Ajker Patrika

তথ্য যাচাই ছাড়া টিকা বাড়াবে আরেক ঝুঁকি

আশিকুর রিমেল ও আজাদুল আদনান, ঢাকা
তথ্য যাচাই ছাড়া টিকা বাড়াবে আরেক ঝুঁকি

রাজধানীর কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে গত রোববার করোনার প্রথম ডোজের টিকা নেন ব্যবসায়ী সাইদুল ইসলাম রেজা (৪৫)। টিকা নেওয়ার এক সপ্তাহ আগে সামান্য জ্বর ও ঠান্ডায় ভুগছিলেন তিনি। তবে তিন দিন পরই সেরে যাওয়ায় করোনার পরীক্ষা করাননি। টিকা নেওয়ার দিন তাঁর কোনো উপসর্গ ছিল না, কেন্দ্র থেকেও বিষয়টি জানতে চাওয়া হয়নি। তিনি নিজেও জানেন না করোনামুক্ত হওয়ার চার সপ্তাহ পর টিকা নিতে হয়। 

রেজা বলেন, ‘নিবন্ধনের কাগজ দেখাইলাম, স্বাক্ষর নিয়ে টিকার জন্য পাঠিয়ে দিল।’ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এস এম আলমগীর হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, শরীরে করোনার জীবাণু থাকা অবস্থায় কেউ যদি টিকা নেয়, তাহলে ভাইরাসটির কার্যকারিতা তীব্রভাবে বেড়ে যেতে পারে। তাই, অবশ্যই করোনামুক্ত হওয়ার অন্তত চার সপ্তাহ পর টিকা নিতে হবে।

টিকা দেওয়ার সময় করোনা আক্রান্ত বা এ-সংক্রান্ত তথ্য জানতে না চাওয়ার বিষয়ে কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মোহাম্মদ সিহাব উদ্দিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বিষয়টি দেখা হবে। যাঁরা ভ্যাকসিন কমিটিতে আছেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বলব।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তি টিকা নিলে তাঁর শরীরে গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। অথবা টিকার কার্যকারিতাও হারাতে পারে।
করোনায় আক্রান্ত অবস্থায় বা সেরে ওঠার পর একটা নির্দিষ্ট সময়ের আগ পর্যন্ত করোনার টিকা নেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। এ জন্য টিকার নিবন্ধনের সময় বিষয়টি জানতে চাওয়া হয়। ডায়াবেটিস, ক্যানসার, কিডনি ও উচ্চ রক্ষচাপের মতো রোগে আক্রান্ত কি না, সে তথ্যও নেওয়া হয়। এর বাইরে টিকা দেওয়ার সময়ও বিষয়টি মৌখিকভাবে জেনে নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া আছে টিকাদান কর্মীদের। কিন্তু টিকা কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিষয়টি খুব একটা গুরুত্ব পাচ্ছে না।

এই অবস্থায় টিকাদান কার্যক্রম জোরদার করতে নিবন্ধন ছাড়াই টিকা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এতে করে গুরুত্বপূর্ণ ওই সব তথ্য যাচাই-বাছাইয়ে আরও শিথিলতা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর ফলে টিকাদানের লক্ষ্য অর্জন কঠিন হতে পারে। কখনো কখনো ঝুঁকিতে পড়তে পারেন টিকাগ্রহীতা। ৭ আগস্ট থেকে শুরু হতে যাচ্ছে গণটিকাদান কার্যক্রম। ওই দিন থেকে সারা দেশে ইউনিয়ন পর্যায়ে টিকা দেওয়া হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা মতে, করোনামুক্ত হওয়ার চার সপ্তাহ পর টিকা নিতে পারবেন আক্রান্ত ব্যক্তি, তার আগে নয়। টিকা নিতে আসা ব্যক্তিকে এসব তথ্য জানাতে প্রতিটি কেন্দ্রে নির্দেশনাও দেওয়া আছে। কিন্তু ৯০ শতাংশের বেশি কেন্দ্রে সেই নির্দেশনার বাস্তবায়ন নেই।

এ ছাড়া টিকার নিবন্ধনের জন্য সুরক্ষা অ্যাপে কিডনি, হৃদরোগ, ক্যানসার, ডায়াবেটিসসহ করোনায় আক্রান্ত কি না এবং হলে কবে হয়েছেন, সে বিষয়ে কয়েকটি নির্দেশনার কথা বলা হয়েছে। টিকা দেওয়ার সময় এসব বিষয়েও প্রায়ই জানতে চাওয়া হয় না। যারা টিকা নিচ্ছেন তাঁরাও খুব একটা সচেতন নন।

গত শনিবার (৩১ জুলাই) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে টিকা নেন সৌদিপ্রবাসী মো. মাজহারুল ইসলাম। তিনিও জানেন না টিকার নির্দেশনাটি। করোনায় আক্রান্ত ছিলেন কি না–এমন প্রশ্নের জবাবে মাজহারুল জানান, পরীক্ষাই তো করা হয়নি। টিকা দেওয়ার সময়ও বুথ থেকে কেউ জানতে চায়নি।

একই চিত্র দেখা যায় রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও। প্রতিদিন টিকা নিতে ভিড় বাড়তে থাকায় বিষয়টি আরও এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। এতে করেই বাড়ছে শঙ্কা।

ঢাকার বাইরেও রাজশাহী, রংপুর, কক্সবাজার, খুলনা, ঠাকুরগাঁও, গোপালগঞ্জ, পাবনাসহ অনেক জেলায় একই চিত্র পাওয়া যায়। রাজশাহী সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজে ১৬টি বুথে প্রতিদিন কয়েক শ মানুষ টিকা নিতে আসেন। কিন্তু প্রায় কারও কাছ থেকেই টিকাগ্রহীতা করোনায় আক্রান্ত কি না, কিংবা হলেও কবে হয়েছিলেন, এসব তথ্য জানতে চাওয়া হচ্ছে না।

বিষয়টি স্বীকার করে ওই কেন্দ্রের নার্স ইনচার্জ রাজিয়া সুলতানা বলেন, ‘এত মানুষের চাপ থাকে যে সব সময় জিজ্ঞেস করা হয়ে ওঠে না।’ এমন বাস্তবতা যখন দৃশ্যমান তখন করোনায় মৃত্যু ও সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার গ্রামাঞ্চলেও শুরু করতে যাচ্ছে গণটিকাদান কার্যক্রম। কিন্তু প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ মানুষই এখনো নমুনা পরীক্ষার বাইরে। তাঁরা জানেনই না কোভিডে আক্রান্ত কি না।

এই প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘যদি কারও মধ্যে সামান্য পরিমাণে লক্ষণ থাকে এবং তিনি টিকা নেন, সে ক্ষেত্রে তাঁর শরীরে টিকার কার্যকারিতা কমে যাবে। করোনায় আক্রান্ত কিন্তু লক্ষণ ছিল না–এমন কিছু মানুষকেও আমরা ঢাকায় টিকা নিতে দেখেছি। গ্রামে এই ঝুঁকিটা আরও বেশি। তাই তাদের উচিত হবে লক্ষণ থাকা অবস্থায় টিকা নেওয়া থেকে বিরত থাকা।’

এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত কোনো টিকাই শতভাগ কার্যকর নয়। এ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মত, যদি কোনো টিকা ৫০ ভাগের বেশি কার্যকরী হয়, তাহলে সেটি ব্যবহার করা যাবে। তার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশে অক্সফোর্ড–অ্যাস্ট্রাজেনেকা, সিনোফার্ম, মডার্না ও ফাইজারের টিকা ব্যবহার করা হচ্ছে। এর মধ্যে ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ সুরক্ষা দেবে অক্সফোর্ড–অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা। চীনের সিনোফার্ম দেবে ৭৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ, মডার্না ৯৪ শতাংশ এবং ফাইজার দেবে ৯৫ শতাংশ সুরক্ষা।
এমতাবস্থায় টিকা গ্রহণকারী ও প্রদানকারীর অসচেতনতার কারণে গণটিকার সফলতার বড় অংশই পণ্ড হয়ে যেতে পারে। একইসঙ্গে টিকা কেনা থেকে শুরু করে সংরক্ষণ, পরিবহনসহ যে ধরনের ব্যয় হচ্ছে, তা কিছুটা হলেও বৃথা যেতে পারে।

আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এস এম আলমগীর হোসেন বলেন, সপ্তাহে এক কোটি মানুষকে টিকা দেওয়া হবে। সেখানে জনে জনে জিজ্ঞাসা করা তো সম্ভব হবে না। তবে কারও যদি শারীরিক অবস্থা নিয়ে সন্দেহ থাকে, তাহলে তিনি টিকা নিতে পারবেন কি না, তা যেন কেন্দ্রে এসে জেনে নেন।

টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. ফরিদ হোসেন মিঞা আজকের পত্রিকাকে বলেন, গ্রাম পর্যায়ে যেহেতু টিকাদান শুরু হবে, সেখানে কেউ যাতে করোনায় আক্রান্ত অবস্থায় টিকা না নেন, সে জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু করা হবে। এ জন্য মাইকিং করার পাশাপাশি ও স্বাস্থ্য সহকারীদের জানানোর বিষয়টিও গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত