Ajker Patrika

৫৭% মামলায় খালাস আপিল নেই একটিও

  • পাঁচ বছরে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের করা মোট মামলা ১৩ হাজার ৩৭৬টি।
  • ৭ হাজার ৫২৯টি মাদকসংক্রান্ত মামলার আসামিরা খালাস পেয়েছেন।
  • ২০২৫ সালের প্রথম চার মাসে ৫৯৯টি মামলার সব আসামি খালাস।
শাহরিয়ার হাসান, ঢাকা 
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

সরকার মাদকের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স (শূন্য সহনশীলতা)’ নীতির কথা বললেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। ২০২০ সাল থেকে পাঁচ বছরে নিম্ন আদালতে রায় হওয়া মামলার ৫৭ শতাংশেরই আসামি খালাস পেয়েছেন। এসব মামলার রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে কোনো আপিলও করা হয়নি। এজাহার থেকে সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের গা ছাড়া ভাব থাকায় আসামিরা খালাস পাচ্ছেন বলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অভিযোগ তুলেছেন।

দেশে মাদক মামলার এই চিত্রের মধ্যেই আজ ২৬ জুন পালিত হচ্ছে মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস। যেটি আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবস হিসেবেও পরিচিত।

মামলার সাজা আর আপিল না করার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এজাহার ও তদন্তে দুর্বলতা, সাক্ষী হাজিরে ব্যর্থতা এবং প্রমাণ উপস্থাপনে ঘাটতির কারণেই আসামিরা খালাস পাচ্ছেন। এসব মামলায় অভিযোগ দাঁড় করানো যাচ্ছে না বলেই আপিলও হয় না।’

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, মাদকের মামলার বেশির ভাগের বাদী মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। পুলিশও কিছু মামলা করে। গত পাঁচ বছরে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের করা মোট মামলা ১৩ হাজার ৩৭৬টি। এগুলোর মধ্যে ৭ হাজার ৫২৯টির আসামিরা খালাস পেয়েছেন; যা শতকরা হিসাবে ৫৭ দশমিক ১৬। নিম্ন আদালতে ২০২৫ সালের প্রথম চার মাসে মোট ১ হাজার ৭৩টি মামলার রায় হয়েছে। এর ৫৯৯টি মামলার সব আসামি খালাস পেয়েছেন; যা ৫৬ শতাংশ।

কিন্তু এসব কোনো মামলার রায়ের বিরুদ্ধে কখনো সংশ্লিষ্ট কেউ আপিল করেননি বলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও আদালত-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

একইভাবে পুলিশের করা মামলায়ও সাজার তুলনায় আসামি খালাসের হার বেশি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়। যদিও এজাহারে বলা হচ্ছে, আসামিরা মাদকসহ হাতেনাতে ধরা পড়েছেন। কিন্তু আদালতে গিয়ে সেই অভিযোগ আর টেকেনি।

আসামি খালাস পাওয়া মামলার রায়ে আদালত প্রায়শই পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন—তদন্ত দুর্বল, সাক্ষ্য অসংলগ্ন, জব্দ তালিকায় অস্পষ্টতা রয়েছে।

বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তার বয়ানে অমিল, জবানবন্দি সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ না হওয়া কিংবা মামলার আলামতের সুরক্ষার অভাবের বিষয়ও উল্লেখ করা হয়।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এবং পুলিশের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সময়সীমার মধ্যে অভিযোগপত্র দিতে গিয়ে তাঁরা প্রায়ই এজাহারনির্ভর হয়ে পড়েছেন। এতে থেকে যায় বহু ত্রুটি। ছবি বা ভিডিও সংযুক্ত না করাও একটি বড় সমস্যা। অভিযানে উৎসাহী অনেক কর্মকর্তাই তদন্তে গা ছাড়া ভাব দেখান। ফলে মামলার শক্ত ভিত্তি থাকে না।

খোদ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অভ্যন্তরীণ পর্যালোচনায় প্রতিবছর মামলায় আসামি খালাসের হার বেশি হওয়ার কথা উঠে এসেছে। তবু এই অবস্থার উন্নয়নে কোনো কাঠামোগত পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। চালু হয়নি প্রশিক্ষণ কর্মসূচি। যদিও নাম প্রকাশ না করার শর্তে অধিদপ্তরের এক পদস্থ কর্মকর্তা বলেন, ‘আদালত সব সময় নানা দিক বিবেচনায় রায় দেন। আমাদের পক্ষ থেকে অভিযোগ প্রমাণে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়। নিয়মিত প্রশিক্ষণ এবং দিকনির্দেশনাও দেওয়া হচ্ছে।’

এদিকে, পরিস্থিতি বিবেচনায় পুলিশ সদর দপ্তর মাদক মামলার সাজার হার বাড়াতে উদ্যোগ নিচ্ছে। মহানগরসহ দেশের থানায় থানায় বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হচ্ছে, ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬১ ধারায় সাক্ষীর জবানবন্দি সঠিকভাবে নিতে হবে। জব্দ তালিকায় ছবি-ভিডিও সংযুক্ত করতে এবং সাক্ষীদের যথাযথভাবে প্রস্তুত করে আদালতে পাঠাতে হবে। জব্দ তালিকার সাক্ষীদের জবানবন্দি ১৬১ ধারায় লিপিবদ্ধ করে সঙ্গে সঙ্গে পড়ে শোনাতে হবে। বিচার শুরুর আগে তাঁদের (সাক্ষী) ঘটনাপ্রবাহ ও জব্দ তালিকার বিষয়টি মনে করিয়ে দিতে হবে। সংশোধিত সাক্ষ্য আইনে ছবি ও ভিডিওর প্রমাণ-মূল্য রয়েছে, তাই জব্দের সময় তা ধারণ করে মামলার নথিতে যুক্ত করতে হবে। তদন্ত শেষে ‘চার্ট অব এভিডেন্স’ দাখিল এবং সাক্ষীদের যথাসময়ে আদালতে হাজিরও নিশ্চিত করতে হবে।

জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার মো. সাজ্জাদ আলী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘মাদক মামলায় অনেক সময় সাক্ষী হিসেবে ভাসমান বা অস্থায়ী ব্যক্তিদের রাখা হয়, যাঁদের পরে পাওয়া যায় না। আমরা এসব বিষয় চিহ্নিত করে সংশোধনে কাজ করছি। খালাসের হার ধীরে ধীরে কমছে।’

টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. ওমর ফারুক বলেন, ‘অভিযোগপত্র দেওয়ার আগে অভিজ্ঞ সরকারি কৌঁসুলির আইনি মতামত নেওয়া বাধ্যতামূলক করা উচিত। এতে অভিযোগ প্রমাণে সুবিধা হবে। আর নিয়মিত আপিল না হলে বিচারব্যবস্থায় ভারসাম্য আসে না।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত