Ajker Patrika

আওয়ামী লীগকেও পথভ্রষ্ট করেছেন শেখ হাসিনা

ড. মইনুল ইসলাম
আপডেট : ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৫: ১১
বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রায় ফ্যাসিস্টের মুখাবয়ব। ছবি: আজকের পত্রিকা
বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রায় ফ্যাসিস্টের মুখাবয়ব। ছবি: আজকের পত্রিকা

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন মওলানা ভাসানীকে সভাপতি এবং শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক করে গঠিত হয়েছিল আওয়ামী লীগ। তখন শেখ মুজিবুর রহমান জেলে ছিলেন, তাঁকে করা হয়েছিল দলের যুগ্ম সম্পাদক। পরবর্তী সময়ে শামসুল হক অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যাওয়ায় শেখ মুজিবুর রহমানকে দলের সাধারণ সম্পাদক করা হয়। অতএব, জন্মলগ্ন থেকেই আওয়ামী লীগ এ দেশের শ্রমজীবী কৃষক-শ্রমিক ও জনগণের রাজনৈতিক দল হিসেবেই পরিগণিত হয়ে উঠেছিল।

১৯৫৪ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত পূর্ব বাংলার সংসদীয় নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ভূমিধস বিজয় অর্জন করেছিল, যুক্তফ্রন্টের সবচেয়ে বড় শরিক ছিল আওয়ামী লীগ। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা ঘোষণার তিন বছরের মধ্যেই ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পথ ধরে আওয়ামী লীগ পরিণত হয়েছিল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের স্বাধিকার ও স্বাধীনতাসংগ্রামের পতাকাবাহী সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় আওয়ামী লীগকে বসিয়ে দিয়েছিল স্বাধীনতাসংগ্রামের একক নেতৃত্বের আসনে, বঙ্গবন্ধুকে ম্যান্ডেট দিয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের একক মুখপাত্র হিসেবে ভূমিকা পালনে। তাই, ১৯৭১ সালের ১ মার্চ যখন স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, তখন আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগের ওপরেই দায়িত্ব বর্তেছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার।

১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনতার প্রথম পতাকা উত্তোলিত হয়েছিল ছাত্রলীগের আ স ম আবদুর রবের হাতেই। পরদিন ঢাকার পল্টন ময়দানে ঘোষিত হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইশতেহার ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজের কণ্ঠে। ২৬ মার্চ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদের ভাষণে গঠিত হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার, রাষ্ট্রপতি ঘোষিত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাজউদ্দীন-ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের তিনটি মূলনীতি ঘোষিত হয়েছিল গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা, যার ভিত্তিতে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়লগ্নে যাত্রা শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের। বাংলাদেশের ইতিহাসের এই স্বর্ণ-অধ্যায়ে আওয়ামী লীগের অনন্য অবস্থানকে যারা অস্বীকার করবে, তারা চিরকাল চিহ্নিত হবে স্বাধীনতাবিরোধী খলনায়ক হিসেবে।

মওলানা ভাসানী ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ পরিত্যাগ করলেও ভারতে গঠিত মুক্তিযুদ্ধের উপদেষ্টা পরিষদের প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন তিনিই, তাজউদ্দীন ছিলেন উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যসচিব। স্বাধীন বাংলাদেশে ভাসানী এবং বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি ভিন্ন পথে মোড় নিলেও বক্ষ্যমাণ কলামে তা আমার বিবেচ্য নয়। আমি আলোচনা করতে চাই ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত স্বৈরশাসক হাসিনা প্রসঙ্গে। এহেন জনমানুষের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে কীভাবে ক্রোনি ক্যাপিটালিজম, চৌর্যতন্ত্র (ক্লেপ্টোক্রেসি) এবং অলিগার্কিতে রূপান্তরিত করায় দেশের জনগণ কর্তৃক ঘৃণিত লুটেরা ও দুর্নীতিবাজ হিসেবে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হয়ে প্রাণভয়ে ভারতে পালিয়ে গেলেন। ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর হাসিনা ভারতে আশ্রয় লাভ করেন। ১৯৮১ সালের ১৭ এপ্রিল আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে বাংলাদেশে ফেরত আসার পর ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত অত্যন্ত বিপৎসংকুল দেড় দশকে বিরোধী দলের নেত্রী হিসেবে তিনি আওয়ামী লীগকে আবার ক্ষমতাসীন করায় সফল হন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বেশি আসনে জয়ী হলেও ক্ষীণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ২০০১ সাল পর্যন্ত হাসিনাকে শাসন চালাতে হওয়ায় তাঁর একনায়কতান্ত্রিক মানসিকতা জনগণের কাছে ধরা পড়েনি। বরং ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পরিচালিত ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী বিপর্যয় ডেকে আনে। কিন্তু ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ভূমিধস বিজয় অর্জন করায় হাসিনা আজীবন ক্ষমতা কুক্ষিগত করার সর্বনাশা পথে পা বাড়ান।

সাড়ে ১৫ বছর ছিল দেশে দুর্নীতি, পুঁজি লুণ্ঠন ও পুঁজি পাচারের মহোৎসব-কাল। এই পুঁজি লুণ্ঠনের কেন্দ্রে ছিল হাসিনার পরিবার ও আত্মীয়স্বজন, এস আলম, সালমান এফ রহমান, সামিটের আজিজ খান, বসুন্ধরার আকবর সোবহান, ওরিয়ন গ্রুপের ওবায়দুল করিম ও নাসা গ্রুপের নজরুল ইসলাম মজুমদারের মতো লুটেরা অলিগার্ক ব্যবসায়ী এবং হাজার হাজার লুটেরা রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও দুর্নীতিবাজ আমলা। শুধু হাসিনার পরিবার, আত্মীয়স্বজন এবং অলিগার্ক ব্যবসায়ীরাই নয়, আওয়ামী লীগের প্রায় সব মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও উচ্চস্তরের নেতা-কর্মী কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতি, পুঁজি লুণ্ঠন ও পুঁজি পাচারে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। হাসিনা আমলের ‘এক নম্বর সমস্যায়’ পরিণত হয়েছিল পুঁজি পাচার।

ভাসানীর আওয়ামী লীগকে হাসিনা দুর্নীতি, বেধড়ক পুঁজি লুণ্ঠন ও পুঁজি পাচারের লীলাক্ষেত্রে কীভাবে পর্যবসিত করলেন? ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের রাতের ভোটের প্রহসনের মাধ্যমে সংসদে আসা সদস্যদের ৬১.৭ শতাংশ ছিলেন ব্যবসায়ী, ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত একতরফা নির্বাচনী প্রহসনে ওই ধারার কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। ২০১৯ সালে দেশের অর্থমন্ত্রীর চেয়ারে বসানো হয়েছিল একজন লুটেরা আদম ব্যাপারীকে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দেশের অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণে সবচেয়ে শক্তিধর ব্যক্তিতে পরিণত করা হয়েছিল দেশের সবচেয়ে বড় ঋণখেলাপি সালমান এফ রহমানকে, তাঁকে বানানো হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি বিনিয়োগ ও শিল্প উপদেষ্টা। তাঁর মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপের খেলাপি ঋণ ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি। চট্টগ্রামের কুখ্যাত এস আলমকে দেশের সাতটি ব্যাংকের ওপর একক নিয়ন্ত্রণ স্থাপনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, যার দ্বিতীয় নজির বিশ্বের আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। এস আলম ওই ব্যাংকগুলো থেকে কমপক্ষে দেড় লাখ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচার করে দিয়েছেন। ২০২৪ সালের ২৯ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের যে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করেছিল, তারা ১ ডিসেম্বর শ্বেতপত্রটির খসড়া প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। শ্বেতপত্র কমিটির গবেষণায় উঠে এসেছে স্বৈরশাসক হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের লুটপাটতন্ত্রের মাধ্যমে প্রতিবছর গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার হিসাবে মোট ২৩৪ বিলিয়ন ডলার লুণ্ঠিত হয়ে দেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি লুণ্ঠনের শিকার হয়েছে ব্যাংকিং ও ফাইন্যান্সিয়াল খাত, তারপর জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত, তারপর ভৌত অবকাঠামো খাত এবং এরপর তথ্যপ্রযুক্তি খাত। সংযুক্ত আরব আমিরাত, কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, হংকং, ভারত এবং কয়েকটি ‘ট্যাক্স হেভেন’ দেশে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়েছে।

হাসিনা কীভাবে জনগণের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে এ রকম একটি ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের লুটপাটের হাতিয়ারে পরিণত করতে পারলেন? আসলে ২০০৯ সালে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ক্রমেই হাসিনা নিজেকে একজন অপ্রতিদ্বন্দ্বী একনায়কের আসনে অধিষ্ঠিত করে ফেলেছিলেন। যেন তিনিই সবজান্তা, সব সিদ্ধান্ত তাঁরই, অন্য কারও ভিন্নমত প্রকাশের অধিকার নেই। আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের একে একে তিনি ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু থেকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনের পর গঠিত মন্ত্রিসভায় একজন মন্ত্রীকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যাঁরা হাসিনার কোনো সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করতে পারেন। কোনো মন্ত্রী, সংসদ সদস্য কিংবা আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা দলের নীতিনির্ধারণী অবস্থানে ছিলেন না। প্রয়াত মতিয়া চৌধুরী, আসাদুজ্জামান নূর, সাবের হোসেন চৌধুরী, সিমিন হোসেন রিমি, ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী, এম এ মান্নান—তাঁদের কারও গায়ে দুর্নীতির আঁচড় না লাগা সত্ত্বেও হাসিনার পতনের পর ওই লেবাস তো এখন সবার গায়ে লেগে গেল! আমার মনে হচ্ছে, সাধারণ জনগণের মতো তাঁরাও ধরে নিয়েছিলেন যে পরপর তিনটি নির্বাচনী প্রহসন সফলভাবে মঞ্চস্থ করা সত্ত্বেও ভারতের সমর্থনে যেহেতু হাসিনা ক্ষমতাসীন থেকে গেছেন, তাই তাঁর জীবদ্দশায় এ দেশে সরকার পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই। একটি গণ-অভ্যুত্থানে হাসিনার পতন হতে পারে—এটা ২০২৪ সালের জুলাই মাসেও ছিল অচিন্তনীয়। ড. কামাল হোসেন এবং ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের মতো মহিরুহকে হাসিনা ১৯৯১ সালেই আওয়ামী লীগ থেকে উৎপাটিত করা সত্ত্বেও তাঁরা কোনো রাজনৈতিক ঝড় তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন। তোফায়েল আহমেদ ২০১৪ সালেই কোণঠাসা অবস্থানে চলে গেছেন। ২০১৮ সালের পর অন্যান্য সিনিয়র নেতাকেও ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে নির্বাসনে পাঠিয়েছেন হাসিনা। এরই ধারাবাহিকতায় জনগণের দল, মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ হাসিনার স্বৈরশাসনে রূপান্তরিত হয়ে গেল ক্রোনি ক্যাপিটালিজম, ক্লেপ্টোক্রেসি (চৌর্যতন্ত্র) এবং গণধিক্কৃত অলিগার্কিতে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ক্ষমতা থেকে উৎখাত হওয়ার পর কমপক্ষে আগামী এক দশক আওয়ামী লীগ এ দেশে বিলোপের গিরিখাতে মরণাপন্ন হয়ে ধুঁকতে থাকবে। এই দুঃখ কোথায় রাখি!

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মামলার আসামিসহ বিএসইসির ২২ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত

নতুন মেট্রো নয়, রুট বাড়ানোর চিন্তা

সরকারি টাকায় ব্যক্তিগত সড়ক কার্পেটিং বিচারপতি খিজির হায়াতের, প্রমাণ পেয়েছে দুদক

অভিনেতা সিদ্দিককে মারধর করে থানায় সোপর্দ, ছিঁড়ে ফেলা হয় পরনের পোশাক

ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের তেলের বরাদ্দ ২৫০ থেকে বেড়ে ৫০০ লিটার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত