Ajker Patrika

সম্পর্কের অস্বস্তি কাটানোই লক্ষ্য

কূটনৈতিক প্রতিবেদক, ঢাকা
সম্পর্কের অস্বস্তি কাটানোই লক্ষ্য

সোনালি অধ্যায়সহ বহু বিশেষণে বর্ণনা করা হয়ে থাকে বাংলাদেশ ও ভারতের বর্তমান সম্পর্ককে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে পদস্থ সকল পর্যায়ের প্রায় সবার মুখের ভাষার সঙ্গে দেহের ভাষাও বদলে গেছে। বলা হচ্ছে, ৫১ বছরে বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেনও গতকাল রোববার বললেন, দুই দেশের সম্পর্ক ‘আদর্শ সম্পর্ক’।

এসবের আড়ালে দ্বিপক্ষীয় অনেক কিছু, বিশেষ করে বাংলাদেশের স্বার্থসম্পর্কিত বহু অনিষ্পন্ন বিষয় হয়ে রয়েছে সম্পর্কের কাঁটা হয়ে। গত ১৩ বছরে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয় না দেওয়াসহ নিরাপত্তা-সংশ্লিষ্ট সব সমস্যা সমাধান করেছে বাংলাদেশ। নিজ দেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে পূর্বাঞ্চলের সড়ক, রেল, নৌ ও সমুদ্রপথে আন্তসংযোগ প্রতিষ্ঠাসহ বহু বিষয়ে সুযোগ করে নিয়েছে ভারত। কিন্তু বাংলাদেশের স্বার্থের বিষয়ে ভারতের গড়িমসি করছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের মন্ত্রীরা কিছু না বললেও স্পষ্ট করেই নিজের মনোভাব প্রকাশ করে থাকেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

২০১৭ সালের এপ্রিলে ভারতের রাষ্ট্রীয় আচার ভেঙে দিল্লির সামরিক বিমান ঘাঁটিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজে স্বাগত জানিয়েছিলেন শেখ হাসিনাকে। দ্বিপক্ষীয় আলাপ শেষে তাঁকে (হাসিনা) পাশে রেখে দিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে সংবাদ সম্মেলনে মোদি ঘোষণা দিয়েছিলেন, তাঁর (মোদি) মেয়াদের মধ্যেই তিস্তার পানি ভাগাভাগির চুক্তি হবে। তাঁর সেই মেয়াদ শেষ হয়েছে। তিস্তায়ও বয়ে গেছে বহু জল। চুক্তি আর হয়নি। ভারতীয় পক্ষের বক্তব্য, পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকারের সঙ্গে কেন্দ্রের ব্যবধান ঘোচেনি বলে চুক্তিটি হচ্ছে না।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ সোমবার রাষ্ট্রীয় সফরে দিল্লি যাচ্ছেন। আগামীকাল মঙ্গলবার দুই নেতার শীর্ষ বৈঠক হবে একই স্থানে, হায়দরাবাদ হাউসে। ভারতীয়রা উদার না হলে যে তিস্তাসহ অভিন্ন অবশিষ্ট ৫৩ নদীর পানি ভাগাভাগি এবং পানি সদ্ব্যবহারের সুযোগ যে আসবে না, এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে তাঁর এক বক্তব্যে। পানি ভাগাভাগির ‘সমস্যা ভারতে’ উল্লেখ করে তিনি সে দেশের বার্তা সংস্থা এএনআই-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘পানি যেহেতু ভারত থেকে আসে, ভারতের উচিত আরও উদার হওয়া। এতে দুই দেশই লাভবান হবে। পানির অভাবে আমাদের দেশের মানুষকে অনেক ভুগতে হয়। বিশেষ করে তিস্তা নিয়ে অনেক সমস্যা হয়। ফসল ফলানো যায় না। আমি মনে করি, এই সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত।’ পানি সমস্যার সমাধান ভারতের ওপর নির্ভর করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন যে, ভারতের উচিত উদার মানসিকতা দেখানো।

ভারত সফরকে সামনে রেখে এএনআই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এ সাক্ষাৎকার গতকাল প্রচার করেছে। মিয়ানমারের নাগরিক রোহিঙ্গাদের সে দেশে ফেরার বিষয়টি কীভাবে দেখেন—এমন এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, তিনি মনে করেন প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালনের সুযোগ আছে।

এবারের সফরে কী কী আলোচনায় আসবে, এমন প্রশ্নের জবাবে গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন বলেন, ‘অনিষ্পন্ন বিষয়’-এ কী করে এগোনো যায়, ‘গতিশীল সম্পর্ক’ কী করে সুসংহত করা যায় এবং দ্বিপক্ষীয় ‘বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ’ কী করে মোকাবিলা করা যায়—সে সব বিষয় আলোচনায় আসবে।

‘স্থিতিশীলতার স্বার্থে’ বাংলাদেশে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখার ক্ষেত্রে ভারতের সহযোগিতা চাওয়া সম্পর্কিত পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাম্প্রতিক এক মন্তব্যের সূত্রে বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে এবারের বৈঠকে আলোচনা করা হবে কিনা—এমন এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এম শাহরিয়ার আলম বলেন, বাংলাদেশের নির্বাচন অন্য কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে আলোচনার বিষয় নয়। বর্তমান জ্বালানি সংকটের প্রেক্ষাপটে ভারতের মাধ্যমে রাশিয়া থেকে তেল আমদানির কোনো পরিকল্পনা নেই বলে তিনি জানান।

আগামীকাল মঙ্গলবার শেখ হাসিনা-নরেন্দ্র মোদি বৈঠকে বাংলাদেশ ও ভারতের বাণিজ্য সম্প্রসারণ, সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি (সেপা), বিনিয়োগ বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সহযোগিতা, জনযোগাযোগ, কুশিয়ারাসহ অভিন্ন কয়েকটি নদীর পানি বণ্টন, গঙ্গা-পদ্মাসহ নদীর অববাহিকাভিত্তিক পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা, সীমান্ত সুরক্ষা, সীমান্ত হত্যা বন্ধ করা, প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা সহযোগিতা, মাদক চোরাচালান ও মানবপাচার রোধ গুরুত্ব পাবে বলে উভয় পক্ষের কর্মকর্তারা জানান।

ওই কর্মকর্তারা বলেন, বাংলাদেশে ভারতীয় ঋণে নেওয়া বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে দুই দেশের সরকারি পর্যায়ে বেশ দ্বিমত আছে। প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও বিএসএফের সীমান্তে হত্যা বন্ধ হয়নি। এ ছাড়া প্রতিরক্ষা ঋণ চুক্তিবিষয়ক সমঝোতা স্মারক বাস্তবায়ন এবং বাংলাদেশ সীমান্তের চারপাশে অনেক স্থানে বিশেষ ধরনের কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের দাবি নিয়েও বেশ চাপ আছে বাংলাদেশের ওপর। এসব বিষয়ই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে কাঁটা হয়ে রয়েছে। দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক শেষে কুশিয়ারার পানি ব্যবস্থাপনা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, রেলওয়ে, আইন, তথ্য ও সম্প্রচার প্রভৃতি ক্ষেত্রে সহযোগিতা সম্পর্কিত সাতটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের সম্ভাবনা রয়েছে।

আগামীকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু ও উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনকড়ের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যেসব ভারতীয় সেনাসদস্য শহীদ হয়েছেন বা আহত হয়েছেন তাঁদের পরিবারের সদস্যদের মাঝে এবারের সফরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্র বৃত্তি প্রদান করা হবে। উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক বা স্নাতকোত্তর এ দুইটি পর্যায়ে এ বৃত্তি প্রদান করা হবে।

প্রধানমন্ত্রী আগামী বুধবার বাংলাদেশ ও ভারতের ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠেয় একটি সম্মেলনে বক্তৃতা করবেন। তাঁর সফরসঙ্গী হিসেবে বাংলাদেশের একটি উচ্চপর্যায়ের ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদল ভারত সফরে যাচ্ছে। সফরের তৃতীয় দিন শেখ হাসিনা আজমির শরিফে যাবেন। এর পরদিন আগামী বৃহস্পতিবার তাঁর ঢাকায় ফেরার কথা রয়েছে। উল্লেখ্য ২০১৯ সালের অক্টোবরে শেখ হাসিনা সর্বশেষ ভারত সফর করেন। 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত