সেলিম জাহান

২০২৪ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশ তার ৫৩তম স্বাধীনতা দিবস পার করছে। ১৯৭১ সালে ৯ মাসের একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা ছিনিয়ে এনেছিলাম বিজয়ের লাল সূর্য। আমাদের স্বাধীনতা শুধু একটি ভূখণ্ডের নয়, নয় একটি মানবগোষ্ঠীর; সে বিজয় একটি চেতনার, একটি সংগ্রামের, একটি মূল্যবোধের।
দীর্ঘদিনের সংগ্রাম এবং একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশ অর্জন করেছিল তার ইপ্সিত স্বাধীনতা। একটি ধ্বংসস্তূপ থেকে ফিনিক্স পাখির মতো গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছিল দেশটি। তার পরের অর্ধ শতাব্দীতে সহস্র অন্তরায় পেরিয়ে দেশটি অর্জন করেছে এমন অর্থনৈতিক অগ্রগতি, এমন মানব উন্নয়ন এবং এমন বৈশ্বিক মর্যাদা যে সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশ নন্দিত হয়েছে একটি ‘উন্নয়ন বিস্ময়’ হিসেবে।
কিন্তু সেই সঙ্গে আমরা মুখোমুখি হচ্ছি নানান উন্নয়ন অন্তরায়ের, নানান সামাজিক সমস্যার। অসমতা, অর্থনৈতিক কাঠামোর নানান নাজুকতা, পরিবেশদূষণ ইত্যাদি বিষয় বাংলাদেশের উন্নয়নে অন্তরায় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, যূথবদ্ধতার অনুপস্থিতি, সাফল্যের মাপকাঠি হিসেবে অর্থ ও ক্ষমতার ব্যবহার, অসহনশীলতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাব, সহিংসতার বিস্তার বাংলাদেশের নানান সামাজিক সমস্যা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
কিন্তু আমার সব সময় মনে হয়েছে যে বাংলাদেশের বহু সমস্যা ও অন্তরায়ের মূল কারণ আমাদের স্বাধীনতার মৌলিক মূল্যবোধ ও চেতনা থেকে বিচ্যুতি। সেই মূল্যবোধ ও চেতনা প্রোথিত ছিল চারটি জাতীয় নীতিতে—জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। জাতীয়তাবাদ আমাদের বাঙালি আত্মসত্তার জন্য আবশ্যিক শর্ত। আত্মসত্তা বোধ একটি জাতির স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য দরকার। গণতন্ত্র ভিন্ন স্বাধীনতা বা মুক্তিকে একটি বজায়ক্ষম ভিত্তির ওপরে প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা মানবিকা অধিকার, সামাজিক ন্যায্যতা এবং সব ধরনের সমতার জন্য অত্যাবশ্যকীয়।
বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-চেতনায় ‘জাতীয়তাবাদ’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ একটা বিশেষ স্থান ছিল। বাঙালি জাতীয়তাবাদকে তিনি ‘চরম জাতীয়তাবাদ’ হিসেবে দেখেননি, দেখেছেন বাঙালি জাতির আত্মসত্তার নির্ণায়ক হিসেবে। তেমনিভাবে বারবার আমাদের আশ্বস্ত করেছেন এই বলে যে, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়’। রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় ও সমাজজীবনে তিনি ধর্ম ও জাতীয়তাবাদকে এমন জায়গায় রেখেছেন, যেখানে বাঙালি জাতির আত্মসত্তা-অস্তিত্বে কোনো দ্বন্দ্ব না থাকে, আর ধর্ম বিষয়ে কোনো সংশয় না থাকে। পরবর্তী সময়ের সব দ্বন্দ্ব ও সংশয়ের স্রষ্টা আমরাই—বহু মীমাংসিত বিষয়কে আবার ঘোলাটে করে দিয়ে।
বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্রকে প্রথাগত শার্সিতে দেখেননি, দেখেছেন সামাজিক ন্যায্যতার দৃষ্টিকোণ থেকে। সামাজিক ন্যায্যতাকে তিনি একটি শোষণমুক্ত সমাজের অপরিহার্য প্রাক্শর্ত হিসেবে ভেবেছেন। তিনি গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের কথা বলেছেন, কিন্তু দুটোকেই দেখেছেন সামাজিক ন্যায্যতার একেকটি স্তম্ভ হিসেবে। তাই সত্তরের দশকের প্রথম দিকে নানা মনে ‘গণতন্ত্র’ ও ‘সমাজতন্ত্র’ বিষয়ে নানা রকমের ধোঁয়াটে ভাব থাকলেও এ বিষয় দুটোতে বঙ্গবন্ধুর ধারণা ছিল শার্সির মতো স্বচ্ছ।
‘গণতন্ত্রকে’ তিনি শুদ্ধ একটি বিষয় হিসেবে ভাবেননি, ভেবেছেন ‘সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র’ হিসেবে; আবার ‘সমাজতন্ত্রকেও’ একটি যান্ত্রিক মাত্রায় দেখেননি, বিবেচনা করেছেন ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’ হিসেবে এবং এ দুটোকেই সম্পৃক্ত করেছেন সামাজিক ন্যায্যতার সঙ্গে। এর পরিপ্রেক্ষিতেই তিনি ‘স্বাধীনতা’ ও ‘মুক্তির’ মধ্যে পার্থক্য করেছেন। তাঁর চেতনায় ‘স্বাধীনতা’ ও ‘মুক্তির’ ব্যঞ্জনা ভিন্ন। স্বাধীনতা এলেই মুক্তি আসে না। স্বাধীনতা অর্জন করার পরেও একটি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বঞ্চনা থাকতে পারে, অসাম্য থাকতে পারে, অন্যায় থাকতে পারে। এগুলো দূর করতে পারলেই তখন কেবল মুক্তি সম্ভব। সুতরাং বাঙালি জাতির সংগ্রাম শুধু স্বাধীনতাপ্রাপ্তিতে শেষ হবে না, তাকে মুক্তি নিশ্চিত করতে হবে। কারণ স্বাধীনতা মুক্তির আবশ্যকীয় শর্ত, কিন্তু পর্যাপ্ত শর্ত নয়।
এই আদর্শিক মূল্যবোধগুলোর ওপর ভিত্তি করেই বাংলাদেশের জন্ম ও পথচলা শুরু। কিন্তু আমরা দেখেছি, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর নিকটজনদের নৃশংসভাবে হত্যার পরে তৎকালীন রাষ্ট্রযন্ত্র এসব মূল্যবোধকে অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে জলাঞ্জলি দিয়েছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে, ইতিহাসের বহু নিষ্পত্তিকৃত সত্যকে খুঁচিয়ে অনাবশ্যক বিতর্কের সৃষ্টি করা হয়েছে, আমাদের নতুন প্রজন্মকে বিপথগামী করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তো শুধু জাতির পিতাকেই হত্যা করা হয়নি, তাঁর চিন্তা-চেতনা আর মূল্যবোধ, যার ভিত্তিতে বাংলাদেশের জন্ম, সেগুলোকেও হত্যা করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। ’৭৫-পরবর্তী সময়ে বাঙালি জাতি এবং বাংলাদেশের মৌলিক চিন্তা-চেতনা ও মূল্যবোধ নস্যাৎ করার জন্য তখনকার রাষ্ট্রযন্ত্র বিবিধ প্রক্রিয়া শুরু করে, যার নানান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক মাত্রিকতা ছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরপরই রাষ্ট্রীয় অপশক্তি তাদের অপকর্মের শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে।
১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে ইতিহাসের ধারা পাল্টে দেওয়ার উদ্দেশ্যে পাঁচটি চিহ্নিত কাজ করা হয়। প্রথমত: সংবিধানকে ওলট-পালট করে তা থেকে মৌলিক চার নীতির বিচ্যুতি ঘটানো, যেমন—ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রকে বাদ দেওয়া। ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে গ্রহণ করা হয় এবং বাংলাদেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্রে পরিণত করার অপপ্রয়াস চালানো হয়।
দ্বিতীয়ত: বাংলাদেশের বিরোধী মৌলবাদী শক্তিগুলোর পুনর্বাসন এবং ১৯৭১-এর গণহত্যার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গকে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসা হয়। বাংলাদেশের যারা বিরোধিতা করে, যারা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিল, তারাই বাংলাদেশের মন্ত্রী হয়ে গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে ক্ষমতার দাপট দেখাতে শুরু করে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের নানান উচ্চপদে আসীন এবং বিদেশে নিরাপদে প্রতিষ্ঠিত করা হয়।
তৃতীয়ত: পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাসকে বিকৃত করে তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করে বিপথগামী করার অপপ্রয়াস চালানো হয়। পাঠ্যসূচিকে ইসলামিকরণের জন্য অন্য ধর্মের কবি-লেখকদের লেখা বাদ দেওয়া হয়। বহু নিষ্পত্তিকৃত সত্যকে খুঁচিয়ে নতুন বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়, যেমন—বাংলাদেশের স্বাধীনতা কে ঘোষণা করেন, আমরা বাঙালি না বাংলাদেশি ইত্যাদি।
চতুর্থত: দেশের মধ্যে উদারপন্থী চিন্তা-চেতনাকে নস্যাৎ করা, সেই সঙ্গে বাংলাদেশের সব রকমের সংখ্যালঘু জোটের নিপীড়ন সংহত করা হলো। রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের নাম করে আমাদের মূল্যবোধের ধর্মনিরপেক্ষতাকে নষ্ট করা হলো এবং সমাজের অসাম্প্রদায়িক কাঠামোকে আঘাত করা হলো।
পঞ্চমত: জোটনিরপেক্ষ চরিত্র ত্যাগ করে মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামি জেটের সঙ্গে সম্পৃক্ততা। এর একটি উদ্দেশ্য ছিল সম্পৎশালী মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে অর্থপ্রাপ্তি, অন্যদিকে এসব দেশের সঙ্গে একটি আদর্শগত সংযোগ স্থাপন।
এসব কর্মকাণ্ডের প্রেক্ষাপটে তিনটি প্রবণতা লক্ষণীয়: এক. একসময় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পীঠস্থান থেকে বলা হয়েছিল, ‘অর্থ কোনো সমস্যা নয়’। দৃশ্যমানতা, জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতা নষ্ট করার এর চেয়ে আর ভালো উপকরণ হয় না। দুই. ‘আমি রাজনীতিকে রাজনীতিকদের জন্য কঠিন করে তুলব’। একটি সুস্থ রাজনৈতিক কাঠামো ধ্বংস করতে এর চেয়ে মোক্ষম অস্ত্র নেই। তিন. দলবদলের রাজনীতিতে উৎসাহিত করা হয়েছিল। এসবেরই সমন্বিত ফলাফল হচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমাজনীতিতে সুস্থ প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে স্থায়ীভাবে পঙ্গু করে দেওয়া।
এই সবকিছুর কারণে পরবর্তী সময়ে তিনটি ধারার সৃষ্টি হয়েছে স্বদেশে। এক. যারা ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও আদর্শিক মূল্যবোধে বিশ্বাস করেনি এবং এর বিরোধিতা করেছে, তাদের অবস্থান আরও সংহত হয়েছে। দুই. আমরা যারা একাত্তরের প্রজন্ম, তাদের একটি অংশ যেমন বাংলাদেশ নামটি, তার মুক্তিযুদ্ধ, তার আদর্শিক মূল্যবোধ দ্বারা সর্বদা সার্বক্ষণিকভাবে উদ্বেলিত হয়েছি, তেমনি আমাদের প্রজন্মের আরেকটি অংশ তো সবকিছু শুধু বিস্মৃতই হইনি, বিপথগামীও তো হয়েছি। তিন. জাতির নতুন প্রজন্মের কাছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইতিহাস, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের আদর্শিক মূল্যবোধ হয় সম্পূর্ণ অজ্ঞাত রয়ে গেছে, নয়তো বিকৃত হয়ে উপস্থাপিত হয়েছে।
২০২৪ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৩ বছর অতিক্রান্ত হলো। আমরা একটি ক্রান্তিকালের মাঝখান দিয়ে চলেছি। যখন ফিরে তাকাই, তখন মনে হয় ১৯৭১ সালের মতো আজও একটি সংগ্রাম আমাদের করতে হবে—সেই লড়াই বাংলাদেশের মূল্যবোধকে সংহত করার, সেই যুদ্ধ বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক চিন্তা-চেতনাকে প্রতিষ্ঠিত করার। চূড়ান্ত বিচারে, এই লড়াই আমাদের বাঁচার লড়াই, এই লড়াইয়ে জিততে হবে।
সেলিম জাহান, ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর ও দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

২০২৪ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশ তার ৫৩তম স্বাধীনতা দিবস পার করছে। ১৯৭১ সালে ৯ মাসের একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা ছিনিয়ে এনেছিলাম বিজয়ের লাল সূর্য। আমাদের স্বাধীনতা শুধু একটি ভূখণ্ডের নয়, নয় একটি মানবগোষ্ঠীর; সে বিজয় একটি চেতনার, একটি সংগ্রামের, একটি মূল্যবোধের।
দীর্ঘদিনের সংগ্রাম এবং একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশ অর্জন করেছিল তার ইপ্সিত স্বাধীনতা। একটি ধ্বংসস্তূপ থেকে ফিনিক্স পাখির মতো গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছিল দেশটি। তার পরের অর্ধ শতাব্দীতে সহস্র অন্তরায় পেরিয়ে দেশটি অর্জন করেছে এমন অর্থনৈতিক অগ্রগতি, এমন মানব উন্নয়ন এবং এমন বৈশ্বিক মর্যাদা যে সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশ নন্দিত হয়েছে একটি ‘উন্নয়ন বিস্ময়’ হিসেবে।
কিন্তু সেই সঙ্গে আমরা মুখোমুখি হচ্ছি নানান উন্নয়ন অন্তরায়ের, নানান সামাজিক সমস্যার। অসমতা, অর্থনৈতিক কাঠামোর নানান নাজুকতা, পরিবেশদূষণ ইত্যাদি বিষয় বাংলাদেশের উন্নয়নে অন্তরায় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, যূথবদ্ধতার অনুপস্থিতি, সাফল্যের মাপকাঠি হিসেবে অর্থ ও ক্ষমতার ব্যবহার, অসহনশীলতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাব, সহিংসতার বিস্তার বাংলাদেশের নানান সামাজিক সমস্যা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
কিন্তু আমার সব সময় মনে হয়েছে যে বাংলাদেশের বহু সমস্যা ও অন্তরায়ের মূল কারণ আমাদের স্বাধীনতার মৌলিক মূল্যবোধ ও চেতনা থেকে বিচ্যুতি। সেই মূল্যবোধ ও চেতনা প্রোথিত ছিল চারটি জাতীয় নীতিতে—জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। জাতীয়তাবাদ আমাদের বাঙালি আত্মসত্তার জন্য আবশ্যিক শর্ত। আত্মসত্তা বোধ একটি জাতির স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য দরকার। গণতন্ত্র ভিন্ন স্বাধীনতা বা মুক্তিকে একটি বজায়ক্ষম ভিত্তির ওপরে প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা মানবিকা অধিকার, সামাজিক ন্যায্যতা এবং সব ধরনের সমতার জন্য অত্যাবশ্যকীয়।
বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-চেতনায় ‘জাতীয়তাবাদ’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ একটা বিশেষ স্থান ছিল। বাঙালি জাতীয়তাবাদকে তিনি ‘চরম জাতীয়তাবাদ’ হিসেবে দেখেননি, দেখেছেন বাঙালি জাতির আত্মসত্তার নির্ণায়ক হিসেবে। তেমনিভাবে বারবার আমাদের আশ্বস্ত করেছেন এই বলে যে, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়’। রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় ও সমাজজীবনে তিনি ধর্ম ও জাতীয়তাবাদকে এমন জায়গায় রেখেছেন, যেখানে বাঙালি জাতির আত্মসত্তা-অস্তিত্বে কোনো দ্বন্দ্ব না থাকে, আর ধর্ম বিষয়ে কোনো সংশয় না থাকে। পরবর্তী সময়ের সব দ্বন্দ্ব ও সংশয়ের স্রষ্টা আমরাই—বহু মীমাংসিত বিষয়কে আবার ঘোলাটে করে দিয়ে।
বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্রকে প্রথাগত শার্সিতে দেখেননি, দেখেছেন সামাজিক ন্যায্যতার দৃষ্টিকোণ থেকে। সামাজিক ন্যায্যতাকে তিনি একটি শোষণমুক্ত সমাজের অপরিহার্য প্রাক্শর্ত হিসেবে ভেবেছেন। তিনি গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের কথা বলেছেন, কিন্তু দুটোকেই দেখেছেন সামাজিক ন্যায্যতার একেকটি স্তম্ভ হিসেবে। তাই সত্তরের দশকের প্রথম দিকে নানা মনে ‘গণতন্ত্র’ ও ‘সমাজতন্ত্র’ বিষয়ে নানা রকমের ধোঁয়াটে ভাব থাকলেও এ বিষয় দুটোতে বঙ্গবন্ধুর ধারণা ছিল শার্সির মতো স্বচ্ছ।
‘গণতন্ত্রকে’ তিনি শুদ্ধ একটি বিষয় হিসেবে ভাবেননি, ভেবেছেন ‘সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র’ হিসেবে; আবার ‘সমাজতন্ত্রকেও’ একটি যান্ত্রিক মাত্রায় দেখেননি, বিবেচনা করেছেন ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’ হিসেবে এবং এ দুটোকেই সম্পৃক্ত করেছেন সামাজিক ন্যায্যতার সঙ্গে। এর পরিপ্রেক্ষিতেই তিনি ‘স্বাধীনতা’ ও ‘মুক্তির’ মধ্যে পার্থক্য করেছেন। তাঁর চেতনায় ‘স্বাধীনতা’ ও ‘মুক্তির’ ব্যঞ্জনা ভিন্ন। স্বাধীনতা এলেই মুক্তি আসে না। স্বাধীনতা অর্জন করার পরেও একটি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বঞ্চনা থাকতে পারে, অসাম্য থাকতে পারে, অন্যায় থাকতে পারে। এগুলো দূর করতে পারলেই তখন কেবল মুক্তি সম্ভব। সুতরাং বাঙালি জাতির সংগ্রাম শুধু স্বাধীনতাপ্রাপ্তিতে শেষ হবে না, তাকে মুক্তি নিশ্চিত করতে হবে। কারণ স্বাধীনতা মুক্তির আবশ্যকীয় শর্ত, কিন্তু পর্যাপ্ত শর্ত নয়।
এই আদর্শিক মূল্যবোধগুলোর ওপর ভিত্তি করেই বাংলাদেশের জন্ম ও পথচলা শুরু। কিন্তু আমরা দেখেছি, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর নিকটজনদের নৃশংসভাবে হত্যার পরে তৎকালীন রাষ্ট্রযন্ত্র এসব মূল্যবোধকে অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে জলাঞ্জলি দিয়েছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে, ইতিহাসের বহু নিষ্পত্তিকৃত সত্যকে খুঁচিয়ে অনাবশ্যক বিতর্কের সৃষ্টি করা হয়েছে, আমাদের নতুন প্রজন্মকে বিপথগামী করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তো শুধু জাতির পিতাকেই হত্যা করা হয়নি, তাঁর চিন্তা-চেতনা আর মূল্যবোধ, যার ভিত্তিতে বাংলাদেশের জন্ম, সেগুলোকেও হত্যা করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। ’৭৫-পরবর্তী সময়ে বাঙালি জাতি এবং বাংলাদেশের মৌলিক চিন্তা-চেতনা ও মূল্যবোধ নস্যাৎ করার জন্য তখনকার রাষ্ট্রযন্ত্র বিবিধ প্রক্রিয়া শুরু করে, যার নানান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক মাত্রিকতা ছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরপরই রাষ্ট্রীয় অপশক্তি তাদের অপকর্মের শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে।
১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে ইতিহাসের ধারা পাল্টে দেওয়ার উদ্দেশ্যে পাঁচটি চিহ্নিত কাজ করা হয়। প্রথমত: সংবিধানকে ওলট-পালট করে তা থেকে মৌলিক চার নীতির বিচ্যুতি ঘটানো, যেমন—ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রকে বাদ দেওয়া। ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে গ্রহণ করা হয় এবং বাংলাদেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্রে পরিণত করার অপপ্রয়াস চালানো হয়।
দ্বিতীয়ত: বাংলাদেশের বিরোধী মৌলবাদী শক্তিগুলোর পুনর্বাসন এবং ১৯৭১-এর গণহত্যার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গকে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসা হয়। বাংলাদেশের যারা বিরোধিতা করে, যারা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিল, তারাই বাংলাদেশের মন্ত্রী হয়ে গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে ক্ষমতার দাপট দেখাতে শুরু করে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের নানান উচ্চপদে আসীন এবং বিদেশে নিরাপদে প্রতিষ্ঠিত করা হয়।
তৃতীয়ত: পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাসকে বিকৃত করে তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করে বিপথগামী করার অপপ্রয়াস চালানো হয়। পাঠ্যসূচিকে ইসলামিকরণের জন্য অন্য ধর্মের কবি-লেখকদের লেখা বাদ দেওয়া হয়। বহু নিষ্পত্তিকৃত সত্যকে খুঁচিয়ে নতুন বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়, যেমন—বাংলাদেশের স্বাধীনতা কে ঘোষণা করেন, আমরা বাঙালি না বাংলাদেশি ইত্যাদি।
চতুর্থত: দেশের মধ্যে উদারপন্থী চিন্তা-চেতনাকে নস্যাৎ করা, সেই সঙ্গে বাংলাদেশের সব রকমের সংখ্যালঘু জোটের নিপীড়ন সংহত করা হলো। রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের নাম করে আমাদের মূল্যবোধের ধর্মনিরপেক্ষতাকে নষ্ট করা হলো এবং সমাজের অসাম্প্রদায়িক কাঠামোকে আঘাত করা হলো।
পঞ্চমত: জোটনিরপেক্ষ চরিত্র ত্যাগ করে মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামি জেটের সঙ্গে সম্পৃক্ততা। এর একটি উদ্দেশ্য ছিল সম্পৎশালী মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে অর্থপ্রাপ্তি, অন্যদিকে এসব দেশের সঙ্গে একটি আদর্শগত সংযোগ স্থাপন।
এসব কর্মকাণ্ডের প্রেক্ষাপটে তিনটি প্রবণতা লক্ষণীয়: এক. একসময় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পীঠস্থান থেকে বলা হয়েছিল, ‘অর্থ কোনো সমস্যা নয়’। দৃশ্যমানতা, জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতা নষ্ট করার এর চেয়ে আর ভালো উপকরণ হয় না। দুই. ‘আমি রাজনীতিকে রাজনীতিকদের জন্য কঠিন করে তুলব’। একটি সুস্থ রাজনৈতিক কাঠামো ধ্বংস করতে এর চেয়ে মোক্ষম অস্ত্র নেই। তিন. দলবদলের রাজনীতিতে উৎসাহিত করা হয়েছিল। এসবেরই সমন্বিত ফলাফল হচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমাজনীতিতে সুস্থ প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে স্থায়ীভাবে পঙ্গু করে দেওয়া।
এই সবকিছুর কারণে পরবর্তী সময়ে তিনটি ধারার সৃষ্টি হয়েছে স্বদেশে। এক. যারা ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও আদর্শিক মূল্যবোধে বিশ্বাস করেনি এবং এর বিরোধিতা করেছে, তাদের অবস্থান আরও সংহত হয়েছে। দুই. আমরা যারা একাত্তরের প্রজন্ম, তাদের একটি অংশ যেমন বাংলাদেশ নামটি, তার মুক্তিযুদ্ধ, তার আদর্শিক মূল্যবোধ দ্বারা সর্বদা সার্বক্ষণিকভাবে উদ্বেলিত হয়েছি, তেমনি আমাদের প্রজন্মের আরেকটি অংশ তো সবকিছু শুধু বিস্মৃতই হইনি, বিপথগামীও তো হয়েছি। তিন. জাতির নতুন প্রজন্মের কাছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইতিহাস, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের আদর্শিক মূল্যবোধ হয় সম্পূর্ণ অজ্ঞাত রয়ে গেছে, নয়তো বিকৃত হয়ে উপস্থাপিত হয়েছে।
২০২৪ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৩ বছর অতিক্রান্ত হলো। আমরা একটি ক্রান্তিকালের মাঝখান দিয়ে চলেছি। যখন ফিরে তাকাই, তখন মনে হয় ১৯৭১ সালের মতো আজও একটি সংগ্রাম আমাদের করতে হবে—সেই লড়াই বাংলাদেশের মূল্যবোধকে সংহত করার, সেই যুদ্ধ বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক চিন্তা-চেতনাকে প্রতিষ্ঠিত করার। চূড়ান্ত বিচারে, এই লড়াই আমাদের বাঁচার লড়াই, এই লড়াইয়ে জিততে হবে।
সেলিম জাহান, ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর ও দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
সেলিম জাহান

২০২৪ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশ তার ৫৩তম স্বাধীনতা দিবস পার করছে। ১৯৭১ সালে ৯ মাসের একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা ছিনিয়ে এনেছিলাম বিজয়ের লাল সূর্য। আমাদের স্বাধীনতা শুধু একটি ভূখণ্ডের নয়, নয় একটি মানবগোষ্ঠীর; সে বিজয় একটি চেতনার, একটি সংগ্রামের, একটি মূল্যবোধের।
দীর্ঘদিনের সংগ্রাম এবং একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশ অর্জন করেছিল তার ইপ্সিত স্বাধীনতা। একটি ধ্বংসস্তূপ থেকে ফিনিক্স পাখির মতো গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছিল দেশটি। তার পরের অর্ধ শতাব্দীতে সহস্র অন্তরায় পেরিয়ে দেশটি অর্জন করেছে এমন অর্থনৈতিক অগ্রগতি, এমন মানব উন্নয়ন এবং এমন বৈশ্বিক মর্যাদা যে সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশ নন্দিত হয়েছে একটি ‘উন্নয়ন বিস্ময়’ হিসেবে।
কিন্তু সেই সঙ্গে আমরা মুখোমুখি হচ্ছি নানান উন্নয়ন অন্তরায়ের, নানান সামাজিক সমস্যার। অসমতা, অর্থনৈতিক কাঠামোর নানান নাজুকতা, পরিবেশদূষণ ইত্যাদি বিষয় বাংলাদেশের উন্নয়নে অন্তরায় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, যূথবদ্ধতার অনুপস্থিতি, সাফল্যের মাপকাঠি হিসেবে অর্থ ও ক্ষমতার ব্যবহার, অসহনশীলতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাব, সহিংসতার বিস্তার বাংলাদেশের নানান সামাজিক সমস্যা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
কিন্তু আমার সব সময় মনে হয়েছে যে বাংলাদেশের বহু সমস্যা ও অন্তরায়ের মূল কারণ আমাদের স্বাধীনতার মৌলিক মূল্যবোধ ও চেতনা থেকে বিচ্যুতি। সেই মূল্যবোধ ও চেতনা প্রোথিত ছিল চারটি জাতীয় নীতিতে—জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। জাতীয়তাবাদ আমাদের বাঙালি আত্মসত্তার জন্য আবশ্যিক শর্ত। আত্মসত্তা বোধ একটি জাতির স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য দরকার। গণতন্ত্র ভিন্ন স্বাধীনতা বা মুক্তিকে একটি বজায়ক্ষম ভিত্তির ওপরে প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা মানবিকা অধিকার, সামাজিক ন্যায্যতা এবং সব ধরনের সমতার জন্য অত্যাবশ্যকীয়।
বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-চেতনায় ‘জাতীয়তাবাদ’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ একটা বিশেষ স্থান ছিল। বাঙালি জাতীয়তাবাদকে তিনি ‘চরম জাতীয়তাবাদ’ হিসেবে দেখেননি, দেখেছেন বাঙালি জাতির আত্মসত্তার নির্ণায়ক হিসেবে। তেমনিভাবে বারবার আমাদের আশ্বস্ত করেছেন এই বলে যে, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়’। রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় ও সমাজজীবনে তিনি ধর্ম ও জাতীয়তাবাদকে এমন জায়গায় রেখেছেন, যেখানে বাঙালি জাতির আত্মসত্তা-অস্তিত্বে কোনো দ্বন্দ্ব না থাকে, আর ধর্ম বিষয়ে কোনো সংশয় না থাকে। পরবর্তী সময়ের সব দ্বন্দ্ব ও সংশয়ের স্রষ্টা আমরাই—বহু মীমাংসিত বিষয়কে আবার ঘোলাটে করে দিয়ে।
বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্রকে প্রথাগত শার্সিতে দেখেননি, দেখেছেন সামাজিক ন্যায্যতার দৃষ্টিকোণ থেকে। সামাজিক ন্যায্যতাকে তিনি একটি শোষণমুক্ত সমাজের অপরিহার্য প্রাক্শর্ত হিসেবে ভেবেছেন। তিনি গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের কথা বলেছেন, কিন্তু দুটোকেই দেখেছেন সামাজিক ন্যায্যতার একেকটি স্তম্ভ হিসেবে। তাই সত্তরের দশকের প্রথম দিকে নানা মনে ‘গণতন্ত্র’ ও ‘সমাজতন্ত্র’ বিষয়ে নানা রকমের ধোঁয়াটে ভাব থাকলেও এ বিষয় দুটোতে বঙ্গবন্ধুর ধারণা ছিল শার্সির মতো স্বচ্ছ।
‘গণতন্ত্রকে’ তিনি শুদ্ধ একটি বিষয় হিসেবে ভাবেননি, ভেবেছেন ‘সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র’ হিসেবে; আবার ‘সমাজতন্ত্রকেও’ একটি যান্ত্রিক মাত্রায় দেখেননি, বিবেচনা করেছেন ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’ হিসেবে এবং এ দুটোকেই সম্পৃক্ত করেছেন সামাজিক ন্যায্যতার সঙ্গে। এর পরিপ্রেক্ষিতেই তিনি ‘স্বাধীনতা’ ও ‘মুক্তির’ মধ্যে পার্থক্য করেছেন। তাঁর চেতনায় ‘স্বাধীনতা’ ও ‘মুক্তির’ ব্যঞ্জনা ভিন্ন। স্বাধীনতা এলেই মুক্তি আসে না। স্বাধীনতা অর্জন করার পরেও একটি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বঞ্চনা থাকতে পারে, অসাম্য থাকতে পারে, অন্যায় থাকতে পারে। এগুলো দূর করতে পারলেই তখন কেবল মুক্তি সম্ভব। সুতরাং বাঙালি জাতির সংগ্রাম শুধু স্বাধীনতাপ্রাপ্তিতে শেষ হবে না, তাকে মুক্তি নিশ্চিত করতে হবে। কারণ স্বাধীনতা মুক্তির আবশ্যকীয় শর্ত, কিন্তু পর্যাপ্ত শর্ত নয়।
এই আদর্শিক মূল্যবোধগুলোর ওপর ভিত্তি করেই বাংলাদেশের জন্ম ও পথচলা শুরু। কিন্তু আমরা দেখেছি, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর নিকটজনদের নৃশংসভাবে হত্যার পরে তৎকালীন রাষ্ট্রযন্ত্র এসব মূল্যবোধকে অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে জলাঞ্জলি দিয়েছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে, ইতিহাসের বহু নিষ্পত্তিকৃত সত্যকে খুঁচিয়ে অনাবশ্যক বিতর্কের সৃষ্টি করা হয়েছে, আমাদের নতুন প্রজন্মকে বিপথগামী করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তো শুধু জাতির পিতাকেই হত্যা করা হয়নি, তাঁর চিন্তা-চেতনা আর মূল্যবোধ, যার ভিত্তিতে বাংলাদেশের জন্ম, সেগুলোকেও হত্যা করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। ’৭৫-পরবর্তী সময়ে বাঙালি জাতি এবং বাংলাদেশের মৌলিক চিন্তা-চেতনা ও মূল্যবোধ নস্যাৎ করার জন্য তখনকার রাষ্ট্রযন্ত্র বিবিধ প্রক্রিয়া শুরু করে, যার নানান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক মাত্রিকতা ছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরপরই রাষ্ট্রীয় অপশক্তি তাদের অপকর্মের শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে।
১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে ইতিহাসের ধারা পাল্টে দেওয়ার উদ্দেশ্যে পাঁচটি চিহ্নিত কাজ করা হয়। প্রথমত: সংবিধানকে ওলট-পালট করে তা থেকে মৌলিক চার নীতির বিচ্যুতি ঘটানো, যেমন—ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রকে বাদ দেওয়া। ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে গ্রহণ করা হয় এবং বাংলাদেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্রে পরিণত করার অপপ্রয়াস চালানো হয়।
দ্বিতীয়ত: বাংলাদেশের বিরোধী মৌলবাদী শক্তিগুলোর পুনর্বাসন এবং ১৯৭১-এর গণহত্যার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গকে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসা হয়। বাংলাদেশের যারা বিরোধিতা করে, যারা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিল, তারাই বাংলাদেশের মন্ত্রী হয়ে গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে ক্ষমতার দাপট দেখাতে শুরু করে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের নানান উচ্চপদে আসীন এবং বিদেশে নিরাপদে প্রতিষ্ঠিত করা হয়।
তৃতীয়ত: পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাসকে বিকৃত করে তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করে বিপথগামী করার অপপ্রয়াস চালানো হয়। পাঠ্যসূচিকে ইসলামিকরণের জন্য অন্য ধর্মের কবি-লেখকদের লেখা বাদ দেওয়া হয়। বহু নিষ্পত্তিকৃত সত্যকে খুঁচিয়ে নতুন বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়, যেমন—বাংলাদেশের স্বাধীনতা কে ঘোষণা করেন, আমরা বাঙালি না বাংলাদেশি ইত্যাদি।
চতুর্থত: দেশের মধ্যে উদারপন্থী চিন্তা-চেতনাকে নস্যাৎ করা, সেই সঙ্গে বাংলাদেশের সব রকমের সংখ্যালঘু জোটের নিপীড়ন সংহত করা হলো। রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের নাম করে আমাদের মূল্যবোধের ধর্মনিরপেক্ষতাকে নষ্ট করা হলো এবং সমাজের অসাম্প্রদায়িক কাঠামোকে আঘাত করা হলো।
পঞ্চমত: জোটনিরপেক্ষ চরিত্র ত্যাগ করে মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামি জেটের সঙ্গে সম্পৃক্ততা। এর একটি উদ্দেশ্য ছিল সম্পৎশালী মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে অর্থপ্রাপ্তি, অন্যদিকে এসব দেশের সঙ্গে একটি আদর্শগত সংযোগ স্থাপন।
এসব কর্মকাণ্ডের প্রেক্ষাপটে তিনটি প্রবণতা লক্ষণীয়: এক. একসময় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পীঠস্থান থেকে বলা হয়েছিল, ‘অর্থ কোনো সমস্যা নয়’। দৃশ্যমানতা, জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতা নষ্ট করার এর চেয়ে আর ভালো উপকরণ হয় না। দুই. ‘আমি রাজনীতিকে রাজনীতিকদের জন্য কঠিন করে তুলব’। একটি সুস্থ রাজনৈতিক কাঠামো ধ্বংস করতে এর চেয়ে মোক্ষম অস্ত্র নেই। তিন. দলবদলের রাজনীতিতে উৎসাহিত করা হয়েছিল। এসবেরই সমন্বিত ফলাফল হচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমাজনীতিতে সুস্থ প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে স্থায়ীভাবে পঙ্গু করে দেওয়া।
এই সবকিছুর কারণে পরবর্তী সময়ে তিনটি ধারার সৃষ্টি হয়েছে স্বদেশে। এক. যারা ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও আদর্শিক মূল্যবোধে বিশ্বাস করেনি এবং এর বিরোধিতা করেছে, তাদের অবস্থান আরও সংহত হয়েছে। দুই. আমরা যারা একাত্তরের প্রজন্ম, তাদের একটি অংশ যেমন বাংলাদেশ নামটি, তার মুক্তিযুদ্ধ, তার আদর্শিক মূল্যবোধ দ্বারা সর্বদা সার্বক্ষণিকভাবে উদ্বেলিত হয়েছি, তেমনি আমাদের প্রজন্মের আরেকটি অংশ তো সবকিছু শুধু বিস্মৃতই হইনি, বিপথগামীও তো হয়েছি। তিন. জাতির নতুন প্রজন্মের কাছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইতিহাস, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের আদর্শিক মূল্যবোধ হয় সম্পূর্ণ অজ্ঞাত রয়ে গেছে, নয়তো বিকৃত হয়ে উপস্থাপিত হয়েছে।
২০২৪ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৩ বছর অতিক্রান্ত হলো। আমরা একটি ক্রান্তিকালের মাঝখান দিয়ে চলেছি। যখন ফিরে তাকাই, তখন মনে হয় ১৯৭১ সালের মতো আজও একটি সংগ্রাম আমাদের করতে হবে—সেই লড়াই বাংলাদেশের মূল্যবোধকে সংহত করার, সেই যুদ্ধ বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক চিন্তা-চেতনাকে প্রতিষ্ঠিত করার। চূড়ান্ত বিচারে, এই লড়াই আমাদের বাঁচার লড়াই, এই লড়াইয়ে জিততে হবে।
সেলিম জাহান, ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর ও দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

২০২৪ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশ তার ৫৩তম স্বাধীনতা দিবস পার করছে। ১৯৭১ সালে ৯ মাসের একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা ছিনিয়ে এনেছিলাম বিজয়ের লাল সূর্য। আমাদের স্বাধীনতা শুধু একটি ভূখণ্ডের নয়, নয় একটি মানবগোষ্ঠীর; সে বিজয় একটি চেতনার, একটি সংগ্রামের, একটি মূল্যবোধের।
দীর্ঘদিনের সংগ্রাম এবং একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশ অর্জন করেছিল তার ইপ্সিত স্বাধীনতা। একটি ধ্বংসস্তূপ থেকে ফিনিক্স পাখির মতো গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছিল দেশটি। তার পরের অর্ধ শতাব্দীতে সহস্র অন্তরায় পেরিয়ে দেশটি অর্জন করেছে এমন অর্থনৈতিক অগ্রগতি, এমন মানব উন্নয়ন এবং এমন বৈশ্বিক মর্যাদা যে সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশ নন্দিত হয়েছে একটি ‘উন্নয়ন বিস্ময়’ হিসেবে।
কিন্তু সেই সঙ্গে আমরা মুখোমুখি হচ্ছি নানান উন্নয়ন অন্তরায়ের, নানান সামাজিক সমস্যার। অসমতা, অর্থনৈতিক কাঠামোর নানান নাজুকতা, পরিবেশদূষণ ইত্যাদি বিষয় বাংলাদেশের উন্নয়নে অন্তরায় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, যূথবদ্ধতার অনুপস্থিতি, সাফল্যের মাপকাঠি হিসেবে অর্থ ও ক্ষমতার ব্যবহার, অসহনশীলতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাব, সহিংসতার বিস্তার বাংলাদেশের নানান সামাজিক সমস্যা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
কিন্তু আমার সব সময় মনে হয়েছে যে বাংলাদেশের বহু সমস্যা ও অন্তরায়ের মূল কারণ আমাদের স্বাধীনতার মৌলিক মূল্যবোধ ও চেতনা থেকে বিচ্যুতি। সেই মূল্যবোধ ও চেতনা প্রোথিত ছিল চারটি জাতীয় নীতিতে—জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। জাতীয়তাবাদ আমাদের বাঙালি আত্মসত্তার জন্য আবশ্যিক শর্ত। আত্মসত্তা বোধ একটি জাতির স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য দরকার। গণতন্ত্র ভিন্ন স্বাধীনতা বা মুক্তিকে একটি বজায়ক্ষম ভিত্তির ওপরে প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা মানবিকা অধিকার, সামাজিক ন্যায্যতা এবং সব ধরনের সমতার জন্য অত্যাবশ্যকীয়।
বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-চেতনায় ‘জাতীয়তাবাদ’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ একটা বিশেষ স্থান ছিল। বাঙালি জাতীয়তাবাদকে তিনি ‘চরম জাতীয়তাবাদ’ হিসেবে দেখেননি, দেখেছেন বাঙালি জাতির আত্মসত্তার নির্ণায়ক হিসেবে। তেমনিভাবে বারবার আমাদের আশ্বস্ত করেছেন এই বলে যে, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়’। রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় ও সমাজজীবনে তিনি ধর্ম ও জাতীয়তাবাদকে এমন জায়গায় রেখেছেন, যেখানে বাঙালি জাতির আত্মসত্তা-অস্তিত্বে কোনো দ্বন্দ্ব না থাকে, আর ধর্ম বিষয়ে কোনো সংশয় না থাকে। পরবর্তী সময়ের সব দ্বন্দ্ব ও সংশয়ের স্রষ্টা আমরাই—বহু মীমাংসিত বিষয়কে আবার ঘোলাটে করে দিয়ে।
বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্রকে প্রথাগত শার্সিতে দেখেননি, দেখেছেন সামাজিক ন্যায্যতার দৃষ্টিকোণ থেকে। সামাজিক ন্যায্যতাকে তিনি একটি শোষণমুক্ত সমাজের অপরিহার্য প্রাক্শর্ত হিসেবে ভেবেছেন। তিনি গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের কথা বলেছেন, কিন্তু দুটোকেই দেখেছেন সামাজিক ন্যায্যতার একেকটি স্তম্ভ হিসেবে। তাই সত্তরের দশকের প্রথম দিকে নানা মনে ‘গণতন্ত্র’ ও ‘সমাজতন্ত্র’ বিষয়ে নানা রকমের ধোঁয়াটে ভাব থাকলেও এ বিষয় দুটোতে বঙ্গবন্ধুর ধারণা ছিল শার্সির মতো স্বচ্ছ।
‘গণতন্ত্রকে’ তিনি শুদ্ধ একটি বিষয় হিসেবে ভাবেননি, ভেবেছেন ‘সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র’ হিসেবে; আবার ‘সমাজতন্ত্রকেও’ একটি যান্ত্রিক মাত্রায় দেখেননি, বিবেচনা করেছেন ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’ হিসেবে এবং এ দুটোকেই সম্পৃক্ত করেছেন সামাজিক ন্যায্যতার সঙ্গে। এর পরিপ্রেক্ষিতেই তিনি ‘স্বাধীনতা’ ও ‘মুক্তির’ মধ্যে পার্থক্য করেছেন। তাঁর চেতনায় ‘স্বাধীনতা’ ও ‘মুক্তির’ ব্যঞ্জনা ভিন্ন। স্বাধীনতা এলেই মুক্তি আসে না। স্বাধীনতা অর্জন করার পরেও একটি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বঞ্চনা থাকতে পারে, অসাম্য থাকতে পারে, অন্যায় থাকতে পারে। এগুলো দূর করতে পারলেই তখন কেবল মুক্তি সম্ভব। সুতরাং বাঙালি জাতির সংগ্রাম শুধু স্বাধীনতাপ্রাপ্তিতে শেষ হবে না, তাকে মুক্তি নিশ্চিত করতে হবে। কারণ স্বাধীনতা মুক্তির আবশ্যকীয় শর্ত, কিন্তু পর্যাপ্ত শর্ত নয়।
এই আদর্শিক মূল্যবোধগুলোর ওপর ভিত্তি করেই বাংলাদেশের জন্ম ও পথচলা শুরু। কিন্তু আমরা দেখেছি, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর নিকটজনদের নৃশংসভাবে হত্যার পরে তৎকালীন রাষ্ট্রযন্ত্র এসব মূল্যবোধকে অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে জলাঞ্জলি দিয়েছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে, ইতিহাসের বহু নিষ্পত্তিকৃত সত্যকে খুঁচিয়ে অনাবশ্যক বিতর্কের সৃষ্টি করা হয়েছে, আমাদের নতুন প্রজন্মকে বিপথগামী করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তো শুধু জাতির পিতাকেই হত্যা করা হয়নি, তাঁর চিন্তা-চেতনা আর মূল্যবোধ, যার ভিত্তিতে বাংলাদেশের জন্ম, সেগুলোকেও হত্যা করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। ’৭৫-পরবর্তী সময়ে বাঙালি জাতি এবং বাংলাদেশের মৌলিক চিন্তা-চেতনা ও মূল্যবোধ নস্যাৎ করার জন্য তখনকার রাষ্ট্রযন্ত্র বিবিধ প্রক্রিয়া শুরু করে, যার নানান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক মাত্রিকতা ছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরপরই রাষ্ট্রীয় অপশক্তি তাদের অপকর্মের শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে।
১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে ইতিহাসের ধারা পাল্টে দেওয়ার উদ্দেশ্যে পাঁচটি চিহ্নিত কাজ করা হয়। প্রথমত: সংবিধানকে ওলট-পালট করে তা থেকে মৌলিক চার নীতির বিচ্যুতি ঘটানো, যেমন—ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রকে বাদ দেওয়া। ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে গ্রহণ করা হয় এবং বাংলাদেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্রে পরিণত করার অপপ্রয়াস চালানো হয়।
দ্বিতীয়ত: বাংলাদেশের বিরোধী মৌলবাদী শক্তিগুলোর পুনর্বাসন এবং ১৯৭১-এর গণহত্যার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গকে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসা হয়। বাংলাদেশের যারা বিরোধিতা করে, যারা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিল, তারাই বাংলাদেশের মন্ত্রী হয়ে গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে ক্ষমতার দাপট দেখাতে শুরু করে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের নানান উচ্চপদে আসীন এবং বিদেশে নিরাপদে প্রতিষ্ঠিত করা হয়।
তৃতীয়ত: পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাসকে বিকৃত করে তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করে বিপথগামী করার অপপ্রয়াস চালানো হয়। পাঠ্যসূচিকে ইসলামিকরণের জন্য অন্য ধর্মের কবি-লেখকদের লেখা বাদ দেওয়া হয়। বহু নিষ্পত্তিকৃত সত্যকে খুঁচিয়ে নতুন বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়, যেমন—বাংলাদেশের স্বাধীনতা কে ঘোষণা করেন, আমরা বাঙালি না বাংলাদেশি ইত্যাদি।
চতুর্থত: দেশের মধ্যে উদারপন্থী চিন্তা-চেতনাকে নস্যাৎ করা, সেই সঙ্গে বাংলাদেশের সব রকমের সংখ্যালঘু জোটের নিপীড়ন সংহত করা হলো। রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের নাম করে আমাদের মূল্যবোধের ধর্মনিরপেক্ষতাকে নষ্ট করা হলো এবং সমাজের অসাম্প্রদায়িক কাঠামোকে আঘাত করা হলো।
পঞ্চমত: জোটনিরপেক্ষ চরিত্র ত্যাগ করে মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামি জেটের সঙ্গে সম্পৃক্ততা। এর একটি উদ্দেশ্য ছিল সম্পৎশালী মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে অর্থপ্রাপ্তি, অন্যদিকে এসব দেশের সঙ্গে একটি আদর্শগত সংযোগ স্থাপন।
এসব কর্মকাণ্ডের প্রেক্ষাপটে তিনটি প্রবণতা লক্ষণীয়: এক. একসময় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পীঠস্থান থেকে বলা হয়েছিল, ‘অর্থ কোনো সমস্যা নয়’। দৃশ্যমানতা, জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতা নষ্ট করার এর চেয়ে আর ভালো উপকরণ হয় না। দুই. ‘আমি রাজনীতিকে রাজনীতিকদের জন্য কঠিন করে তুলব’। একটি সুস্থ রাজনৈতিক কাঠামো ধ্বংস করতে এর চেয়ে মোক্ষম অস্ত্র নেই। তিন. দলবদলের রাজনীতিতে উৎসাহিত করা হয়েছিল। এসবেরই সমন্বিত ফলাফল হচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমাজনীতিতে সুস্থ প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে স্থায়ীভাবে পঙ্গু করে দেওয়া।
এই সবকিছুর কারণে পরবর্তী সময়ে তিনটি ধারার সৃষ্টি হয়েছে স্বদেশে। এক. যারা ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও আদর্শিক মূল্যবোধে বিশ্বাস করেনি এবং এর বিরোধিতা করেছে, তাদের অবস্থান আরও সংহত হয়েছে। দুই. আমরা যারা একাত্তরের প্রজন্ম, তাদের একটি অংশ যেমন বাংলাদেশ নামটি, তার মুক্তিযুদ্ধ, তার আদর্শিক মূল্যবোধ দ্বারা সর্বদা সার্বক্ষণিকভাবে উদ্বেলিত হয়েছি, তেমনি আমাদের প্রজন্মের আরেকটি অংশ তো সবকিছু শুধু বিস্মৃতই হইনি, বিপথগামীও তো হয়েছি। তিন. জাতির নতুন প্রজন্মের কাছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইতিহাস, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের আদর্শিক মূল্যবোধ হয় সম্পূর্ণ অজ্ঞাত রয়ে গেছে, নয়তো বিকৃত হয়ে উপস্থাপিত হয়েছে।
২০২৪ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৩ বছর অতিক্রান্ত হলো। আমরা একটি ক্রান্তিকালের মাঝখান দিয়ে চলেছি। যখন ফিরে তাকাই, তখন মনে হয় ১৯৭১ সালের মতো আজও একটি সংগ্রাম আমাদের করতে হবে—সেই লড়াই বাংলাদেশের মূল্যবোধকে সংহত করার, সেই যুদ্ধ বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক চিন্তা-চেতনাকে প্রতিষ্ঠিত করার। চূড়ান্ত বিচারে, এই লড়াই আমাদের বাঁচার লড়াই, এই লড়াইয়ে জিততে হবে।
সেলিম জাহান, ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর ও দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

ত্রিমুখী সম্পর্ক নিয়ে অনেক মুভি হয়েছে। এ রকম মুভি দেখেননি, এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন। কেবল মুভিতেই কেন, বাস্তবেও ত্রিমুখী সম্পর্কের অনেক ঘটনা আমরা দেখে থাকি। সব ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ত্রিভুজ সম্পর্কের শেষ পরিণতি সাধারণত ভালো হয় না।
১০ ঘণ্টা আগে
আমরা চব্বিশের আন্দোলন দেখেছি—বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন থেকে যা রূপ নেয় স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে। এর আগপর্যন্ত স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন সম্পর্কে জেনেছি নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান এবং নূর হোসেনের আত্মত্যাগের কথা। অনেকে দুটো ঘটনারই সাক্ষী। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর নূর হোসেন শহীদ হন পুলিশের গুলিতে।
১০ ঘণ্টা আগে
গত এক বছরে আমাদের জাতি এক অভূতপূর্ব রাজনৈতিক প্রজ্ঞা লাভ করেছে। জাতীয় গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ঘরের ভেতর থেকে চায়ের দোকান, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়—সর্বত্রই রাজনৈতিক আলোচনা, পর্যালোচনা এবং সেই সঙ্গে যাঁর যাঁর সুচিন্তিত মন্তব্যও দিয়ে যাচ্ছেন।
১০ ঘণ্টা আগে
দেশে এমনিতেই ফসলি জমি হ্রাস পাচ্ছে। সেটি কমে যাওয়া মানে খাদ্যের উৎপাদনও কমে যাওয়া। যে কারণে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়ে থাকে, কোনো আবাদি জমি যাতে পতিত না থাকে।
১০ ঘণ্টা আগেমাসুদ কামাল

ত্রিমুখী সম্পর্ক নিয়ে অনেক মুভি হয়েছে। এ রকম মুভি দেখেননি, এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন। কেবল মুভিতেই কেন, বাস্তবেও ত্রিমুখী সম্পর্কের অনেক ঘটনা আমরা দেখে থাকি। সব ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ত্রিভুজ সম্পর্কের শেষ পরিণতি সাধারণত ভালো হয় না।
গত বছরের এ সময়ে আমাদের রাজনীতিতে খুব শক্ত একটা ত্রিভুজ সম্পর্ক দেখা গিয়েছিল। বিএনপি-অন্তর্বর্তী সরকার-জামায়াত—এই তিন পক্ষের দহরম-মহরম। তাদের সবারই লক্ষ্য তখন ছিল রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করা। এর প্রাথমিক ধাপ, কদিন আগে অর্থাৎ ২০২৪-এর অক্টোবরে অর্জিত হয়েছে। সে দিন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে এই সরকার একটা নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ করেছে। এরপর বাকি ছিল মূল দল আওয়ামী লীগকে অকার্যকর ও অপ্রাসঙ্গিক করা। গত বছরের এ সময়ে সেই চেষ্টা আমরা দেখেছি। প্রশাসনিকভাবে যেমন, ঠিক তেমনি সামাজিকভাবেও স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিস্ট দল হিসেবে আওয়ামী লীগবিরোধী প্রচারণা বেশ জোরেশোরেই চলছিল। এ কাজে বিএনপি, জামায়াত, সরকার—সবাই বেশ আন্তরিকও ছিল। সে সময়ে মাঠের শক্তি হিসেবে বেশ বড় একটা ভূমিকা রেখেছে এনসিপি বা জাতীয় নাগরিক পার্টি। তারপর মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে যখন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলো, আমার বিবেচনায় ত্রিভুজ দহরম-মহরমের সেটাই ছিল পিক-টাইম। এর পর থেকে নিজ নিজ স্বার্থ নিয়ে ধীরে ধীরে সবাই মাঠে নেমে পড়ল। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকল দূরত্ব।
মে মাসের ১২ তারিখে আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলো, তার মাসখানেক পর জুনের ১৫ তারিখে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস লন্ডনে গিয়ে বৈঠক করলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে। বলতে গেলে ওই বৈঠকটাই যেন সম্পর্কে ভাঙনের ক্ষেত্রে একটা প্রকাশ্য কারণ হতে পারল। জামায়াত অভিযোগ তুলল সরকারের প্রতি—বলল, বিএনপির প্রতি পক্ষপাতিত্ব করছে সরকার। অভিযোগের পেছনের কারণটিও তারা প্রকাশ করল। বলল, ওই বৈঠকের পরই নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় হিসেবে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধের কথাটি বলা হয়েছে। একটিমাত্র দলের শীর্ষ নেতার সঙ্গে কথার পরিপ্রেক্ষিতে যদি নির্বাচনের সময় নির্ধারিত হয়, তাহলে সেই দলের প্রতি সরকারের পক্ষপাতের বিষয়টি অস্বীকার করা তো সহজ হয় না।
জুনের পর থেকে যত দিন যেতে থাকল, সাধারণ মানুষের কাছেও বিএনপি-জামায়াতের মুখোমুখি অবস্থানটা পরিষ্কার হতে থাকল। ঐকমত্য কমিশনেও দেখা গেল দুই দলের এই বিরোধের প্রকাশ। সংস্কারের অনেক প্রস্তাবেই বিএনপি-জামায়াতকে পরস্পরবিরোধী অবস্থানে দেখা গেল। বিএনপির পক্ষ থেকে একের পর এক আসতে থাকল নোট অব ডিসেন্ট বা আপত্তি। এরপর আবার বিপত্তি দেখা গেল জুলাই সনদ বাস্তবায়নে যে ‘গণভোট’ করার কথা বলা হচ্ছে, সেটি অনুষ্ঠানের তারিখ নিয়ে। বিএনপি বলল, নির্বাচনের দিনই হোক গণভোট, বিপরীতে জামায়াত বলছে—নির্বাচনের আগে, সম্ভব হলে এই নভেম্বরেই গণভোট হতে হবে। গণভোটের রায় নিয়ে, সেটার ওপর ভিত্তি করেই হবে নির্বাচন। আবার জুলাই সনদ বাস্তবায়নের যে আদেশ, তার খসড়া নিয়েও বড় ধরনের আপত্তি তুলল বিএনপি। আপত্তির মাত্রাটা এতটাই প্রবল যে, তারা বলল—জুলাই সনদ নিয়ে ঐকমত্য কমিশন তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। খেলায় যে রেফারির ওপর সব পক্ষ ভরসা রাখে, সে রেফারিই এবার গোল দিয়ে বসে আছে। অর্থাৎ চরম পক্ষপাতের অভিযোগ। যে কমিশনের প্রধান হচ্ছেন খোদ সরকারপ্রধান ড. ইউনূস, তাঁরই বিরুদ্ধে পক্ষপাত ও প্রতারণার অভিযোগ! বিষয়টি কিন্তু এরপর আর হালকা থাকল না।
তাহলে এখন কী হবে? গণভোট কবে হবে? গণভোটে জনগণের সামনে প্রশ্ন কী থাকবে? এসব প্রশ্নের সমাধান কে দেবে? ঐকমত্য কমিশনের প্রধান ও সক্রিয় দুই ব্যক্তি ড. আলী রীয়াজ ও মনির হায়দার এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছেন। তড়িঘড়ি করে তাঁদের এই চলে যাওয়া নিয়েও নানা ধরনের সন্দেহ উচ্চারিত হতে থাকল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই দুজনকে নিয়ে দেখা গেল নানা ধরনের ট্রল। সমাধানের পথ হিসেবে বলা হলো, সরকারপ্রধান ড. ইউনূস এর সমাধান করবেন। এ প্রবণতা আমরা আগের সরকারের আমলেও দেখেছি। সবকিছুই যেন শেখ হাসিনা করতেন। যত সাফল্য, সব তাঁর। মন্ত্রীদের কিছু জিজ্ঞাসা করা হলে বলতেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় এ সাফল্য এসেছে।’ আবার যদি কোনো জটিলতা দেখা দিত, সবাই মিলে মিটিং করে শেষে সিদ্ধান্ত হতো ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’ এর সমাধান দেবেন। দল, অঙ্গসংগঠন, কিংবা ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের কোনো কমিটি করতে হবে—অবধারিতভাবেই দায়িত্ব চলে যাবে ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর’ কাছে। এভাবেই একজন ব্যক্তি স্বৈরাচারী হয়ে ওঠেন। একপর্যায়ে তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেন, তিনি ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত কেউ নিতে পারে না। সব কাজ তাঁকেই করতে হয়। তিনি আসলে অন্যদের মতো নয়, তিনি অনেকটা মহাপুরুষের মতো। আমার মতে, এই স্বৈরাচারী মনোভাবের শুরুটা হয় আশপাশে থাকা মোসাহেবদের কারণেই। এবারও তা-ই হয়েছে, মোসাহেবরা বলতে শুরু করেছেন—ড. ইউনূসই দেবেন শেষ সিদ্ধান্ত!
সরকার অবশ্য অদ্ভুত একটা কাজ করেছে। যখন তাদের ওপর দায়িত্ব এল সংকট নিরসনের, তারা একটা বৈঠক করল, আর বলে দিল—সাত দিনের সময় দেওয়া হলো, এর মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের বসে সমস্যার নিরসন করতে হবে। যে বিরোধের নিরসন টানা আট মাস রাজনৈতিক দলগুলো একসঙ্গে বসে সমাধান করতে পারেনি, সেটা সাত দিনে কীভাবে সম্ভব হবে? তা ছাড়া আরেকটি কথাও উচ্চারিত হচ্ছে। জুলাই সনদ নিয়ে এই বিরোধ, বাস্তবায়ন প্রস্তাবে নোট অব ডিসেন্টগুলোকে না রাখা, এটা আসলে কার দায়? এ অপকর্মটি করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। যে কমিশনের প্রধান আবার ড. ইউনূস নিজে। তাহলে যে ক্রাইসিস সৃষ্টি করেছে ড. ইউনূসের কমিশন, সেটির সমাধানের দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর দেওয়া কেন? এদিকে আবার সেই সাত দিনও শেষ হয়ে গেছে গতকাল রোববার। কোনো সমাধান কি হয়েছে? এখন কী হবে? যথারীতি সেই একই কথা বলা হচ্ছে—ড. ইউনূসই দেবেন সমাধান। কিন্তু কীভাবে? তিনি কি খুব বড় রাজনীতিবিদ? আবার যদি ড. ইউনূস কিংবা তাঁর পরিষদ যদি কোনো একটা সিদ্ধান্ত দেয়, তাহলে সেটাকে কি আর ঐকমত্যের সিদ্ধান্ত বলা যাবে? এটা তো তাঁর সরকারের সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে। সরকারই যদি সিদ্ধান্ত দেবে, তাহলে আর সংস্কার কমিশনের নামে এত নাটকের কী প্রয়োজন ছিল? এত সময়ক্ষেপণই বা কেন করা হলো?
এতসব প্রশ্নের জবাব আসলে কে দেবে, কী দেবে, কেউ জানে না। হয়তো জবাব কখনোই পাওয়া যাবে না। তবে বিএনপি কিন্তু এরই মধ্যে সরকারের দিকে আঙুল তুলতে শুরু করেছে। এর মধ্যে গত শনিবার দেখলাম বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ সরাসরি সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে বললেন—এভাবে সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়ার কোনো এখতিয়ার এই সরকারের নেই। এই সরকার যে কোনো নির্বাচিত সরকার নয়, এটাও তিনি তাদের স্মরণে রাখতে বলেছেন। জামায়াতে ইসলামী আবার এ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। তারা এরই মধ্যে আট দলের একটা জোট বানিয়ে নিয়েছে। এই আট দলকে নিয়ে রাস্তায়ও নেমে গেছে পাঁচ দফা দাবি আদায়ে। তাদের এক শীর্ষস্থানীয় নেতা প্রকাশ্যে বলেছেন—ঘি তাদের চাই। আর এই ঘি পেতে যদি আঙুল বাঁকা করতে হয়, তারা সেটাই করবে। এ বক্তব্য কি কেবলই রেটরিক, নাকি এর মধ্যে প্রচ্ছন্ন কোনো হুমকি আছে; সেটাও কিন্তু চিন্তার বিষয়। এসবের বিপরীতে বিএনপিও বসে নেই। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী শনিবার এক জায়গায় বললেন, বিএনপির মতো বড় দলের কর্মীরা যদি রাস্তায় নামে, তাহলে সংঘাত হতে পারে।
এ রকম পরিস্থিতিতে জনগণের অবস্থান কোথায়? আমরা এখন বসে আছি ক্লাইমেক্সের অপেক্ষায়! এরই মধ্যে পরস্পরের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ আমরা দেখতে পাচ্ছি।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

ত্রিমুখী সম্পর্ক নিয়ে অনেক মুভি হয়েছে। এ রকম মুভি দেখেননি, এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন। কেবল মুভিতেই কেন, বাস্তবেও ত্রিমুখী সম্পর্কের অনেক ঘটনা আমরা দেখে থাকি। সব ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ত্রিভুজ সম্পর্কের শেষ পরিণতি সাধারণত ভালো হয় না।
গত বছরের এ সময়ে আমাদের রাজনীতিতে খুব শক্ত একটা ত্রিভুজ সম্পর্ক দেখা গিয়েছিল। বিএনপি-অন্তর্বর্তী সরকার-জামায়াত—এই তিন পক্ষের দহরম-মহরম। তাদের সবারই লক্ষ্য তখন ছিল রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করা। এর প্রাথমিক ধাপ, কদিন আগে অর্থাৎ ২০২৪-এর অক্টোবরে অর্জিত হয়েছে। সে দিন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে এই সরকার একটা নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ করেছে। এরপর বাকি ছিল মূল দল আওয়ামী লীগকে অকার্যকর ও অপ্রাসঙ্গিক করা। গত বছরের এ সময়ে সেই চেষ্টা আমরা দেখেছি। প্রশাসনিকভাবে যেমন, ঠিক তেমনি সামাজিকভাবেও স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিস্ট দল হিসেবে আওয়ামী লীগবিরোধী প্রচারণা বেশ জোরেশোরেই চলছিল। এ কাজে বিএনপি, জামায়াত, সরকার—সবাই বেশ আন্তরিকও ছিল। সে সময়ে মাঠের শক্তি হিসেবে বেশ বড় একটা ভূমিকা রেখেছে এনসিপি বা জাতীয় নাগরিক পার্টি। তারপর মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে যখন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলো, আমার বিবেচনায় ত্রিভুজ দহরম-মহরমের সেটাই ছিল পিক-টাইম। এর পর থেকে নিজ নিজ স্বার্থ নিয়ে ধীরে ধীরে সবাই মাঠে নেমে পড়ল। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকল দূরত্ব।
মে মাসের ১২ তারিখে আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলো, তার মাসখানেক পর জুনের ১৫ তারিখে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস লন্ডনে গিয়ে বৈঠক করলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে। বলতে গেলে ওই বৈঠকটাই যেন সম্পর্কে ভাঙনের ক্ষেত্রে একটা প্রকাশ্য কারণ হতে পারল। জামায়াত অভিযোগ তুলল সরকারের প্রতি—বলল, বিএনপির প্রতি পক্ষপাতিত্ব করছে সরকার। অভিযোগের পেছনের কারণটিও তারা প্রকাশ করল। বলল, ওই বৈঠকের পরই নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় হিসেবে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধের কথাটি বলা হয়েছে। একটিমাত্র দলের শীর্ষ নেতার সঙ্গে কথার পরিপ্রেক্ষিতে যদি নির্বাচনের সময় নির্ধারিত হয়, তাহলে সেই দলের প্রতি সরকারের পক্ষপাতের বিষয়টি অস্বীকার করা তো সহজ হয় না।
জুনের পর থেকে যত দিন যেতে থাকল, সাধারণ মানুষের কাছেও বিএনপি-জামায়াতের মুখোমুখি অবস্থানটা পরিষ্কার হতে থাকল। ঐকমত্য কমিশনেও দেখা গেল দুই দলের এই বিরোধের প্রকাশ। সংস্কারের অনেক প্রস্তাবেই বিএনপি-জামায়াতকে পরস্পরবিরোধী অবস্থানে দেখা গেল। বিএনপির পক্ষ থেকে একের পর এক আসতে থাকল নোট অব ডিসেন্ট বা আপত্তি। এরপর আবার বিপত্তি দেখা গেল জুলাই সনদ বাস্তবায়নে যে ‘গণভোট’ করার কথা বলা হচ্ছে, সেটি অনুষ্ঠানের তারিখ নিয়ে। বিএনপি বলল, নির্বাচনের দিনই হোক গণভোট, বিপরীতে জামায়াত বলছে—নির্বাচনের আগে, সম্ভব হলে এই নভেম্বরেই গণভোট হতে হবে। গণভোটের রায় নিয়ে, সেটার ওপর ভিত্তি করেই হবে নির্বাচন। আবার জুলাই সনদ বাস্তবায়নের যে আদেশ, তার খসড়া নিয়েও বড় ধরনের আপত্তি তুলল বিএনপি। আপত্তির মাত্রাটা এতটাই প্রবল যে, তারা বলল—জুলাই সনদ নিয়ে ঐকমত্য কমিশন তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। খেলায় যে রেফারির ওপর সব পক্ষ ভরসা রাখে, সে রেফারিই এবার গোল দিয়ে বসে আছে। অর্থাৎ চরম পক্ষপাতের অভিযোগ। যে কমিশনের প্রধান হচ্ছেন খোদ সরকারপ্রধান ড. ইউনূস, তাঁরই বিরুদ্ধে পক্ষপাত ও প্রতারণার অভিযোগ! বিষয়টি কিন্তু এরপর আর হালকা থাকল না।
তাহলে এখন কী হবে? গণভোট কবে হবে? গণভোটে জনগণের সামনে প্রশ্ন কী থাকবে? এসব প্রশ্নের সমাধান কে দেবে? ঐকমত্য কমিশনের প্রধান ও সক্রিয় দুই ব্যক্তি ড. আলী রীয়াজ ও মনির হায়দার এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছেন। তড়িঘড়ি করে তাঁদের এই চলে যাওয়া নিয়েও নানা ধরনের সন্দেহ উচ্চারিত হতে থাকল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই দুজনকে নিয়ে দেখা গেল নানা ধরনের ট্রল। সমাধানের পথ হিসেবে বলা হলো, সরকারপ্রধান ড. ইউনূস এর সমাধান করবেন। এ প্রবণতা আমরা আগের সরকারের আমলেও দেখেছি। সবকিছুই যেন শেখ হাসিনা করতেন। যত সাফল্য, সব তাঁর। মন্ত্রীদের কিছু জিজ্ঞাসা করা হলে বলতেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় এ সাফল্য এসেছে।’ আবার যদি কোনো জটিলতা দেখা দিত, সবাই মিলে মিটিং করে শেষে সিদ্ধান্ত হতো ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’ এর সমাধান দেবেন। দল, অঙ্গসংগঠন, কিংবা ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের কোনো কমিটি করতে হবে—অবধারিতভাবেই দায়িত্ব চলে যাবে ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর’ কাছে। এভাবেই একজন ব্যক্তি স্বৈরাচারী হয়ে ওঠেন। একপর্যায়ে তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেন, তিনি ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত কেউ নিতে পারে না। সব কাজ তাঁকেই করতে হয়। তিনি আসলে অন্যদের মতো নয়, তিনি অনেকটা মহাপুরুষের মতো। আমার মতে, এই স্বৈরাচারী মনোভাবের শুরুটা হয় আশপাশে থাকা মোসাহেবদের কারণেই। এবারও তা-ই হয়েছে, মোসাহেবরা বলতে শুরু করেছেন—ড. ইউনূসই দেবেন শেষ সিদ্ধান্ত!
সরকার অবশ্য অদ্ভুত একটা কাজ করেছে। যখন তাদের ওপর দায়িত্ব এল সংকট নিরসনের, তারা একটা বৈঠক করল, আর বলে দিল—সাত দিনের সময় দেওয়া হলো, এর মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের বসে সমস্যার নিরসন করতে হবে। যে বিরোধের নিরসন টানা আট মাস রাজনৈতিক দলগুলো একসঙ্গে বসে সমাধান করতে পারেনি, সেটা সাত দিনে কীভাবে সম্ভব হবে? তা ছাড়া আরেকটি কথাও উচ্চারিত হচ্ছে। জুলাই সনদ নিয়ে এই বিরোধ, বাস্তবায়ন প্রস্তাবে নোট অব ডিসেন্টগুলোকে না রাখা, এটা আসলে কার দায়? এ অপকর্মটি করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। যে কমিশনের প্রধান আবার ড. ইউনূস নিজে। তাহলে যে ক্রাইসিস সৃষ্টি করেছে ড. ইউনূসের কমিশন, সেটির সমাধানের দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর দেওয়া কেন? এদিকে আবার সেই সাত দিনও শেষ হয়ে গেছে গতকাল রোববার। কোনো সমাধান কি হয়েছে? এখন কী হবে? যথারীতি সেই একই কথা বলা হচ্ছে—ড. ইউনূসই দেবেন সমাধান। কিন্তু কীভাবে? তিনি কি খুব বড় রাজনীতিবিদ? আবার যদি ড. ইউনূস কিংবা তাঁর পরিষদ যদি কোনো একটা সিদ্ধান্ত দেয়, তাহলে সেটাকে কি আর ঐকমত্যের সিদ্ধান্ত বলা যাবে? এটা তো তাঁর সরকারের সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে। সরকারই যদি সিদ্ধান্ত দেবে, তাহলে আর সংস্কার কমিশনের নামে এত নাটকের কী প্রয়োজন ছিল? এত সময়ক্ষেপণই বা কেন করা হলো?
এতসব প্রশ্নের জবাব আসলে কে দেবে, কী দেবে, কেউ জানে না। হয়তো জবাব কখনোই পাওয়া যাবে না। তবে বিএনপি কিন্তু এরই মধ্যে সরকারের দিকে আঙুল তুলতে শুরু করেছে। এর মধ্যে গত শনিবার দেখলাম বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ সরাসরি সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে বললেন—এভাবে সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়ার কোনো এখতিয়ার এই সরকারের নেই। এই সরকার যে কোনো নির্বাচিত সরকার নয়, এটাও তিনি তাদের স্মরণে রাখতে বলেছেন। জামায়াতে ইসলামী আবার এ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। তারা এরই মধ্যে আট দলের একটা জোট বানিয়ে নিয়েছে। এই আট দলকে নিয়ে রাস্তায়ও নেমে গেছে পাঁচ দফা দাবি আদায়ে। তাদের এক শীর্ষস্থানীয় নেতা প্রকাশ্যে বলেছেন—ঘি তাদের চাই। আর এই ঘি পেতে যদি আঙুল বাঁকা করতে হয়, তারা সেটাই করবে। এ বক্তব্য কি কেবলই রেটরিক, নাকি এর মধ্যে প্রচ্ছন্ন কোনো হুমকি আছে; সেটাও কিন্তু চিন্তার বিষয়। এসবের বিপরীতে বিএনপিও বসে নেই। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী শনিবার এক জায়গায় বললেন, বিএনপির মতো বড় দলের কর্মীরা যদি রাস্তায় নামে, তাহলে সংঘাত হতে পারে।
এ রকম পরিস্থিতিতে জনগণের অবস্থান কোথায়? আমরা এখন বসে আছি ক্লাইমেক্সের অপেক্ষায়! এরই মধ্যে পরস্পরের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ আমরা দেখতে পাচ্ছি।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

২০২৪ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশ তার ৫৩তম স্বাধীনতা দিবস পার করছে। ১৯৭১ সালে ৯ মাসের একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা ছিনিয়ে এনেছিলাম বিজয়ের লাল সূর্য। আমাদের স্বাধীনতা শুধু একটি ভূখণ্ডের নয়, নয় একটি মানবগোষ্ঠীর; সে বিজয় একটি চেতনার, একটি সংগ্রামের, একটি মূল্যবোধের
২৬ মার্চ ২০২৪
আমরা চব্বিশের আন্দোলন দেখেছি—বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন থেকে যা রূপ নেয় স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে। এর আগপর্যন্ত স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন সম্পর্কে জেনেছি নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান এবং নূর হোসেনের আত্মত্যাগের কথা। অনেকে দুটো ঘটনারই সাক্ষী। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর নূর হোসেন শহীদ হন পুলিশের গুলিতে।
১০ ঘণ্টা আগে
গত এক বছরে আমাদের জাতি এক অভূতপূর্ব রাজনৈতিক প্রজ্ঞা লাভ করেছে। জাতীয় গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ঘরের ভেতর থেকে চায়ের দোকান, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়—সর্বত্রই রাজনৈতিক আলোচনা, পর্যালোচনা এবং সেই সঙ্গে যাঁর যাঁর সুচিন্তিত মন্তব্যও দিয়ে যাচ্ছেন।
১০ ঘণ্টা আগে
দেশে এমনিতেই ফসলি জমি হ্রাস পাচ্ছে। সেটি কমে যাওয়া মানে খাদ্যের উৎপাদনও কমে যাওয়া। যে কারণে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়ে থাকে, কোনো আবাদি জমি যাতে পতিত না থাকে।
১০ ঘণ্টা আগেশহীদ নূর হোসেন দিবস
সৈয়দা সাদিয়া শাহরীন

আমরা চব্বিশের আন্দোলন দেখেছি—বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন থেকে যা রূপ নেয় স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে। এর আগপর্যন্ত স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন সম্পর্কে জেনেছি নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান এবং নূর হোসেনের আত্মত্যাগের কথা। অনেকে দুটো ঘটনারই সাক্ষী। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর নূর হোসেন শহীদ হন পুলিশের গুলিতে। কারণটা শুধু তাঁর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেওয়া ছিল না, ছিল তাঁর বুকে-পিঠে লেখা স্লোগানও—‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। নূর হোসেনের এই অদম্য সাহসই যে পরবর্তী সময়ে চব্বিশের জুলাই-আগস্টে তরুণদের মাঝে ছড়িয়ে যায়, সেটা না বললেও চলে। কেননা, ইতিহাস সাক্ষী এবং শিক্ষক—দুটো ভূমিকা পালন করে। শহীদ নূর হোসেন দিবসের নেপথ্যে কী, কেন তিনি শহীদ হন? এসব প্রশ্নের উত্তর না পেলে হয়তো আজকের প্রজন্ম অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারত না। তাই নূর হোসেনকে ভুলে যাওয়া যায় না।
বেবিট্যাক্সিচালকের সন্তান নূর হোসেনের জন্ম ঢাকায়, নারিন্দায়, ১৯৬১ সালে। পড়ালেখার দৌড় বেশি দূর যায়নি, অষ্টম শ্রেণিতেই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। কিন্তু রাজনীতিতে সক্রিয়। আর মোটর ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। ছিলেন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের বনগ্রাম শাখার প্রচার সম্পাদক। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি না নিয়েও রাজনীতির শব্দ নিয়ে খেলায় মেধার পরিচয় দিয়েছিলেন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময়। জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনকালে নাখোশ হয়ে আর সবার সঙ্গে রাজনৈতিক মিছিলে যোগ দেওয়ার আগের দিন, অর্থাৎ ১৯৮৭ সালের ৯ নভেম্বর নূর হোসেন ঠিক করে ফেলেছিলেন কী হবে তাঁর স্লোগান। সেদিন পপুলার আর্ট নামের একটি দোকান থেকে সাদা রং দিয়ে নিজের বুকে লিখিয়ে নেন ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’। আর পিঠে লেখান ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। প্রচার সম্পাদকের কাজটা ভালোই জানতেন! এই কাজ করে বাড়ি গেলেন না। দুদিন আগেই ঘরছাড়া হয়েছিলেন যদিও। আশ্রয় নিয়েছিলেন একটি মসজিদে। পরিবার ১০ নভেম্বর সকালে তাঁকে খুঁজে পেলেও তিনি বাড়ি ফিরতে চাননি। গায়ে কাপড় টেনে ঢেকে দিয়েছিলেন সেই কঠোর স্লোগান।
কাজ শেষে বাড়ি ফিরবে বলে মা-বাবাকে বিদায় দিয়েছিলেন নূর হোসেন। কিন্তু ফেরা আর হলো কই? ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর জোটবদ্ধ বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহ ‘ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি’ গ্রহণ করে। কর্মসূচির লক্ষ্য ছিল সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি আদায়। সেদিন স্বৈরাচারবিরোধী যে মিছিলটি পল্টন এলাকার ‘জিরো পয়েন্ট’ অতিক্রম করছিল, সেখানে ছিলেন নূর। কাঁদানে গ্যাস ও গুলি ছুড়ে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ করে দেয় তৎকালীন সরকারের পালিত পুলিশ। নূর হোসেনকে তখন আলাদা করে চেনা যাচ্ছিল খুব সহজে, গায়ে লেখা শ্বেত স্লোগানের কারণে। গুলি এসে বিঁধেছিল সেই গায়ে। তাঁর সঙ্গে সেদিন নিহত হন যুবলীগ নেতা বাবুলও। কিন্তু অষ্টম শ্রেণি পাস নূর হোসেনের গায়ে লেখা স্লোগান তাঁকে আজও অমর করে রেখেছে।
কোঁকড়া চুলের নূর হোসেন তিন দশক পরেও তরুণ, প্রাসঙ্গিক। তাঁর আত্মত্যাগ পরবর্তীকালে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় পথ দেখায়। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পতন ঘটে এরশাদ সরকারের। যে গণতন্ত্রকে মুক্তি দিতে নূর প্রাণ দিয়েছিলেন, সেই গণতন্ত্র বন্দী হয়ে গিয়েছিল আবারও। আর আবারও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং সরকার পতন হলো, কিন্তু গণতন্ত্র কি আজও মুক্তি পেল? কখনো পাবে? এ প্রশ্ন হয়তো নূর হোসেন মনে মনে ভাবছেন, অন্য জগতে বসে। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা।
লেখক: সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

আমরা চব্বিশের আন্দোলন দেখেছি—বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন থেকে যা রূপ নেয় স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে। এর আগপর্যন্ত স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন সম্পর্কে জেনেছি নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান এবং নূর হোসেনের আত্মত্যাগের কথা। অনেকে দুটো ঘটনারই সাক্ষী। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর নূর হোসেন শহীদ হন পুলিশের গুলিতে। কারণটা শুধু তাঁর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেওয়া ছিল না, ছিল তাঁর বুকে-পিঠে লেখা স্লোগানও—‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। নূর হোসেনের এই অদম্য সাহসই যে পরবর্তী সময়ে চব্বিশের জুলাই-আগস্টে তরুণদের মাঝে ছড়িয়ে যায়, সেটা না বললেও চলে। কেননা, ইতিহাস সাক্ষী এবং শিক্ষক—দুটো ভূমিকা পালন করে। শহীদ নূর হোসেন দিবসের নেপথ্যে কী, কেন তিনি শহীদ হন? এসব প্রশ্নের উত্তর না পেলে হয়তো আজকের প্রজন্ম অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারত না। তাই নূর হোসেনকে ভুলে যাওয়া যায় না।
বেবিট্যাক্সিচালকের সন্তান নূর হোসেনের জন্ম ঢাকায়, নারিন্দায়, ১৯৬১ সালে। পড়ালেখার দৌড় বেশি দূর যায়নি, অষ্টম শ্রেণিতেই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। কিন্তু রাজনীতিতে সক্রিয়। আর মোটর ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। ছিলেন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের বনগ্রাম শাখার প্রচার সম্পাদক। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি না নিয়েও রাজনীতির শব্দ নিয়ে খেলায় মেধার পরিচয় দিয়েছিলেন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময়। জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনকালে নাখোশ হয়ে আর সবার সঙ্গে রাজনৈতিক মিছিলে যোগ দেওয়ার আগের দিন, অর্থাৎ ১৯৮৭ সালের ৯ নভেম্বর নূর হোসেন ঠিক করে ফেলেছিলেন কী হবে তাঁর স্লোগান। সেদিন পপুলার আর্ট নামের একটি দোকান থেকে সাদা রং দিয়ে নিজের বুকে লিখিয়ে নেন ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’। আর পিঠে লেখান ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। প্রচার সম্পাদকের কাজটা ভালোই জানতেন! এই কাজ করে বাড়ি গেলেন না। দুদিন আগেই ঘরছাড়া হয়েছিলেন যদিও। আশ্রয় নিয়েছিলেন একটি মসজিদে। পরিবার ১০ নভেম্বর সকালে তাঁকে খুঁজে পেলেও তিনি বাড়ি ফিরতে চাননি। গায়ে কাপড় টেনে ঢেকে দিয়েছিলেন সেই কঠোর স্লোগান।
কাজ শেষে বাড়ি ফিরবে বলে মা-বাবাকে বিদায় দিয়েছিলেন নূর হোসেন। কিন্তু ফেরা আর হলো কই? ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর জোটবদ্ধ বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহ ‘ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি’ গ্রহণ করে। কর্মসূচির লক্ষ্য ছিল সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি আদায়। সেদিন স্বৈরাচারবিরোধী যে মিছিলটি পল্টন এলাকার ‘জিরো পয়েন্ট’ অতিক্রম করছিল, সেখানে ছিলেন নূর। কাঁদানে গ্যাস ও গুলি ছুড়ে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ করে দেয় তৎকালীন সরকারের পালিত পুলিশ। নূর হোসেনকে তখন আলাদা করে চেনা যাচ্ছিল খুব সহজে, গায়ে লেখা শ্বেত স্লোগানের কারণে। গুলি এসে বিঁধেছিল সেই গায়ে। তাঁর সঙ্গে সেদিন নিহত হন যুবলীগ নেতা বাবুলও। কিন্তু অষ্টম শ্রেণি পাস নূর হোসেনের গায়ে লেখা স্লোগান তাঁকে আজও অমর করে রেখেছে।
কোঁকড়া চুলের নূর হোসেন তিন দশক পরেও তরুণ, প্রাসঙ্গিক। তাঁর আত্মত্যাগ পরবর্তীকালে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় পথ দেখায়। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পতন ঘটে এরশাদ সরকারের। যে গণতন্ত্রকে মুক্তি দিতে নূর প্রাণ দিয়েছিলেন, সেই গণতন্ত্র বন্দী হয়ে গিয়েছিল আবারও। আর আবারও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং সরকার পতন হলো, কিন্তু গণতন্ত্র কি আজও মুক্তি পেল? কখনো পাবে? এ প্রশ্ন হয়তো নূর হোসেন মনে মনে ভাবছেন, অন্য জগতে বসে। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা।
লেখক: সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

২০২৪ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশ তার ৫৩তম স্বাধীনতা দিবস পার করছে। ১৯৭১ সালে ৯ মাসের একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা ছিনিয়ে এনেছিলাম বিজয়ের লাল সূর্য। আমাদের স্বাধীনতা শুধু একটি ভূখণ্ডের নয়, নয় একটি মানবগোষ্ঠীর; সে বিজয় একটি চেতনার, একটি সংগ্রামের, একটি মূল্যবোধের
২৬ মার্চ ২০২৪
ত্রিমুখী সম্পর্ক নিয়ে অনেক মুভি হয়েছে। এ রকম মুভি দেখেননি, এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন। কেবল মুভিতেই কেন, বাস্তবেও ত্রিমুখী সম্পর্কের অনেক ঘটনা আমরা দেখে থাকি। সব ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ত্রিভুজ সম্পর্কের শেষ পরিণতি সাধারণত ভালো হয় না।
১০ ঘণ্টা আগে
গত এক বছরে আমাদের জাতি এক অভূতপূর্ব রাজনৈতিক প্রজ্ঞা লাভ করেছে। জাতীয় গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ঘরের ভেতর থেকে চায়ের দোকান, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়—সর্বত্রই রাজনৈতিক আলোচনা, পর্যালোচনা এবং সেই সঙ্গে যাঁর যাঁর সুচিন্তিত মন্তব্যও দিয়ে যাচ্ছেন।
১০ ঘণ্টা আগে
দেশে এমনিতেই ফসলি জমি হ্রাস পাচ্ছে। সেটি কমে যাওয়া মানে খাদ্যের উৎপাদনও কমে যাওয়া। যে কারণে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়ে থাকে, কোনো আবাদি জমি যাতে পতিত না থাকে।
১০ ঘণ্টা আগেমামুনুর রশীদ

গত এক বছরে আমাদের জাতি এক অভূতপূর্ব রাজনৈতিক প্রজ্ঞা লাভ করেছে। জাতীয় গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ঘরের ভেতর থেকে চায়ের দোকান, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়—সর্বত্রই রাজনৈতিক আলোচনা, পর্যালোচনা এবং সেই সঙ্গে যাঁর যাঁর সুচিন্তিত মন্তব্যও দিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিদিনই সকাল-বিকেল কিছু না কিছু ঘটনা ঘটছে, সেসবের ওপরও তাৎক্ষণিক মন্তব্য হয়ে যাচ্ছে। এবারের উচ্চমাধ্যমিকের ফলেও তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। শিক্ষার্থীরাও পড়াশোনায় তেমন মনোযোগী হতে পারছে না। সমগ্র আলোচনা ওই রাজনীতিতে। চায়ের কাপেই বড় বড় সিদ্ধান্ত হয়ে যাচ্ছে।
মধ্যবিত্তের বাজারঘাটে টান পড়লেও তা আলোচনায় খুব একটা জায়গা পাচ্ছে না। রাজনীতিই মুখ্য এবং মুখ্য আলোচনার বিষয়। একটা বিষয় অবশ্য দেখার আছে—ক্লান্তিহীন, আড্ডাবাজ বাঙালি যেকোনো বিষয়ের ওপর আলোচনা করতে এবং সিদ্ধান্ত দিতে বড়ই উৎসাহী। ক্রিকেট খেলা দেখতে দেখতে অবলীলায় বিশ্ববিখ্যাত ব্যাটার বা বোলারদের ভুল ধরতে একটুও বিলম্ব করে না।
বলা হয়ে থাকে, সম্মিলিতভাবে বাঙালি সব সময়ই সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। জাতি যে এত রাজনীতিসচেতন হয়ে পড়ল, সেও ভালো কথা। কিন্তু যখন দেখি কোথাও সড়ক দুর্ঘটনা হলো বা পুলিশের লাঠিপেটায় রক্তাক্ত দেহ পড়ে আছে, কোথাও কোনো নারীর অসম্মান হচ্ছে, তখন তার ফোনের ক্যামেরাটি গর্জে ওঠে বটে কিন্তু মানুষ আগায় না। সবকিছু যে ক্যামেরায় ধারণ করার বিষয় নয়, প্রতিবাদী হওয়া প্রয়োজন, তা বোঝার বোধ হয় এখন আর দরকার নেই।
আমাদের লেখাপড়ার সময়টা ছিল ষাটের দশক, যখন দেশে বিপুল পরিমাণে নানা জায়গায় আন্দোলন চলছিল। তার মধ্যে শিল্প-সাহিত্য, বিজ্ঞানচিন্তা এবং বড় বড় রাজনৈতিক তত্ত্ব নিয়েও কথাবার্তা হতো। মিছিলে যাওয়ার আগে ও পরে এসব বিষয় নিয়ে তর্কের ঝড় উঠত। এই তর্কাতর্কির ফলেই একটা বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু এখন এমন একটা সময় এসেছে, যখন রাজনীতিই একমাত্র আলোচনা, তর্কবিতর্কের বিষয়।
এই সময়ের মধ্যে যে কত মানবিক বিপর্যয় ঘটে গেল, দুর্নীতি সকল সময়ের রেকর্ড অতিক্রম করল। শিক্ষাব্যবস্থা নিম্নমুখী, কতিপয় দুর্বৃত্ত আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠল—তার আলোচনা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ করে না। অসহায় কিছু মানুষকে দেখা যায় কোর্ট-কাচারিতে, জেলখানায় দৌড়াদৌড়ি করতে। আবার থানায় প্রচুর মানুষের ভিড়। মানুষ ভেবেছিল একটা পরিবর্তন আসবে, দুর্নীতির কবর রচনা হবে, সরকার একটি কল্যাণমুখী প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবে, দুর্নীতি বিদায় করতে যেমন কমিশন গঠন করেছে, তা দিয়েই চিরতরে এই অসুখটি নির্মূল হয়ে যাবে। কিন্তু তা হলো না। নির্বাচনই এখন একমাত্র আলোচনার বিষয়। অধিকাংশ লোক ভাবছে নির্বাচন হবে না। এই অবিশ্বাসই-বা কেন? মানুষ একটা আস্থাহীনতা এবং অবিশ্বাসের জায়গায় দাঁড়িয়ে গেল কেন?
বাঙালি চিরকালই সরকারবিরোধী। কারণ আছে অনেক। কিন্তু আস্থাহীনতা যদি সংক্রামক হয়ে জাতির সর্বক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে যায়, তাহলে তার পরিণতি কী হবে? উত্তরের জন্য বহু দূর অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই। এখনই দেখা যাচ্ছে মানবিক মূল্যবোধে ধস নেমেছে, যার হাজার হাজার উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে। আরও বহুবার বলেছি, রাষ্ট্রকে আমরা মানবিক করতে পারিনি। সব দল মিলেই ব্যবস্থাটা এমন হয়েছে যে সরকার রাষ্ট্রকে অধিকার করে ফেলেছে, সমাজ কোনোমতে ধিকিধিকি জ্বলছে। তবে সমাজের শক্তি এখনো আছে। নইলে যে নৈরাজ্যকে আমরা দেখেছি, তাতে দেশে বিপুল পরিমাণে দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়ে অনেক কিছুই তছনছ হয়ে যেত। কোনো কোনো ওয়াজ-মাহফিল থেকে যেসব উসকানিমূলক বক্তব্য আসে, তাতে সব জায়গায় অগ্ন্যুৎপাত হওয়ার কথা। কিছু কিছু জায়গায় যে তা হয়নি, তা-ও সত্য নয়। অনেক জায়গায়ই ফেসবুকের একটি পোস্ট অনেক দাঙ্গাবাজির কারণ হয়েছে। সেসব ঘটনায় আমাদের সমাজ সত্যিই একটা ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এবার কোনো শক্তিই তেমন দুর্বার হয়ে উঠতে পারেনি। আর সমাজের সবচেয়ে বড় শক্তিটি এখনো সোচ্চার হতে পারেনি।
আমাদের অর্ধশতকের শিক্ষাব্যবস্থা মানুষকে সত্য বলতে শেখায়নি। রাজনীতিবিদ, আমলা, বিচারক, শিক্ষক ও শিক্ষাব্যবস্থার নিয়ন্ত্রকও সত্য ভাষাকে উৎসাহিত করেনি। একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা সর্বত্রই উৎসাহিত হয়েছে। আজকে যে শুধু রাজনীতিই একমাত্র আলোচ্য বিষয়, তার কারণও হচ্ছে সমাজের অন্য সমস্যাগুলোর সমাধান না করে একটি দুর্নীতির পথই বেছে নিয়েছে সবাই। যদি সব জায়গায়ই একটা সুস্থ-স্বাভাবিক ধারা অব্যাহত থাকত, তাহলে এ জায়গায় এসে দাঁড়াতাম না আমরা। সমাজের সর্বত্র সত্যকে মূল্যায়ন করার একটা ব্যবস্থাই পারত সমাজকে রক্ষা করতে। রাজনীতির বৃহত্তর অর্থে প্রয়োগটাও হয়নি।
মানুষের মহত্তম কল্যাণের পথটা রাজনীতিই খুলে দেয়। চীন, রাশিয়া, কিউবার বিপ্লবে সে দেশগুলোর জনগণ একটা মুক্তির পথ পেয়েছিল। তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক সব ধর্মান্ধতা এবং গোঁড়ামি থেকে একটা মুক্ত সমাজ গড়েছিলেন। আমাদের দেশেও লাখ লাখ মানুষ দেশের জন্য বড় বড় ত্যাগ স্বীকার করেছেন। কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্ব তা সমাজের কাজে ব্যবহার করতে পারেননি। একটাই বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা হলো ক্ষমতা। ক্ষমতার ব্যবহার এবং অপব্যবহার একটি সমাজের জন্য যে কত ভয়ংকর হতে পারে, তা আমরা দেখেছি। এটা সবাই স্বীকার করছেন, আমরা একটি সংকটকাল পার করছি। তার মধ্যেও মানুষের মনে আশা জাগে—একটা সুদিন আসবে। কীভাবে যে সে আশা পূর্ণ হবে আমি জানি না, কেউ জানে কি না জানি না, তবে কেউ না কেউ নিশ্চয়ই জানেন। জেনে থাকলে আমাদের খবর দেবেন।
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব

গত এক বছরে আমাদের জাতি এক অভূতপূর্ব রাজনৈতিক প্রজ্ঞা লাভ করেছে। জাতীয় গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ঘরের ভেতর থেকে চায়ের দোকান, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়—সর্বত্রই রাজনৈতিক আলোচনা, পর্যালোচনা এবং সেই সঙ্গে যাঁর যাঁর সুচিন্তিত মন্তব্যও দিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিদিনই সকাল-বিকেল কিছু না কিছু ঘটনা ঘটছে, সেসবের ওপরও তাৎক্ষণিক মন্তব্য হয়ে যাচ্ছে। এবারের উচ্চমাধ্যমিকের ফলেও তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। শিক্ষার্থীরাও পড়াশোনায় তেমন মনোযোগী হতে পারছে না। সমগ্র আলোচনা ওই রাজনীতিতে। চায়ের কাপেই বড় বড় সিদ্ধান্ত হয়ে যাচ্ছে।
মধ্যবিত্তের বাজারঘাটে টান পড়লেও তা আলোচনায় খুব একটা জায়গা পাচ্ছে না। রাজনীতিই মুখ্য এবং মুখ্য আলোচনার বিষয়। একটা বিষয় অবশ্য দেখার আছে—ক্লান্তিহীন, আড্ডাবাজ বাঙালি যেকোনো বিষয়ের ওপর আলোচনা করতে এবং সিদ্ধান্ত দিতে বড়ই উৎসাহী। ক্রিকেট খেলা দেখতে দেখতে অবলীলায় বিশ্ববিখ্যাত ব্যাটার বা বোলারদের ভুল ধরতে একটুও বিলম্ব করে না।
বলা হয়ে থাকে, সম্মিলিতভাবে বাঙালি সব সময়ই সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। জাতি যে এত রাজনীতিসচেতন হয়ে পড়ল, সেও ভালো কথা। কিন্তু যখন দেখি কোথাও সড়ক দুর্ঘটনা হলো বা পুলিশের লাঠিপেটায় রক্তাক্ত দেহ পড়ে আছে, কোথাও কোনো নারীর অসম্মান হচ্ছে, তখন তার ফোনের ক্যামেরাটি গর্জে ওঠে বটে কিন্তু মানুষ আগায় না। সবকিছু যে ক্যামেরায় ধারণ করার বিষয় নয়, প্রতিবাদী হওয়া প্রয়োজন, তা বোঝার বোধ হয় এখন আর দরকার নেই।
আমাদের লেখাপড়ার সময়টা ছিল ষাটের দশক, যখন দেশে বিপুল পরিমাণে নানা জায়গায় আন্দোলন চলছিল। তার মধ্যে শিল্প-সাহিত্য, বিজ্ঞানচিন্তা এবং বড় বড় রাজনৈতিক তত্ত্ব নিয়েও কথাবার্তা হতো। মিছিলে যাওয়ার আগে ও পরে এসব বিষয় নিয়ে তর্কের ঝড় উঠত। এই তর্কাতর্কির ফলেই একটা বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু এখন এমন একটা সময় এসেছে, যখন রাজনীতিই একমাত্র আলোচনা, তর্কবিতর্কের বিষয়।
এই সময়ের মধ্যে যে কত মানবিক বিপর্যয় ঘটে গেল, দুর্নীতি সকল সময়ের রেকর্ড অতিক্রম করল। শিক্ষাব্যবস্থা নিম্নমুখী, কতিপয় দুর্বৃত্ত আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠল—তার আলোচনা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ করে না। অসহায় কিছু মানুষকে দেখা যায় কোর্ট-কাচারিতে, জেলখানায় দৌড়াদৌড়ি করতে। আবার থানায় প্রচুর মানুষের ভিড়। মানুষ ভেবেছিল একটা পরিবর্তন আসবে, দুর্নীতির কবর রচনা হবে, সরকার একটি কল্যাণমুখী প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবে, দুর্নীতি বিদায় করতে যেমন কমিশন গঠন করেছে, তা দিয়েই চিরতরে এই অসুখটি নির্মূল হয়ে যাবে। কিন্তু তা হলো না। নির্বাচনই এখন একমাত্র আলোচনার বিষয়। অধিকাংশ লোক ভাবছে নির্বাচন হবে না। এই অবিশ্বাসই-বা কেন? মানুষ একটা আস্থাহীনতা এবং অবিশ্বাসের জায়গায় দাঁড়িয়ে গেল কেন?
বাঙালি চিরকালই সরকারবিরোধী। কারণ আছে অনেক। কিন্তু আস্থাহীনতা যদি সংক্রামক হয়ে জাতির সর্বক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে যায়, তাহলে তার পরিণতি কী হবে? উত্তরের জন্য বহু দূর অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই। এখনই দেখা যাচ্ছে মানবিক মূল্যবোধে ধস নেমেছে, যার হাজার হাজার উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে। আরও বহুবার বলেছি, রাষ্ট্রকে আমরা মানবিক করতে পারিনি। সব দল মিলেই ব্যবস্থাটা এমন হয়েছে যে সরকার রাষ্ট্রকে অধিকার করে ফেলেছে, সমাজ কোনোমতে ধিকিধিকি জ্বলছে। তবে সমাজের শক্তি এখনো আছে। নইলে যে নৈরাজ্যকে আমরা দেখেছি, তাতে দেশে বিপুল পরিমাণে দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়ে অনেক কিছুই তছনছ হয়ে যেত। কোনো কোনো ওয়াজ-মাহফিল থেকে যেসব উসকানিমূলক বক্তব্য আসে, তাতে সব জায়গায় অগ্ন্যুৎপাত হওয়ার কথা। কিছু কিছু জায়গায় যে তা হয়নি, তা-ও সত্য নয়। অনেক জায়গায়ই ফেসবুকের একটি পোস্ট অনেক দাঙ্গাবাজির কারণ হয়েছে। সেসব ঘটনায় আমাদের সমাজ সত্যিই একটা ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এবার কোনো শক্তিই তেমন দুর্বার হয়ে উঠতে পারেনি। আর সমাজের সবচেয়ে বড় শক্তিটি এখনো সোচ্চার হতে পারেনি।
আমাদের অর্ধশতকের শিক্ষাব্যবস্থা মানুষকে সত্য বলতে শেখায়নি। রাজনীতিবিদ, আমলা, বিচারক, শিক্ষক ও শিক্ষাব্যবস্থার নিয়ন্ত্রকও সত্য ভাষাকে উৎসাহিত করেনি। একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা সর্বত্রই উৎসাহিত হয়েছে। আজকে যে শুধু রাজনীতিই একমাত্র আলোচ্য বিষয়, তার কারণও হচ্ছে সমাজের অন্য সমস্যাগুলোর সমাধান না করে একটি দুর্নীতির পথই বেছে নিয়েছে সবাই। যদি সব জায়গায়ই একটা সুস্থ-স্বাভাবিক ধারা অব্যাহত থাকত, তাহলে এ জায়গায় এসে দাঁড়াতাম না আমরা। সমাজের সর্বত্র সত্যকে মূল্যায়ন করার একটা ব্যবস্থাই পারত সমাজকে রক্ষা করতে। রাজনীতির বৃহত্তর অর্থে প্রয়োগটাও হয়নি।
মানুষের মহত্তম কল্যাণের পথটা রাজনীতিই খুলে দেয়। চীন, রাশিয়া, কিউবার বিপ্লবে সে দেশগুলোর জনগণ একটা মুক্তির পথ পেয়েছিল। তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক সব ধর্মান্ধতা এবং গোঁড়ামি থেকে একটা মুক্ত সমাজ গড়েছিলেন। আমাদের দেশেও লাখ লাখ মানুষ দেশের জন্য বড় বড় ত্যাগ স্বীকার করেছেন। কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্ব তা সমাজের কাজে ব্যবহার করতে পারেননি। একটাই বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা হলো ক্ষমতা। ক্ষমতার ব্যবহার এবং অপব্যবহার একটি সমাজের জন্য যে কত ভয়ংকর হতে পারে, তা আমরা দেখেছি। এটা সবাই স্বীকার করছেন, আমরা একটি সংকটকাল পার করছি। তার মধ্যেও মানুষের মনে আশা জাগে—একটা সুদিন আসবে। কীভাবে যে সে আশা পূর্ণ হবে আমি জানি না, কেউ জানে কি না জানি না, তবে কেউ না কেউ নিশ্চয়ই জানেন। জেনে থাকলে আমাদের খবর দেবেন।
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব

২০২৪ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশ তার ৫৩তম স্বাধীনতা দিবস পার করছে। ১৯৭১ সালে ৯ মাসের একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা ছিনিয়ে এনেছিলাম বিজয়ের লাল সূর্য। আমাদের স্বাধীনতা শুধু একটি ভূখণ্ডের নয়, নয় একটি মানবগোষ্ঠীর; সে বিজয় একটি চেতনার, একটি সংগ্রামের, একটি মূল্যবোধের
২৬ মার্চ ২০২৪
ত্রিমুখী সম্পর্ক নিয়ে অনেক মুভি হয়েছে। এ রকম মুভি দেখেননি, এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন। কেবল মুভিতেই কেন, বাস্তবেও ত্রিমুখী সম্পর্কের অনেক ঘটনা আমরা দেখে থাকি। সব ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ত্রিভুজ সম্পর্কের শেষ পরিণতি সাধারণত ভালো হয় না।
১০ ঘণ্টা আগে
আমরা চব্বিশের আন্দোলন দেখেছি—বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন থেকে যা রূপ নেয় স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে। এর আগপর্যন্ত স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন সম্পর্কে জেনেছি নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান এবং নূর হোসেনের আত্মত্যাগের কথা। অনেকে দুটো ঘটনারই সাক্ষী। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর নূর হোসেন শহীদ হন পুলিশের গুলিতে।
১০ ঘণ্টা আগে
দেশে এমনিতেই ফসলি জমি হ্রাস পাচ্ছে। সেটি কমে যাওয়া মানে খাদ্যের উৎপাদনও কমে যাওয়া। যে কারণে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়ে থাকে, কোনো আবাদি জমি যাতে পতিত না থাকে।
১০ ঘণ্টা আগেসম্পাদকীয়

দেশে এমনিতেই ফসলি জমি হ্রাস পাচ্ছে। সেটি কমে যাওয়া মানে খাদ্যের উৎপাদনও কমে যাওয়া। যে কারণে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়ে থাকে, কোনো আবাদি জমি যাতে পতিত না থাকে।
সেই ফসলি জমির মাটিই যদি কেটে নেওয়া হয়, তাহলে খাদ্য উৎপাদনের কী হবে! মাদারীপুর সদর উপজেলায় আড়িয়াল খাঁ ও কুমার নদের পাড়ের অন্তত ২০টি স্থান থেকে অবৈধভাবে মাটি কেটে বিক্রি করছেন স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি। তাঁদের একজন হলেন ইলিয়াস চৌকিদার। প্রতিদিন রাত থেকে ভোর পর্যন্ত ট্রলারে করে অবাধে মাটি কেটে নেওয়ার ফলে নদীপাড়ের গ্রামগুলোর মানুষের জীবনে এক বিশাল ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে।
বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০-এর ৪-এর খ ও গ ধারা অনুযায়ী সেতু, কালভার্ট, বাঁধ, সড়ক, রেললাইন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার ১ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে বালু বা মাটি তোলা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু যাঁরা মাটি কাটেন তাঁরা এই আইন মানেন না। আইন অমান্য করার জন্য তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। কিন্তু তাঁদের বিরুদ্ধে কম ক্ষেত্রেই ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়। প্রশাসন অবৈধভাবে মাটি কাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় না কেন, সেটা বোধগম্য নয়।
নদীর পাড় থেকে মাটি কাটার কারণে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হচ্ছে, যা ভাঙনে সহায়তা করবে। শুধু নদীভাঙনই নয়, এভাবে মাটি কাটার ফলে একজন কৃষকের সবজিখেত সরাসরি ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়েছে। কয়েকজন কৃষক অভিযোগ করেছেন, ফসলি জমির মাটি কেটে নেওয়ায় জমির উর্বরতা শক্তি হ্রাস পাচ্ছে এবং ফলনও কমে গেছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ সত্ত্বেও ইলিয়াস চৌকিদার মাটি কাটা অব্যাহত রেখেছেন। এমনকি প্রতিবাদ করায় তিনি গ্রামের একজনকে ‘চোখ তুলে ফেলার’ হুমকিও দিয়েছেন। ভুক্তভোগী স্থানীয় বাসিন্দারা বহুবার প্রশাসনের কাছে অভিযোগ দিলেও কোনো আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
অবৈধভাবে এই মাটি কাটা রোধে নদের তীরবর্তী এলাকাগুলোতে নিয়মিত টহলের ব্যবস্থা চালু করা দরকার। কেবল দিনের বেলাতেই নয়, মাটি কাটার মূল সময় অর্থাৎ রাতে ও ভোরে কঠোর নজরদারি বাড়াতে হবে। পাশাপাশি যাঁরা রাজনৈতিক প্রভাবে এ ধরনের অপকর্ম করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। কেবল জরিমানা নয়, মাটি কাটার সরঞ্জাম জব্দ এবং কঠোর কারাদণ্ড নিশ্চিত করতে হবে, যাতে অন্যরা এমন কাজ করার সাহস না পান।
নদীর পাড়ের ফসলি জমি বাঁচানো না গেলে, পুরো গ্রামই একদিন মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে পারে। সে জন্য প্রশাসনকে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, যাতে এই দুই নদ স্বাভাবিকভাবে প্রবাহিত হতে পারে এবং নদের দুই পাড়ের স্থানীয় মানুষজন ভাঙন ও ভূমি হারানোর আতঙ্ক থেকে মুক্তি পান।
অবৈধভাবে মাটি কাটা প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। মাটি ব্যবস্থাপনা নিয়ে সরকারি যে আইন রয়েছে, আমরা সেই আইনের বাস্তবায়ন দেখতে চাই।

দেশে এমনিতেই ফসলি জমি হ্রাস পাচ্ছে। সেটি কমে যাওয়া মানে খাদ্যের উৎপাদনও কমে যাওয়া। যে কারণে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়ে থাকে, কোনো আবাদি জমি যাতে পতিত না থাকে।
সেই ফসলি জমির মাটিই যদি কেটে নেওয়া হয়, তাহলে খাদ্য উৎপাদনের কী হবে! মাদারীপুর সদর উপজেলায় আড়িয়াল খাঁ ও কুমার নদের পাড়ের অন্তত ২০টি স্থান থেকে অবৈধভাবে মাটি কেটে বিক্রি করছেন স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি। তাঁদের একজন হলেন ইলিয়াস চৌকিদার। প্রতিদিন রাত থেকে ভোর পর্যন্ত ট্রলারে করে অবাধে মাটি কেটে নেওয়ার ফলে নদীপাড়ের গ্রামগুলোর মানুষের জীবনে এক বিশাল ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে।
বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০-এর ৪-এর খ ও গ ধারা অনুযায়ী সেতু, কালভার্ট, বাঁধ, সড়ক, রেললাইন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার ১ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে বালু বা মাটি তোলা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু যাঁরা মাটি কাটেন তাঁরা এই আইন মানেন না। আইন অমান্য করার জন্য তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। কিন্তু তাঁদের বিরুদ্ধে কম ক্ষেত্রেই ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়। প্রশাসন অবৈধভাবে মাটি কাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় না কেন, সেটা বোধগম্য নয়।
নদীর পাড় থেকে মাটি কাটার কারণে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হচ্ছে, যা ভাঙনে সহায়তা করবে। শুধু নদীভাঙনই নয়, এভাবে মাটি কাটার ফলে একজন কৃষকের সবজিখেত সরাসরি ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়েছে। কয়েকজন কৃষক অভিযোগ করেছেন, ফসলি জমির মাটি কেটে নেওয়ায় জমির উর্বরতা শক্তি হ্রাস পাচ্ছে এবং ফলনও কমে গেছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ সত্ত্বেও ইলিয়াস চৌকিদার মাটি কাটা অব্যাহত রেখেছেন। এমনকি প্রতিবাদ করায় তিনি গ্রামের একজনকে ‘চোখ তুলে ফেলার’ হুমকিও দিয়েছেন। ভুক্তভোগী স্থানীয় বাসিন্দারা বহুবার প্রশাসনের কাছে অভিযোগ দিলেও কোনো আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
অবৈধভাবে এই মাটি কাটা রোধে নদের তীরবর্তী এলাকাগুলোতে নিয়মিত টহলের ব্যবস্থা চালু করা দরকার। কেবল দিনের বেলাতেই নয়, মাটি কাটার মূল সময় অর্থাৎ রাতে ও ভোরে কঠোর নজরদারি বাড়াতে হবে। পাশাপাশি যাঁরা রাজনৈতিক প্রভাবে এ ধরনের অপকর্ম করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। কেবল জরিমানা নয়, মাটি কাটার সরঞ্জাম জব্দ এবং কঠোর কারাদণ্ড নিশ্চিত করতে হবে, যাতে অন্যরা এমন কাজ করার সাহস না পান।
নদীর পাড়ের ফসলি জমি বাঁচানো না গেলে, পুরো গ্রামই একদিন মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে পারে। সে জন্য প্রশাসনকে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, যাতে এই দুই নদ স্বাভাবিকভাবে প্রবাহিত হতে পারে এবং নদের দুই পাড়ের স্থানীয় মানুষজন ভাঙন ও ভূমি হারানোর আতঙ্ক থেকে মুক্তি পান।
অবৈধভাবে মাটি কাটা প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। মাটি ব্যবস্থাপনা নিয়ে সরকারি যে আইন রয়েছে, আমরা সেই আইনের বাস্তবায়ন দেখতে চাই।

২০২৪ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশ তার ৫৩তম স্বাধীনতা দিবস পার করছে। ১৯৭১ সালে ৯ মাসের একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা ছিনিয়ে এনেছিলাম বিজয়ের লাল সূর্য। আমাদের স্বাধীনতা শুধু একটি ভূখণ্ডের নয়, নয় একটি মানবগোষ্ঠীর; সে বিজয় একটি চেতনার, একটি সংগ্রামের, একটি মূল্যবোধের
২৬ মার্চ ২০২৪
ত্রিমুখী সম্পর্ক নিয়ে অনেক মুভি হয়েছে। এ রকম মুভি দেখেননি, এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন। কেবল মুভিতেই কেন, বাস্তবেও ত্রিমুখী সম্পর্কের অনেক ঘটনা আমরা দেখে থাকি। সব ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ত্রিভুজ সম্পর্কের শেষ পরিণতি সাধারণত ভালো হয় না।
১০ ঘণ্টা আগে
আমরা চব্বিশের আন্দোলন দেখেছি—বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন থেকে যা রূপ নেয় স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে। এর আগপর্যন্ত স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন সম্পর্কে জেনেছি নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান এবং নূর হোসেনের আত্মত্যাগের কথা। অনেকে দুটো ঘটনারই সাক্ষী। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর নূর হোসেন শহীদ হন পুলিশের গুলিতে।
১০ ঘণ্টা আগে
গত এক বছরে আমাদের জাতি এক অভূতপূর্ব রাজনৈতিক প্রজ্ঞা লাভ করেছে। জাতীয় গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ঘরের ভেতর থেকে চায়ের দোকান, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়—সর্বত্রই রাজনৈতিক আলোচনা, পর্যালোচনা এবং সেই সঙ্গে যাঁর যাঁর সুচিন্তিত মন্তব্যও দিয়ে যাচ্ছেন।
১০ ঘণ্টা আগে