ক্রিং ক্রিং ক্রিং...
সাইকেলের ঘণ্টাধ্বনি শুনলেই দৌড়ে দরজার কাছে যেতাম। জানতাম, পেপার আঙ্কেলই এসেছেন। এত সকালে তিনি ছাড়া কেউ আসেন না। বড় একটা ব্যাগে অনেকগুলো পত্রিকা নিয়ে ছিমছাম মফস্বলের অলিগলি সাইকেলে চড়ে প্রথম সকালটা প্রতিদিন ঘুরে বেড়াতেন তিনি। সঙ্গে থাকত বড় একটা কালো ছাতা। কখনো ছাতাটা খুলতে দেখিনি। আমাদের বাড়ির দরজায় সাইকেল রেখে পেপারের ব্যাগ আর ছাতাটা নিয়ে ভেতরে ঢুকতেন। বৈঠকখানায় বসে রং চায়ে চুমুক দিতে দিতে বাবার সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা জুড়ে দিতেন।
চায়ের কাপে ঝড় তুলতে তুলতে তাঁদের আলোচনাও ঝড়ে পরিণত হতো প্রায় সময়। পেপার আঙ্কেল আর কারও বাসায় গিয়ে এভাবে আড্ডা দিতেন কি না, জানি না!
আমি তাঁদের আলোচনা না বুঝলেও এতটুকু বুঝে গিয়েছিলাম, আমাদের দেশে প্রধান তিনটি দল আছে। এর মধ্যে একটা হচ্ছে সরকারি দল, যেটা দেশ পরিচালনা করে। কিন্তু দেশ পরিচালনা কী জিনিস, সেটা তখনো বুঝিনি, আজও বুঝি না!
সদ্য স্কুলে ভর্তি হয়েছি তখন। বানান করে পড়া শিখছি। বাবার বইগুলো বড়দের বলে কঠিন লাগত পড়তে। কিন্তু অধীর আগ্রহে প্রতিটা সকাল অপেক্ষা করেছি পেপার আঙ্কেল কখন আসবেন, পত্রিকা নিয়ে। পত্রিকার ভাষা তখন খুব বেশি বুঝতে না পারলেও বড়দের বইয়ের মতো কঠিন কিছু মনে হতো না। বানান করে করে পড়েছি, না পারলে বড়দের সাহায্য নিয়েছি। পত্রিকার এ-মাথা থেকে ও-মাথা পড়তে পড়তে সময় গড়িয়ে গেলে মায়ের বকা শুনেছি স্কুলের বই নিয়ে বসার জন্য। একটু বড় হয়ে যখন পত্রিকায় শব্দভেদ
বা এ-জাতীয় খেলা-ধাঁধা বুঝতে শিখেছি, তখন বাসার সব বাংলা বই নিয়ে বসে পড়তাম সমাধান করার জন্য।
পরদিন উত্তর মিলিয়ে নিতাম। শুদ্ধ হলে মহানন্দে নতুন ধাঁধার উত্তর খুঁজতাম। এভাবেই বাংলা ভাষার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা গাঢ় করেছে পেপার আঙ্কেলের আনা দৈনিক পত্রিকাগুলো।
পেপার আঙ্কেলের নাম সিরাজ। সম্ভবত সিরাজুদ্দিন। সঙ্গে একটা হোসেন ছিল কি না, মনে পড়ছে না। সিরাজ নামের শেষে হোসেন শব্দটাই যেন বেশি খাপ খায়। এত বছর পর পেপার আঙ্কেলের কথা মনে পড়ার কারণ নেই কোনো। এমনি এমনি শৈশবের শিক্ষার স্মৃতিগুলো মাঝে মাঝে মনে পড়ে। সময়ের সঙ্গে পেপার আঙ্কেল হারিয়ে গেছেন। বেঁচে আছেন না মারা গেছেন, কে জানে। বাবাকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, পেপার আঙ্কেল কোথায় আছেন, কেমন আছেন। বাবা বলতে পারলেন না। আমি ‘সিরাজ’ নামটা মনে রাখায় বাবাও খুব অবাক হলেন। তাঁর নিজেরও মনে নেই। অথচ পাখিডাকা প্রতি সকালে রাজনীতির আলাপগুলোও এই ভুলে যাওয়া ব্যক্তির সঙ্গেই করতেন। আমি স্কুল পাস করা অবধি মাঝে মাঝে পেপার আঙ্কেলকে এলাকায় দেখতাম। তাঁর গ্রাহকসংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছিল। স্যাটেলাইটের যুগে সবাই টেলিভিশনে খবর দেখায় মগ্ন, কাগুজে পত্রিকায় আর স্বাদ পায় না। রাজনৈতিক মতের দ্বন্দ্ব থাকায় বাবাও তাঁর কাছ থেকে পত্রিকা নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। আর এখন তো ইন্টারনেটের সময়। সবাই টেলিভিশনে খবর দেখাও কমিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমার মন পড়ে থাকে পেপার আঙ্কেলের আনা সেই পত্রিকার ঘ্রাণে।
এখন পত্রিকা অফিসে কাজ করি। কাগজের পত্রিকা হাতে পাই প্রতিদিন। তবু সেই আকর্ষণ কাজ করে না, সেই ঘ্রাণ পাই না। বাসায় কে পত্রিকা দিয়ে যায়, সেটাও জানি না। দারোয়ানের কাছে কোনো এক হকার দিয়ে যান শুনেছি। জানি না, পেপার আঙ্কেলের মতো এই হকারও সাম্প্রতিক রাজনীতি বোঝেন কি না কিংবা কারও বাসায় গিয়ে রং চায়ে টোস্ট ডুবিয়ে রাজনীতির বিতর্ক জুড়ে দেন কি না। আদৌ কি তাঁর সেই সময় আছে?
লেখক: সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
ক্রিং ক্রিং ক্রিং...
সাইকেলের ঘণ্টাধ্বনি শুনলেই দৌড়ে দরজার কাছে যেতাম। জানতাম, পেপার আঙ্কেলই এসেছেন। এত সকালে তিনি ছাড়া কেউ আসেন না। বড় একটা ব্যাগে অনেকগুলো পত্রিকা নিয়ে ছিমছাম মফস্বলের অলিগলি সাইকেলে চড়ে প্রথম সকালটা প্রতিদিন ঘুরে বেড়াতেন তিনি। সঙ্গে থাকত বড় একটা কালো ছাতা। কখনো ছাতাটা খুলতে দেখিনি। আমাদের বাড়ির দরজায় সাইকেল রেখে পেপারের ব্যাগ আর ছাতাটা নিয়ে ভেতরে ঢুকতেন। বৈঠকখানায় বসে রং চায়ে চুমুক দিতে দিতে বাবার সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা জুড়ে দিতেন।
চায়ের কাপে ঝড় তুলতে তুলতে তাঁদের আলোচনাও ঝড়ে পরিণত হতো প্রায় সময়। পেপার আঙ্কেল আর কারও বাসায় গিয়ে এভাবে আড্ডা দিতেন কি না, জানি না!
আমি তাঁদের আলোচনা না বুঝলেও এতটুকু বুঝে গিয়েছিলাম, আমাদের দেশে প্রধান তিনটি দল আছে। এর মধ্যে একটা হচ্ছে সরকারি দল, যেটা দেশ পরিচালনা করে। কিন্তু দেশ পরিচালনা কী জিনিস, সেটা তখনো বুঝিনি, আজও বুঝি না!
সদ্য স্কুলে ভর্তি হয়েছি তখন। বানান করে পড়া শিখছি। বাবার বইগুলো বড়দের বলে কঠিন লাগত পড়তে। কিন্তু অধীর আগ্রহে প্রতিটা সকাল অপেক্ষা করেছি পেপার আঙ্কেল কখন আসবেন, পত্রিকা নিয়ে। পত্রিকার ভাষা তখন খুব বেশি বুঝতে না পারলেও বড়দের বইয়ের মতো কঠিন কিছু মনে হতো না। বানান করে করে পড়েছি, না পারলে বড়দের সাহায্য নিয়েছি। পত্রিকার এ-মাথা থেকে ও-মাথা পড়তে পড়তে সময় গড়িয়ে গেলে মায়ের বকা শুনেছি স্কুলের বই নিয়ে বসার জন্য। একটু বড় হয়ে যখন পত্রিকায় শব্দভেদ
বা এ-জাতীয় খেলা-ধাঁধা বুঝতে শিখেছি, তখন বাসার সব বাংলা বই নিয়ে বসে পড়তাম সমাধান করার জন্য।
পরদিন উত্তর মিলিয়ে নিতাম। শুদ্ধ হলে মহানন্দে নতুন ধাঁধার উত্তর খুঁজতাম। এভাবেই বাংলা ভাষার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা গাঢ় করেছে পেপার আঙ্কেলের আনা দৈনিক পত্রিকাগুলো।
পেপার আঙ্কেলের নাম সিরাজ। সম্ভবত সিরাজুদ্দিন। সঙ্গে একটা হোসেন ছিল কি না, মনে পড়ছে না। সিরাজ নামের শেষে হোসেন শব্দটাই যেন বেশি খাপ খায়। এত বছর পর পেপার আঙ্কেলের কথা মনে পড়ার কারণ নেই কোনো। এমনি এমনি শৈশবের শিক্ষার স্মৃতিগুলো মাঝে মাঝে মনে পড়ে। সময়ের সঙ্গে পেপার আঙ্কেল হারিয়ে গেছেন। বেঁচে আছেন না মারা গেছেন, কে জানে। বাবাকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, পেপার আঙ্কেল কোথায় আছেন, কেমন আছেন। বাবা বলতে পারলেন না। আমি ‘সিরাজ’ নামটা মনে রাখায় বাবাও খুব অবাক হলেন। তাঁর নিজেরও মনে নেই। অথচ পাখিডাকা প্রতি সকালে রাজনীতির আলাপগুলোও এই ভুলে যাওয়া ব্যক্তির সঙ্গেই করতেন। আমি স্কুল পাস করা অবধি মাঝে মাঝে পেপার আঙ্কেলকে এলাকায় দেখতাম। তাঁর গ্রাহকসংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছিল। স্যাটেলাইটের যুগে সবাই টেলিভিশনে খবর দেখায় মগ্ন, কাগুজে পত্রিকায় আর স্বাদ পায় না। রাজনৈতিক মতের দ্বন্দ্ব থাকায় বাবাও তাঁর কাছ থেকে পত্রিকা নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। আর এখন তো ইন্টারনেটের সময়। সবাই টেলিভিশনে খবর দেখাও কমিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমার মন পড়ে থাকে পেপার আঙ্কেলের আনা সেই পত্রিকার ঘ্রাণে।
এখন পত্রিকা অফিসে কাজ করি। কাগজের পত্রিকা হাতে পাই প্রতিদিন। তবু সেই আকর্ষণ কাজ করে না, সেই ঘ্রাণ পাই না। বাসায় কে পত্রিকা দিয়ে যায়, সেটাও জানি না। দারোয়ানের কাছে কোনো এক হকার দিয়ে যান শুনেছি। জানি না, পেপার আঙ্কেলের মতো এই হকারও সাম্প্রতিক রাজনীতি বোঝেন কি না কিংবা কারও বাসায় গিয়ে রং চায়ে টোস্ট ডুবিয়ে রাজনীতির বিতর্ক জুড়ে দেন কি না। আদৌ কি তাঁর সেই সময় আছে?
লেখক: সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
জাতীয় প্রেসক্লাবে ৭ সেপ্টেম্বর গণশক্তি আয়োজন করে ‘জুলাই সনদ ও নির্বাচন’ শীর্ষক এক আলোচনা সভা। সেই সভায় নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না যে প্রশ্নটি করেছেন, তা কোটি টাকার সঙ্গে তুলনা করাই যায়। তাঁর সহজ জিজ্ঞাসা—‘ভোটের দিন যাঁর যেখানে শক্তি আছে, তাঁর যদি মনে হয় জিততে পারবেন না...
১ দিন আগেহিমালয়কন্যা নেপালের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ভূদৃশ্যটি পর্বতমালার মতোই চড়াই-উতরাইয়ে ভরা। ১০ বছরের মাওবাদী বিদ্রোহের রক্তক্ষরণের পর ২০০৮ সালে উচ্ছেদ হয়েছিল রাজতন্ত্র। সেই থেকে ১৩ বার সরকার বদল হয়েছে। ক্ষমতার মসনদে ঘুরেফিরে দেখা যাচ্ছিল গুটিকয়েক নেতাকে।
১ দিন আগেবেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) পরিচালিত ‘২০২৫ সালের মধ্যবর্তী সময়ে দেশের পরিবারসমূহের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি’ শীর্ষক সাম্প্রতিক জরিপের ফলাফলে উঠে এসেছে যে তিন বছরে (২০২২-২৫) দেশে দারিদ্র্যের হার ৯ দশমিক ৩ শতাংশ বেড়ে এখন ২৮ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে।
১ দিন আগেবাংলা ভাষায় একটি পরিচিত শব্দবন্ধ হলো বায়ুচড়া। এর আভিধানিক অর্থ হলো পাগলামি। পাগলামি, উন্মাদনা বা উন্মত্ততা অর্থে আমরা ‘মাথা গরম হওয়া’র কথা কমবেশি সবাই জানি। একই অর্থে বায়ুরোগ বা বায়ুগ্রস্ততাও তুলনামূলকভাবে পরিচিত। এমনকি পাগলামি অর্থে ‘মাথা ফোরটি নাইন হওয়া’র কথাও প্রচলিত রয়েছে।
১ দিন আগে