আলতাফ পারভেজ

বৈশ্বিক মহামারী করোনার সময় গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ করোনা সেবা উদ্যোগ নিয়ে সেই সময় লেখার পর কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছিলেন, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী কেন অনেকের কাছে অপছন্দের। তিনি ওষুধ ও স্বাস্থ্য বিষয়ে অতীতে কী করতে চেয়েছিলেন? গতকাল রাতে তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। তাঁর মৃত্যুর পর আজ পুরোনো বিতর্কটাকে সামনে এনে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে চাই। বিষয়টি পৃথকভাবে আলোচনার দাবি রাখে। সে জন্যই আলাদা করে এই আলাপের উদ্যোগ। এখানে যেসব তথ্য-উপাত্ত ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলো জাফরুল্লাহ চৌধুরীর পুরোনো লেখা থেকে নেওয়া।
করোনার বিরুদ্ধে সেই সময় দীর্ঘযুদ্ধে বেঁচে-মরে শেষপর্যন্ত যে কয়জন জয়ী হয়েছিলেন এদেশে, তাঁদের অবশ্যই ওষুধ ও স্বাস্থ্য প্রশ্নে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর জীবন-কর্ম নিয়ে অতীতের সংগ্রামের কথাটা আসা স্বাভাবিক বিষয়। অসমাপ্ত সেই সংগ্রামের শিক্ষা এ সময়ে কাজে লাগতে পারে। এটা কেবল একজন জাফরুল্লাহ চৌধুরীর একার ব্যাপার না।
গণস্বাস্থ্য ফার্মা এবং গণস্বাস্থ্য হাসপাতাল দুবার ভাঙচুরের শিকার হয়। প্রথমবার এটিতে আগুন দেওয়ার চেষ্টা হয় ১৯৮৪ সালের আগস্টে; দ্বিতীয়বার ১৯৯০ এর অক্টোবরে। গণস্বাস্থ্য ও ডা. জাফরুল্লাহ প্রথমবার আক্রান্ত হয় ওষুধনীতি নিয়ে, দ্বিতীয়বার স্বাস্থ্যনীতি নিয়ে। দুটো ঘটনায় প্রবল যোগসূত্র আছে। আমরা ওষুধনীতির অধ্যায় থেকে শুরু করতে পারি।
মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই দেশের স্বাস্থ্যখাত এবং ওষুধ নিয়ে নতুন ভাবনা শুরু হয়েছিল। বিশাল গ্রামবাংলায় কীভাবে স্বাস্থ্যসেবাকে সঠিকভাবে এগিয়ে নেওয়া যায় সেটা যুদ্ধোত্তর সমাজেরই একটা আকাঙ্খা ছিল। বিশেষ করে সেই সব চিকিৎসক এটা তীব্রভাবে ভাবতেন, যারা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ‘মুক্তি’ বিষয়টিকে এরা স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি খাতেও সম্প্রসারণ করতে তৎপর ছিল।
সে সময় আমাদের দেশটিতে স্বাস্থ্যখাতের অবস্থা করুণ ছিল। প্রতি একহাজার নবজাতকের ২৬০ জন ৫ বছরের মধ্যে মারা যেত। অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ পাওয়া দুরূহ ব্যাপার ছিল। দামও ছিল অযৌক্তিকভাবে বেশি। ওষুধের ব্যবসার প্রধান সুবিধাভোগী ছিল বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। সরকার সেই সময় টিসিবির মাধ্যমে পূর্ব ইউরোপের কিছু দেশ থেকে ওষুধ আমদানি শুরু করে। এতে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যসহ অনেকে অসন্তুষ্ট ছিল। তাতে সেটাও কমাতে হয়। ফলে ওষুধ খাতে বহুজাতিকদের একচেটিয়াত্ব বাড়তেই থাকে।
১৯৭৮ সালে দেশে একটা ওষুধ নীতির খসড়া তৈরির কাজ শুরু হয়। এ সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন ড. এম এম হক। খসড়া অবস্থাতেই ওই ওষুধ নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় ‘ওষুধ শিল্প সমিতি’। তাদের প্রতিবাদে ওটা খসড়াতেই থেমে যায়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী পদ হারান। এ কাজে তখনকার একজন মন্ত্রীরও ইন্ধন ছিল।
বাংলাদেশে অনেকেই বলেন ওষুধ নীতি জেনারেল এরশাদের অবদান তা কিন্তু ঠিক নয়। এটা ছিল মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী একটা ধারাবাহিক প্রচেষ্টারই জের।
১৯৮২ সালে এসে ২৮ এপ্রিল ওষুধনীতি তৈরি করতে ৮ সদস্যের একটা কমিটি হয়। এই কমিটিতে কোন আমলা ছিল না। সবাই ছিল চিকিৎসাবিদ্যার লোক। যার প্রধান ছিলেন তৎকালীন পিজির অধ্যাপক নূরুল ইসলাম। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এই কমিটির একজন সদস্য ছিলেন মাত্র। এই কমিটির অধিকাংশ সদস্য বিএমএ’র সদস্যও ছিলেন।
এই কমিটি অনেকগুলো বৈঠক শেষে ১৬টি মানদন্ডের ভিত্তিতে দেশের ওষুধ খাত নিয়ে তদন্তে নামে। দেশে সে সময় ওষুধ তৈরির জন্য ১৭৭টি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স ছিল। পাশাপাশি প্রচুর বিদেশি ওষুধ আমদানি হতো। কমিটি প্রায় ৪ হাজার ধরনের ওষুধের সন্ধান পায়। দেখা যায়, এতো বিভিন্ন নামের ওষুধ আসলে ১৫০টি উপাদানে তৈরি ওষুধেরই রকমারি কোম্পানি নাম মাত্র।
১৬টি মানদন্ডের ভিত্তিতে এসব ওষুধ পরীক্ষা শেষে নূরুল ইসলাম কমিটি ১ হাজার ৭৪২টি ক্ষতিকর বা অপ্রয়োজনীয় বা অকার্যকর ওষুধ শনাক্ত করে। এর মাঝে প্রায় ৯০০ ওষুধ তারা বাজার থেকে বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে তুলে নেয়ার সুপারিশ করে। পাশাপাশি ‘অত্যাবশ্যকীয় ওষুধে’র একটা তালিকা করা হয়। এই কমিটির বড় অবদান ছিল--
১. ওষুধের মান ও মূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য রাষ্ট্রীয় কাঠামো শক্তিশালী করার সুপারিশ;
২. বাংলাদেশে কারখানা না করে থার্ড পার্টির মাধ্যমে ওষুধ উৎপাদনে বিদেশি কোম্পানির উপর বিধিনিষেধ আরোপ;
৩. দেশে থাকলে বিদেশ থেকে ওষুধের কাঁচামাল আমদানি নিরুৎসাহিত করা এবং বিদেশ থেকে ওষুধের কাঁচামাল আমদানিকে প্রতিযোগিতামূলক করা;
৪. আয়ুর্বেদি ও ইউনানী ওষুধকে আইনের আওতায় আনা;
৫. ৪৫টি অত্যাবশ্যকীয় ওষুধকে পর্যায়ক্রমে জিনেরিক নামে বাজারজাত করা। আগে একই এমপিসিলিন ৪৮টি কোম্পানি ৪৮ নামে বাজারজাত করতো। আলাদা ব্র্যান্ড নাম হওয়ায় সাধারণ ক্রেতা অনেক ব্র্যান্ডে দামের ক্ষেত্রে প্রতারিত হতো।
১৯৮২ সালের ২৯ মে মন্ত্রিসভা এসব সুপারিশ অনুমোদন করে। ১২ জুন সেটা ‘ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ’ নামে প্রজ্ঞাপন আকারে জারি হয়।
তৃতীয় বিশ্বের স্বাস্থ্যখাতের জন্য এটা ছিল এক অভাবনীয় দৃষ্টান্ত। বহুজাতিকরা এতদিন নিজেদের চ্যালেঞ্জ অযোগ্য ভাবতো। সেখানে এই প্রথম একটা ঘা লাগে।
পাল্টা ঝড় উঠতেও দেরি হলো না। ১ জুন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত জেনারেল এরশাদের সঙ্গে দেখা করেন। ওষুধকে ঘিরে দেশ-বিদেশে রাজনীতির পুরো চেহারাটি আস্তে আস্তে সে সময় বাংলাদেশে উদোম হতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি জার্মানি, ডাচ ও ব্রিটেনের রাষ্ট্রদূতও সরকারের উপর সম্মিলিত চাপ দেন ওষুধ নীতি বদলাতে।
যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মিসেস কুনকে সে সময় বাংলাদেশের প্রভাবশালী দৈনিকের সম্পাদক এবং বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঘন ঘন বৈঠক করতে দেখা যায়। ঢাকার টিকাটুলি থেকে প্রকাশিত প্রভাবশালী একটা বাংলা এবং একটা ইংরেজি দৈনিক সে সময় ওষুধ নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়। জুনেই জেনারেল এরশাদকে যুক্তরাষ্ট্র সফরের আমন্ত্রণ জানানো হয়। তিনি যদিও এটা আইনে পরিণত করেই ওয়াশিংটন গেলেন--কিন্তু সেখানে গিয়ে কথা দিয়ে এলেন যে আইনটি রিভিউ করা হবে।
ওষুধনীতি বাস্তবায়ন হলে বিদেশি বিনিয়োগ চলে যাবে এবং বহু ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাবে এমন একটা প্রচারণা চলতে থাকে তুমুল বেগে সে সময়।
বিদেশি এই চাপ প্রয়োগের মূল কারণ ছিল বাংলাদেশের এই ওষুধ নীতি সফল হয়ে গেলে তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশে একই রকম নীতির জন্য রাজনৈতিক রূপান্তরবাদীরা চাপ প্রয়োগ শুরু করবে।
বাংলাদেশের ওষুধ বিষয় কীভাবে আন্তর্জাতিক মুরুব্বিদের মাথাব্যথার কারণ হয়েছে এ নিয়ে ওয়াশিংটন পোস্টে রিপোর্ট হয় ১৯৮২ সালের ১৯ আগস্ট। শিরোনাম ছিল: ‘ইউএস ইজ এইডিং ড্রাগ কোম্পানিজ ইন বাংলাদেশ’।
ক্রমাগত চাপ ও তদবিরে মাধ্যমে মূল ড্রাগ পলিসি এরপর অনেকখানি পাল্টে যায়। প্রথম ‘রিভিউ’ হয় ১৯৮২ সালের ৭ সেপ্টেম্বর। ১৯৮৩ সালের ডিসেম্বরে ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ আরো সংশোধিত হয়।
ওষুধ নীতি নিয়ে বিতর্ককালের সবচেয়ে বিস্ময়কর দিক ছিল কোম্পানিগুলোর পাল্টা প্রচারণা এবং তাতে দেশের চিকিৎসক সমাজের সংহতিতে ঢাকার মধ্যবিত্তরা সাধারণভাবে ওষুধ নীতির বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়েছিল।
এখানকার মধ্যবিত্তরা যেকোন বড় ধরনের রূপান্তর উদ্যোগে যে কীভাবে প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকা রাখতে পারে তার একটা মহড়া হয়ে যায় ওষুধ নীতির বিরুদ্ধে তাদের অবস্থানে। একই ঘটনা দেখা যায় কয়েক বছর পর স্বাস্থ্যনীতির বিরুদ্ধে তাদের অবস্থানেও।
বলাবাহুল্য, জেনারেল এরশাদের সরকার দেশ-বিদেশের এসব মহলের বিরুদ্ধে দীর্ঘযুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার মতো সরকার ছিল না। ফলে দ্রুতই ওষুধ নীতিতে সংশোধন ঘটতে থাকে। পরবর্তীকালের এ রকম নির্বাহী আদেশের ফল হিসেবে খুব কম সংখ্যক ওষুধই আর মূল্য নিয়ন্ত্রণের আওতায় থাকে। তারপরও ওষুধনীতির এমন কিছু সুফল অবশিষ্ট ছিল যার মাধ্যমে দেশের ওষুধশিল্প অনেক বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায়। ধীরে ধীরে বাংলাদেশ ওষুধ রফতানিকারক দেশে পরিণত হয়। কিন্তু এসব বিকাশ থেকে ভোক্তা হিসেবে রোগীরা প্রত্যাশিত মাত্রায় সুবিধা পায়নি।
ওষুধ নীতির এই ইতিহাসের মাঝেই ১৯৮৩ সালের জুলাইয়ে দেশের চিকিৎসা পেশার নেতৃত্বস্থানীয় ৬৩ জন ব্যক্তি বিএমএকে অনুরোধ করে প্রফেসর নূরুল ইসলাম ও ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য।
সেই সময় জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষের বিশেষ রাগ ছিল কয়েকটি কারণে। যেসব চিকিৎসক স্বাধীনতা-যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ও ওষুধ খাতে আমূল পরিবর্তনের জন্য লড়ছিলেন তিনি ছিলেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে সক্রিয় একজন। আন্তর্জাতিক যোগাযোগের মাধ্যমে ওষুধের কাঁচামাল এবং ওষুধের দাম সম্পর্কে হালনাগাদ তথ্য-উপাত্ত, বহুজাতিকদের ব্যবসায়িক চাতুরি সম্পর্কিত তথ্যাদি গণস্বাস্থ্যের মাধ্যমে দেশে ব্যাপক প্রচারের উদ্যোগ নেন তিনি। সরকারকেও তিনি এসব তথ্য এনে দিতেন। তৃতীয়ত জনস্বাস্থ্য নিয়ে বিদেশে যারা কাজ করছে এমন একটিভিস্টদেরও তিনি বাংলাদেশের ওষুধনীতির লড়াইয়ে কাজে লাগাচ্ছিলেন।
তাঁর কাছে এটা ছিল বৈশ্বিক স্বাস্থ্য আন্দোলনের একটা রাজনৈতিক কাজ। বাংলাদেশের ‘র্যাডিক্যাল’দের তরফ থেকে তিনি সেসময় ভালো সংহতি পাননি। বরং তখন এমনও প্রচার চালানো হয়, ‘জাফরুল্লাহ খ্রিস্টানদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে একটা মুসলমান দেশের ওষুধ শিল্প ধ্বংসে নেমেছেন। এতে বাংলাদেশ ভারতীয় ওষুধের বাজারে পরিণত হবে।’ তাঁর বিচার চেয়ে অজ্ঞাত উৎস থেকে পোস্টার লাগানো হয় দেয়ালে দেয়ালে।
ওষুধনীতির বিরুদ্ধে এ রকম অবিশ্বাস্য মাত্রার প্রচার-প্রচারণা রুখতে এবং স্বাস্থ্য বিষয়ে প্রকৃত তথ্য তুলে ধরতেই এক সময় ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ নামে একটা সংগঠন গড়ে উঠেছিল। কিন্তু ওষুধ তৈরিকারী কোম্পানিগুলোর বিজ্ঞাপনের যে চাপ ও কার্যকারিতা আজও বাংলাদেশের প্রচার মাধ্যমে এবং ভোক্তাদের মনোজগতে প্রভাব বিস্তার করে আছে তাতে স্বাস্থ্য খাতে ভোক্তা-বান্ধব পুনর্গঠন প্রকৃতই কঠিন। এ খাতে ডা. জাফরুল্লাহ’র মতো চরিত্রকেও এখন আর বিশেষ দেখা যায় না।
ওষুধ নীতির পর দ্বিতীয়বার ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী আক্রান্ত হন স্বাস্থ্যনীতি তৈরির সময়। ১৯৮৭ সালের মার্চে স্বাস্থ্যনীতির তৈরির জন্য চার সদস্যের যে কমিটি হয় তাতে ছিলেন তিনি। এই কমিটির প্রধান সুপারিশ ছিল স্বাস্থ্য খাতের বিকেন্দ্রীকরণ। বিশেষ করে চিকিৎসকদের গ্রামে নেয়ার ব্যবস্থা করা, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনাকে একত্রিত করা, স্বাস্থ্য কাঠামোতে জনপ্রতিনিধিদের মতামত প্রকাশের সুযোগ তৈরি, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জবাবদিহিতা বাড়াতে অডিট শক্তিশালী করা, রাষ্ট্রীয় মেডিক্যাল কলেজসমূহের শিক্ষকদের প্রাইভেট প্রাকটিস বন্ধ করা এবং তার বদলে তাদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো ইত্যাদি।
১৯৯০ সালের অক্টোবরে এই স্বাস্থ্যনীতি বিল আকারে জাতীয় সংসদে আলোচনার জন ওঠে। এই দিনই ডাক্তারদের সংগঠন বিএমএ ‘জনস্বার্থ বিরোধী স্বাস্থ্যনীতির বিরুদ্ধে’ ৭২ ঘন্টার ধর্মঘটের ডাক দেয়। পাশাপাশি তারা ডা. জাফরুল্লাহসহ আরো দুই জনের সদস্যপদ খারিজ করে স্বাস্থ্যনীতি তৈরিতে যুক্ত থাকায়। ২৭ অক্টোবর গণস্বাস্থ্যকেন্দ্র আবার ব্যাপকভাবে ভাঙ্গচুর হয়। অংশ বিশেষে আগুন দেয়া হয়।
স্বাস্থ্যনীতির বিরুদ্ধে এই আন্দোলনের পাশাপাশি সেই সময় জেনারেল এরশাদের পদত্যাগের দাবিতেও দেশে আন্দোলন চলছিল। তারই ফল হিসেবে নব্বুয়ের ডিসেম্বরে এরশাদ পদত্যাগ করেন। বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে দেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। সেই সরকারে অন্যতম উপদেষ্টা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন বিএমএ’র সভাপতি ডা. এম এ মাজেদ। সরকারের প্রথম দিনই সংসদে প্রস্তাব আকারে থাকা স্বাস্থ্যনীতি-বিলটি বাতিল হয়। তবে ডা. জাফরুল্লাহ’র বিরুদ্ধে অনেকেরই রাগ-ক্ষোভ তখনও থামেনি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকাকে দিয়ে তাঁকে গ্রেফতারের জন্য চাপ প্রয়োগ করা হতে থাকে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিরুদ্ধেও তদন্ত শুরু হয়। সে সময় বিএমএ’র নানান দাবির সমর্থনে এগিয়ে আসতে দেখা যায় ওষুধ শিল্প সমিতিকে।
ওষুধ মালিকদের সঙ্গে চিকিৎসকদের সেই বন্ধন ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় এদেশে কেবল শক্তিশালীই হয়েছে। বিপরীতে জনকল্যাণমূলক একটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য বিকল্প চেষ্টাগুলো খুব বেশি দাঁড়াতে পারেনি।
লেখক: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসবিষয়ক গবেষক

বৈশ্বিক মহামারী করোনার সময় গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ করোনা সেবা উদ্যোগ নিয়ে সেই সময় লেখার পর কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছিলেন, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী কেন অনেকের কাছে অপছন্দের। তিনি ওষুধ ও স্বাস্থ্য বিষয়ে অতীতে কী করতে চেয়েছিলেন? গতকাল রাতে তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। তাঁর মৃত্যুর পর আজ পুরোনো বিতর্কটাকে সামনে এনে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে চাই। বিষয়টি পৃথকভাবে আলোচনার দাবি রাখে। সে জন্যই আলাদা করে এই আলাপের উদ্যোগ। এখানে যেসব তথ্য-উপাত্ত ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলো জাফরুল্লাহ চৌধুরীর পুরোনো লেখা থেকে নেওয়া।
করোনার বিরুদ্ধে সেই সময় দীর্ঘযুদ্ধে বেঁচে-মরে শেষপর্যন্ত যে কয়জন জয়ী হয়েছিলেন এদেশে, তাঁদের অবশ্যই ওষুধ ও স্বাস্থ্য প্রশ্নে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর জীবন-কর্ম নিয়ে অতীতের সংগ্রামের কথাটা আসা স্বাভাবিক বিষয়। অসমাপ্ত সেই সংগ্রামের শিক্ষা এ সময়ে কাজে লাগতে পারে। এটা কেবল একজন জাফরুল্লাহ চৌধুরীর একার ব্যাপার না।
গণস্বাস্থ্য ফার্মা এবং গণস্বাস্থ্য হাসপাতাল দুবার ভাঙচুরের শিকার হয়। প্রথমবার এটিতে আগুন দেওয়ার চেষ্টা হয় ১৯৮৪ সালের আগস্টে; দ্বিতীয়বার ১৯৯০ এর অক্টোবরে। গণস্বাস্থ্য ও ডা. জাফরুল্লাহ প্রথমবার আক্রান্ত হয় ওষুধনীতি নিয়ে, দ্বিতীয়বার স্বাস্থ্যনীতি নিয়ে। দুটো ঘটনায় প্রবল যোগসূত্র আছে। আমরা ওষুধনীতির অধ্যায় থেকে শুরু করতে পারি।
মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই দেশের স্বাস্থ্যখাত এবং ওষুধ নিয়ে নতুন ভাবনা শুরু হয়েছিল। বিশাল গ্রামবাংলায় কীভাবে স্বাস্থ্যসেবাকে সঠিকভাবে এগিয়ে নেওয়া যায় সেটা যুদ্ধোত্তর সমাজেরই একটা আকাঙ্খা ছিল। বিশেষ করে সেই সব চিকিৎসক এটা তীব্রভাবে ভাবতেন, যারা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ‘মুক্তি’ বিষয়টিকে এরা স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি খাতেও সম্প্রসারণ করতে তৎপর ছিল।
সে সময় আমাদের দেশটিতে স্বাস্থ্যখাতের অবস্থা করুণ ছিল। প্রতি একহাজার নবজাতকের ২৬০ জন ৫ বছরের মধ্যে মারা যেত। অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ পাওয়া দুরূহ ব্যাপার ছিল। দামও ছিল অযৌক্তিকভাবে বেশি। ওষুধের ব্যবসার প্রধান সুবিধাভোগী ছিল বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। সরকার সেই সময় টিসিবির মাধ্যমে পূর্ব ইউরোপের কিছু দেশ থেকে ওষুধ আমদানি শুরু করে। এতে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যসহ অনেকে অসন্তুষ্ট ছিল। তাতে সেটাও কমাতে হয়। ফলে ওষুধ খাতে বহুজাতিকদের একচেটিয়াত্ব বাড়তেই থাকে।
১৯৭৮ সালে দেশে একটা ওষুধ নীতির খসড়া তৈরির কাজ শুরু হয়। এ সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন ড. এম এম হক। খসড়া অবস্থাতেই ওই ওষুধ নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় ‘ওষুধ শিল্প সমিতি’। তাদের প্রতিবাদে ওটা খসড়াতেই থেমে যায়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী পদ হারান। এ কাজে তখনকার একজন মন্ত্রীরও ইন্ধন ছিল।
বাংলাদেশে অনেকেই বলেন ওষুধ নীতি জেনারেল এরশাদের অবদান তা কিন্তু ঠিক নয়। এটা ছিল মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী একটা ধারাবাহিক প্রচেষ্টারই জের।
১৯৮২ সালে এসে ২৮ এপ্রিল ওষুধনীতি তৈরি করতে ৮ সদস্যের একটা কমিটি হয়। এই কমিটিতে কোন আমলা ছিল না। সবাই ছিল চিকিৎসাবিদ্যার লোক। যার প্রধান ছিলেন তৎকালীন পিজির অধ্যাপক নূরুল ইসলাম। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এই কমিটির একজন সদস্য ছিলেন মাত্র। এই কমিটির অধিকাংশ সদস্য বিএমএ’র সদস্যও ছিলেন।
এই কমিটি অনেকগুলো বৈঠক শেষে ১৬টি মানদন্ডের ভিত্তিতে দেশের ওষুধ খাত নিয়ে তদন্তে নামে। দেশে সে সময় ওষুধ তৈরির জন্য ১৭৭টি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স ছিল। পাশাপাশি প্রচুর বিদেশি ওষুধ আমদানি হতো। কমিটি প্রায় ৪ হাজার ধরনের ওষুধের সন্ধান পায়। দেখা যায়, এতো বিভিন্ন নামের ওষুধ আসলে ১৫০টি উপাদানে তৈরি ওষুধেরই রকমারি কোম্পানি নাম মাত্র।
১৬টি মানদন্ডের ভিত্তিতে এসব ওষুধ পরীক্ষা শেষে নূরুল ইসলাম কমিটি ১ হাজার ৭৪২টি ক্ষতিকর বা অপ্রয়োজনীয় বা অকার্যকর ওষুধ শনাক্ত করে। এর মাঝে প্রায় ৯০০ ওষুধ তারা বাজার থেকে বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে তুলে নেয়ার সুপারিশ করে। পাশাপাশি ‘অত্যাবশ্যকীয় ওষুধে’র একটা তালিকা করা হয়। এই কমিটির বড় অবদান ছিল--
১. ওষুধের মান ও মূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য রাষ্ট্রীয় কাঠামো শক্তিশালী করার সুপারিশ;
২. বাংলাদেশে কারখানা না করে থার্ড পার্টির মাধ্যমে ওষুধ উৎপাদনে বিদেশি কোম্পানির উপর বিধিনিষেধ আরোপ;
৩. দেশে থাকলে বিদেশ থেকে ওষুধের কাঁচামাল আমদানি নিরুৎসাহিত করা এবং বিদেশ থেকে ওষুধের কাঁচামাল আমদানিকে প্রতিযোগিতামূলক করা;
৪. আয়ুর্বেদি ও ইউনানী ওষুধকে আইনের আওতায় আনা;
৫. ৪৫টি অত্যাবশ্যকীয় ওষুধকে পর্যায়ক্রমে জিনেরিক নামে বাজারজাত করা। আগে একই এমপিসিলিন ৪৮টি কোম্পানি ৪৮ নামে বাজারজাত করতো। আলাদা ব্র্যান্ড নাম হওয়ায় সাধারণ ক্রেতা অনেক ব্র্যান্ডে দামের ক্ষেত্রে প্রতারিত হতো।
১৯৮২ সালের ২৯ মে মন্ত্রিসভা এসব সুপারিশ অনুমোদন করে। ১২ জুন সেটা ‘ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ’ নামে প্রজ্ঞাপন আকারে জারি হয়।
তৃতীয় বিশ্বের স্বাস্থ্যখাতের জন্য এটা ছিল এক অভাবনীয় দৃষ্টান্ত। বহুজাতিকরা এতদিন নিজেদের চ্যালেঞ্জ অযোগ্য ভাবতো। সেখানে এই প্রথম একটা ঘা লাগে।
পাল্টা ঝড় উঠতেও দেরি হলো না। ১ জুন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত জেনারেল এরশাদের সঙ্গে দেখা করেন। ওষুধকে ঘিরে দেশ-বিদেশে রাজনীতির পুরো চেহারাটি আস্তে আস্তে সে সময় বাংলাদেশে উদোম হতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি জার্মানি, ডাচ ও ব্রিটেনের রাষ্ট্রদূতও সরকারের উপর সম্মিলিত চাপ দেন ওষুধ নীতি বদলাতে।
যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মিসেস কুনকে সে সময় বাংলাদেশের প্রভাবশালী দৈনিকের সম্পাদক এবং বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঘন ঘন বৈঠক করতে দেখা যায়। ঢাকার টিকাটুলি থেকে প্রকাশিত প্রভাবশালী একটা বাংলা এবং একটা ইংরেজি দৈনিক সে সময় ওষুধ নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়। জুনেই জেনারেল এরশাদকে যুক্তরাষ্ট্র সফরের আমন্ত্রণ জানানো হয়। তিনি যদিও এটা আইনে পরিণত করেই ওয়াশিংটন গেলেন--কিন্তু সেখানে গিয়ে কথা দিয়ে এলেন যে আইনটি রিভিউ করা হবে।
ওষুধনীতি বাস্তবায়ন হলে বিদেশি বিনিয়োগ চলে যাবে এবং বহু ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাবে এমন একটা প্রচারণা চলতে থাকে তুমুল বেগে সে সময়।
বিদেশি এই চাপ প্রয়োগের মূল কারণ ছিল বাংলাদেশের এই ওষুধ নীতি সফল হয়ে গেলে তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশে একই রকম নীতির জন্য রাজনৈতিক রূপান্তরবাদীরা চাপ প্রয়োগ শুরু করবে।
বাংলাদেশের ওষুধ বিষয় কীভাবে আন্তর্জাতিক মুরুব্বিদের মাথাব্যথার কারণ হয়েছে এ নিয়ে ওয়াশিংটন পোস্টে রিপোর্ট হয় ১৯৮২ সালের ১৯ আগস্ট। শিরোনাম ছিল: ‘ইউএস ইজ এইডিং ড্রাগ কোম্পানিজ ইন বাংলাদেশ’।
ক্রমাগত চাপ ও তদবিরে মাধ্যমে মূল ড্রাগ পলিসি এরপর অনেকখানি পাল্টে যায়। প্রথম ‘রিভিউ’ হয় ১৯৮২ সালের ৭ সেপ্টেম্বর। ১৯৮৩ সালের ডিসেম্বরে ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ আরো সংশোধিত হয়।
ওষুধ নীতি নিয়ে বিতর্ককালের সবচেয়ে বিস্ময়কর দিক ছিল কোম্পানিগুলোর পাল্টা প্রচারণা এবং তাতে দেশের চিকিৎসক সমাজের সংহতিতে ঢাকার মধ্যবিত্তরা সাধারণভাবে ওষুধ নীতির বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়েছিল।
এখানকার মধ্যবিত্তরা যেকোন বড় ধরনের রূপান্তর উদ্যোগে যে কীভাবে প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকা রাখতে পারে তার একটা মহড়া হয়ে যায় ওষুধ নীতির বিরুদ্ধে তাদের অবস্থানে। একই ঘটনা দেখা যায় কয়েক বছর পর স্বাস্থ্যনীতির বিরুদ্ধে তাদের অবস্থানেও।
বলাবাহুল্য, জেনারেল এরশাদের সরকার দেশ-বিদেশের এসব মহলের বিরুদ্ধে দীর্ঘযুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার মতো সরকার ছিল না। ফলে দ্রুতই ওষুধ নীতিতে সংশোধন ঘটতে থাকে। পরবর্তীকালের এ রকম নির্বাহী আদেশের ফল হিসেবে খুব কম সংখ্যক ওষুধই আর মূল্য নিয়ন্ত্রণের আওতায় থাকে। তারপরও ওষুধনীতির এমন কিছু সুফল অবশিষ্ট ছিল যার মাধ্যমে দেশের ওষুধশিল্প অনেক বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায়। ধীরে ধীরে বাংলাদেশ ওষুধ রফতানিকারক দেশে পরিণত হয়। কিন্তু এসব বিকাশ থেকে ভোক্তা হিসেবে রোগীরা প্রত্যাশিত মাত্রায় সুবিধা পায়নি।
ওষুধ নীতির এই ইতিহাসের মাঝেই ১৯৮৩ সালের জুলাইয়ে দেশের চিকিৎসা পেশার নেতৃত্বস্থানীয় ৬৩ জন ব্যক্তি বিএমএকে অনুরোধ করে প্রফেসর নূরুল ইসলাম ও ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য।
সেই সময় জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষের বিশেষ রাগ ছিল কয়েকটি কারণে। যেসব চিকিৎসক স্বাধীনতা-যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ও ওষুধ খাতে আমূল পরিবর্তনের জন্য লড়ছিলেন তিনি ছিলেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে সক্রিয় একজন। আন্তর্জাতিক যোগাযোগের মাধ্যমে ওষুধের কাঁচামাল এবং ওষুধের দাম সম্পর্কে হালনাগাদ তথ্য-উপাত্ত, বহুজাতিকদের ব্যবসায়িক চাতুরি সম্পর্কিত তথ্যাদি গণস্বাস্থ্যের মাধ্যমে দেশে ব্যাপক প্রচারের উদ্যোগ নেন তিনি। সরকারকেও তিনি এসব তথ্য এনে দিতেন। তৃতীয়ত জনস্বাস্থ্য নিয়ে বিদেশে যারা কাজ করছে এমন একটিভিস্টদেরও তিনি বাংলাদেশের ওষুধনীতির লড়াইয়ে কাজে লাগাচ্ছিলেন।
তাঁর কাছে এটা ছিল বৈশ্বিক স্বাস্থ্য আন্দোলনের একটা রাজনৈতিক কাজ। বাংলাদেশের ‘র্যাডিক্যাল’দের তরফ থেকে তিনি সেসময় ভালো সংহতি পাননি। বরং তখন এমনও প্রচার চালানো হয়, ‘জাফরুল্লাহ খ্রিস্টানদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে একটা মুসলমান দেশের ওষুধ শিল্প ধ্বংসে নেমেছেন। এতে বাংলাদেশ ভারতীয় ওষুধের বাজারে পরিণত হবে।’ তাঁর বিচার চেয়ে অজ্ঞাত উৎস থেকে পোস্টার লাগানো হয় দেয়ালে দেয়ালে।
ওষুধনীতির বিরুদ্ধে এ রকম অবিশ্বাস্য মাত্রার প্রচার-প্রচারণা রুখতে এবং স্বাস্থ্য বিষয়ে প্রকৃত তথ্য তুলে ধরতেই এক সময় ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ নামে একটা সংগঠন গড়ে উঠেছিল। কিন্তু ওষুধ তৈরিকারী কোম্পানিগুলোর বিজ্ঞাপনের যে চাপ ও কার্যকারিতা আজও বাংলাদেশের প্রচার মাধ্যমে এবং ভোক্তাদের মনোজগতে প্রভাব বিস্তার করে আছে তাতে স্বাস্থ্য খাতে ভোক্তা-বান্ধব পুনর্গঠন প্রকৃতই কঠিন। এ খাতে ডা. জাফরুল্লাহ’র মতো চরিত্রকেও এখন আর বিশেষ দেখা যায় না।
ওষুধ নীতির পর দ্বিতীয়বার ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী আক্রান্ত হন স্বাস্থ্যনীতি তৈরির সময়। ১৯৮৭ সালের মার্চে স্বাস্থ্যনীতির তৈরির জন্য চার সদস্যের যে কমিটি হয় তাতে ছিলেন তিনি। এই কমিটির প্রধান সুপারিশ ছিল স্বাস্থ্য খাতের বিকেন্দ্রীকরণ। বিশেষ করে চিকিৎসকদের গ্রামে নেয়ার ব্যবস্থা করা, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনাকে একত্রিত করা, স্বাস্থ্য কাঠামোতে জনপ্রতিনিধিদের মতামত প্রকাশের সুযোগ তৈরি, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জবাবদিহিতা বাড়াতে অডিট শক্তিশালী করা, রাষ্ট্রীয় মেডিক্যাল কলেজসমূহের শিক্ষকদের প্রাইভেট প্রাকটিস বন্ধ করা এবং তার বদলে তাদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো ইত্যাদি।
১৯৯০ সালের অক্টোবরে এই স্বাস্থ্যনীতি বিল আকারে জাতীয় সংসদে আলোচনার জন ওঠে। এই দিনই ডাক্তারদের সংগঠন বিএমএ ‘জনস্বার্থ বিরোধী স্বাস্থ্যনীতির বিরুদ্ধে’ ৭২ ঘন্টার ধর্মঘটের ডাক দেয়। পাশাপাশি তারা ডা. জাফরুল্লাহসহ আরো দুই জনের সদস্যপদ খারিজ করে স্বাস্থ্যনীতি তৈরিতে যুক্ত থাকায়। ২৭ অক্টোবর গণস্বাস্থ্যকেন্দ্র আবার ব্যাপকভাবে ভাঙ্গচুর হয়। অংশ বিশেষে আগুন দেয়া হয়।
স্বাস্থ্যনীতির বিরুদ্ধে এই আন্দোলনের পাশাপাশি সেই সময় জেনারেল এরশাদের পদত্যাগের দাবিতেও দেশে আন্দোলন চলছিল। তারই ফল হিসেবে নব্বুয়ের ডিসেম্বরে এরশাদ পদত্যাগ করেন। বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে দেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। সেই সরকারে অন্যতম উপদেষ্টা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন বিএমএ’র সভাপতি ডা. এম এ মাজেদ। সরকারের প্রথম দিনই সংসদে প্রস্তাব আকারে থাকা স্বাস্থ্যনীতি-বিলটি বাতিল হয়। তবে ডা. জাফরুল্লাহ’র বিরুদ্ধে অনেকেরই রাগ-ক্ষোভ তখনও থামেনি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকাকে দিয়ে তাঁকে গ্রেফতারের জন্য চাপ প্রয়োগ করা হতে থাকে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিরুদ্ধেও তদন্ত শুরু হয়। সে সময় বিএমএ’র নানান দাবির সমর্থনে এগিয়ে আসতে দেখা যায় ওষুধ শিল্প সমিতিকে।
ওষুধ মালিকদের সঙ্গে চিকিৎসকদের সেই বন্ধন ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় এদেশে কেবল শক্তিশালীই হয়েছে। বিপরীতে জনকল্যাণমূলক একটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য বিকল্প চেষ্টাগুলো খুব বেশি দাঁড়াতে পারেনি।
লেখক: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসবিষয়ক গবেষক

গত এপ্রিলে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আউটলুক’-এর পূর্বাভাস জানিয়েছিল, এ বছর বাংলাদেশে নতুন করে আরও ৩০ লাখ মানুষ অতিদরিদ্র শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়বে এবং দারিদ্র্যের হার ২০ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ২১ দশমিক ২ শতাংশে।
৯ ঘণ্টা আগে
বাংলাদেশের কৃষি এখন এক সংকটময় সন্ধিক্ষণে। একদিকে বাড়ছে জনসংখ্যা, কমছে আবাদি জমি; অন্যদিকে কৃষিশ্রমিকের অভাব ভয়াবহ আকার নিয়েছে। স্বাধীনতার পর যেখানে মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৭৫ শতাংশ কৃষিনির্ভর ছিল, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপে দেখা যায়, ২০২২ সালে তা নেমে এসেছে প্রায় ৪৫ শতাংশে।
৯ ঘণ্টা আগে
দেশে যখন জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে অস্থিরতা বিরাজ করছে, জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়ে নানা শঙ্কা তৈরি হয়েছে—এ রকম পরিস্থিতিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউজিসি কর্তৃক প্রস্তাবিত নতুন খসড়া নীতিমালা উচ্চশিক্ষার এ সেক্টরে একটা পরিবর্তনের আশাবাদ তৈরি করতে পারে।
৯ ঘণ্টা আগে
ত্রিমুখী সম্পর্ক নিয়ে অনেক মুভি হয়েছে। এ রকম মুভি দেখেননি, এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন। কেবল মুভিতেই কেন, বাস্তবেও ত্রিমুখী সম্পর্কের অনেক ঘটনা আমরা দেখে থাকি। সব ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ত্রিভুজ সম্পর্কের শেষ পরিণতি সাধারণত ভালো হয় না।
১ দিন আগেএকটি ন্যূনতম সভ্য রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে তাদের মনের মধ্যে এ আকাঙ্ক্ষা থাকতেই পারে যে, এ রাষ্ট্র তথা এর পরিচালক ও রাজনীতিকেরা জনগণের জীবনযাপনের ক্ষেত্রে বিরাজমান সংকট নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবেন এবং তা দূরীকরণের উপায় নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করবেন। যেহেতু অন্তর্বর্তী সরকারের সব চিন্তাই সংসদ নির্বাচন নিয়ে, তাই তারা এ বিষয়টির প্রতি তেমন নজর দিতে পারছে না।
আবু তাহের খান

গত এপ্রিলে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আউটলুক’-এর পূর্বাভাস জানিয়েছিল, এ বছর বাংলাদেশে নতুন করে আরও ৩০ লাখ মানুষ অতিদরিদ্র শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়বে এবং দারিদ্র্যের হার ২০ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ২১ দশমিক ২ শতাংশে। বিশ্বব্যাংকের অধিকাংশ পরামর্শ ও সহায়তা বাংলাদেশের জন্য পরিত্যাজ্য হলেও তাদের এ পূর্বাভাসকে আমলে নেওয়ার যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে। কারণ, এটি বাংলাদেশের বিত্তসহায়ক ও জনবিমুখ অর্থনৈতিক নীতিমালাজনিত এমন এক ফলাফলকে তুলে ধরেছে, যে বিষয়ে বাংলাদেশ জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হলে দেশে দারিদ্র্যের হার সামনের দিনগুলোতে ক্রমান্বয়ে আরও বাড়তেই থাকবে এবং এর ফলে দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ, বিশেষত দরিদ্র ও নিম্নবিত্তের আওতাধীন জনগোষ্ঠী ক্ষুধা, অপুষ্টি ও অনাহারের মতো বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে।
বিশ্বব্যাংকের দেওয়া ওই পূর্বাভাসের পর ইতিমধ্যে ছয় মাস পেরিয়ে গেছে। কিন্তু উল্লিখিত পরিস্থিতি মোকাবিলায় অদ্যাবধি রাষ্ট্রের নীতিকাঠামোতে এমন কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি বা আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, যা পরবর্তী বছরগুলোতে গিয়ে উল্লিখিত দারিদ্র্য বৃদ্ধির হারকে রুখে দিতে পারবে। তবে এ সরকার যেহেতু একটি অন্তর্বর্তী সরকার, সেহেতু এ বিষয়ে তাদের নানা দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও সীমাবদ্ধতা থাকতেই পারে। কিন্তু কথা হচ্ছে, ফেব্রুয়ারির আসন্ন নির্বাচনে (যদি হয়) জিতে যারা ক্ষমতায় যেতে চায়, তাদের কি এ বিষয়ে কোনো অঙ্গীকার, প্রস্তুতি বা চিন্তাভাবনা আছে? তাদের কথাবার্তা ও আচরণ দেখে তো তেমনটি মনে হচ্ছে না। বিষয়টি তাহলে দাঁড়াচ্ছে এই যে অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থানগত দুর্বলতা এবং এ বিষয়ে ক্ষমতায় যেতে ইচ্ছুক রাজনৈতিক দলগুলোর সীমাহীন নির্লিপ্ততা—এ দুয়ে মিলে দেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতি মোকাবিলা-প্রচেষ্টা এখন একেবারেই শূন্যের কোঠায়। ফলে দেশের দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির পরিবারগুলো এখন চরম খাদ্যাভাব ও অপুষ্টিতে ভুগছে। তাদের সন্তানেরা গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষায় প্রবেশাধিকার না পেয়ে নিম্নব্যয়ের মানহীন মাদ্রাসাশিক্ষার দিকে ঝুঁকছে। চিকিৎসার জন্য শহরের সরকারি হাসপাতালই তাদের মূল ভরসা, যেখানে চাহিদার তুলনায় সেবা সরবরাহের পরিমাণ খুবই অপ্রতুল। আর ভোগ্যপণ্যের অতি উচ্চমূল্যের কারণে তাদের মধ্যকার একটি বড় অংশই দৈনন্দিন জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম উপকরণটুকু সংগ্রহ করতে না পেরে প্রায়ই অর্ধাহার বা আপসমূলক নিম্ন-আহারের মধ্য দিয়ে জীবন কাটাচ্ছে। মোট কথা, বিত্তবান, সুবিধাভোগী ও রাষ্ট্রীয় প্রশ্রয়ে রাতারাতি অবৈধ বিত্তের মালিক হয়ে ওঠা নব্য বিত্তবানেরা ছাড়া দেশের সিংহভাগ মানুষকেই এখন চরম অর্থকষ্টের মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, দেশের সাধারণ মানুষের এইসব দুর্ভোগ ও মানবেতর জীবনযাপনের কষ্ট রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের বোধ, চিন্তা ও উপলব্ধিকে একেবারেই স্পর্শ করতে পারছে না অথবা বলা যেতে পারে, এসব কষ্ট উপলব্ধি করার মতো বোধই তাঁদের নেই। অন্যদিকে নিকট ভবিষ্যতে যাঁরা রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত প্রণয়নের দায়িত্বে যাবেন বলে আশা করছেন, তাঁরাও ঘুণাক্ষরে ভাবছেন না সাধারণ মানুষের জীবন কীভাবে ক্রমেই বিপন্ন থেকে বিপন্নতর হয়ে পড়ছে। আর উন্নয়ন অর্থনীতি সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিমাত্রই জানেন, ক্রমহ্রাসমান দারিদ্র্য যদি মাঝপথে এসে আবার পশ্চাৎমুখী হতে শুরু করে অর্থাৎ বাড়তে থাকে, তাহলে সেটিকে আর শিগগির কমিয়ে আনতে পারাটা অনেকটাই সাধ্যের বাইরে চলে যাবে। এবং দারিদ্র্যবিমোচন-প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সম্ভবত এই মুহূর্তে সে রকম একটি অন্তর্বর্তী সংকটকালই পার করছে। আর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার ও বৈদেশিক চুক্তি সম্পাদনের পেছনে তাদের অধিকাংশ সময় ও মনোযোগ নিবদ্ধ করার কারণে জনস্বার্থের প্রতি তারা যে উপেক্ষামূলক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছে, বস্তুত তা থেকেই এ সংকটের সৃষ্টি।
জনস্বার্থের প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের উপেক্ষা ও নির্লিপ্ততার সবচেয়ে বড় শিকার এখন কৃষক ও কৃষি খাত এবং আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক শ্রমের সঙ্গে সম্পর্কিত শ্রমজীবী মানুষ। আর তাদের অধিকাংশই যেহেতু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া মানুষ এবং তারা যেহেতু সংগঠিত নয় বলে প্রতিবাদ করার কোনো সামর্থ্যও তাদের নেই। অন্যদিকে ক্ষমতারোহণের লড়াইয়ে উন্মত্ত রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতামগ্নতা এতটাই প্রচণ্ড হয়ে উঠেছে যে তাদের পক্ষেও আর কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থের দিকে তাকানোর ফুরসত নেই। অতএব দরিদ্র ও নিম্নবিত্তের মানুষের আপাতত এটাই নিয়তি যে, তাদের আরও কিছুকাল ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অনাহার, পুষ্টিহীনতা, অশিক্ষা, চিকিৎসাহীনতা, বাসস্থান-সংকট, মব-অত্যাচার ইত্যাদি বিষয়গুলোকে মোকাবিলা করেই টিকে থাকতে হবে।
তো এই যখন দেশের অধিকাংশ মানুষের জীবনযাপনের স্তর ও বৈশিষ্ট্য, তখন একটি ন্যূনতম সভ্য রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে তাদের মনের মধ্যে এ আকাঙ্ক্ষা থাকতেই পারে যে, এ রাষ্ট্র তথা এর পরিচালক ও রাজনীতিকেরা জনগণের জীবনযাপনের ক্ষেত্রে বিরাজমান সংকট নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবেন এবং তা দূরীকরণের উপায় নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করবেন। যেহেতু অন্তর্বর্তী সরকারের সব চিন্তাই সংসদ নির্বাচন নিয়ে, তাই তারা এ বিষয়টির প্রতি তেমন নজর দিতে পারছে না। অন্যদিকে, ক্ষমতায় যেতে ইচ্ছুক রাজনীতিকেরা জনগণের জীবনযাপনের সে কষ্ট ও দুর্ভোগ নিয়ে উদ্বিগ্ন ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবেন তো দূরের কথা, তাঁদের কাছে জনগণ নিছকই ভোটের সময়কার বক্তৃতা-মাঠের মাথাগুনতির অলংকার ও উপকরণ মাত্র। আর সে কারণেই বিশ্বব্যাংক যখন তথ্য দেয় যে দারিদ্র্য আবার ফিরে আসছে, তখন মাঠের জীবনে অভ্যস্ত মানুষ হিসেবে ভয় হয়—বাংলাদেশ আবার দক্ষিণ সুদান, কঙ্গো বা মোজাম্বিকের দিকে যাত্রা করছে না তো?
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে মানব উন্নয়ন সূচকে (এইচডিআই) বাংলাদেশ এই সেদিনও শ্রীলঙ্কা ও ভারত ব্যতীত অন্য পাঁচটি দেশের তুলনায় প্রায় সব কটি সূচকেই সুস্পষ্টভাবে এগিয়ে ছিল। এমনকি বেশ কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল শ্রীলঙ্কা ও ভারতের চেয়েও এগিয়ে। কিন্তু দারিদ্র্যহার বৃদ্ধির পূর্ব-প্রবণতা আবার ফিরে আসার পরিপ্রেক্ষিতে আশঙ্কা হয়, এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ হয়তো পুনরায় পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের পর্যায়ে নেমে যেতে পারে। এই সেদিনও বাংলাদেশের তুলনায় বহু ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা ভিয়েতনাম এখন বাংলাদেশকে প্রায় কোনো ক্ষেত্রেই আর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে গণ্য করে না। এমনকি বাংলাদেশের নাগরিকদের তারা ভিসাও দিতে চায় না। ২০২২ সালের জুলাইয়ে শ্রীলঙ্কায় প্রচণ্ড জনবিক্ষোভের মুখে সরকার পতনের মাত্র এক বছরের মধ্যে দেশটি শুধু ঘুরেই দাঁড়ায়নি, তাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার এখন ৫ দশমিক ২ শতাংশ, যা বাংলাদেশের তুলনায় দশমিক ৪ শতাংশ বেশি এবং সার্কভুক্ত দেশ হয়েও বাংলাদেশকে ভিসা দিতে তারা কড়াকড়ি করছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারে সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ এখন শুধু পাকিস্তানের (৩.২ শতাংশ) ও আফগানিস্তানের (২.৭ শতাংশ) চেয়ে এগিয়ে আছে।
এসব বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনা করার অবকাশ কি মনে হয় অন্তর্বর্তী সরকার বা ‘ফেব্রুয়ারি নির্বাচনে’ অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণকারী দলসমূহের আছে? নেই। উপরিউক্ত পূর্বাভাস অনুযায়ী, এ বছর দেশে দারিদ্র্যের হার যেখানে ১ দশমিক ২ শতাংশ বাড়ছে, সেখানে পরবর্তী বছরগুলোতেও যদি এ ধারা অব্যাহত থাকে, তাহলে ২০৩০ সাল নাগাদ দেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতি ও সাধারণ জনগণের বিপর্যস্ত জীবনমানের অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা ভাবতেই গা শিউরে ওঠে বৈকি! রাষ্ট্রের পরিচালকদের এ ব্যাপারে নির্বিকার থাকা চলে না। দেশ ও দেশের সাধারণ মানুষের এই মুহূর্তের কষ্টময় জীবনযাপনের প্রতি ন্যূনতম মমতা জানিয়ে বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া উচিত।
লেখক: সাবেক পরিচালক, বিসিক

গত এপ্রিলে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আউটলুক’-এর পূর্বাভাস জানিয়েছিল, এ বছর বাংলাদেশে নতুন করে আরও ৩০ লাখ মানুষ অতিদরিদ্র শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়বে এবং দারিদ্র্যের হার ২০ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ২১ দশমিক ২ শতাংশে। বিশ্বব্যাংকের অধিকাংশ পরামর্শ ও সহায়তা বাংলাদেশের জন্য পরিত্যাজ্য হলেও তাদের এ পূর্বাভাসকে আমলে নেওয়ার যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে। কারণ, এটি বাংলাদেশের বিত্তসহায়ক ও জনবিমুখ অর্থনৈতিক নীতিমালাজনিত এমন এক ফলাফলকে তুলে ধরেছে, যে বিষয়ে বাংলাদেশ জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হলে দেশে দারিদ্র্যের হার সামনের দিনগুলোতে ক্রমান্বয়ে আরও বাড়তেই থাকবে এবং এর ফলে দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ, বিশেষত দরিদ্র ও নিম্নবিত্তের আওতাধীন জনগোষ্ঠী ক্ষুধা, অপুষ্টি ও অনাহারের মতো বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে।
বিশ্বব্যাংকের দেওয়া ওই পূর্বাভাসের পর ইতিমধ্যে ছয় মাস পেরিয়ে গেছে। কিন্তু উল্লিখিত পরিস্থিতি মোকাবিলায় অদ্যাবধি রাষ্ট্রের নীতিকাঠামোতে এমন কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি বা আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, যা পরবর্তী বছরগুলোতে গিয়ে উল্লিখিত দারিদ্র্য বৃদ্ধির হারকে রুখে দিতে পারবে। তবে এ সরকার যেহেতু একটি অন্তর্বর্তী সরকার, সেহেতু এ বিষয়ে তাদের নানা দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও সীমাবদ্ধতা থাকতেই পারে। কিন্তু কথা হচ্ছে, ফেব্রুয়ারির আসন্ন নির্বাচনে (যদি হয়) জিতে যারা ক্ষমতায় যেতে চায়, তাদের কি এ বিষয়ে কোনো অঙ্গীকার, প্রস্তুতি বা চিন্তাভাবনা আছে? তাদের কথাবার্তা ও আচরণ দেখে তো তেমনটি মনে হচ্ছে না। বিষয়টি তাহলে দাঁড়াচ্ছে এই যে অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থানগত দুর্বলতা এবং এ বিষয়ে ক্ষমতায় যেতে ইচ্ছুক রাজনৈতিক দলগুলোর সীমাহীন নির্লিপ্ততা—এ দুয়ে মিলে দেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতি মোকাবিলা-প্রচেষ্টা এখন একেবারেই শূন্যের কোঠায়। ফলে দেশের দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির পরিবারগুলো এখন চরম খাদ্যাভাব ও অপুষ্টিতে ভুগছে। তাদের সন্তানেরা গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষায় প্রবেশাধিকার না পেয়ে নিম্নব্যয়ের মানহীন মাদ্রাসাশিক্ষার দিকে ঝুঁকছে। চিকিৎসার জন্য শহরের সরকারি হাসপাতালই তাদের মূল ভরসা, যেখানে চাহিদার তুলনায় সেবা সরবরাহের পরিমাণ খুবই অপ্রতুল। আর ভোগ্যপণ্যের অতি উচ্চমূল্যের কারণে তাদের মধ্যকার একটি বড় অংশই দৈনন্দিন জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম উপকরণটুকু সংগ্রহ করতে না পেরে প্রায়ই অর্ধাহার বা আপসমূলক নিম্ন-আহারের মধ্য দিয়ে জীবন কাটাচ্ছে। মোট কথা, বিত্তবান, সুবিধাভোগী ও রাষ্ট্রীয় প্রশ্রয়ে রাতারাতি অবৈধ বিত্তের মালিক হয়ে ওঠা নব্য বিত্তবানেরা ছাড়া দেশের সিংহভাগ মানুষকেই এখন চরম অর্থকষ্টের মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, দেশের সাধারণ মানুষের এইসব দুর্ভোগ ও মানবেতর জীবনযাপনের কষ্ট রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের বোধ, চিন্তা ও উপলব্ধিকে একেবারেই স্পর্শ করতে পারছে না অথবা বলা যেতে পারে, এসব কষ্ট উপলব্ধি করার মতো বোধই তাঁদের নেই। অন্যদিকে নিকট ভবিষ্যতে যাঁরা রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত প্রণয়নের দায়িত্বে যাবেন বলে আশা করছেন, তাঁরাও ঘুণাক্ষরে ভাবছেন না সাধারণ মানুষের জীবন কীভাবে ক্রমেই বিপন্ন থেকে বিপন্নতর হয়ে পড়ছে। আর উন্নয়ন অর্থনীতি সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিমাত্রই জানেন, ক্রমহ্রাসমান দারিদ্র্য যদি মাঝপথে এসে আবার পশ্চাৎমুখী হতে শুরু করে অর্থাৎ বাড়তে থাকে, তাহলে সেটিকে আর শিগগির কমিয়ে আনতে পারাটা অনেকটাই সাধ্যের বাইরে চলে যাবে। এবং দারিদ্র্যবিমোচন-প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সম্ভবত এই মুহূর্তে সে রকম একটি অন্তর্বর্তী সংকটকালই পার করছে। আর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার ও বৈদেশিক চুক্তি সম্পাদনের পেছনে তাদের অধিকাংশ সময় ও মনোযোগ নিবদ্ধ করার কারণে জনস্বার্থের প্রতি তারা যে উপেক্ষামূলক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছে, বস্তুত তা থেকেই এ সংকটের সৃষ্টি।
জনস্বার্থের প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের উপেক্ষা ও নির্লিপ্ততার সবচেয়ে বড় শিকার এখন কৃষক ও কৃষি খাত এবং আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক শ্রমের সঙ্গে সম্পর্কিত শ্রমজীবী মানুষ। আর তাদের অধিকাংশই যেহেতু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া মানুষ এবং তারা যেহেতু সংগঠিত নয় বলে প্রতিবাদ করার কোনো সামর্থ্যও তাদের নেই। অন্যদিকে ক্ষমতারোহণের লড়াইয়ে উন্মত্ত রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতামগ্নতা এতটাই প্রচণ্ড হয়ে উঠেছে যে তাদের পক্ষেও আর কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থের দিকে তাকানোর ফুরসত নেই। অতএব দরিদ্র ও নিম্নবিত্তের মানুষের আপাতত এটাই নিয়তি যে, তাদের আরও কিছুকাল ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অনাহার, পুষ্টিহীনতা, অশিক্ষা, চিকিৎসাহীনতা, বাসস্থান-সংকট, মব-অত্যাচার ইত্যাদি বিষয়গুলোকে মোকাবিলা করেই টিকে থাকতে হবে।
তো এই যখন দেশের অধিকাংশ মানুষের জীবনযাপনের স্তর ও বৈশিষ্ট্য, তখন একটি ন্যূনতম সভ্য রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে তাদের মনের মধ্যে এ আকাঙ্ক্ষা থাকতেই পারে যে, এ রাষ্ট্র তথা এর পরিচালক ও রাজনীতিকেরা জনগণের জীবনযাপনের ক্ষেত্রে বিরাজমান সংকট নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবেন এবং তা দূরীকরণের উপায় নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করবেন। যেহেতু অন্তর্বর্তী সরকারের সব চিন্তাই সংসদ নির্বাচন নিয়ে, তাই তারা এ বিষয়টির প্রতি তেমন নজর দিতে পারছে না। অন্যদিকে, ক্ষমতায় যেতে ইচ্ছুক রাজনীতিকেরা জনগণের জীবনযাপনের সে কষ্ট ও দুর্ভোগ নিয়ে উদ্বিগ্ন ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবেন তো দূরের কথা, তাঁদের কাছে জনগণ নিছকই ভোটের সময়কার বক্তৃতা-মাঠের মাথাগুনতির অলংকার ও উপকরণ মাত্র। আর সে কারণেই বিশ্বব্যাংক যখন তথ্য দেয় যে দারিদ্র্য আবার ফিরে আসছে, তখন মাঠের জীবনে অভ্যস্ত মানুষ হিসেবে ভয় হয়—বাংলাদেশ আবার দক্ষিণ সুদান, কঙ্গো বা মোজাম্বিকের দিকে যাত্রা করছে না তো?
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে মানব উন্নয়ন সূচকে (এইচডিআই) বাংলাদেশ এই সেদিনও শ্রীলঙ্কা ও ভারত ব্যতীত অন্য পাঁচটি দেশের তুলনায় প্রায় সব কটি সূচকেই সুস্পষ্টভাবে এগিয়ে ছিল। এমনকি বেশ কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল শ্রীলঙ্কা ও ভারতের চেয়েও এগিয়ে। কিন্তু দারিদ্র্যহার বৃদ্ধির পূর্ব-প্রবণতা আবার ফিরে আসার পরিপ্রেক্ষিতে আশঙ্কা হয়, এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ হয়তো পুনরায় পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের পর্যায়ে নেমে যেতে পারে। এই সেদিনও বাংলাদেশের তুলনায় বহু ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা ভিয়েতনাম এখন বাংলাদেশকে প্রায় কোনো ক্ষেত্রেই আর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে গণ্য করে না। এমনকি বাংলাদেশের নাগরিকদের তারা ভিসাও দিতে চায় না। ২০২২ সালের জুলাইয়ে শ্রীলঙ্কায় প্রচণ্ড জনবিক্ষোভের মুখে সরকার পতনের মাত্র এক বছরের মধ্যে দেশটি শুধু ঘুরেই দাঁড়ায়নি, তাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার এখন ৫ দশমিক ২ শতাংশ, যা বাংলাদেশের তুলনায় দশমিক ৪ শতাংশ বেশি এবং সার্কভুক্ত দেশ হয়েও বাংলাদেশকে ভিসা দিতে তারা কড়াকড়ি করছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারে সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ এখন শুধু পাকিস্তানের (৩.২ শতাংশ) ও আফগানিস্তানের (২.৭ শতাংশ) চেয়ে এগিয়ে আছে।
এসব বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনা করার অবকাশ কি মনে হয় অন্তর্বর্তী সরকার বা ‘ফেব্রুয়ারি নির্বাচনে’ অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণকারী দলসমূহের আছে? নেই। উপরিউক্ত পূর্বাভাস অনুযায়ী, এ বছর দেশে দারিদ্র্যের হার যেখানে ১ দশমিক ২ শতাংশ বাড়ছে, সেখানে পরবর্তী বছরগুলোতেও যদি এ ধারা অব্যাহত থাকে, তাহলে ২০৩০ সাল নাগাদ দেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতি ও সাধারণ জনগণের বিপর্যস্ত জীবনমানের অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা ভাবতেই গা শিউরে ওঠে বৈকি! রাষ্ট্রের পরিচালকদের এ ব্যাপারে নির্বিকার থাকা চলে না। দেশ ও দেশের সাধারণ মানুষের এই মুহূর্তের কষ্টময় জীবনযাপনের প্রতি ন্যূনতম মমতা জানিয়ে বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া উচিত।
লেখক: সাবেক পরিচালক, বিসিক

মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই দেশের স্বাস্থ্যখাত এবং ওষুধ নিয়ে নতুন ভাবনা শুরু হয়েছিল। বিশাল গ্রামবাংলায় কীভাবে স্বাস্থ্যসেবাকে সঠিকভাবে এগিয়ে নেওয়া যায় সেটা যুদ্ধোত্তর সমাজেরই একটা আকাঙ্খা ছিল। বিশেষ করে সেই সব চিকিৎসক এটা তীব্রভাবে ভাবতেন, যারা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ‘মুক্তি’ বিষয়টিকে এরা স্বাস্থ্য
১৩ এপ্রিল ২০২৩
বাংলাদেশের কৃষি এখন এক সংকটময় সন্ধিক্ষণে। একদিকে বাড়ছে জনসংখ্যা, কমছে আবাদি জমি; অন্যদিকে কৃষিশ্রমিকের অভাব ভয়াবহ আকার নিয়েছে। স্বাধীনতার পর যেখানে মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৭৫ শতাংশ কৃষিনির্ভর ছিল, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপে দেখা যায়, ২০২২ সালে তা নেমে এসেছে প্রায় ৪৫ শতাংশে।
৯ ঘণ্টা আগে
দেশে যখন জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে অস্থিরতা বিরাজ করছে, জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়ে নানা শঙ্কা তৈরি হয়েছে—এ রকম পরিস্থিতিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউজিসি কর্তৃক প্রস্তাবিত নতুন খসড়া নীতিমালা উচ্চশিক্ষার এ সেক্টরে একটা পরিবর্তনের আশাবাদ তৈরি করতে পারে।
৯ ঘণ্টা আগে
ত্রিমুখী সম্পর্ক নিয়ে অনেক মুভি হয়েছে। এ রকম মুভি দেখেননি, এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন। কেবল মুভিতেই কেন, বাস্তবেও ত্রিমুখী সম্পর্কের অনেক ঘটনা আমরা দেখে থাকি। সব ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ত্রিভুজ সম্পর্কের শেষ পরিণতি সাধারণত ভালো হয় না।
১ দিন আগেশাইখ সিরাজ

বাংলাদেশের কৃষি এখন এক সংকটময় সন্ধিক্ষণে। একদিকে বাড়ছে জনসংখ্যা, কমছে আবাদি জমি; অন্যদিকে কৃষিশ্রমিকের অভাব ভয়াবহ আকার নিয়েছে। স্বাধীনতার পর যেখানে মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৭৫ শতাংশ কৃষিনির্ভর ছিল, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপে দেখা যায়, ২০২২ সালে তা নেমে এসেছে প্রায় ৪৫ শতাংশে। এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে কৃষিতে কর্মরত মানুষের হার নেমে আসবে ২০ শতাংশে।
এমন পরিস্থিতিতে উৎপাদন বাড়ানোর একমাত্র টেকসই উপায় হলো কৃষি যান্ত্রিকীকরণ; যেখানে যন্ত্র শ্রমের বিকল্প হয়ে উঠছে, উৎপাদন ব্যয় কমাচ্ছে, আর কৃষককে বাজার প্রতিযোগিতায় টিকিয়ে রাখছে।
বাংলাদেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের সূচনা ষাটের দশকে, তখন হাতে আসে পাওয়ার টিলার ও সেচপাম্প। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে সরকারি উদ্যোগে ৪০ হাজার লো-লিফট পাম্প বিতরণ করা হয়। এরপর ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যার পর সরকার আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করলে বেসরকারি খাত যন্ত্র ব্যবসায় প্রবেশ করে। যান্ত্রিকীকরণের গতি তখন থেকে বাড়তে থাকে।
কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৯৫ শতাংশ জমি চাষ হয় পাওয়ার টিলারে, ৯৫ শতাংশ সেচ হয় মেশিনে এবং ৭০ শতাংশ ফসল মাড়াই যান্ত্রিকভাবে সম্পন্ন হয়। কিন্তু রোপণ ও কর্তনের ক্ষেত্রে এই অগ্রগতি এখনো সীমিত; রাইস ট্রান্সপ্লান্টার ব্যবহার মাত্র ১২.৪ শতাংশ এবং কম্বাইন হার্ভেস্টার ১৭.৩ শতাংশ কৃষকের মধ্যে সীমিত (বিআরআরআই ও ডিএই সমীক্ষা, ২০১৮)। যদিও এই তথ্য নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
২০১৯ সালে সরকার যান্ত্রিকীকরণে গতি আনতে ‘কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প (২০২০-২০২৫)’ হাতে নেয়। যার বাজেট ছিল ৩ হাজার কোটি টাকার ওপরে। প্রকল্পের তথ্যমতে, ৫১ প্রকার কৃষিযন্ত্রে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে পাহাড়ি ও চরাঞ্চলে এবং ৫০ শতাংশ ভর্তুকি অন্য এলাকায়। বিশেষত যে যন্ত্রগুলোতে ভর্তুকি দেওয়া হয়, সেসব যন্ত্র ক্ষুদ্র বা মাঝারি কৃষকের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। আমি বারবার বলে আসছিলাম, ক্ষুদ্র কৃষিযন্ত্রে ভর্তুকি না দিলে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ উদ্যোগটি সফল হবে না। মনে পড়ে, বরগুনায় মাঠে কাজ করার সময় কয়েকজন কৃষক বলছিলেন, যাঁরা কৃষিযন্ত্রের জন্য আবেদন করেছিলেন, তাঁদের কেউই কৃষিযন্ত্র পাননি। অথচ যিনি পেয়েছেন, তিনি কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত নন।
নেত্রকোনার হাওর এলাকায় কাজ করার সময় কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, হার্ভেস্টার দ্রুত সময়ে ফসল তোলার কাজে সহায়তা করেছে, ফলে পানি চলে আসার আগেই গত দুই বছর ফসল তুলতে পেরেছেন তাঁরা। তবে বড় অভিযোগ ছিল, একজনই পেয়েছেন একাধিক যন্ত্র। তবে আশার কথা, কৃষিযন্ত্রের ব্যবহারে হাওর অঞ্চলের মতো জায়গা থেকে অতিদ্রুত ধান কেটে নিতে পারায় ফসলকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করা যাচ্ছে।
যান্ত্রিকীকরণ যেমন শ্রমঘাটতি পূরণ করছে, উৎপাদন খরচও কমাচ্ছে। গবেষণা অনুযায়ী, পাওয়ার টিলারে জমি চাষ করলে সময় ৬০ শতাংশ কমে, কম্বাইন হার্ভেস্টারে ধান কাটা ও মাড়াই করলে খরচ ৩০-৪০ শতাংশ কমে, আর ক্ষতি (ধান চিটা যাওয়া ইত্যাদি) কমে ১০-১৫ শতাংশ থেকে ২-৩ শতাংশে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) তথ্য অনুযায়ী, এক বিঘা ধান কাটতে যেখানে শ্রমিক লাগে ১২-১৫ জন, কম্বাইন হার্ভেস্টার তা করে ফেলে মাত্র ২০-২৫ মিনিটে। অর্থাৎ এক মেশিন দিনে ২৫-৩০ বিঘা জমির কাজ শেষ করতে পারে, যা আগে লাগত তিন দিন এবং কমপক্ষে ৫০ শ্রমিক।
যান্ত্রিকীকরণ শুধু কৃষকের কাজ সহজ করছে না, নতুন গ্রামীণ উদ্যোক্তা শ্রেণিও তৈরি করছে। যাঁরা নিজের জমি না থাকলেও এখন যন্ত্র কিনে অন্য কৃষককে সেবা দিয়ে আয় করছেন। একজন কম্বাইন হার্ভেস্টার মালিক বছরে গড়ে ১৫০০-২০০০ বিঘা জমিতে সেবা দেন, আয় করতে পারেন ভালো।
তবে সমস্যা এখনো বহু। একটি কম্বাইন হার্ভেস্টারের দাম ২৫-৩০ লাখ টাকা, রাইস ট্রান্সপ্লান্টার ১২-১৫ লাখ। গড় জমি আয়তন মাত্র ০.৬ হেক্টর, ফলে বড় মেশিনের কার্যকারিতা কমে যায়। ৪০ শতাংশ কৃষক অভিযোগ করেছেন, স্থানীয় পর্যায়ে সেবা পাওয়া যায় না (বিআইডিএস সমীক্ষা, ২০২৩)। বর্তমানে দেশে প্রয়োজন প্রায় ৬০ হাজার প্রশিক্ষিত মেকানিক, আছে মাত্র ১৫ হাজার।
২০২০ সালের জাতীয় কৃষি যান্ত্রিকীকরণ নীতিতে বলা আছে, কৃষিকে দক্ষ, লাভজনক ও পরিবেশবান্ধব খাতে রূপান্তর করা হবে। কিন্তু মাঠে দেখা যায়, অনেক সময় ভর্তুকি বণ্টনে অস্বচ্ছতা, রাজনৈতিক প্রভাব এবং মনিটরিংয়ের ঘাটতি প্রকৃত কৃষককে বঞ্চিত করছে।
যান্ত্রিকীকরণ শুধু কৃষির পরিশ্রম কমাবে না, বরং ভবিষ্যৎ খাদ্যনিরাপত্তার ভিত্তি তৈরি করবে। এর জন্য প্রয়োজন হাওর, চর, পাহাড়ে আলাদা যন্ত্র ও কৌশল প্রয়োগ, কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটগুলোতে ‘অ্যাগ্রি-মেশিনারি টেকনিশিয়ান’ কোর্স বাধ্যতামূলক করা, যন্ত্রাংশ আমদানির ওপর নির্ভরতা কমাতে স্থানীয় কারখানা স্থাপন যেন বছরে ৫০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় সম্ভব হয়, যন্ত্র বিতরণে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং সেন্সর, ড্রোন ও ডেটাভিত্তিক যন্ত্র ব্যবস্থাপনা ধীরে ধীরে চালু করা।
বাংলাদেশের কৃষি এখন উৎপাদন থেকে দক্ষতায় উত্তরণের পথে। এ যাত্রায় যন্ত্রই হবে কৃষকের প্রধান সহযাত্রী। কিন্তু যন্ত্র যেন শুধু প্রদর্শনী না হয়, তা নিশ্চিত করতে হলে প্রয়োজন হবে নীতি, প্রশিক্ষণ, বাজার ও মনিটরিংয়ের সমন্বয়। যন্ত্রের শব্দ যেন কৃষকের ক্লান্তির নয়, আশার প্রতিধ্বনি হয়ে ওঠে। কারণ, কৃষকই জানেন, যন্ত্রের চেয়ে বড় জাদু তাঁর হাতে নেই, যদি তিনি সুযোগটা পান সঠিকভাবে।
সময়ের সঙ্গে পাল্টে চলেছে পৃথিবী। সেই সঙ্গে আধুনিক থেকে আধুনিকতর হচ্ছে বিশ্বের কৃষি ব্যবস্থাপনা ও উৎপাদন কৌশল। খাদ্যনিরাপত্তার প্রশ্নে প্রতিটি রাষ্ট্রই উদ্যোগী হচ্ছে স্মার্ট কৃষির বিকাশে। পরিবর্তিত কৃষি প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কৃষিকৌশল নিয়ে গবেষণা ও যান্ত্রিক উৎকর্ষে খুব দ্রুতই এগিয়ে যাচ্ছে উন্নত দেশগুলো। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার ও ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে কম লোকের অংশগ্রহণে স্বল্প সময়ে বেশি উৎপাদন নিশ্চিত করছে। সেখানে আমাদের মতো কৃষিপ্রধান দেশের অবস্থান নিয়ে ভাবনার অবকাশ রয়েছে। এই সময়ে বিশ্বের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যেতে না পারলে ভবিষ্যতের পথে পিছিয়ে থাকতে হবে অনেক দূর।
লেখক: পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, চ্যানেল আই

বাংলাদেশের কৃষি এখন এক সংকটময় সন্ধিক্ষণে। একদিকে বাড়ছে জনসংখ্যা, কমছে আবাদি জমি; অন্যদিকে কৃষিশ্রমিকের অভাব ভয়াবহ আকার নিয়েছে। স্বাধীনতার পর যেখানে মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৭৫ শতাংশ কৃষিনির্ভর ছিল, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপে দেখা যায়, ২০২২ সালে তা নেমে এসেছে প্রায় ৪৫ শতাংশে। এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে কৃষিতে কর্মরত মানুষের হার নেমে আসবে ২০ শতাংশে।
এমন পরিস্থিতিতে উৎপাদন বাড়ানোর একমাত্র টেকসই উপায় হলো কৃষি যান্ত্রিকীকরণ; যেখানে যন্ত্র শ্রমের বিকল্প হয়ে উঠছে, উৎপাদন ব্যয় কমাচ্ছে, আর কৃষককে বাজার প্রতিযোগিতায় টিকিয়ে রাখছে।
বাংলাদেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের সূচনা ষাটের দশকে, তখন হাতে আসে পাওয়ার টিলার ও সেচপাম্প। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে সরকারি উদ্যোগে ৪০ হাজার লো-লিফট পাম্প বিতরণ করা হয়। এরপর ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যার পর সরকার আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করলে বেসরকারি খাত যন্ত্র ব্যবসায় প্রবেশ করে। যান্ত্রিকীকরণের গতি তখন থেকে বাড়তে থাকে।
কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৯৫ শতাংশ জমি চাষ হয় পাওয়ার টিলারে, ৯৫ শতাংশ সেচ হয় মেশিনে এবং ৭০ শতাংশ ফসল মাড়াই যান্ত্রিকভাবে সম্পন্ন হয়। কিন্তু রোপণ ও কর্তনের ক্ষেত্রে এই অগ্রগতি এখনো সীমিত; রাইস ট্রান্সপ্লান্টার ব্যবহার মাত্র ১২.৪ শতাংশ এবং কম্বাইন হার্ভেস্টার ১৭.৩ শতাংশ কৃষকের মধ্যে সীমিত (বিআরআরআই ও ডিএই সমীক্ষা, ২০১৮)। যদিও এই তথ্য নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
২০১৯ সালে সরকার যান্ত্রিকীকরণে গতি আনতে ‘কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প (২০২০-২০২৫)’ হাতে নেয়। যার বাজেট ছিল ৩ হাজার কোটি টাকার ওপরে। প্রকল্পের তথ্যমতে, ৫১ প্রকার কৃষিযন্ত্রে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে পাহাড়ি ও চরাঞ্চলে এবং ৫০ শতাংশ ভর্তুকি অন্য এলাকায়। বিশেষত যে যন্ত্রগুলোতে ভর্তুকি দেওয়া হয়, সেসব যন্ত্র ক্ষুদ্র বা মাঝারি কৃষকের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। আমি বারবার বলে আসছিলাম, ক্ষুদ্র কৃষিযন্ত্রে ভর্তুকি না দিলে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ উদ্যোগটি সফল হবে না। মনে পড়ে, বরগুনায় মাঠে কাজ করার সময় কয়েকজন কৃষক বলছিলেন, যাঁরা কৃষিযন্ত্রের জন্য আবেদন করেছিলেন, তাঁদের কেউই কৃষিযন্ত্র পাননি। অথচ যিনি পেয়েছেন, তিনি কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত নন।
নেত্রকোনার হাওর এলাকায় কাজ করার সময় কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, হার্ভেস্টার দ্রুত সময়ে ফসল তোলার কাজে সহায়তা করেছে, ফলে পানি চলে আসার আগেই গত দুই বছর ফসল তুলতে পেরেছেন তাঁরা। তবে বড় অভিযোগ ছিল, একজনই পেয়েছেন একাধিক যন্ত্র। তবে আশার কথা, কৃষিযন্ত্রের ব্যবহারে হাওর অঞ্চলের মতো জায়গা থেকে অতিদ্রুত ধান কেটে নিতে পারায় ফসলকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করা যাচ্ছে।
যান্ত্রিকীকরণ যেমন শ্রমঘাটতি পূরণ করছে, উৎপাদন খরচও কমাচ্ছে। গবেষণা অনুযায়ী, পাওয়ার টিলারে জমি চাষ করলে সময় ৬০ শতাংশ কমে, কম্বাইন হার্ভেস্টারে ধান কাটা ও মাড়াই করলে খরচ ৩০-৪০ শতাংশ কমে, আর ক্ষতি (ধান চিটা যাওয়া ইত্যাদি) কমে ১০-১৫ শতাংশ থেকে ২-৩ শতাংশে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) তথ্য অনুযায়ী, এক বিঘা ধান কাটতে যেখানে শ্রমিক লাগে ১২-১৫ জন, কম্বাইন হার্ভেস্টার তা করে ফেলে মাত্র ২০-২৫ মিনিটে। অর্থাৎ এক মেশিন দিনে ২৫-৩০ বিঘা জমির কাজ শেষ করতে পারে, যা আগে লাগত তিন দিন এবং কমপক্ষে ৫০ শ্রমিক।
যান্ত্রিকীকরণ শুধু কৃষকের কাজ সহজ করছে না, নতুন গ্রামীণ উদ্যোক্তা শ্রেণিও তৈরি করছে। যাঁরা নিজের জমি না থাকলেও এখন যন্ত্র কিনে অন্য কৃষককে সেবা দিয়ে আয় করছেন। একজন কম্বাইন হার্ভেস্টার মালিক বছরে গড়ে ১৫০০-২০০০ বিঘা জমিতে সেবা দেন, আয় করতে পারেন ভালো।
তবে সমস্যা এখনো বহু। একটি কম্বাইন হার্ভেস্টারের দাম ২৫-৩০ লাখ টাকা, রাইস ট্রান্সপ্লান্টার ১২-১৫ লাখ। গড় জমি আয়তন মাত্র ০.৬ হেক্টর, ফলে বড় মেশিনের কার্যকারিতা কমে যায়। ৪০ শতাংশ কৃষক অভিযোগ করেছেন, স্থানীয় পর্যায়ে সেবা পাওয়া যায় না (বিআইডিএস সমীক্ষা, ২০২৩)। বর্তমানে দেশে প্রয়োজন প্রায় ৬০ হাজার প্রশিক্ষিত মেকানিক, আছে মাত্র ১৫ হাজার।
২০২০ সালের জাতীয় কৃষি যান্ত্রিকীকরণ নীতিতে বলা আছে, কৃষিকে দক্ষ, লাভজনক ও পরিবেশবান্ধব খাতে রূপান্তর করা হবে। কিন্তু মাঠে দেখা যায়, অনেক সময় ভর্তুকি বণ্টনে অস্বচ্ছতা, রাজনৈতিক প্রভাব এবং মনিটরিংয়ের ঘাটতি প্রকৃত কৃষককে বঞ্চিত করছে।
যান্ত্রিকীকরণ শুধু কৃষির পরিশ্রম কমাবে না, বরং ভবিষ্যৎ খাদ্যনিরাপত্তার ভিত্তি তৈরি করবে। এর জন্য প্রয়োজন হাওর, চর, পাহাড়ে আলাদা যন্ত্র ও কৌশল প্রয়োগ, কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটগুলোতে ‘অ্যাগ্রি-মেশিনারি টেকনিশিয়ান’ কোর্স বাধ্যতামূলক করা, যন্ত্রাংশ আমদানির ওপর নির্ভরতা কমাতে স্থানীয় কারখানা স্থাপন যেন বছরে ৫০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় সম্ভব হয়, যন্ত্র বিতরণে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং সেন্সর, ড্রোন ও ডেটাভিত্তিক যন্ত্র ব্যবস্থাপনা ধীরে ধীরে চালু করা।
বাংলাদেশের কৃষি এখন উৎপাদন থেকে দক্ষতায় উত্তরণের পথে। এ যাত্রায় যন্ত্রই হবে কৃষকের প্রধান সহযাত্রী। কিন্তু যন্ত্র যেন শুধু প্রদর্শনী না হয়, তা নিশ্চিত করতে হলে প্রয়োজন হবে নীতি, প্রশিক্ষণ, বাজার ও মনিটরিংয়ের সমন্বয়। যন্ত্রের শব্দ যেন কৃষকের ক্লান্তির নয়, আশার প্রতিধ্বনি হয়ে ওঠে। কারণ, কৃষকই জানেন, যন্ত্রের চেয়ে বড় জাদু তাঁর হাতে নেই, যদি তিনি সুযোগটা পান সঠিকভাবে।
সময়ের সঙ্গে পাল্টে চলেছে পৃথিবী। সেই সঙ্গে আধুনিক থেকে আধুনিকতর হচ্ছে বিশ্বের কৃষি ব্যবস্থাপনা ও উৎপাদন কৌশল। খাদ্যনিরাপত্তার প্রশ্নে প্রতিটি রাষ্ট্রই উদ্যোগী হচ্ছে স্মার্ট কৃষির বিকাশে। পরিবর্তিত কৃষি প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কৃষিকৌশল নিয়ে গবেষণা ও যান্ত্রিক উৎকর্ষে খুব দ্রুতই এগিয়ে যাচ্ছে উন্নত দেশগুলো। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার ও ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে কম লোকের অংশগ্রহণে স্বল্প সময়ে বেশি উৎপাদন নিশ্চিত করছে। সেখানে আমাদের মতো কৃষিপ্রধান দেশের অবস্থান নিয়ে ভাবনার অবকাশ রয়েছে। এই সময়ে বিশ্বের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যেতে না পারলে ভবিষ্যতের পথে পিছিয়ে থাকতে হবে অনেক দূর।
লেখক: পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, চ্যানেল আই

মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই দেশের স্বাস্থ্যখাত এবং ওষুধ নিয়ে নতুন ভাবনা শুরু হয়েছিল। বিশাল গ্রামবাংলায় কীভাবে স্বাস্থ্যসেবাকে সঠিকভাবে এগিয়ে নেওয়া যায় সেটা যুদ্ধোত্তর সমাজেরই একটা আকাঙ্খা ছিল। বিশেষ করে সেই সব চিকিৎসক এটা তীব্রভাবে ভাবতেন, যারা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ‘মুক্তি’ বিষয়টিকে এরা স্বাস্থ্য
১৩ এপ্রিল ২০২৩
গত এপ্রিলে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আউটলুক’-এর পূর্বাভাস জানিয়েছিল, এ বছর বাংলাদেশে নতুন করে আরও ৩০ লাখ মানুষ অতিদরিদ্র শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়বে এবং দারিদ্র্যের হার ২০ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ২১ দশমিক ২ শতাংশে।
৯ ঘণ্টা আগে
দেশে যখন জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে অস্থিরতা বিরাজ করছে, জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়ে নানা শঙ্কা তৈরি হয়েছে—এ রকম পরিস্থিতিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউজিসি কর্তৃক প্রস্তাবিত নতুন খসড়া নীতিমালা উচ্চশিক্ষার এ সেক্টরে একটা পরিবর্তনের আশাবাদ তৈরি করতে পারে।
৯ ঘণ্টা আগে
ত্রিমুখী সম্পর্ক নিয়ে অনেক মুভি হয়েছে। এ রকম মুভি দেখেননি, এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন। কেবল মুভিতেই কেন, বাস্তবেও ত্রিমুখী সম্পর্কের অনেক ঘটনা আমরা দেখে থাকি। সব ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ত্রিভুজ সম্পর্কের শেষ পরিণতি সাধারণত ভালো হয় না।
১ দিন আগেসম্পাদকীয়

দেশে যখন জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে অস্থিরতা বিরাজ করছে, জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়ে নানা শঙ্কা তৈরি হয়েছে—এ রকম পরিস্থিতিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউজিসি কর্তৃক প্রস্তাবিত নতুন খসড়া নীতিমালা উচ্চশিক্ষার এ সেক্টরে একটা পরিবর্তনের আশাবাদ তৈরি করতে পারে।
ইউজিসির প্রস্তাবে অনেক ভালো পরামর্শ আছে। কিন্তু বড় আশাবাদের জায়গা হলো, কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এখন আর ইচ্ছেমতো টিউশন ফি নির্ধারণ করতে পারবে না। আগের আইনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষ নিজে ফি নির্ধারণ করে ইউজিসির কাছ থেকে শুধু অনুমোদন নিত। এতে তারা ইচ্ছেমতো ফি নির্ধারণ করত। সেখানে শিক্ষার্থীদের সমস্যা-সংকট দেখা হতো না। কিন্তু এখন ইউজিসিই ফি নির্ধারণ করে দেবে আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তা মানতে বাধ্য থাকবে। না মানলে জরিমানার মধ্যে পড়তে হবে।
আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা ব্যাপক বৃদ্ধির প্রয়োজন থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা পাওয়া শুরু হয়। এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় কাছাকাছি সংখ্যায় চলে গেছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। একসময় শুধু আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান পরিবারের সন্তানেরা এসব জায়গায় পড়ার সুযোগ পেত। কিন্তু এখন নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানেরাও এখানে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। বিশেষ করে দরিদ্র হলেও শুধু মেধার কারণে তারা সে সুযোগ পাচ্ছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু ধনীর সন্তানেরা পড়ার সুযোগ পায়—আগের সেই ধারণার পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু সেই সুযোগের জায়গাটা এখনো অবারিত হয়নি। কারণ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে এখনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশনসহ নানা বাড়তি ফির কারণে নিম্নবিত্ত বা দরিদ্র ঘরের সন্তানেরা সেখানে অধ্যয়ন করার কথা কল্পনাও করতে পারে না।
একসময় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ ছিল, এখানে টাকার বিনিময়ে সনদ বিক্রি করা হয়। আদতে কথাটি এখন আর প্রযোজ্য নয়। কারণ, দেশের অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গুণ, মান ও গবেষণায় এগিয়ে আছে। দেশ এবং দেশের বাইরের নানা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা থেকে সেটা জানা যায়।
এদের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ হলো, এখানে শুধু প্রাতিষ্ঠানিক বা বিষয়ওয়ারি বিষয়েই দক্ষ করে তোলা হয়। সেখানে মুক্তবুদ্ধি বা রাজনীতিচর্চার সুযোগ নেই। একই সঙ্গে শুধু ক্যারিয়ারিস্ট হিসেবে গড়ে তোলা হয়। ফলে এখানকার শিক্ষার্থীরা ফার্মের মুরগির মতো করে গড়ে ওঠে। সমাজ, মানুষ ও রাষ্ট্র নিয়ে তারা ভাবে না। কিন্তু কথাটি যে ঠিক নয়, ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণই সেটা প্রমাণ করে দিয়েছে।
আমাদের দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক ভালো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় অনেক ক্ষেত্রে ভালো কিছু আর আলোর মুখ দেখে না। নিয়ম অনুযায়ী, ইউজিসির এই খসড়া প্রস্তাব আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যাবে, তারপর মন্ত্রণালয় সেটা অনুমোদন দেবে। আমরা চাই, ইউজিসির এই প্রস্তাবটি বড় বেশি সংশোধিত না হয়ে পাস করা হোক। তাতে শিক্ষাব্যবস্থায় একটা নতুন ধারা তৈরি হতে পারে।

দেশে যখন জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে অস্থিরতা বিরাজ করছে, জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়ে নানা শঙ্কা তৈরি হয়েছে—এ রকম পরিস্থিতিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউজিসি কর্তৃক প্রস্তাবিত নতুন খসড়া নীতিমালা উচ্চশিক্ষার এ সেক্টরে একটা পরিবর্তনের আশাবাদ তৈরি করতে পারে।
ইউজিসির প্রস্তাবে অনেক ভালো পরামর্শ আছে। কিন্তু বড় আশাবাদের জায়গা হলো, কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এখন আর ইচ্ছেমতো টিউশন ফি নির্ধারণ করতে পারবে না। আগের আইনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষ নিজে ফি নির্ধারণ করে ইউজিসির কাছ থেকে শুধু অনুমোদন নিত। এতে তারা ইচ্ছেমতো ফি নির্ধারণ করত। সেখানে শিক্ষার্থীদের সমস্যা-সংকট দেখা হতো না। কিন্তু এখন ইউজিসিই ফি নির্ধারণ করে দেবে আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তা মানতে বাধ্য থাকবে। না মানলে জরিমানার মধ্যে পড়তে হবে।
আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা ব্যাপক বৃদ্ধির প্রয়োজন থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা পাওয়া শুরু হয়। এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় কাছাকাছি সংখ্যায় চলে গেছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। একসময় শুধু আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান পরিবারের সন্তানেরা এসব জায়গায় পড়ার সুযোগ পেত। কিন্তু এখন নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানেরাও এখানে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। বিশেষ করে দরিদ্র হলেও শুধু মেধার কারণে তারা সে সুযোগ পাচ্ছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু ধনীর সন্তানেরা পড়ার সুযোগ পায়—আগের সেই ধারণার পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু সেই সুযোগের জায়গাটা এখনো অবারিত হয়নি। কারণ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে এখনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশনসহ নানা বাড়তি ফির কারণে নিম্নবিত্ত বা দরিদ্র ঘরের সন্তানেরা সেখানে অধ্যয়ন করার কথা কল্পনাও করতে পারে না।
একসময় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ ছিল, এখানে টাকার বিনিময়ে সনদ বিক্রি করা হয়। আদতে কথাটি এখন আর প্রযোজ্য নয়। কারণ, দেশের অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গুণ, মান ও গবেষণায় এগিয়ে আছে। দেশ এবং দেশের বাইরের নানা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা থেকে সেটা জানা যায়।
এদের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ হলো, এখানে শুধু প্রাতিষ্ঠানিক বা বিষয়ওয়ারি বিষয়েই দক্ষ করে তোলা হয়। সেখানে মুক্তবুদ্ধি বা রাজনীতিচর্চার সুযোগ নেই। একই সঙ্গে শুধু ক্যারিয়ারিস্ট হিসেবে গড়ে তোলা হয়। ফলে এখানকার শিক্ষার্থীরা ফার্মের মুরগির মতো করে গড়ে ওঠে। সমাজ, মানুষ ও রাষ্ট্র নিয়ে তারা ভাবে না। কিন্তু কথাটি যে ঠিক নয়, ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণই সেটা প্রমাণ করে দিয়েছে।
আমাদের দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক ভালো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় অনেক ক্ষেত্রে ভালো কিছু আর আলোর মুখ দেখে না। নিয়ম অনুযায়ী, ইউজিসির এই খসড়া প্রস্তাব আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যাবে, তারপর মন্ত্রণালয় সেটা অনুমোদন দেবে। আমরা চাই, ইউজিসির এই প্রস্তাবটি বড় বেশি সংশোধিত না হয়ে পাস করা হোক। তাতে শিক্ষাব্যবস্থায় একটা নতুন ধারা তৈরি হতে পারে।

মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই দেশের স্বাস্থ্যখাত এবং ওষুধ নিয়ে নতুন ভাবনা শুরু হয়েছিল। বিশাল গ্রামবাংলায় কীভাবে স্বাস্থ্যসেবাকে সঠিকভাবে এগিয়ে নেওয়া যায় সেটা যুদ্ধোত্তর সমাজেরই একটা আকাঙ্খা ছিল। বিশেষ করে সেই সব চিকিৎসক এটা তীব্রভাবে ভাবতেন, যারা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ‘মুক্তি’ বিষয়টিকে এরা স্বাস্থ্য
১৩ এপ্রিল ২০২৩
গত এপ্রিলে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আউটলুক’-এর পূর্বাভাস জানিয়েছিল, এ বছর বাংলাদেশে নতুন করে আরও ৩০ লাখ মানুষ অতিদরিদ্র শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়বে এবং দারিদ্র্যের হার ২০ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ২১ দশমিক ২ শতাংশে।
৯ ঘণ্টা আগে
বাংলাদেশের কৃষি এখন এক সংকটময় সন্ধিক্ষণে। একদিকে বাড়ছে জনসংখ্যা, কমছে আবাদি জমি; অন্যদিকে কৃষিশ্রমিকের অভাব ভয়াবহ আকার নিয়েছে। স্বাধীনতার পর যেখানে মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৭৫ শতাংশ কৃষিনির্ভর ছিল, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপে দেখা যায়, ২০২২ সালে তা নেমে এসেছে প্রায় ৪৫ শতাংশে।
৯ ঘণ্টা আগে
ত্রিমুখী সম্পর্ক নিয়ে অনেক মুভি হয়েছে। এ রকম মুভি দেখেননি, এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন। কেবল মুভিতেই কেন, বাস্তবেও ত্রিমুখী সম্পর্কের অনেক ঘটনা আমরা দেখে থাকি। সব ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ত্রিভুজ সম্পর্কের শেষ পরিণতি সাধারণত ভালো হয় না।
১ দিন আগেমাসুদ কামাল

ত্রিমুখী সম্পর্ক নিয়ে অনেক মুভি হয়েছে। এ রকম মুভি দেখেননি, এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন। কেবল মুভিতেই কেন, বাস্তবেও ত্রিমুখী সম্পর্কের অনেক ঘটনা আমরা দেখে থাকি। সব ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ত্রিভুজ সম্পর্কের শেষ পরিণতি সাধারণত ভালো হয় না।
গত বছরের এ সময়ে আমাদের রাজনীতিতে খুব শক্ত একটা ত্রিভুজ সম্পর্ক দেখা গিয়েছিল। বিএনপি-অন্তর্বর্তী সরকার-জামায়াত—এই তিন পক্ষের দহরম-মহরম। তাদের সবারই লক্ষ্য তখন ছিল রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করা। এর প্রাথমিক ধাপ, কদিন আগে অর্থাৎ ২০২৪-এর অক্টোবরে অর্জিত হয়েছে। সে দিন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে এই সরকার একটা নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ করেছে। এরপর বাকি ছিল মূল দল আওয়ামী লীগকে অকার্যকর ও অপ্রাসঙ্গিক করা। গত বছরের এ সময়ে সেই চেষ্টা আমরা দেখেছি। প্রশাসনিকভাবে যেমন, ঠিক তেমনি সামাজিকভাবেও স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিস্ট দল হিসেবে আওয়ামী লীগবিরোধী প্রচারণা বেশ জোরেশোরেই চলছিল। এ কাজে বিএনপি, জামায়াত, সরকার—সবাই বেশ আন্তরিকও ছিল। সে সময়ে মাঠের শক্তি হিসেবে বেশ বড় একটা ভূমিকা রেখেছে এনসিপি বা জাতীয় নাগরিক পার্টি। তারপর মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে যখন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলো, আমার বিবেচনায় ত্রিভুজ দহরম-মহরমের সেটাই ছিল পিক-টাইম। এর পর থেকে নিজ নিজ স্বার্থ নিয়ে ধীরে ধীরে সবাই মাঠে নেমে পড়ল। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকল দূরত্ব।
মে মাসের ১২ তারিখে আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলো, তার মাসখানেক পর জুনের ১৫ তারিখে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস লন্ডনে গিয়ে বৈঠক করলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে। বলতে গেলে ওই বৈঠকটাই যেন সম্পর্কে ভাঙনের ক্ষেত্রে একটা প্রকাশ্য কারণ হতে পারল। জামায়াত অভিযোগ তুলল সরকারের প্রতি—বলল, বিএনপির প্রতি পক্ষপাতিত্ব করছে সরকার। অভিযোগের পেছনের কারণটিও তারা প্রকাশ করল। বলল, ওই বৈঠকের পরই নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় হিসেবে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধের কথাটি বলা হয়েছে। একটিমাত্র দলের শীর্ষ নেতার সঙ্গে কথার পরিপ্রেক্ষিতে যদি নির্বাচনের সময় নির্ধারিত হয়, তাহলে সেই দলের প্রতি সরকারের পক্ষপাতের বিষয়টি অস্বীকার করা তো সহজ হয় না।
জুনের পর থেকে যত দিন যেতে থাকল, সাধারণ মানুষের কাছেও বিএনপি-জামায়াতের মুখোমুখি অবস্থানটা পরিষ্কার হতে থাকল। ঐকমত্য কমিশনেও দেখা গেল দুই দলের এই বিরোধের প্রকাশ। সংস্কারের অনেক প্রস্তাবেই বিএনপি-জামায়াতকে পরস্পরবিরোধী অবস্থানে দেখা গেল। বিএনপির পক্ষ থেকে একের পর এক আসতে থাকল নোট অব ডিসেন্ট বা আপত্তি। এরপর আবার বিপত্তি দেখা গেল জুলাই সনদ বাস্তবায়নে যে ‘গণভোট’ করার কথা বলা হচ্ছে, সেটি অনুষ্ঠানের তারিখ নিয়ে। বিএনপি বলল, নির্বাচনের দিনই হোক গণভোট, বিপরীতে জামায়াত বলছে—নির্বাচনের আগে, সম্ভব হলে এই নভেম্বরেই গণভোট হতে হবে। গণভোটের রায় নিয়ে, সেটার ওপর ভিত্তি করেই হবে নির্বাচন। আবার জুলাই সনদ বাস্তবায়নের যে আদেশ, তার খসড়া নিয়েও বড় ধরনের আপত্তি তুলল বিএনপি। আপত্তির মাত্রাটা এতটাই প্রবল যে, তারা বলল—জুলাই সনদ নিয়ে ঐকমত্য কমিশন তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। খেলায় যে রেফারির ওপর সব পক্ষ ভরসা রাখে, সে রেফারিই এবার গোল দিয়ে বসে আছে। অর্থাৎ চরম পক্ষপাতের অভিযোগ। যে কমিশনের প্রধান হচ্ছেন খোদ সরকারপ্রধান ড. ইউনূস, তাঁরই বিরুদ্ধে পক্ষপাত ও প্রতারণার অভিযোগ! বিষয়টি কিন্তু এরপর আর হালকা থাকল না।
তাহলে এখন কী হবে? গণভোট কবে হবে? গণভোটে জনগণের সামনে প্রশ্ন কী থাকবে? এসব প্রশ্নের সমাধান কে দেবে? ঐকমত্য কমিশনের প্রধান ও সক্রিয় দুই ব্যক্তি ড. আলী রীয়াজ ও মনির হায়দার এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছেন। তড়িঘড়ি করে তাঁদের এই চলে যাওয়া নিয়েও নানা ধরনের সন্দেহ উচ্চারিত হতে থাকল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই দুজনকে নিয়ে দেখা গেল নানা ধরনের ট্রল। সমাধানের পথ হিসেবে বলা হলো, সরকারপ্রধান ড. ইউনূস এর সমাধান করবেন। এ প্রবণতা আমরা আগের সরকারের আমলেও দেখেছি। সবকিছুই যেন শেখ হাসিনা করতেন। যত সাফল্য, সব তাঁর। মন্ত্রীদের কিছু জিজ্ঞাসা করা হলে বলতেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় এ সাফল্য এসেছে।’ আবার যদি কোনো জটিলতা দেখা দিত, সবাই মিলে মিটিং করে শেষে সিদ্ধান্ত হতো ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’ এর সমাধান দেবেন। দল, অঙ্গসংগঠন, কিংবা ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের কোনো কমিটি করতে হবে—অবধারিতভাবেই দায়িত্ব চলে যাবে ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর’ কাছে। এভাবেই একজন ব্যক্তি স্বৈরাচারী হয়ে ওঠেন। একপর্যায়ে তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেন, তিনি ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত কেউ নিতে পারে না। সব কাজ তাঁকেই করতে হয়। তিনি আসলে অন্যদের মতো নয়, তিনি অনেকটা মহাপুরুষের মতো। আমার মতে, এই স্বৈরাচারী মনোভাবের শুরুটা হয় আশপাশে থাকা মোসাহেবদের কারণেই। এবারও তা-ই হয়েছে, মোসাহেবরা বলতে শুরু করেছেন—ড. ইউনূসই দেবেন শেষ সিদ্ধান্ত!
সরকার অবশ্য অদ্ভুত একটা কাজ করেছে। যখন তাদের ওপর দায়িত্ব এল সংকট নিরসনের, তারা একটা বৈঠক করল, আর বলে দিল—সাত দিনের সময় দেওয়া হলো, এর মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের বসে সমস্যার নিরসন করতে হবে। যে বিরোধের নিরসন টানা আট মাস রাজনৈতিক দলগুলো একসঙ্গে বসে সমাধান করতে পারেনি, সেটা সাত দিনে কীভাবে সম্ভব হবে? তা ছাড়া আরেকটি কথাও উচ্চারিত হচ্ছে। জুলাই সনদ নিয়ে এই বিরোধ, বাস্তবায়ন প্রস্তাবে নোট অব ডিসেন্টগুলোকে না রাখা, এটা আসলে কার দায়? এ অপকর্মটি করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। যে কমিশনের প্রধান আবার ড. ইউনূস নিজে। তাহলে যে ক্রাইসিস সৃষ্টি করেছে ড. ইউনূসের কমিশন, সেটির সমাধানের দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর দেওয়া কেন? এদিকে আবার সেই সাত দিনও শেষ হয়ে গেছে গতকাল রোববার। কোনো সমাধান কি হয়েছে? এখন কী হবে? যথারীতি সেই একই কথা বলা হচ্ছে—ড. ইউনূসই দেবেন সমাধান। কিন্তু কীভাবে? তিনি কি খুব বড় রাজনীতিবিদ? আবার যদি ড. ইউনূস কিংবা তাঁর পরিষদ যদি কোনো একটা সিদ্ধান্ত দেয়, তাহলে সেটাকে কি আর ঐকমত্যের সিদ্ধান্ত বলা যাবে? এটা তো তাঁর সরকারের সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে। সরকারই যদি সিদ্ধান্ত দেবে, তাহলে আর সংস্কার কমিশনের নামে এত নাটকের কী প্রয়োজন ছিল? এত সময়ক্ষেপণই বা কেন করা হলো?
এতসব প্রশ্নের জবাব আসলে কে দেবে, কী দেবে, কেউ জানে না। হয়তো জবাব কখনোই পাওয়া যাবে না। তবে বিএনপি কিন্তু এরই মধ্যে সরকারের দিকে আঙুল তুলতে শুরু করেছে। এর মধ্যে গত শনিবার দেখলাম বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ সরাসরি সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে বললেন—এভাবে সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়ার কোনো এখতিয়ার এই সরকারের নেই। এই সরকার যে কোনো নির্বাচিত সরকার নয়, এটাও তিনি তাদের স্মরণে রাখতে বলেছেন। জামায়াতে ইসলামী আবার এ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। তারা এরই মধ্যে আট দলের একটা জোট বানিয়ে নিয়েছে। এই আট দলকে নিয়ে রাস্তায়ও নেমে গেছে পাঁচ দফা দাবি আদায়ে। তাদের এক শীর্ষস্থানীয় নেতা প্রকাশ্যে বলেছেন—ঘি তাদের চাই। আর এই ঘি পেতে যদি আঙুল বাঁকা করতে হয়, তারা সেটাই করবে। এ বক্তব্য কি কেবলই রেটরিক, নাকি এর মধ্যে প্রচ্ছন্ন কোনো হুমকি আছে; সেটাও কিন্তু চিন্তার বিষয়। এসবের বিপরীতে বিএনপিও বসে নেই। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী শনিবার এক জায়গায় বললেন, বিএনপির মতো বড় দলের কর্মীরা যদি রাস্তায় নামে, তাহলে সংঘাত হতে পারে।
এ রকম পরিস্থিতিতে জনগণের অবস্থান কোথায়? আমরা এখন বসে আছি ক্লাইমেক্সের অপেক্ষায়! এরই মধ্যে পরস্পরের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ আমরা দেখতে পাচ্ছি।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

ত্রিমুখী সম্পর্ক নিয়ে অনেক মুভি হয়েছে। এ রকম মুভি দেখেননি, এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন। কেবল মুভিতেই কেন, বাস্তবেও ত্রিমুখী সম্পর্কের অনেক ঘটনা আমরা দেখে থাকি। সব ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ত্রিভুজ সম্পর্কের শেষ পরিণতি সাধারণত ভালো হয় না।
গত বছরের এ সময়ে আমাদের রাজনীতিতে খুব শক্ত একটা ত্রিভুজ সম্পর্ক দেখা গিয়েছিল। বিএনপি-অন্তর্বর্তী সরকার-জামায়াত—এই তিন পক্ষের দহরম-মহরম। তাদের সবারই লক্ষ্য তখন ছিল রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করা। এর প্রাথমিক ধাপ, কদিন আগে অর্থাৎ ২০২৪-এর অক্টোবরে অর্জিত হয়েছে। সে দিন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে এই সরকার একটা নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ করেছে। এরপর বাকি ছিল মূল দল আওয়ামী লীগকে অকার্যকর ও অপ্রাসঙ্গিক করা। গত বছরের এ সময়ে সেই চেষ্টা আমরা দেখেছি। প্রশাসনিকভাবে যেমন, ঠিক তেমনি সামাজিকভাবেও স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিস্ট দল হিসেবে আওয়ামী লীগবিরোধী প্রচারণা বেশ জোরেশোরেই চলছিল। এ কাজে বিএনপি, জামায়াত, সরকার—সবাই বেশ আন্তরিকও ছিল। সে সময়ে মাঠের শক্তি হিসেবে বেশ বড় একটা ভূমিকা রেখেছে এনসিপি বা জাতীয় নাগরিক পার্টি। তারপর মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে যখন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলো, আমার বিবেচনায় ত্রিভুজ দহরম-মহরমের সেটাই ছিল পিক-টাইম। এর পর থেকে নিজ নিজ স্বার্থ নিয়ে ধীরে ধীরে সবাই মাঠে নেমে পড়ল। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকল দূরত্ব।
মে মাসের ১২ তারিখে আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলো, তার মাসখানেক পর জুনের ১৫ তারিখে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস লন্ডনে গিয়ে বৈঠক করলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে। বলতে গেলে ওই বৈঠকটাই যেন সম্পর্কে ভাঙনের ক্ষেত্রে একটা প্রকাশ্য কারণ হতে পারল। জামায়াত অভিযোগ তুলল সরকারের প্রতি—বলল, বিএনপির প্রতি পক্ষপাতিত্ব করছে সরকার। অভিযোগের পেছনের কারণটিও তারা প্রকাশ করল। বলল, ওই বৈঠকের পরই নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় হিসেবে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধের কথাটি বলা হয়েছে। একটিমাত্র দলের শীর্ষ নেতার সঙ্গে কথার পরিপ্রেক্ষিতে যদি নির্বাচনের সময় নির্ধারিত হয়, তাহলে সেই দলের প্রতি সরকারের পক্ষপাতের বিষয়টি অস্বীকার করা তো সহজ হয় না।
জুনের পর থেকে যত দিন যেতে থাকল, সাধারণ মানুষের কাছেও বিএনপি-জামায়াতের মুখোমুখি অবস্থানটা পরিষ্কার হতে থাকল। ঐকমত্য কমিশনেও দেখা গেল দুই দলের এই বিরোধের প্রকাশ। সংস্কারের অনেক প্রস্তাবেই বিএনপি-জামায়াতকে পরস্পরবিরোধী অবস্থানে দেখা গেল। বিএনপির পক্ষ থেকে একের পর এক আসতে থাকল নোট অব ডিসেন্ট বা আপত্তি। এরপর আবার বিপত্তি দেখা গেল জুলাই সনদ বাস্তবায়নে যে ‘গণভোট’ করার কথা বলা হচ্ছে, সেটি অনুষ্ঠানের তারিখ নিয়ে। বিএনপি বলল, নির্বাচনের দিনই হোক গণভোট, বিপরীতে জামায়াত বলছে—নির্বাচনের আগে, সম্ভব হলে এই নভেম্বরেই গণভোট হতে হবে। গণভোটের রায় নিয়ে, সেটার ওপর ভিত্তি করেই হবে নির্বাচন। আবার জুলাই সনদ বাস্তবায়নের যে আদেশ, তার খসড়া নিয়েও বড় ধরনের আপত্তি তুলল বিএনপি। আপত্তির মাত্রাটা এতটাই প্রবল যে, তারা বলল—জুলাই সনদ নিয়ে ঐকমত্য কমিশন তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। খেলায় যে রেফারির ওপর সব পক্ষ ভরসা রাখে, সে রেফারিই এবার গোল দিয়ে বসে আছে। অর্থাৎ চরম পক্ষপাতের অভিযোগ। যে কমিশনের প্রধান হচ্ছেন খোদ সরকারপ্রধান ড. ইউনূস, তাঁরই বিরুদ্ধে পক্ষপাত ও প্রতারণার অভিযোগ! বিষয়টি কিন্তু এরপর আর হালকা থাকল না।
তাহলে এখন কী হবে? গণভোট কবে হবে? গণভোটে জনগণের সামনে প্রশ্ন কী থাকবে? এসব প্রশ্নের সমাধান কে দেবে? ঐকমত্য কমিশনের প্রধান ও সক্রিয় দুই ব্যক্তি ড. আলী রীয়াজ ও মনির হায়দার এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছেন। তড়িঘড়ি করে তাঁদের এই চলে যাওয়া নিয়েও নানা ধরনের সন্দেহ উচ্চারিত হতে থাকল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই দুজনকে নিয়ে দেখা গেল নানা ধরনের ট্রল। সমাধানের পথ হিসেবে বলা হলো, সরকারপ্রধান ড. ইউনূস এর সমাধান করবেন। এ প্রবণতা আমরা আগের সরকারের আমলেও দেখেছি। সবকিছুই যেন শেখ হাসিনা করতেন। যত সাফল্য, সব তাঁর। মন্ত্রীদের কিছু জিজ্ঞাসা করা হলে বলতেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় এ সাফল্য এসেছে।’ আবার যদি কোনো জটিলতা দেখা দিত, সবাই মিলে মিটিং করে শেষে সিদ্ধান্ত হতো ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’ এর সমাধান দেবেন। দল, অঙ্গসংগঠন, কিংবা ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের কোনো কমিটি করতে হবে—অবধারিতভাবেই দায়িত্ব চলে যাবে ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর’ কাছে। এভাবেই একজন ব্যক্তি স্বৈরাচারী হয়ে ওঠেন। একপর্যায়ে তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেন, তিনি ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত কেউ নিতে পারে না। সব কাজ তাঁকেই করতে হয়। তিনি আসলে অন্যদের মতো নয়, তিনি অনেকটা মহাপুরুষের মতো। আমার মতে, এই স্বৈরাচারী মনোভাবের শুরুটা হয় আশপাশে থাকা মোসাহেবদের কারণেই। এবারও তা-ই হয়েছে, মোসাহেবরা বলতে শুরু করেছেন—ড. ইউনূসই দেবেন শেষ সিদ্ধান্ত!
সরকার অবশ্য অদ্ভুত একটা কাজ করেছে। যখন তাদের ওপর দায়িত্ব এল সংকট নিরসনের, তারা একটা বৈঠক করল, আর বলে দিল—সাত দিনের সময় দেওয়া হলো, এর মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের বসে সমস্যার নিরসন করতে হবে। যে বিরোধের নিরসন টানা আট মাস রাজনৈতিক দলগুলো একসঙ্গে বসে সমাধান করতে পারেনি, সেটা সাত দিনে কীভাবে সম্ভব হবে? তা ছাড়া আরেকটি কথাও উচ্চারিত হচ্ছে। জুলাই সনদ নিয়ে এই বিরোধ, বাস্তবায়ন প্রস্তাবে নোট অব ডিসেন্টগুলোকে না রাখা, এটা আসলে কার দায়? এ অপকর্মটি করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। যে কমিশনের প্রধান আবার ড. ইউনূস নিজে। তাহলে যে ক্রাইসিস সৃষ্টি করেছে ড. ইউনূসের কমিশন, সেটির সমাধানের দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর দেওয়া কেন? এদিকে আবার সেই সাত দিনও শেষ হয়ে গেছে গতকাল রোববার। কোনো সমাধান কি হয়েছে? এখন কী হবে? যথারীতি সেই একই কথা বলা হচ্ছে—ড. ইউনূসই দেবেন সমাধান। কিন্তু কীভাবে? তিনি কি খুব বড় রাজনীতিবিদ? আবার যদি ড. ইউনূস কিংবা তাঁর পরিষদ যদি কোনো একটা সিদ্ধান্ত দেয়, তাহলে সেটাকে কি আর ঐকমত্যের সিদ্ধান্ত বলা যাবে? এটা তো তাঁর সরকারের সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে। সরকারই যদি সিদ্ধান্ত দেবে, তাহলে আর সংস্কার কমিশনের নামে এত নাটকের কী প্রয়োজন ছিল? এত সময়ক্ষেপণই বা কেন করা হলো?
এতসব প্রশ্নের জবাব আসলে কে দেবে, কী দেবে, কেউ জানে না। হয়তো জবাব কখনোই পাওয়া যাবে না। তবে বিএনপি কিন্তু এরই মধ্যে সরকারের দিকে আঙুল তুলতে শুরু করেছে। এর মধ্যে গত শনিবার দেখলাম বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ সরাসরি সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে বললেন—এভাবে সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়ার কোনো এখতিয়ার এই সরকারের নেই। এই সরকার যে কোনো নির্বাচিত সরকার নয়, এটাও তিনি তাদের স্মরণে রাখতে বলেছেন। জামায়াতে ইসলামী আবার এ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। তারা এরই মধ্যে আট দলের একটা জোট বানিয়ে নিয়েছে। এই আট দলকে নিয়ে রাস্তায়ও নেমে গেছে পাঁচ দফা দাবি আদায়ে। তাদের এক শীর্ষস্থানীয় নেতা প্রকাশ্যে বলেছেন—ঘি তাদের চাই। আর এই ঘি পেতে যদি আঙুল বাঁকা করতে হয়, তারা সেটাই করবে। এ বক্তব্য কি কেবলই রেটরিক, নাকি এর মধ্যে প্রচ্ছন্ন কোনো হুমকি আছে; সেটাও কিন্তু চিন্তার বিষয়। এসবের বিপরীতে বিএনপিও বসে নেই। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী শনিবার এক জায়গায় বললেন, বিএনপির মতো বড় দলের কর্মীরা যদি রাস্তায় নামে, তাহলে সংঘাত হতে পারে।
এ রকম পরিস্থিতিতে জনগণের অবস্থান কোথায়? আমরা এখন বসে আছি ক্লাইমেক্সের অপেক্ষায়! এরই মধ্যে পরস্পরের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ আমরা দেখতে পাচ্ছি।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই দেশের স্বাস্থ্যখাত এবং ওষুধ নিয়ে নতুন ভাবনা শুরু হয়েছিল। বিশাল গ্রামবাংলায় কীভাবে স্বাস্থ্যসেবাকে সঠিকভাবে এগিয়ে নেওয়া যায় সেটা যুদ্ধোত্তর সমাজেরই একটা আকাঙ্খা ছিল। বিশেষ করে সেই সব চিকিৎসক এটা তীব্রভাবে ভাবতেন, যারা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ‘মুক্তি’ বিষয়টিকে এরা স্বাস্থ্য
১৩ এপ্রিল ২০২৩
গত এপ্রিলে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আউটলুক’-এর পূর্বাভাস জানিয়েছিল, এ বছর বাংলাদেশে নতুন করে আরও ৩০ লাখ মানুষ অতিদরিদ্র শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়বে এবং দারিদ্র্যের হার ২০ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ২১ দশমিক ২ শতাংশে।
৯ ঘণ্টা আগে
বাংলাদেশের কৃষি এখন এক সংকটময় সন্ধিক্ষণে। একদিকে বাড়ছে জনসংখ্যা, কমছে আবাদি জমি; অন্যদিকে কৃষিশ্রমিকের অভাব ভয়াবহ আকার নিয়েছে। স্বাধীনতার পর যেখানে মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৭৫ শতাংশ কৃষিনির্ভর ছিল, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপে দেখা যায়, ২০২২ সালে তা নেমে এসেছে প্রায় ৪৫ শতাংশে।
৯ ঘণ্টা আগে
দেশে যখন জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে অস্থিরতা বিরাজ করছে, জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়ে নানা শঙ্কা তৈরি হয়েছে—এ রকম পরিস্থিতিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউজিসি কর্তৃক প্রস্তাবিত নতুন খসড়া নীতিমালা উচ্চশিক্ষার এ সেক্টরে একটা পরিবর্তনের আশাবাদ তৈরি করতে পারে।
৯ ঘণ্টা আগে