Ajker Patrika

বাংলাদেশ-পাকিস্তান

সম্পর্ক উষ্ণ হলে সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে দক্ষিণ এশিয়ায়

সাহিদুল ইসলাম চৌধুরী, ঢাকা 
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

গণ-অভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে নিজের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে ১৫ বছরের নিশ্চল অবস্থা কাটাতে বেশ তৎপর হয়ে উঠেছে পাকিস্তান।

যদিও অন্তর্বর্তী সরকার পাকিস্তানের বিষয়ে আপাতত সতর্কতার সঙ্গে এগোচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের স্থানীয় ও বিদেশি বিশ্লেষকেরা মনে করেছেন, প্রায় দেড় যুগ একমুখী থাকার পর বাংলাদেশের কূটনীতি এক বছর ধরে ভিন্ন গতিতে যাত্রা শুরু করেছে। এখন পাকিস্তান বেশ সক্রিয় হওয়ায় যা ঘটতে চলেছে, তা সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় একটি বড় ঘটনা। এমন তৎপরতার মুখে দুই দেশের সরকার ও নাগরিকদের মধ্যে যাতায়াত বাড়লে এবং বোঝাপড়ায় গতি এলে তার প্রভাব ভবিষ্যতে পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় পড়বে।

গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট এম হুমায়ুন কবির সোমবার বলেন, ‘ঢাকা ও ইসলামাবাদের মধ্যে সম্পর্ক যদি স্বাভাবিক হয়, তা হবে একটি ইতিবাচক ঘটনা। দুই দেশই এর সুফল পাবে।’ পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারসহ দেশটির তিন প্রভাবশালী মন্ত্রীর ঢাকা সফরের বিষয়ে আলাপকালে তিনি আজকের পত্রিকা'কে এ কথা বলেন।

পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খান ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহসিন রাজা নাকভি এরই মধ্যে ঢাকা ঘুরে গেছেন। বাংলাদেশে পররাষ্ট্র, বাণিজ্য ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে আলাদা বৈঠক ছাড়াও তাঁরা সবাই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ ছাড়া যৌথ অর্থনৈতিক কমিশনের সভায় যোগ দিতে আগামী সেপ্টেম্বরের শেষে অথবা অক্টোবরের শুরুতে ঢাকা সফরের প্রস্তাব দিয়ে রেখেছেন অর্থমন্ত্রী মুহাম্মদ আওরঙ্গজেব।

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান পরস্পরের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখলে রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক ও প্রতিরক্ষা খাতে সহযোগিতা বাড়ার সুযোগ আছে। যেমন বাংলাদেশ এখন তৈরি পোশাকশিল্পের জন্য তুলা আনে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের মতো দূরের দেশগুলো থেকে। যদিও কাছে পাকিস্তান ও ভারতে তুলা আছে।

ভারতের সঙ্গে টানাপোড়েন দীর্ঘায়িত হলে পাকিস্তান থেকে অল্প সময়ে কম দামে তুলা আনার সুযোগ এখানকার শিল্পোদ্যোক্তারা কাজে লাগাতে পারবেন।

প্রতিরক্ষা খাতে বাংলাদেশ ও ইসলামাবাদের মধ্যে দূরত্ব কমছে, এমনটা উল্লেখ করে হুমায়ুন কবির বলেন, প্রতিরক্ষা খাতে কেনাকাটার এ সম্পর্ক আগে থেকেই আছে। এখন উচ্চপর্যায়ে দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ ও যাতায়াত বেড়েছে। এ বিষয়ের ওপর ভারতসহ আঞ্চলিক দেশগুলোরও নজর আছে।

ইসহাক দারের ঢাকা সফরে বারবার সার্ক (দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা) প্রসঙ্গ আসার উল্লেখ করে হুমায়ুন কবির বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে ভারত উদ্বিগ্ন। এমন অবস্থা দীর্ঘায়িত হলে ভারত আবার দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতিবেশীদের সঙ্গে দূরত্ব কিছুটা ঘোচানো এবং সার্ক চাঙা করার মাধ্যমে আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার করায় মনোযোগী হতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে একটু সময় লাগা অস্বাভাবিক নয়। এর বাইরে বিভিন্ন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থায় বাংলাদেশ পাকিস্তানের সহায়তা পেতে পারে।

হুমায়ুন কবির মনে করেন, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কে গতি এলেও সে কারণে যেন ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। ভারতের উদ্বেগ ও স্পর্শকাতরতা বিবেচনায় রাখা খুব দরকার। আর দীর্ঘ স্থলসীমান্ত এবং সমুদ্র সীমানা থাকায় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্মানজনক সম্পর্ক হলে দুই দেশই লাভবান হয়।

পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে মার্কিন বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান মনে করেন, ঢাকা ও ইসলামাবাদের মধ্যে সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হওয়া দক্ষিণ এশিয়ায় গত এক বছরে সবচেয়ে বড় ঘটনা। উড্রো উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর স্কলারসের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের এই পরিচালক গত রোববার এক্স-পোস্টে বলেন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক ভবিষ্যতে ঠিক কোন দিকে গড়াবে, তা বোঝা যাবে আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে ঢাকায় নতুন সরকার আসার পর।

ইসহাক দার তাঁর কমবেশি ৩৬ ঘণ্টার সফরে সরকারের বাইরে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান ছাড়াও এনসিপিসহ তিন দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন।

বিশ্লেষকেরা মনে করেন, দুই দেশের ওপরের দিকে সফর বিনিময়ের মধ্যেও ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়াসহ অমীমাংসিত বিষয়গুলোর স্পষ্ট সুরাহা না হলে বারবার সামনে আসতেই থাকবে।

যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসভিত্তিক ইউএসসি ডরনসাইফ কলেজ অব লেটার্স, আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সেসের অধ্যাপক ডেরেক গ্রসম্যান গতকাল সোমবার এক এক্স-পোস্টে প্রশ্ন তোলেন, ‘পাকিস্তান বলছে, দেশটি দুবার একাত্তরের বিষয়ে ক্ষমা চেয়েছে। তারপরও বিষয়টি সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের ক্ষেত্রে অনতিক্রম্য বাধা হয়ে রয়ে যাবে কি?’

পাকিস্তানের একজন সাবেক কূটনীতিক মনে করেন, একাত্তর-পূর্ব আর্থিক লেনদেনের হিস্যা আদায় করতে চাইলে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার সুযোগ আছে।

এ বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির অবশ্য মনে করেন, একাত্তরের প্রসঙ্গ সামনে এলেও বাংলাদেশ ও পাকিস্তান দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ লেনদেনের যে সম্পর্ক, তা ভবিষ্যতে চালিয়ে যাবে। তিনি বলেন, ‘দুই দেশের মধ্যে এখন মোট দ্বিপক্ষীয় বার্ষিক বাণিজ্য মাত্র ১০০ কোটি ডলারের। তুলা, কাপড়, শিল্পের কাঁচামালের কেনাবেচা বাড়িয়ে এখনই এটা ২০০ কোটি ডলারে নেওয়া সম্ভব। তবে সম্পর্ক নির্বিঘ্ন করতে চাইলে পাকিস্তানের উচিত একাত্তরের বিষয়টি মিটিয়ে ফেলা।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত