Ajker Patrika

মামদানির বিজয়

পরিচয়বাদের রাজনীতিতে নতুন দিশা

জাহাঙ্গীর আলম
জোহরান মামদানি। ছবি: সংগৃহীত
জোহরান মামদানি। ছবি: সংগৃহীত

পৃথিবীতে কট্টর-ডানপন্থার উত্থানের অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছে পরিচয়বাদের রাজনীতি। এদিকে নরেন্দ্র মোদির ভারতে ‘হিন্দু খাতরে ম্যাঁ হেঁ’, ওদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প, আর্জেন্টিনার হাভিয়ের মিলেই থেকে নেদারল্যান্ডসের গিয়ার্ত ওয়াইল্ডার্স, ইতালির জর্জিয়া মেলোনি, জার্মানির এলিস ওয়েডেলের কণ্ঠেও একই জিগির—অভিবাসী আগ্রাসনে খ্রিষ্টধর্ম ও সংস্কৃতি আজ অস্তিত্ব-সংকটে! ব্যর্থতার পুরো দায় উদার গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার। কল্পিত ‘নিষ্কলুষ ইউরোপীয় মূল্যবোধ’ আর ‘মহান আমেরিকা’ ফিরিয়ে আনাই তাদের রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা। ফলে অবধারিতভাবে তাদের অভিবাসীবিরোধী এবং বহুসংস্কৃতির ধারণার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ এক আন্তর্জাতিক (মূলত পশ্চিম) রাজনীতির ডাক দিতে হচ্ছে। তাদের রাজনীতির ভাষায় ‘আমরা এবং ওরা’ প্রধান হয়ে উঠছে।

২০০৮ সালে ইউরোপজুড়ে মহামন্দার জের এবং কোভিড মহামারির পর অব্যাহত অস্থির অর্থনীতির কালে কোণঠাসা মধ্যবিত্ত আর কণ্ঠস্বরহীন খেটে খাওয়া মানুষের সামনে তাৎক্ষণিক সমাধান সূত্র হাজির করে বাজিমাত করছে এই নব্য রক্ষণশীলেরা। তাদের সুস্পষ্ট কোনো অর্থনৈতিক অ্যাজেন্ডা নেই, কিন্তু এই দুর্দশার জন্য দায়ী কথিত শত্রু চিহ্নিত করে ক্রোধ উসকে দেওয়ার কাজটা বেশ দক্ষতার সঙ্গেই করতে পারছে।

তবে একই সঙ্গে নৃতাত্ত্বিক, ধর্মীয়, যৌন অভিমুখিতা (সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন), গায়ের রং, ভাষা, আঞ্চলিক, শ্রেণি এমনকি প্রতিবন্ধিতা পর্যন্ত পরিচয়বাদী রাজনীতির স্বতন্ত্র ধারা হিসেবে বিদ্যমান। রাজনীতির ধরনগুলোর মধ্যে রয়েছে বিদ্যমান ব্যবস্থায় সমানাধিকার; সাধারণ শত্রু নির্ধারণ করে ঐক্যবদ্ধ করা; নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর আইনগত স্বীকৃতি; সম্পদ পুনর্বণ্টন বা হিস্যা দাবির মাধ্যমে অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন; প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে নিপীড়িত ও উপেক্ষিত আত্মপরিচয় যেমন কৃষ্ণাঙ্গ ও নারী, সমকামী ও গরিব ইত্যাদি।

সবচেয়ে মুশকিল হলো, এই পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতি রক্ষণশীল ও উদার উভয় রাজনৈতিক ঘরানাতেই ব্যবহৃত হতে শুরু করেছে। বামপন্থী সামাজিক ন্যায্যতার আন্দোলন থেকে শুরু করে কট্টর-ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন—দুই শিবিরেই পরিচয়বাদের রাজনীতির বিস্তৃত প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে।

এই পরিচয়বাদের রাজনীতিকে পুঁজি করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হরেদরে ‘অপর’ করা এবং শত্রু সাব্যস্ত করে নিকাশযোগ্য করে তোলার ন্যায্যতা উৎপাদন চলছে হামেশাই। ভোটের মাঠে উদার গণতান্ত্রিক ও কট্টর ডানপন্থীদের মুখোমুখি অবস্থান সামাজিক সংহতিকে নষ্ট করছে। দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের ক্রোধ উসকে দিয়ে ফায়দা নিতে পারছে কট্টরপন্থীরা।

এই জটিল পরিস্থিতিতে নিউইয়র্কের মতো অভিবাসী অধ্যুষিত বহুসংস্কৃতির শহরের মেয়র নির্বাচন একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিতে পারে। হতে পারে পরিচয়বাদের রাজনীতির ঝুঁকি মোকাবিলার একটি নতুন দিশা।

মাইকেল ব্লুমবার্গ (১৩.৩ মিলিয়ন ডলার), লডার ফ্যামিলি (২.৬ মিলিয়ন), জো গেবিয়া (২ মিলিয়ন), বিল অ্যাকম্যান (১.৭৫ মিলিয়ন), ব্যারি ডিলার (৫ লাখ), লরি টিশ (১ লাখ ৫০ হাজার), স্টিভ উইন (৫ লাখ), অ্যালিস ওয়ালটন (২ লাখ)-এর মতো ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী জোহরান মামদানিকে ঠেকাতে বিপুল টাকা ঢেলেছেন। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রভাবশালী ইসরায়েল লবি এআইপিএসির টাকাও মামদানির বিরুদ্ধে প্রচারণায় ব্যবহৃত হয়েছে। খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, বিশ্বের শীর্ষ ধনী ইলন মাস্ক সরাসরি মামদানির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন, এমনকি ডেমোক্রেটিক পার্টির মধ্যেও, বিশেষ করে ইসরায়েল ইস্যুতে মামদানির অবস্থান এবং তাঁর মুসলিম পরিচয়ের কারণে দ্বিধায় ছিলেন অনেকে।

এরপরও প্রায় দুই লাখ ভোটের ব্যবধানে নিউইয়র্কের সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমোকে হারিয়ে ইতিহাস গড়েছেন জোহরান মামদানি। ৩৪ বছর বয়সী এ তরুণ নিউইয়র্কের প্রথম মুসলিম মেয়র এবং এক শতকের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সী মেয়র।

এই অভূতপূর্ব রাজনৈতিক সাফল্যের পেছনে কী? শুধুই কি অর্থনৈতিক মুক্তির প্রতিশ্রুতি? এমন মুক্তির প্রতিশ্রুতি তো ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ইউরোপে কট্টর ডানপন্থীরাও দিচ্ছে! যদিও সুনির্দিষ্ট সমাধান সূত্র থেকে নজর ঘোরানোর কৌশল হিসেবে তারা পরিচয়বাদের রাজনীতির আশ্রয় নিয়েছে। মামদানির প্রচার-কৌশলের মূলে ছিল মূলত সুনির্দিষ্ট অ্যাজেন্ডা এবং সেই সঙ্গে পরিচয়বাদের রাজনীতিকে বিচক্ষণতার সঙ্গে ভোটের রাজনীতিতে ব্যবহার।

ট্রাম্পের মতো পুঁজিপতিদের কর্মসংস্থানের প্রলোভন খুব একটা কাজে দিচ্ছে না—এটা পরিষ্কার। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় জনগণের কর্মসংস্থান করে দেওয়ার চালাকি আর চলবে না। জনগণকে তার হিস্যা ফিরিয়ে দেওয়ার রাজনীতিই যে শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয়—সেটিই দেখিয়ে দিয়েছেন জোহরান মামদানি।

পরিচয়বাদের রাজনীতিকে উদারপন্থী ও রক্ষণশীল উভয় শিবিরই পুঁজি করার চেষ্টা সব সময় করেছে। কিন্তু এই পরিচয়বাদের রাজনীতি বিভেদের অনিবার্য পরিণতি এড়িয়ে যে ঐক্য ও মুক্তির সিঁড়িও হতে পারে, সেই দৃষ্টান্ত সম্ভবত আমেরিকার রাজনীতিতে তো বটেই, বহির্বিশ্বেও রাজনীতির নতুন পাঠ হতে পারে। এই ধারণা জোহরান সম্ভবত তাঁর পরিবার থেকেই পেয়েছেন। বাবা মাহমুদ মামদানির উত্তর-ঔপনিবেশিক পাঠ এবং মা নির্মাতা মীরা নায়ারের চলচ্চিত্রে উঠে আসা আত্মপরিচয়ের সংকট থেকে উত্তরণের পাঠ জোহরান ভালোই রপ্ত করেছেন। সেটির ছায়া নির্বাচনী প্রচারে বিভিন্ন বক্তৃতা, বিবৃতি ও সাক্ষাৎকারে দেখা গেছে। জোহরান কখনো তাঁর মুসলিম ও সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট পরিচয় গোপন বা অস্বীকার করতে রাজি হননি। তাঁকে বারবার অ্যান্টিসেমিটিক (ইহুদিবিদ্বেষী) বলে প্রচার করা হয়েছে। কিন্তু নিজের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক পরিচয় এবং ইসরায়েল প্রশ্নে অবস্থান থেকে একচুলও নড়েননি। প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর আত্মপরিচয় অক্ষুণ্ন রেখেই সামাজিক ন্যায্যতার প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ হওয়া যে জরুরি, সেটি তিনি ভোটারদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন।

পরিচয়বাদের রাজনীতি নিয়ে মামদানির অবস্থান এবং প্রচার-কৌশল নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচনে যে সবাইকে ছাপিয়ে প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল, নিজ নির্বাচনী এলাকা কুইন্সে সবচেয়ে কম ভোট পাওয়ার একটি ব্যাখ্যা সেখান থেকে পাওয়া যেতে পারে। কুইন্সে তিনি পেয়েছেন ৪৭ শতাংশ ভোট। অথচ অন্য প্রায় সব এলাকায় পেয়েছেন ৫০ শতাংশের বেশি। এর পেছনে বড় কারণ দেখা যাচ্ছে, দক্ষিণ এশীয় অভিবাসী অধ্যুষিত খ্রিষ্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ কুইন্সে নির্বাচনী কৌশলেই ভুল ছিল। সেখানে মামদানিকে বারবার মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। অথচ নিউইয়র্কের খেটে-খাওয়া মানুষের মেয়র হতে চেয়েছেন তিনি।

এখানে আরেকটি বিষয় বলা ভালো, ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতিশ্রুতির ফাঁকা বুলি, বিভেদের রাজনীতি ও অবাস্তব উন্নয়ন অঙ্গীকার ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে ওঠা; তরুণদের রাজনীতিসচেতনতা; ফিলিস্তিনের পক্ষে গণজোয়ার; নিউইয়র্কের ইহুদি জনগোষ্ঠীর বড় অংশের জায়োনিজমবিরোধী অবস্থান—এসবও জোহরান মামদানির বিজয়ে কমবেশি ভূমিকা রেখেছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...