Ajker Patrika

লুক্সেমবার্গের শেনজেন গ্রাম

সীমান্তহীন ইউরোপের স্বপ্নের শুরু যেখানে

ফিচার ডেস্ক
আপডেট : ২৯ আগস্ট ২০২৫, ২০: ২৯
ছবি: ভিসিট লুক্সেমবার্গ
ছবি: ভিসিট লুক্সেমবার্গ

অনেকে ‘শেনজেন’ বা ‘সেঙ্গেন’ শব্দটি চেনে ভিসাসংক্রান্ত একটি শব্দ হিসেবে। তা একেবারে ভুল নয়। শেনজেন নামের সেই ভিসা দিয়ে ইউরোপের ২৯টি দেশে অবাধে ভ্রমণ করা যায়। কিন্তু সীমান্তহীন ইউরোপ ভ্রমণে ব্যবহৃত হওয়া এই ভিসার নাম কোথা থেকে এল? সেটাই আসলে গল্প।

লুক্সেমবার্গ নামের একটি দেশের নাম নিশ্চয় শুনেছেন। সেই দেশের এক ছোট্ট গ্রামের নাম শেনজেন। মোজেল নদীর পাড়ের সেই শান্ত গ্রাম একসময় ইতিহাসের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল। এখান থেকেই শুরু হয়েছিল ইউরোপের সীমান্তহীন ভ্রমণের যাত্রা—শেনজেন ভিসার মাধ্যমে।

তিন দেশের মিলনস্থল

মোজেল নদী ইউরোপের বুকে আঁকাবাঁকা পথে বয়ে চলেছে। এর মাঝপথে সেই শেনজেন গ্রামে একসঙ্গে মিলেছে লুক্সেমবার্গ, জার্মানি, ফ্রান্স—এই তিন দেশের সীমান্ত। এই জায়গাকে বলা হয় ‘ট্রাইপয়েন্ট’ বা তিন দেশের মিলনস্থল। এই ভৌগোলিক অবস্থান ঘিরে জন্ম নেয় ইতিহাসের এক বড় অধ্যায়।

শেনজেন চুক্তি

১৯৮৫ সালের জুন মাসে বেলজিয়াম, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি, লুক্সেমবার্গ ও নেদারল্যান্ডস—এই পাঁচ দেশ শেনজেন গ্রামে এক ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষর করে। এর নাম রাখা হয় শেনজেন চুক্তি। এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো ইউরোপে সীমান্তহীন ভ্রমণের স্বপ্ন দেখানো হয়। সে সময়ে এই ধারণা ছিল একেবারেই নতুন এবং প্রায় অবিশ্বাস্য; বিশেষ করে জার্মানি ও ফ্রান্সের মতো দেশগুলোর মধ্যে সীমান্ত তুলে দেওয়া যাবে—এমনটা অনেকের কাছে ছিল স্বপ্নের মতো বিষয়। ইউরোপিয়ান মিউজিয়াম শেনজেনের পরিচালক মার্টিনা ক্নেইপ বলেন, ‘১৯৮৫ সালে খোলা সীমান্ত ছিল একধরনের স্বপ্নের মতো; বিশেষ করে জার্মানি ও ফ্রান্সের মধ্যে সীমান্ত তুলে দেওয়া একেবারেই অকল্পনীয় ছিল।’

আজকের শেনজেন

বর্তমানে ইউরোপের ২৯টি দেশ এই চুক্তির আওতায় রয়েছে। শেনজেন ভিসা হাতে থাকলেই ভ্রমণকারীরা সহজে অর্ধেকের বেশি ইউরোপ ঘুরে আসতে পারে। আর সেই ভিসার নামধারী গ্রামটি আজ এক বিশেষ পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। প্রতিবছর প্রায় ৪০ হাজার দর্শনার্থী যায় গ্রামটি দেখতে।

শেনজেন মিউজিয়াম

পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ হলো শেনজেন মিউজিয়াম। এর সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে ‘কলাম অব নেশনস’ নামের একটি ধাতব ভাস্কর্য। যেখানে প্রতীকীভাবে শেনজেন এলাকার দেশগুলোকে উপস্থাপন করা হয়েছে। এর চারপাশে বাতাসে উড়তে থাকে বিভিন্ন দেশের পতাকা। মিউজিয়ামের ভেতরে রয়েছে অংশগ্রহণমূলক প্রদর্শনী, ঐতিহাসিক ভিডিও ফুটেজ ও নথিপত্র। এক পাশে রাখা আছে বিভিন্ন দেশের সাবেক কাস্টমস কর্মকর্তাদের ৩০টি সার্ভিস ক্যাপ। এগুলো মনে করিয়ে দেয়, সীমান্ত পার হওয়া একসময় কত জটিল আনুষ্ঠানিকতার বিষয় ছিল।

ছবি: ভিসিট লুক্সেমবার্গ
ছবি: ভিসিট লুক্সেমবার্গ

নেই কোনো কাঁটাতারের বেড়া

শেনজেন কেবল ইতিহাসের গল্প নয়, প্রকৃতিপ্রেমী আর ভ্রমণকারীদের জন্যও এক চমৎকার জায়গা। এখানকার অন্যতম আকর্ষণ হলো প্রায় ৭ দশমিক ৭ কিলোমিটারের একটি হাইকিং পথ। এই পথ শুরু হয় মিউজিয়াম থেকে এবং ফ্রান্স ও লুক্সেমবার্গ হয়ে আবার শেনজেনে ফিরে আসে। কোনো বর্ডার চেকপোস্ট নেই, নেই কোনো কাঁটাতারের বেড়া। তবু চোখে ধরা পড়ে ভিন্নতা। ফ্রান্সের দিকে দূরে দেখা যায় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ধোঁয়া, আর জার্মানির দিকে ঘুরতে থাকে উইন্ড টারবাইনের ব্লেড।

ছবি: উইকিপিডিয়া
ছবি: উইকিপিডিয়া

আঙুর আর ওয়াইনের গ্রাম

শেনজেন আসলে আঙুর আর ওয়াইনের গ্রামও। মাত্র ৫৪৮ জন মানুষের বসবাসের এই গ্রামে আছে তিনটি আঙুর খামার। পাহাড়ের ঢালে সারি সারি আঙুরগাছের বাগান সাজানো। সেসব আঙুর থেকে তৈরি হয় স্থানীয় জনপ্রিয় রিভানার সাদা ওয়াইন। এখানকার স্থানীয় ওয়াইন উৎপাদক লুসিয়েন গ্লোডেন চার প্রজন্ম ধরে এই কাজ করে আসছেন। তাঁর আঙুর খামার বিস্তৃত রয়েছে লুক্সেমবার্গ, ফ্রান্স ও জার্মানিতে। তিনি প্রতিবছর প্রায় ৪০ হাজার বোতল ওয়াইন উৎপাদন করেন।

শেনজেন ওয়াইন স্থানীয়দের জন্য প্রতিদিনের পানীয়। দামও খুব বেশি নয়। এখানকার রিভানার ওয়াইন হালকা, মসৃণ এবং সাধারণ খাবারের সঙ্গে মানানসই।

ছবি: ভিসিট লুক্সেমবার্গ
ছবি: ভিসিট লুক্সেমবার্গ

উৎসবের আমন্ত্রণ

প্রতিবছর আগস্টের প্রথম সপ্তাহে শেনজেনে হয় ‘পিনো অ্যান্ড ফ্রিৎসুর’ উৎসব। তখন গ্রামজুড়ে চলে উৎসবের আমেজ। সবার হাতে থাকে পিনো ব্ল্যাঙ্ক ওয়াইন আর টেবিলে পরিবেশন করা হয় মোজেল নদীর মাছ ভাজা।

আমাদের কাছে শেনজেন হয়তো শুধু একটি ভিসা। কিন্তু লুক্সেমবার্গের এই ছোট্ট গ্রাম সীমান্তহীন ইউরোপের প্রতীক। ইতিহাস, প্রকৃতি, আঙুর বাগান আর ওয়াইনের অঞ্চল এই শেনজেন।

সূত্র: ডয়চে ভেলে

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত