Ajker Patrika

নিরাপদ জীবিকার দাবি সমুদ্রের মৎস্যজীবীদের

শাইখ সিরাজ
আলীপুর ফিশ ল্যান্ডিং স্টেশনে মৎস্যজীবীর সঙ্গে কথা বলছেন লেখক। ছবি: হৃদয়ে মাটি ও মানুষ
আলীপুর ফিশ ল্যান্ডিং স্টেশনে মৎস্যজীবীর সঙ্গে কথা বলছেন লেখক। ছবি: হৃদয়ে মাটি ও মানুষ

দেশের সমুদ্র অর্থনীতির বড় একটি অংশ জুড়ে আছে সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ। এই সম্পদ আহরণে নিবেদিত মৎস্যজীবীদের প্রতিনিয়ত মুখোমুখি হতে হচ্ছে প্রতিকূল পরিবেশের। সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে প্রাণ হারাতে হচ্ছে তাঁদের। উপকূলীয় অঞ্চলের জেলেদের দাবি, জীবিকার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার। দেশে মোট উৎপাদিত মাছের ১৫.০৫ ভাগ সমুদ্র থেকে আহরণ করা হয়। (সূত্র: মৎস্য অধিদপ্তর)

এ থেকে উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় সাড়ে ১৩ লাখ মানুষের জীবিকা নির্বাহ হচ্ছে। উত্তাল সমুদ্রের বুক থেকে মাছ ধরে আনা সহজ কাজ নয়। বিশেষ করে আকস্মিক ঝড়ঝঞ্ঝা মোকাবিলা করে জেলেরা সমুদ্রে জীবন বাজি রেখে জীবিকা নির্বাহ করেন। আজ মাছ উৎপাদনে দেশের যে সাফল্য, তার অংশীজন এই প্রতিকূল পরিবেশে কাজ করা জেলেরাও। তাঁদের নিরাপদ জীবিকা ও উন্নত জীবনমানের দাবি দীর্ঘদিনের।

গত ৪০ বছরে কক্সবাজার, পটুয়াখালীসহ বিভিন্ন সামুদ্রিক মৎস্য অবতরণে গিয়ে সেখানকার মৎস্যজীবী মানুষের কথা শোনার সুযোগ আমার হয়েছে। মনে পড়ে, ২০০৭ সালে এক বৃষ্টির দিনে পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় মহিপুর ফিশ ল্যান্ডিং স্টেশনে উপস্থিত ছিলাম। সেখানে মাছ ব্যবসায়ী ও জেলেদের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছিলাম তাঁদের সুখ-দুঃখ এবং সুবিধা-অসুবিধার কথা শুনে। সে সময় তাঁরা বলেছিলেন, অতল সমুদ্রে ভেসে মাছ ধরতে গিয়ে আবহাওয়ার খবর জানার একমাত্র মাধ্যম রেডিও। কিন্তু অনেক ট্রলারমালিক ট্রলারে রেডিও রাখতে দিতেন না। কারণ, ঝড়ের পূর্বে জালে মাছ পড়ে বেশি। ঝড়ের খবরে ভয় পেয়ে জেলেরা আগেই ফিরে এলে লোকসান গুনতে হয়। আবার কেউ কেউ বলছিলেন, রেডিওতে যে সময় সংকেত দেওয়া হয়, সে সংকেত পেয়ে ফিরতে ফিরতে সমুদ্র উত্তাল হয়ে ওঠে, ৫ নম্বর বিপৎসংকেত চলে আসে। এ ছাড়া মোহনার নাব্যতা কম। বয়াবাতি, সংকেতবাতি না থাকায় অন্ধকারে পথ হারিয়ে ফেলায় ঝড়ের কবলে অনেক জেলের জীবনহানি ঘটে।

এসবের পাশাপাশি আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসংবলিত নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের দাবি ছিল মৎস্যজীবীদের। তাঁদের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় আন্ধারমানিক নদীর দুই তীরে বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন দুটি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র স্থাপন করে। ২০২২ সালে সেগুলো উদ্বোধন করা হয়। নদীর উত্তর তীরে মহিপুর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র আর দক্ষিণে আলীপুর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র। বিএফডিসির মহিপুর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রটি উদ্বোধন হলেও মৎস্য ব্যবসায়ী, আড়তদারদের সংখ্যা ও স্থান সংকুলানসহ নানা জটিলতায় চালু করা যায়নি। তবে আলীপুর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে জেলে আর মাছ ব্যবসায়ীরা দারুণ উৎসাহে তাঁদের কার্যক্রম শুরু করেছেন। বছরখানেক আগে আলীপুর ফিশ ল্যান্ডিং স্টেশনটি ঘুরে দেখে এসেছি। জেলে, আড়তদার আর মাছ ব্যবসায়ীদের হাঁকডাকে সরগরম। ট্রলার থেকে মাছ নামানো হচ্ছে। সেই মাছ তোলা হচ্ছে ডাকে। এরপর প্যাকেট হয়ে চলে যাচ্ছে সারা দেশের বাজারে।

সেখানে মৎস্যজীবীরা আমাকে জানালেন সাংবাদিক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা প্রায়ই ইলিশের একটি জাত চন্দনা ইলিশকে জাটকা ভেবে হয়রানি করেন। তাঁরা আমাকে জাটকা এবং চন্দনা ইলিশ দেখালেন। বললেন, চন্দনা ইলিশকে কেউ কেউ ‘সার্ডিন’, ‘চাকোরি’, ‘কলম্বো’ ও ‘ডটেড গিজার্ড শাড’ নামেও চেনেন। এই মাছের গায়ের রং ইলিশের মতো সাদা হলেও পিঠ ইলিশের মতো সুরমা রঙের নয়। চোখ জাটকার চেয়ে বড়। ইলিশের চেয়েও চ্যাপ্টা। সাইজে জাটকার মতোই, কিন্তু আদতে পূর্ণবয়স্ক। দেখতে অনেকটাই ইলিশের কাছাকাছি হওয়ায় সাংবাদিক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা জাটকা ভেবে আটকে দেন। আবার ব্যবসায়ীরাও ক্রেতাদের কাছে ইলিশ বলে বিক্রি করে অধিক লাভ করেন।

২০১৬ সালে এই অবতরণ কেন্দ্রগুলো নির্মাণ শুরুর সময় একবার আসার সুযোগ হয়েছিল। মূলত সমুদ্র থেকে আহরিত মাছের অপচয় রোধ এবং মান অক্ষুণ্ন রেখে ভোক্তার কাছে পৌঁছে দিতেই এই অবতরণ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু এই অবতরণ কেন্দ্রের পরিবেশ ততটা পরিচ্ছন্ন নয়। আলীপুর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক মো. শাকিল আহমেদ অবশ্য তাঁদের লোকবল-সংকটের কথা বললেন।

নদীতীরে সারি সারি ট্রলার। সাগর থেকে মাছ ধরে ট্রলার ভিড়ছে ঘাটে। কথা হয় কয়েকজন মৎস্যজীবীর সঙ্গে। এই মৎস্যজীবীদের জীবন-জীবিকা যেমন অ্যাডভেঞ্চারপূর্ণ, তেমনি ঝুঁকিপূর্ণ ও শঙ্কাময়। প্রায়ই মুখোমুখি হতে হয় ঝড়ঝঞ্ঝার। যেন জীবন বাজি রেখে জীবিকার লড়াই।

২০০৭ সালে মৎস্যজীবীদের দাবিগুলোর প্রতিধ্বনি এখনো তাঁদের কণ্ঠে। তাঁরা জানালেন, মোহনার নাব্যতা কম থাকায় ঝড় বা বন্যার সময় তাঁদের ঘাটে ফিরতে সমস্যা হয়। এখন পর্যন্ত বয়াবাতি বা সংকেতবাতি না থাকায় অন্ধকারে পথ হারিয়ে ফেলে ঝড়ের কবলে অনেক জেলের জীবনহানি ঘটছে।

জেলেরা আরও বলছিলেন, মা ইলিশ ধরায় ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা, ১ নভেম্বর থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত জাটকা ধরায় ৮ মাসের নিষেধাজ্ঞা, মার্চ-এপ্রিলের দুই মাসের অভয়ারণ্যের নিষেধাজ্ঞা এবং সাগরে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা মিলিয়ে বছরে ১৪৭ দিনের নিষেধাজ্ঞা পালন করতে হয় তাঁদের। নিষেধাজ্ঞাকালে খাদ্য সহায়তা হিসেবে চাল পেলেও তা অপ্রতুল বলে দাবি করেন জেলেরা। এই নিষেধাজ্ঞার সময়টি কমানোর দাবি তোলেন তাঁরা। কয়েকজন জেলে জানালেন আমাদের সমুদ্রসীমায় প্রতিবেশী দেশের অনুপ্রবেশের কথাও।

জীবিকার তাগিদে জীবন হাতে নিয়ে সমুদ্র দাপিয়ে রুপালি মাছের অর্থনীতি রচনা করেছেন যে চঞ্চল নাবিকেরা, তাঁদের নিরাপত্তার কথা ভাবতে হবে আমাদের। স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু সমুদ্র অর্থনীতির বিকাশে যাবতীয় জটিলতা দূর করতে উদ্যোগী হতে হবে। আজকের দিনে বৈরী আবহাওয়ায় কিংবা যেকোনো সংকটে যোগাযোগের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরির মাধ্যমে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান খুব একটা কঠিন কাজ নয়। সামুদ্রিক মাছের আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করতে প্রয়োজন মাছ আহরণ থেকে বাজারজাত পর্যন্ত নিয়মবদ্ধ পরিচর্যাগুলোর অনুশীলন। সারা বিশ্বেই ব্লু ইকোনমির ধারণা বিকশিত হচ্ছে। আমি বিশ্বাস করি, উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের সমুদ্র অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব।

লেখক: পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, চ্যানেল আই

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত