Ajker Patrika

পুলিশ-আদালত মানছে না রিমান্ডের নির্দেশনা

আশরাফ-উল-আলম, ঢাকা
পুলিশ-আদালত মানছে না রিমান্ডের নির্দেশনা

চিত্রনায়িকা পরীমণিকে বারবার রিমান্ডে নিয়ে বিচার বিভাগকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট। গত বুধবার হাইকোর্টের এক আদেশে বলা হয়েছে, প্রথম দফায় রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য যথেষ্ট সময় পাওয়া গেছে। তা সত্ত্বেও আইনগত ভিত্তি ছাড়া আরও দুই দফা রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে পরীমণিকে। এ ক্ষেত্রে হাইকোর্টের আদেশও ভঙ্গ করা হয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নেওয়ার ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের যেসব নির্দেশনা রয়েছে তা যেমন পুলিশ মানছে না, তেমনি নিম্ন আদালতের বিচারকরাও অনুসরণ করছেন না। অথচ রিমান্ডে নিয়ে আসামিদের নির্যাতন ও হয়রানি করার ঘটনা অহরহ ঘটছে। 
জানতে চাইলে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের সভাপতি আইনজীবী মনজিল মোরশেদ বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশনা হলো আইন। এই আইন মানতে সবাই বাধ্য। পুলিশ রিমান্ড কেন চায় আর আদালত কেন মঞ্জুর করেন, তা বুঝতে হবে। এখানে পুলিশ ও বিচারক কেউই আইন মানছেন না। সাম্প্রতিক হাইকোর্টের আদেশেই সেটা স্পষ্ট হয়ে গেছে।

২০১৭ সালের ১৮ জুলাই খুলনায় শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন পিরোজপুরের সুবিদপুর গ্রামের মো. শাহজালাল। শাহজালালের ওপর পুলিশ নির্যাতনের ঘটনা সে সময় দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ২০১৪ সালে মিরপুরের বাসিন্দা ইশতিয়াক হোসেন জনিকে গ্রেপ্তার করার পর ক্রিকেট খেলার স্ট্যাম্প দিয়ে পিটিয়ে আহত করা হয়। এরপর জনি মারা যান। এ ঘটনায় পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইনে মামলা করা হয়। মামলায় কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে আসামিও করা হয়। গত বছর 8 জুন যশোরের শাহবাজপুর গ্রামের ইমরান হোসেনকে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন চালিয়ে তার দুটি কিডনি অকেজো করে দেয় পুলিশ। এ নিয়েও হাইকোর্টে রিট হয়। 

তখন বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। ঘটনা আরও আছে। বরিশালে এক নারীকে রিমান্ডে নিয়ে ধর্ষণের ও শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে সম্প্রতি। 
আইনজীবীরা বলছেন, দেশের প্রচলিত আইনে রিমান্ডের কোনো সংজ্ঞা নেই। তবে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ ধারায় আসামিকে পুলিশ হেফাজতে দেওয়ার বিধান রয়েছে। তবে সে ব্যাপারে হাইকোর্ট কিছু দিক নির্দেশনাও রয়েছে।

ইন্ডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রুবেলকে রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী এলাকা থেকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করে অমানুষিক নির্যাতন করে পুলিশ। ১৯৯৮ সালের ২৩ জুলাই মিন্টু রোডের ডিবি কার্যালয়ে মৃত্যু হয় তাঁর। এর আগে ১৯৯৭ সালে চট্টগ্রামের রাউজানে সীমা চৌধুরী নামের একজন নারী পুলিশ হেফাজতে ধর্ষিত হয়ে মারা যান। একই সময়ে অরুণ চক্রবর্তী নামের আরেকজন রাজধানীর মালিবাগে পুলিশের হেফাজতে মারা যান।

এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন এবং আরও কয়েকজন ব্যক্তি ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় বিনা পরোয়ানায় কাউকে গ্রেপ্তারের বিধান চ্যালেঞ্জ করে রিট আবেদন করেন। একই সঙ্গে কিছু দিক নির্দেশনা দাবি করেন। ১৯৯৮ সালের ২৯ নভেম্বর শুনানি শেষে হাইকোর্ট রুল জারি করেন। ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল রুলের ওপর শুনানি শেষে বিচারপতি হামিদুল হক এবং বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী বেঞ্চ রায় দেন। রায়ে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার ও রিমান্ডের বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে ১৫টি নির্দেশনা দেন হাইকোর্ট।

এসব নির্দেশনার মধ্যে রিমান্ডের বিষয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কারও রিমান্ডের প্রয়োজন হলে তাঁকে ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে কারাগারের কাচনির্মিত বিশেষ কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। কক্ষের বাইরে তাঁর আইনজীবী ও নিকটাত্মীয় থাকতে পারবেন। কারাগারে জিজ্ঞাসাবাদে প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া না গেলে তদন্তকারী কর্মকর্তা ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে সর্বোচ্চ তিন দিন পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবেন। তবে এ ক্ষেত্রে উপযুক্ত কারণ থাকতে হবে। জিজ্ঞাসাবাদের আগে ও পরে ওই ব্যক্তির ডাক্তারি পরীক্ষাও করতে হবে।

ওই আদেশে আরও বলা হয়, পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ উঠলে ম্যাজিস্ট্রেট সঙ্গে সঙ্গে মেডিকেল বোর্ড গঠন করবেন। সেই বোর্ড যদি বলে, ওই ব্যক্তির ওপর নির্যাতন করা হয়েছে, তাহলে পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ম্যাজিস্ট্রেট ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এবং তাঁকে দণ্ডবিধির ৩৩০ ধারায় অভিযুক্ত করবেন। আর পুলিশ হেফাজতে বা কারাগারে গ্রেপ্তার ব্যক্তি মারা গেলে সঙ্গে সঙ্গে নিকটস্থ ম্যাজিস্ট্রেটকে জানাতে হবে। পুলিশ বা কারা হেফাজতে কেউ মারা গেলে ম্যাজিস্ট্রেট তা তদন্তের ব্যবস্থা করবেন। 
গত ১৪ মার্চ বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বেঞ্চ চাঁদপুরের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নুরে আলমকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছেন। একটি মামলায় ফরহাদ নামে এক আসামিকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় তাঁকে নির্যাতন করা হয়। ফরহাদের শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন থাকার পরও ম্যাজিস্ট্রেট তাঁর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণ করেন। শরীরের নির্যাতনের চিহ্ন থাকা সত্ত্বেও কেন জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়েছে তার ব্যাখ্যা চান হাইকোর্ট।

ভুক্তভোগীরা বলেছেন, পরীমণি দেশের একজন জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা। তাঁর ক্ষেত্রে সহজেই উচ্চ আদালতে প্রতিকার পাওয়া সম্ভব হয়েছে। কিন্তু প্রতিদিন শত শত ব্যক্তি গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। কিন্তু তাঁরা প্রতিকার পাচ্ছেন না।

জানতে চাইলে সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট তবারক হোসেন বলেন, পুলিশ রিমান্ড চাচ্ছে আর আদালত রিমান্ড দিয়ে যাচ্ছে-এটা কোনোভাবেই বিচারক সুলভ মনোভাব হতে পারে না। এই অবস্থার অবসান হওয়া দরকার। 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত