িবহরে ফরাসি যুদ্ধবিমান থেকে গোলা ছোড়া হলে, মুয়াম্মার গাদ্দাফি যখন গাড়ি ছেড়ে বের হয়ে আসেন, তখন তিনি বিক্ষুব্ধ বিদ্রোহীদের হাতে পড়েন। ভিডিওতে এটুকুই দেখা যায়। অজানা কারণে ভিডিওর কিছু অংশ বাদ পড়ে যায়। এরপর দেখা যায়, গুলিবিদ্ধ গাদ্দাফির প্রাণহীন রক্তাক্ত দেহ। কে তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত করেছে, সে রহস্য আজও উদ্‌ঘাটিত হয়নি।

সারকোজি যাঁদের কাছ থেকে সাহায্য নিয়েছেন, তিনি বরাবরই তাঁদেরকে দূরে সরিয়ে দিতে দ্বিতীয়বার চিন্তা করেননি। নিকোলা সারকোজিকে যাঁরা ভালো চেনেন, তাঁরা এ কথাই বলেন। নির্বাচনের বৈতরণি পার হতে পাঁচ কোটি ইউরো দিয়ে সাহায্য করেছিলেন বলে গাদ্দাফির এমন করুণ পরিণতি হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। প্যারিসে রাষ্ট্রীয় সফরে আমন্ত্রণ করে সারকোজি যাঁকে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন, সেই বন্ধুর বুকে কার গুলি বিঁধে ছিল, তা প্রমাণিত না হলেও অভিযোগের তিরটি তৎকালীন ফরাসি প্রেসিডেন্ট এই নিকোলা সারকোজির দিকেই তাক করা আছে।

ফ্রান্সের পঞ্চম সাংবিধানিক প্রজাতন্ত্রে এই প্রথম একজন সাবেক প্রেসিডেন্ট কয়েদির পোশাকে জীবনের পাঁচ-পাঁচটি বছর কারাগারে কাটাবেন। এর আগে এমন কেলেঙ্কারির কালিমা সাবেক কোনো ফরাসি রাষ্ট্রপ্রধানকে গায়ে মাখতে হয়নি। আজ গাদ্দাফি বেঁচে নেই। সারকোজি বেঁচে আছেন। ধরাধামের অমোঘ নিয়মে একদিন সারকোজিকেও পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হবে। তবে চিরকালের জন্য ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে দার্শনিক মন্তেস্কুর দেশে গণতন্ত্রকে ম্লান করেছিল একজন নিকোলা সারকোজি, যিনি ছিলেন রাষ্ট্রপ্রধান, হলেন কয়েদি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ধর্ষণের আলামত নষ্ট, ধুনট থানার সাবেক ওসির বিরুদ্ধে পরোয়ানা

হিমাগারে ডেকে নির্যাতন: রাজশাহীতে আ.লীগ নেতার তিন ছেলে-মেয়ের জামিন, পুলিশের ‘দুর্বল’ ভূমিকা

ফার্মগেটে হলিক্রস কলেজ ও চার্চের সামনে ককটেল বিস্ফোরণ

যাদের একাধিক দেশের পাসপোর্ট আছে, তারাই অন্যদের সেফ এক্সিটের তালিকা করে: আসিফ

পাকিস্তানের ‘জাফর এক্সপ্রেস’ পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক ট্রেন!

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত