Ajker Patrika

জুলাই জাতীয় সনদ: বাস্তবায়ন নিয়ে মতভেদে সনদ স্বাক্ষরে অনিশ্চয়তা

তানিম আহমেদ, ঢাকা
জুলাই জাতীয় সনদ: বাস্তবায়ন নিয়ে মতভেদে সনদ স্বাক্ষরে অনিশ্চয়তা

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো অনড় অবস্থান থেকে সরছে না। বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো সাংবিধানিক বিভিন্ন বিষয় নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে বাস্তবায়নের পক্ষে। অন্যদিকে সনদের ভিত্তিতে নির্বাচনের পক্ষে অনড় জামায়াত, এনসিপিসহ কয়েকটি দল। বাস্তবায়নের দিকনির্দেশনা না থাকলে সনদে স্বাক্ষর করবে না বলেও জানাচ্ছে দলগুলো।

বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, এই অনিশ্চয়তা শুধু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকেই নয়; বরং নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। তবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বলছে, আজ রোববারের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা জুলাই সনদ বাস্তবায়নে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দেবেন, যাতে সনদ নিয়ে অস্বস্তি কাটবে।

জুলাই সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি ঠিক করতে গত বৃহস্পতিবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে বসে কমিশন। সেখানে সনদ বাস্তবায়নের চারটি পদ্ধতির কথা সুপারিশ করা হয়। যেগুলো হলো গণভোট, বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ, অধ্যাদেশ ও নির্বাহী আদেশ।

বিএনপিসহ তার সমমনারা সাংবিধানিক বিভিন্ন বিষয় ছাড়া অন্যগুলো অধ্যাদেশ ও নির্বাহী আদেশে বাস্তবায়নের পক্ষে। সাংবিধানিক বিষয়গুলো পরবর্তী সংসদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন চায় দলটি।

তবে জামায়াতে ইসলামী বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ ও এনসিপি গণপরিষদের মাধ্যমে জুলাই সনদের বাস্তবায়ন চেয়েছে। দলগুলো আইনি ভিত্তি না থাকলে সনদে স্বাক্ষর করবে না বলেও জানিয়েছে একাধিকবার।

জুলাই সনদের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো সমঝোতায় না পৌঁছালে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হবে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডারস বিভাগের চেয়ারম্যান শারমীন আহমেদ। সে ক্ষেত্রে বড় দল হিসেবে বিএনপি একমাত্র নির্বাচনের দাবিদার হিসেবে মাঠে থাকবে বলে মনে করেন তিনি। শারমীন আহমেদ বলেন, ‘জামায়াত ও এনসিপি, যারা দাবি করছে জুলাই আন্দোলনে তাদের বেশি অংশগ্রহণ ছিল, তারা রাজনৈতিক ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে জুলাই সনদের সাংবিধানিক ভিত্তি চাইবে। সেটা নিয়ে সমঝোতাকে দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করবে। একই সঙ্গে বিএনপিও নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করবে। দুই ধরনের দাবি নিয়ে আন্দোলন শুরু হলে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। যেটা নির্বাচনের পরিবেশকে নষ্ট করবে, ভোটাররা নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিরাপদ মনে করবেন না।’

চূড়ান্ত জুলাই সনদ গত বৃহস্পতিবার রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। কমিশনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, সনদের চূড়ান্ত ভাষ্যে সবার মতের প্রতিফলন ঘটানো হয়েছে। এ জন্য সনদে স্বাক্ষরের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে গতকাল শনিবার বিকেল ৫টার মধ্যে দুজন ব্যক্তির নাম পাঠানোর অনুরোধ জানানো হয়।

সূত্র জানায়, গতকাল বিকেল পর্যন্ত বিএনপি ও এনসিপিসহ ১৫টি দল নাম পাঠিয়েছে। কমিশন বলছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নির্ধারিত সময়ে সবকিছু হয় না। দু-এক দিনের মধ্যে সব দলের পক্ষ থেকে নাম পাওয়ার আশা করছেন তাঁরা।

আজ রোববার সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি ঠিক করতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় দিনের মতো বৈঠকে বসবে কমিশন। বেলা আড়াইটা থেকে শুরু হওয়া বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস উপস্থিত থাকবেন। সেখানে তিনি দিকনির্দেশনা মূলক বক্তব্য দেবেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে দলগুলো মত বদলাতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

জুলাই সনদে স্বাক্ষর করতে বিএনপির পক্ষ থেকে দুজনের নাম পাঠানো হয়েছে বলে দলটির একটি সূত্র জানিয়েছে। তাঁরা হলেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ।

জামায়াত থেকে বলা হয়েছে, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া ঠিক হলেই তাঁরা স্বাক্ষরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। সে সময় স্বাক্ষরের জন্য নাম পাঠাবে দলটি।

জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এখনো সনদ হয়নি। হলেই তো স্বাক্ষরের বিষয়টি আসবে। কমিশনের রোববারের (আজ) আলোচনার ধরন দেখেই আমরা স্বাক্ষরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।’

জুলাই জাতীয় সনদ নিয়ে শুক্রবার রাতে এনসিপির নির্বাহী কমিটির বৈঠকে আলোচনা হয় বলে সূত্রে জানা গেছে। সেখানে জুলাই সনদ নিয়ে বিএনপি, জামায়াতসহ রাজনৈতিক দল ও কমিশনের অবস্থা নিয়ে বিস্তারিত কথা হয়। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য গণপরিষদ নির্বাচনে দাবিতে থাকার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। এটার জন্য রাজনৈতিক লড়াই বজায় রাখবে দলটি।

জুলাই সনদে স্বাক্ষরের বিষয়ে আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলাম ও সদস্যসচিব আখতার হোসেনের নাম এনসিপির পক্ষ থেকে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন। তিনি বলেন, ‘স্বাক্ষর করব কি না, তা নিয়ে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসছি। তাদের মতামত জেনে স্বাক্ষরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব। এ ক্ষেত্রে বাস্তবায়নপ্রক্রিয়ায় গণপরিষদ থাকবে কি না, সেটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।’

ইসলামী আন্দোলনের প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন বলেন, তাঁর দল নাম পাঠাবে, তবে যেহেতু তাঁদের প্রধান দাবি (নিম্নকক্ষে পিআর) নিয়ে সনদে কিছু নেই, তাই এ দাবির পক্ষে থাকা সমমনা দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করা হবে ইসলামী আন্দোলন সনদে স্বাক্ষর করবে কি, করবে না।

বাসদ সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ জানান, তাঁর দল সনদে কিছু সংশোধনের শর্ত উল্লেখ করে প্রতিনিধিদের নাম জানাবে। তিনি বলেন, ‘যদি আমাদের শর্ত পূরণ না করা হয়, তাহলে আমরা সনদে স্বাক্ষর করব না।’

গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খানও জানিয়েছেন, তাঁর দলও সনদের জরুরি কিছু সংশোধনের দাবি রেখে প্রতিনিধিদের নাম পাঠাবে।

সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, তাঁর দল প্রতিনিধিদের নামের তালিকা পাঠাতে সময় চায়। তিনি বলেন, ‘কমিশনের কাছে আমাদের কিছু দাবি ছিল যেমন চার মূলনীতি অক্ষুণ্ন রাখতে হবে। তা ছাড়া, চূড়ান্ত সনদের ভূমিকা এবং অঙ্গীকারনামা নিয়ে আমাদের দলের আপত্তি আছে। এসব বিষয় যদি কমিশন এড়িয়ে যায়, তবে সনদে স্বাক্ষর করব কি না, তা সময়ই বলে দেবে।’

নাগরিক ঐক্যের সাংগঠনিক সম্পাদক সাকিব আনোয়ার বলেন, দলের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না ঢাকার বাইরে থাকায় তাঁর দল এখনো প্রতিনিধির তালিকা বা সনদে স্বাক্ষরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবে আজ রাতের মধ্যেই সিদ্ধান্ত হবে বলে তিনি জানান।

বাসদ মার্ক্সবাদীর পক্ষে দুজন প্রতিনিধির নাম পাঠানোর পাশাপাশি একাধিক আপত্তি জানানো হয়েছে। দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক সনদের সঙ্গে জুলাই সনদের তুলনা করা যাচ্ছে না। এই সনদের চরিত্র নির্ণয় করা না গেলে, ভবিষ্যতে এটি প্রশ্নের মুখে পড়তে বাধ্য।

কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, ‘জুলাই সনদের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর আনুষ্ঠানিক বক্তব্য না পাওয়া পর্যন্ত কিছু বলা ঠিক হবে না। কারণ তাঁরা বাইরে অনেক কথা বলবেন। সেগুলো অনুসরণ করা আমাদের জন্য মুশকিল।’

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান বলেন, সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো কিছুই সংসদ ছাড়া সম্ভব নয়। দেশের বিদ্যমান আইন ও চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো কিছু করা ঠিক হবে না। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় মূল বিষয় ছিল গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। সেটা না হওয়ার জন্য এত কিছু হয়েছে। তাই সবাইকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য একমত হওয়া উচিত। কিন্তু জুলাই সনদের নামে নির্বাচনকে পেঁচিয়ে দেওয়া জাতির জন্য আত্মঘাতী হবে বলে মনে করেন তিনি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

৯ পুলিশ পরিদর্শক বাধ্যতামূলক অবসরে

‎ডিভোর্সের পরও জোর করে রাতযাপন, বর্তমান স্বামীকে নিয়ে প্রাক্তন স্বামীকে হত্যা ‎

গণবিক্ষোভ আতঙ্কে মোদি সরকার, ১৯৭৪-পরবর্তী সব আন্দোলন নিয়ে গবেষণার নির্দেশ

নিজের বিচারের দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি কলেজশিক্ষকের

আমাদের জন্য ভারত নেই, বঙ্গোপসাগরে ডুবে মরতে হবে—বিএনপি নেতার সতর্কবার্তা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত