Ajker Patrika

প্রকৃত বিপ্লবকে প্রতিহত করাই ছিল অভিপ্রায়

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
আপডেট : ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮: ৪৪
প্রকৃত বিপ্লবকে প্রতিহত করাই ছিল অভিপ্রায়

পুঁজিবাদের দুঃশাসনের কালে পাকিস্তানের অবস্থা তো দেখা যাচ্ছে আরও করুণ। ইমরান খান পদচ্যুত হয়েছেন, ‘দুর্নীতিতে দক্ষ’ প্রমাণিত হওয়ায়। তাঁর জায়গায় এসেছেন পুরোনো মুসলিম লীগের পুরোনো নেতা শাহবাজ শরিফ; কিন্তু তাঁকে তো শুনলাম আদালত তলব করেছেন অর্থ পাচারের মামলায়। তাঁর ছেলেকেও। ওদিকে ইমরান খানের দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ, বিদেশ থেকে মোটা মোটা অঙ্কের অর্থ গ্রহণের। অভিযোগ অন্য কেউ আনেনি; এনেছে দেশটির নির্বাচন কমিশনই।

গরিব বাংলাদেশের কত টাকা যে বিদেশে গেছে পাচার হয়ে, তার হিসাব তো মনে হয় কোনো দিনই পাওয়া যাবে না। টাকা পাচার হয়ে নানা জায়গায় যায়। একটা অংশ নাকি নিশ্চিন্তে জমা থাকে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে। এই ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক ওই দেশটির ব্যাংকগুলো বেশ নিরাপদ। সেখানে কপালদার বাংলাদেশি ব্যক্তিদের জমা নাকি বাড়ছেই। ওরা কারা তা জানা যায় না। তবে বাংলাদেশে কর্মরত সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত একটি তথ্য ফাঁস করে দিয়েছিলেন। সেটা হলো, আমানতকারীদের বিষয়ে তথ্য দেওয়া হবে কি, ঠিকমতো তো চাওয়াই হয় না। ওদিকে এটা তো অনুমান না করে উপায়ই নেই যে বাংলাদেশের বড় বড় প্রজেক্টে বড় বড় মানুষের বড় বড় অঙ্কের অর্থলাভ ঘটে। ভর্তির জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরীক্ষা হয় এবং প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটে। টাকাই ঘটায় যা ঘটাবার। প্রশ্নপত্র ফাঁসের ক্ষেত্রে নাকি ‘হাজার কোটি’ টাকার লেনদেন ঘটে থাকে। ভর্তির চেয়েও বড় বাণিজ্য চাকরির, সে বাণিজ্য তো ক্রমাগত নিজেই নিজেকে অতিক্রম করে চলেছে।

সবকিছুই কিন্তু ঘটছে রাষ্ট্রের অধীনে। রাষ্ট্র অঙ্গীকার করেছে দুর্নীতি দমন করবে। দমনের জন্য বিস্তর ব্যবস্থা আছে। আইন আছে, আদালত রয়েছে; রয়েছে দুর্নীতি দমনের স্বাধীন কমিশন; কাজ করছেন গোয়েন্দারা, তৎপর রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার বিভিন্ন বাহিনী, গণমাধ্যমও উন্মুখ থাকে দুর্নীতির কাহিনি উন্মোচনের জন্য এবং উন্মোচন যে ঘটে না এমনও নয়; চমকপ্রদ খবরগুলো তো গণমাধ্যমের কল্যাণেই আমরা পেয়ে থাকি। কিন্তু দুর্নীতি কমে না, বরং বাড়তেই থাকে; বিদেশিরা বলে যতই ডাকাডাকি করো না কেন, বিনিয়োগে যাচ্ছি না। কারণ তোমাদের দেশের দুর্নীতি বিনিয়োগে পদে পদে বাধা দেবে, মুনাফা যা করব সেটা গিলে খেয়ে ফেলতে চাইবে। রাষ্ট্র যে পারছে না দুর্নীতি দমন করতে তার আসল রহস্যটা তো রয়েছে এইখানে, রাষ্ট্রের যারা শাসকশ্রেণি তারা মুখে যা-ই বলুক না কেন, অন্তরে অন্তরে নিজেরাই দুর্নীতির প্রতি অনুরক্ত এবং সেই অনুরাগেরও আসল কারণ হলো এটা যে গোটা ব্যবস্থাটা হচ্ছে পুঁজিবাদী। পুঁজিবাদ অন্য কিছু বোঝে না, মুনাফা ছাড়া। পুঁজিবাদে দুর্নীতি থাকবে এটা অনিবার্য। তবে যেসব রাষ্ট্রে কিছুটা জবাবদিহি আছে, আছে স্বচ্ছতাও এবং যেখানে সরকারের জন্য ঝুঁকি থাকে জনপ্রিয়তা হারালে ক্ষমতা থেকে পড়ে যাওয়ার, সেখানে দুর্নীতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকে। পুঁজিবাদ নিজেও সংযত হয়, টিকে থাকার স্বার্থে। আর পুঁজিবাদ যেখানে রাষ্ট্রের বাধানিষেধের মোটেই তোয়াক্কা করে না, দায় নেয় না জবাবদিহির, সেখানে কে থামাবে লুণ্ঠন, কে বাধা দেবে দুর্নীতিকে? অনেক দেশেই কেউ তা দেয় না, দেয় না আমাদের এই বাংলাদেশেও। তবে আমাদের ক্ষেত্রে বেদনাটা এইখানে যে মুক্তির জন্য আমরা বড় বড় সংগ্রাম করেছি এবং সে সংগ্রামের লক্ষ্য একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্র গঠন ছিল না, লক্ষ্য ছিল একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনই।

সমাজতন্ত্রে পৌঁছানোর জন্যই গণতন্ত্র চাই। সে গণতন্ত্রে কেবল মানুষের ভোটাধিকারই থাকবে না, থাকবে অধিকার ও সুযোগের সাম্যও; সেখানে ক্ষমতা কোনো একটি জায়গায় পুঞ্জীভূত থেকে স্বৈরাচারী, দুর্গন্ধযুক্ত ও বিষাক্ত হয়ে উঠতে পারবে না, সেখানে ক্ষমতার যথার্থ বিকেন্দ্রীকরণ ঘটবে এবং সর্বস্তরেই ক্ষমতা চলে যাবে প্রকৃত জনপ্রতিধিদের হাতে। সেদিকে তো আমরা এগোতে পারিনি, এগোনো ভুলে বরং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার একদা-ঘোষিত লক্ষ্য থেকে ক্রমাগত পিছিয়েই গেছি।

একটা ভুল ধারণা চালু ছিল, এখনো মনে হয় আছে; সেটা হলো বাংলাদেশ একটি জাতিরাষ্ট্র। এটা বলার অর্থ দাঁড়ায়, এই রাষ্ট্র কেবল একটি জাতির মানুষেরই, যে মানুষেরা সবাই বাঙালি। এটা কিন্তু সত্য নয়। বাংলাদেশ একটি জাতিরাষ্ট্র নয়, এটি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। রাষ্ট্র সে রকমটা হয়নি বটে, তবে সেটিই তার হওয়ার কথা ছিল। বস্তুত, এ যুগে একটি রাষ্ট্রের সব মানুষ এক জাতির হবে, এমনটা মোটেই সম্ভব নয়। আমেরিকা চেষ্টা করেছিল বিভিন্ন জাতির মানুষকে একসঙ্গে করে, ফুটন্ত পাত্রে ফেলে রান্না করার কায়দাতে, এক জাতিতে পরিণত করে তবে ছাড়বে। পারেনি। করতে গিয়ে নানা ধরনের বিভেদ-বিদ্বেষের সৃষ্টি করেছে; এখনো করে চলেছে। গ্রেট ব্রিটেন মেনে নিয়েছে, বাধ্য হয়েছে মেনে নিতে যে ওই রাষ্ট্র শুধু ইংরেজদের নয়, এমনকি শুধু শ্বেতাঙ্গদেরও নয়, নানা বর্ণের ও সংস্কৃতির মানুষ সেখানে রয়েছে এবং থাকবে। বাংলাদেশেও বাঙালিদের পাশাপাশি অবাঙালিরা আছে, তা সংখ্যায় তারা যত কমই হোক না কেন। অধিকার ও সুযোগের ক্ষেত্রে এ রাষ্ট্রে নাগরিকদের ভেতর শ্রেণি, বর্ণ, ধর্ম ও লিঙ্গের ব্যবধান থাকার কথা নয়। সেটা যে রয়ে গেছে এবং অনবরত বাড়ছেই, তাতেই প্রমাণ হয় যে এ রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক নয়; এ রাষ্ট্র পুঁজিবাদী এবং এর কাঠামো আমলাতান্ত্রিক। আগে যেমন ছিল।

রাষ্ট্র হিসেবে শ্রীলঙ্কা বিপদে পড়েছিল, শিগগিরই যে কাটবে এমনও ধারণা কেউ করেনি। মূল সমস্যাটা ছিল অর্থনৈতিক, কিন্তু সেটি তৈরি হয়েছিল রাজনৈতিক কারণে। রাষ্ট্র চলে গিয়েছিল একটি পরিবারের সর্বাত্মক কর্তৃত্বের অধীনে। শাসকেরা ভিন্ন মত শুনতে চাননি, অন্য দলকে দাঁড়াতেই দেননি। যা ইচ্ছা তা-ই করেছেন। ফলে অর্থনৈতিক দুর্দশা বেড়েছে এবং তার কারণে মানুষ শেষ পর্যন্ত ভীষণ খেপে গিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে; প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের অবরোধ করেছে, তাঁদের কেউ কেউ পালিয়ে বেঁচেছেন।

আমাদের দেশে সরকারের পতনও ঘটল; কিন্তু কারা এল ক্ষমতায়? যারা এল তারা তো আগের শাসকদেরই আপনজন; তাদের ক্ষমতাপ্রাপ্তিতে রাষ্ট্রের স্বৈরাচারী চরিত্রে তো কোনো পরিবর্তন ঘটল না। আর পরিবর্তন যে ঘটবেও না, তা বোঝা যায় এটা দেখেই যে যাঁরা আন্দোলন করেছেন, তাঁদের কেউ কেউ এখন বিপদে পড়েছেন। কয়েকজন ইতিমধ্যে গ্রেপ্তারও হয়েছেন। কেউ কেউ আত্মগোপন করেছেন। আন্দোলনকারীদের ওপর আধা সামরিক বাহিনীর হামলাও ঘটেছে। ওদিকে আন্দোলন নিজেও দুই ভাগ হয়ে গেছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। পুঁজিবাদী-কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থায় এটাই ঘটবে, সরকার নামে বদলাবে, কাজে বদলাবে না এবং রাষ্ট্রের স্বভাব-চরিত্রে মৌলিক কোনো পরিবর্তন ঘটবে না। বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ বাড়িয়ে, অর্থনীতিকে হয়তো সাময়িকভাবে কোনোমতে রক্ষা করা যাবে, কিন্তু তাতে তো সাধারণ মানুষের ভাগ্য বদলাবে না। আসল কথা ওই একটাই; পুঁজিবাদী রাষ্ট্র নাগরিকদের এখন আর স্বস্তি দিতে পারবে না, সুখ তো নয়ই। প্রতিটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে এখন যা প্রয়োজন তা হলো সামাজিক বিপ্লব, যে বিপ্লব প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে। কিন্তু পুঁজিবাদী রাষ্ট্র তো নিজে বেঁচে থাকতে এবং বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই সেটা ঘটতে দেবে না। নানা রকম বিপ্লব ঘটাতে থাকবে, প্রকৃত বিপ্লবকে প্রতিহত করার প্রতিজ্ঞাতে।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

নতুন মেট্রো নয়, রুট বাড়ানোর চিন্তা

মামলার আসামিসহ বিএসইসির ২২ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত

সরকারি টাকায় ব্যক্তিগত সড়ক কার্পেটিং বিচারপতি খিজির হায়াতের, প্রমাণ পেয়েছে দুদক

অভিনেতা সিদ্দিককে মারধর করে থানায় সোপর্দ, ছিঁড়ে ফেলা হয় পরনের পোশাক

ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের তেলের বরাদ্দ ২৫০ থেকে বেড়ে ৫০০ লিটার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত