Ajker Patrika

সত্যিই কি দেশ এখন বাঘের মুখে

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস গত বৃহস্পতিবার কুমিল্লায় দলীয় এক কর্মসূচিতে বলেছেন, ‘দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব আজ হুমকির মুখে। একটি কথা স্পষ্ট করে বলতে চাই, আমরা আগে ছিলাম কুকুরের মুখে, এখন বাঘের মুখে পড়েছি। আমরা নির্বাচনের কথা বলছি, কারণ আমরা দেখতে পাচ্ছি, আমাদের দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিরাপদ নয়।

আজাদুর রহমান চন্দন
১৪ মে যমুনা অভিমুখে শিক্ষার্থীরা মিছিল শুরু করলে পুলিশ তাতে বাধা দেয়। ছবি: আজকের পত্রিকা
১৪ মে যমুনা অভিমুখে শিক্ষার্থীরা মিছিল শুরু করলে পুলিশ তাতে বাধা দেয়। ছবি: আজকের পত্রিকা

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের জন্য করিডর দেওয়া নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার রেশ কাটতে না কাটতেই সামনে এল চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বিদেশিদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার তাগিদ। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এই টার্মিনাল ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বিদেশিদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার কাজ ত্বরান্বিত করতে রীতিমতো জোরালো তাগিদ দিয়েছেন। ১৪ মে চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল পরিদর্শনের পর বন্দর ও নৌপরিবহন খাতের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং বন্দর ব্যবহারকারী সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি বলেছেন, বন্দর ব্যবস্থাপনায় ‘পৃথিবীর সেরা’ যারা, তাদের হাতে ছেড়ে দিতে হবে, যেভাবেই হোক। মানুষ রাজি না থাকলে রাজি করাতে হবে। সরকারপ্রধান ‘পৃথিবীর সেরা’ হিসেবে যে প্রতিষ্ঠানের প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন, সেটি হলো সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি ডিপি ওয়ার্ল্ড। প্রতিষ্ঠানটি ২০০৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ছয়টি বন্দরের টার্মিনাল পরিচালনা একটি ব্রিটিশ কোম্পানির কাছ থেকে অধিগ্রহণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়ার আশঙ্কায় এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল মার্কিন কংগ্রেস। ফলে ডিপি ওয়ার্ল্ড ওই বন্দরগুলোর পরিচালনার ভার পোর্ট আমেরিকা নামে সদ্য প্রতিষ্ঠিত একটি মার্কিন কোম্পানির কাছে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। ওই পোর্ট আমেরিকাই বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় টার্মিনাল অপারেটর।

চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের অর্থনীতির লাইফলাইন বা প্রাণকেন্দ্র তো বটেই, জাতীয় সার্বভৌমত্বেরও প্রতীক। দেশের মোট আমদানি-রপ্তানির প্রায় ৯০ শতাংশই এই বন্দর দিয়ে পরিচালিত হয়। বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালে প্রতিবছর জাহাজ থেকে ১০ লাখ একক কনটেইনার ওঠানো-নামানোর স্বাভাবিক ক্ষমতা আছে। জানা মতে, দেশি অপারেটর গত বছর এই টার্মিনালে জাহাজ থেকে ১২ লাখ ৮১ হাজার কনটেইনার ওঠানো-নামানোর কাজ করেছে। এমন পারফরম্যান্স সত্ত্বেও কাকে খুশি করতে বা কোন উদ্দেশ্য হাসিল করতে টার্মিনাল পরিচালনার ভার বিদেশিদের হাতে তুলে দিতে এমন তাড়াহুড়া চলছে? বন্দরসংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকেরা বলছেন, টার্মিনালটি বিদেশি অপারেটরকে দিয়ে পরিচালনা করালে চট্টগ্রাম বন্দরের রাজস্ব আয় অর্ধেকেরও নিচে নেমে আসবে। ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমে নিয়োজিত স্থানীয় শ্রমশক্তি কর্মসংস্থান হারাবে। বিদেশি অপারেটররা লাভের অংশ বিদেশি মুদ্রায় বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাবে। অথচ নতুনভাবে সেখানে বিদেশি বিনিয়োগ করার কোনো সুযোগ নেই। ফলে টার্মিনালটি পরিচালনার দায়িত্ব বিদেশিদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ আত্মঘাতী। এর পেছনে আন্তর্জাতিক চক্রান্তের বাইরে কিছুই দেখছে না দেশের অনেক রাজনৈতিক দলও।

বিএনপির ঘনিষ্ঠ মিত্র ১২ দলীয় জোটের নেতারা ১৫ মে এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছেন, যেকোনো মূল্যে চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল দেশি প্রতিষ্ঠানের হাতেই থাকতে হবে। চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশি কোম্পানিকে লিজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হবে আত্মঘাতী। নেতারা আরও বলেন, নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত প্রধান সমুদ্রবন্দর বিদেশি কোম্পানির তত্ত্বাবধানে দেওয়ার তৎপরতা জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী। এত বড় জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্ত এককভাবে নেওয়ার কোনো এখতিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের নেই। একই দিনে বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতারা অভিযোগ করে বলেছেন, মানবিক করিডরের নামে বাংলাদেশ, মিয়ানমারসহ দক্ষিণ এশিয়ায় অস্থিরতা তৈরি করে যুদ্ধ বাধানোর চক্রান্ত করছে যুক্তরাষ্ট্র। আর তা বাস্তবায়নে অন্তর্বর্তী সরকার সহযোগীর ভূমিকা পালন করছে। কথিত মানবিক করিডরের নামে বাংলাদেশকে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে জড়ানোর চক্রান্ত ও নিউমুরিং টার্মিনাল বিদেশিদের দেওয়ার প্রতিবাদে এবং কাতারকে সামরিক সরঞ্জাম তৈরির কারখানা প্রতিষ্ঠার অনুমতি না দেওয়ার দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বাম গণতান্ত্রিক জোট আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশে জোটের নেতারা আরও বলেন, বাংলাদেশের জনগণ দেশের জাতীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তায় জড়িত এমন কোনো বিষয়ে ছাড় দেবে না। বর্তমান সরকারের এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার নেই বলেও দাবি করেন নেতারা।

দুর্নীতিগ্রস্ত ও দমন-পীড়নকারী সরকারের পতন ঘটানোর পর জরুরি করণীয় ছিল দুর্নীতিমুক্ত, দক্ষ ও জনমুখী জনপ্রশাসন প্রতিষ্ঠা; অর্থনীতিসহ সব ক্ষেত্রে বৈষম্য নিরসনের উদ্যোগসহ নির্বাচনব্যবস্থার আমূল সংস্কারের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার কাজে মনোযোগ দেওয়া। সেখানে নানা ক্ষেত্রে বৈষম্যের নতুন নতুন রূপ দেখা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার দাবিতে সম্প্রতি জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) ডাকে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনের সড়ক আটকে অবস্থান নেয় কয়েকটি রাজনৈতিক দল। পরে তারা শাহবাগেও সমাবেশ করে। তাদের সেসব কর্মসূচিতে কোনো রকম বাধা দেওয়া তো দূরের কথা, বরং সমাবেশে ঢাকা ওয়াসাকে খাওয়ার পানি বিতরণ করতে এবং পরিবেশ শীতল করতে সিটি করপোরেশনের গাড়ি দিয়ে পানি ছিটাতে দেখা যায়। অথচ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তিন দফা দাবি নিয়ে ১৪ মে যমুনা অভিমুখে মিছিল শুরু করলে পুলিশ তাতে বাধা দেয়। আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে একপর্যায়ে নিক্ষেপ করা হয় কাঁদানে গ্যাসের শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড। ব্যবহার করা হয় জলকামান। এর পর থেকেই আন্দোলনের পক্ষভেদে সরকারের আলাদা অবস্থান নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। প্রশ্ন উঠছে, কোনো আন্দোলনে কেন সরকারের ‘সদয় আচরণ’ আর কোনো আন্দোলনে কেন এমন বলপ্রয়োগ?

রাখাইনের জন্য মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হচ্ছে, এই করিডরের মাধ্যমে রাখাইনে দুর্যোগকবলিত মানুষের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা সহজতর হবে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, মানবিকতার মোড়কে বাস্তবে এটি স্ট্র্যাটেজিক উপস্থিতি নিশ্চিত করার পথ মাত্র। আগেই বলেছি, বিশ্বের যেসব জায়গায় এ ধরনের মানবিক করিডর হয়েছে, তার কোনো কোনোটি বিবদমান পক্ষগুলোর স্বতঃস্ফূর্ত আলোচনার মাধ্যমে, আবার কোনোটি জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় হয়েছে। সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কোনো একটি পক্ষ যদি এই উদ্যোগে সায় না দেয়, তাহলে জটিলতা দেখা দিতে বাধ্য। আলোচিত করিডর নিয়ে মিয়ানমার সরকার নাখোশ বলে এরই মধ্যে খবর মিলছে নানা মাধ্যমে। মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুনে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রতিরক্ষা শাখার প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আফতাব হোসেনকে জরুরি ভিত্তিতে দায়িত্ব হস্তান্তরপূর্বক ‘প্রতিস্থাপক ব্যতিরেকে’ দেশে প্রত্যাবর্তনের আদেশ দিয়েছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। কোনো কোনো সংবাদমাধ্যমের দাবি, মিয়ানমার সরকারের অসন্তোষের কারণেই আফতাব হোসেনকে সরিয়ে আনা হচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে আরও কত-কী যে দেখতে হবে!

কোনো দেশ যখন নিজের প্রধান বন্দর বিদেশি সামরিক বাহিনী বা তার সহযোগী প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেয়, তখন সে তার বাণিজ্যের পাশাপাশি নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বও অনেকাংশে তুলে দেয়। বন্দর পরিচালনার ভার কাকে দেওয়া হবে বা না হবে, তা শুধু কারিগরি ও ব্যবস্থাপনাগত দক্ষতার ওপর নির্ভর করে না। একটি দেশের বন্দর হলো স্ট্র্যাটেজিক সম্পদ, যার সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তা সম্পর্কিত। ইচ্ছা হলেই কোনো বিদেশি কোম্পানির হাতে তার পরিচালনার ভার তুলে দেওয়া ঠিক নয়। তথাকথিত মুক্তবাজার অর্থনীতির দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও বন্দরের ব্যবস্থাপনা ও কর্তৃত্বকে আর দশটা বিনিয়োগের মতো দেখে না, দেখেনি। জাতীয় নিরাপত্তা ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ বিবেচনায় যে প্রতিষ্ঠানকে যুক্তরাষ্ট্র ২০০৬ সালে টার্মিনাল পরিচালনা করতে দেয়নি, সেই ডিপি ওয়ার্ল্ডের হাতেই অন্তর্বর্তী সরকার কোন বিবেচনায় চট্টগ্রাম বন্দরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও লাভজনক টার্মিনাল পরিচালনার ভার তুলে দিতে চাইছে? ডিপি ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে মার্কিন নৌবাহিনীর ঘনিষ্ঠতার কথা বিশ্বব্যাপী সুবিদিত।

চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব বিদেশিদের হাতে ছেড়ে দেওয়া কিংবা রাখাইনের জন্য করিডর চালুর সরাসরি বিরোধিতা না করলেও বিএনপি কৌশলে বিপক্ষেই কথা বলছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস গত বৃহস্পতিবার কুমিল্লায় দলীয় এক কর্মসূচিতে বলেছেন, ‘দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব আজ হুমকির মুখে। একটি কথা স্পষ্ট করে বলতে চাই, আমরা আগে ছিলাম কুকুরের মুখে, এখন বাঘের মুখে পড়েছি। আমরা নির্বাচনের কথা বলছি, কারণ আমরা দেখতে পাচ্ছি, আমাদের দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিরাপদ নয়। অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন দেওয়ার সরকার, দেশের নীতিনির্ধারণী বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার সরকার নয়। মিয়ানমারের রাখাইনে করিডর দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেবে নির্বাচিত সরকার, এই সিদ্ধান্ত দেওয়ার মালিক আপনারা নন।’

বাঘের মুখে পড়ার এই মন্তব্য কি কেবলই রাজনৈতিক, নাকি প্রকৃত বাস্তবতা? কিছুদিনের মধ্যেই বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে বলে আশা করা যায়।

লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে তিন বাহিনীর প্রধান

১৭ বছর খাইনি, এবার খাব—টেন্ডার জমা দেওয়া ঠিকাদারকে বললেন বিএনপি নেতা

দেশে এল স্টারলিংক: কতগুলো ডিভাইস যুক্ত করা যাবে, কীভাবে করবেন

যৌথ পরিবারে কোরবানি কার ওপর ওয়াজিব

মধ্যরাতে হাক্কানীর মালিকের বাসায় মবের হানা, আটক তিন সমন্বয়ককে ছাড়িয়ে নিলেন হান্নান মাসউদ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত