Ajker Patrika

সাহসী সাংবাদিকতা পেশার নোবেল জয়

চিররঞ্জন সরকার, কলাম লেখক
সাহসী সাংবাদিকতা পেশার নোবেল জয়

আগে যাঁরা সাংবাদিকতা পেশায় আসতেন, তাঁদের মধ্যে ছিল সততা, নিষ্ঠা। তাঁদের বলিষ্ঠ কলম থেকে আগুন ঝরত। পাঠককুল ঋদ্ধ হতো। শাসককুল ভয় পেত। বর্তমানে যাঁরা আসছেন, তাঁদের প্যাশন অবশ্যই আছে।

বিশ্বের বহু দেশেই সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নেই। সরকার, বিরোধী দল, ক্ষমতাবান গোষ্ঠী—যাকে নিয়েই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়, তারাই সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সরব হয়। নিজেদের অপকর্মের কথা প্রকাশ পেলেই সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে তেড়ে আসে। শুধু হামলা-মামলাই নয়, শিকারি ব্যক্তি যেভাবে পাখি হত্যা করে, ঠিক সেভাবে গুলি করে অপছন্দের সাংবাদিকদের হত্যা করা হয়। গোটা পৃথিবীতেই বর্তমানে সাংবাদিকেরা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছেন। স্বাধীন গণমাধ্যম, মুক্ত সাংবাদিকতার বিষয়গুলো প্রচণ্ড হুমকির মধ্যে রয়েছে।

সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার এমন দুঃসময়ে সুইডেনের নোবেল কমিটি এবার শান্তি পুরস্কারের জন্য নির্বাচন করেছে দুজন সাংবাদিককে। তাঁরা হলেন ফিলিপাইনের নারী সাংবাদিক মারিয়া রেসা ও রাশিয়ার সাংবাদিক দিমিত্রি মুরাতভ। সাংবাদিকতার পেশাকে শান্তির সঙ্গে জুড়ে দিয়ে নোবেল কমিটি বিশ্বব্যাপী নতুন এক বার্তা দিতে চেয়েছে। একই সঙ্গে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার দাবিতে বুক চিতিয়ে লড়াই করার গুরুত্বকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছে।

নোবেল কমিটি বলেছে, ‘এই দুজনের অবাধ, নিরপেক্ষ ও তথ্যনিষ্ঠ সাংবাদিকতা সব সময়ই ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, মিথ্যা ও যুদ্ধবাজদের মুখোশ খুলে দিতে তৎপর থেকেছে। কোনো কুণ্ঠাবোধ না করে অসম সাহসে তাঁরা কাজ করে গেছেন। কাজ করে চলেছেন। মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা ও সংবাদমাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া বিশ্বভ্রাতৃত্ব অসম্ভব। নিরস্ত্রীকরণ ও উন্নততর পৃথিবী গড়ে তোলাও সম্ভব নয়। তাই এই দুজনকে সম্মান জানানোর মাধ্যমে নোবেল কমিটি আলফ্রেড নোবেলের শেষ ইচ্ছাপত্রকেই সম্মান জানাল।’

দেশের বিভিন্ন সরকারের স্বেচ্ছাচারিতা, স্বৈরতন্ত্র, ক্ষমতার অপব্যবহার, মিথ্যা, দুর্নীতির মুখোশ খুলে দেওয়া ও মানুষকে বশে রাখতে হিংসা, সন্ত্রাসের ব্যবহারের বিরুদ্ধে নির্ভয়ে অকুণ্ঠচিত্তে প্রতিবাদে গর্জে ওঠার জন্য ফিলিপাইনে এক দশক ধরেই কিংবদন্তি হয়ে উঠেছেন সাংবাদিক মারিয়া রেসা। ২০১২ সালে তিনি আরেক জনকে সঙ্গে নিয়ে গোড়াপত্তন করেন ‘র‍্যাপলার’ নামে একটি অনলাইন সংবাদ সংস্থার। র‍্যাপলারের প্রধান হিসেবে রেসা এখনো সেই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন বিভিন্ন অত্যাচারী সরকারের দাঁত-নখকে উপেক্ষা করে। খুনি, ড্রাগ মাফিয়াদের অস্ত্রের মুখে বিন্দুমাত্র ভয় না পেয়ে। রেসার সেই লড়াই তাঁর নিজের দেশেরই মানুষের একাংশের বিরুদ্ধে হয়ে উঠলেও সঠিক জায়গায় কুঠারাঘাত করতে পেরেছেন বলে তাঁকে জনপ্রিয়ও করে তুলেছে উত্তরোত্তর। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কীভাবে ভুয়া খবর ছড়াতে সাহায্য করছে, বিরোধীদের হেয় করার হাতিয়ার হয়ে উঠছে, সেই মুখোশ উন্মোচনেও দ্বিধা করেননি অনলাইন সংবাদমাধ্যমকর্মী রেসা।

অন্যদিকে একই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন রাশিয়ার বিশিষ্ট সাংবাদিক দিমিত্রি মুরাতভ। ২৮ বছর আগে ১৯৯৩ সালে কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে গোড়াপত্তন করেন রাশিয়ায় পুরোদস্তুর নিরপেক্ষ বলে পরিচিত একটি সংবাদপত্রের। যার নাম ‘নোভায়া গাজেতা’। ১৯৯৫ সাল থেকে তিনি ওই সংবাদপত্রের প্রধান সম্পাদক। শুরু থেকেই মুরাতভ ও তাঁর পত্রিকা সরকারের ক্ষমতার অপব্যবহার, মিথ্যাচার, স্বৈরতন্ত্র, দুর্নীতি, পুলিশি বর্বরতা, অবৈধ গ্রেপ্তারি, ভোটে জালিয়াতি ও দেশের ভেতর ও বাইরে রুশ সামরিক বাহিনীর যাবতীয় দুর্নীতি ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সরব থেকেছে। প্রতিবাদে গর্জে উঠতে দ্বিধা করেনি বিন্দুমাত্র।

দুই সাংবাদিককে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য বেছে নেওয়া অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। যদিও নোবেল কমিটির বিরুদ্ধে অনেক সমালোচনা হচ্ছে। শান্তির নোবেলের জন্য যদি সাংবাদিককেই বেছে নেওয়া হয়, তাহলে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ বাদ পড়লেন কেন? তাঁর চেয়ে যোগ্য ও সাহসী সাংবাদিক বিশ্বে আর কে আছেন?

 শান্তিতে নোবেল পুরস্কার নিয়ে বিতর্ক হয়তো থাকবেই। বিশ্ব মোড়লদের রাজনৈতিক স্বার্থ ও ইচ্ছের ঊর্ধ্বে ওঠা নোবেল কমিটির পক্ষে কতটুকু সম্ভব, সে সন্দেহ রেখেও বলা যায়, যে দুই সাংবাদিককে এ বছর শান্তির জন্য নোবেল কমিটি নির্বাচন করেছে, তাঁরা নিঃসন্দেহে যোগ্য। সাংবাদিকতা পেশার এমন স্বীকৃতি বড় বেশি প্রয়োজন ছিল।

গণমাধ্যম বা সংবাদমাধ্যমকে বলা হয় গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ। এর প্রধান চালিকাশক্তি সাংবাদিকেরা। তাঁদের অনেক সময়ই শাসক দলের অপ্রিয় সংবাদ ও বিরুদ্ধ সমালোচনা জনসমক্ষে তুলে ধরতে হয়।

সেটাই তাঁদের পেশা। সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের বহু প্রতিকূলতার মধ্যেও খবর সংগ্রহ করতে হয় এবং বিভিন্ন অপরাধ ও দুর্নীতির চুলচেরা বিশ্লেষণের মাধ্যমে আসল সত্যটি বের করে আনতে হয়।

সরকারপক্ষও সংযত থাকতে বাধ্য হয় সাংবাদিকদের সমালোচনার ভয়ে। আর অগণিত সাধারণ মানুষ সাম্প্রতিকতম তথ্য পেয়ে থাকে তাঁদের খবরের ভিত্তিতে। কিন্তু কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, সাংবাদিকদের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মী ও সমর্থকদের দ্বারা নিগৃহীত ও আক্রান্ত হতে হচ্ছে। আমাদের দেশেও সাংবাদিকেরা অত্যন্ত বিরুদ্ধ ও নেতিবাচক পরিবেশে কাজ করেন। একাধিক মূল্যায়নে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে আমাদের অবস্থান শেষের সারিতে। এক পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ১৯৯৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ২২ বছরে বাংলাদেশে ৩৫ জন সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ১৫৪ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হামলা-মামলা ও হয়রানির শিকার হয়েছেন আর 
গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন একজন সাংবাদিক।

সংবাদমাধ্যমের নির্ভীক ও তথ্যপূর্ণ খবরই দেশের নাগরিকদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির সহায়ক। সাংবাদিকতা একসময়ে ছিল কলম-ক্যামেরার ব্যবহারে পেশাদারি।

বর্তমানে স্মার্টফোন, কম্পিউটার-ক্যামেরার ব্যবহারে পেশাদারি। ব্যবসায়িক স্বার্থ, না জনগণের স্বার্থ–এই দ্বন্দ্ব এ পেশার জন্মলগ্ন থেকে আজও বিদ্যমান। আগে যাঁরা সাংবাদিকতা পেশায় আসতেন, তাঁদের মধ্যে ছিল সততা, নিষ্ঠা। তাঁদের বলিষ্ঠ কলম থেকে আগুন ঝরত। পাঠককুল ঋদ্ধ হতেন। শাসককুল ভয় পেতেন। বর্তমানে যাঁরা আসছেন, তাঁদের প্যাশন অবশ্যই আছে। কিন্তু সংবাদপত্র মালিকের চাহিদামতো লেখা লিখতে হয়। অনেক সময় এ জন্য নিজের মনের সঙ্গে, বিবেকের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়।

অবশ্য ব্যতিক্রম এখানেও আছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াই করে অনেকে টিকে আছেন। রাজনীতির লাল চোখকে তাঁরা ভয় পান না। এমন সাংবাদিকের সংখ্যা কমে গেলেও একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। আর সাংবাদিকদের দিন শেষ হয়ে যায়নি। তাঁদের কলম থেকে আর ফুল ফুটবে না, আগুন ঝরবে না—এ হতে পারে না। তাহলে সারা পৃথিবীতে গণতন্ত্র থাকবে না। সংবাদপত্রের বিভিন্ন শাখায় এখনো কিছু নির্ভীক বিশেষজ্ঞ রয়েছেন, যাঁরা এর ঐতিহ্যের ধারা বহন করে চলেছেন। মৃত্যু উপত্যকা সিরিয়ায় চিত্রসাংবাদিক আল কাদের হাবাকের শিশুদের জীবন বাঁচানোর ঘটনা আজও অনুপ্রাণিত করে। মারিয়া রেসা ও দিমিত্রি মুরাতভও নিশ্চয়ই সাংবাদিকদের অকুতোভয় পেশাদারি বজায় রাখার ক্ষেত্রে প্রেরণা জোগাবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

‘আমরা মরে গেলাম ঋণের দায়ে আর খাওয়ার অভাবে’, চিরকুটে লেখা

বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত আমদানির ঘোষণা দিতেই ভারতে হু হু করে বাড়ছে চালের দাম

এপিএসের বেতন ১ বছরে বেড়েছে ১৮ বছরের সমান

ফেসবুকে ছাত্রলীগ নেতার ‘হুমকি’, রাবিতে ১৫ আগস্টের কনসার্টে যাচ্ছে না আর্টসেল

পাবনায় প্রবাসীর স্ত্রীকে নিয়ে এএসআই উধাও, থানায় শ্বশুরের জিডি

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত