Ajker Patrika

ইতিহাসের প্রথম নারী ব্যবসায়ীর খোঁজে

আপডেট : ২৪ মার্চ ২০২২, ১২: ০১
ইতিহাসের প্রথম নারী ব্যবসায়ীর খোঁজে

করোনা-পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক বিশাল পরিবর্তন এসেছে ব্যবসার ক্ষেত্রে। বিশেষ করে নারীদের বড় একটি অংশ ব্যবসায় আগ্রহী হয়ে উঠছেন। ঠিক কবে থেকে নারীদের ব্যবসায় আগমন, ইতিহাসের প্রথম নারী ব্যবসায়ী কে—এসব বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে এসেছে গবেষণায়।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিতে সাংবাদিক ও লেখক সোফি হার্ডচের একটি লেখা সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। সোফি এ নিয়ে পরিচালিত গবেষণার ভিত্তিতে লেখাটি লিখেছেন।

গবেষণায় দেখা গেছে, ইতিহাসের প্রথম নারী ব্যবসায়ী ছিলেন ইরাকের উত্তরাঞ্চলের টাইগ্রিস নদীর তীরে অবস্থিত আসুর শহরের এক নারী, যাঁর নাম ছিল আহাহা। সময়টা খ্রিষ্টপূর্ব ১৮৭০। আহাহা নামের সেই নারী ব্যবসা করতে এসে তাঁর আপন ভাইয়ের কাছে প্রতারণার শিকার হয়েছিলেন।

আহাহা ইরাকের আসুর শহর থেকে তুরস্কের কানেশ শহরে ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছিলেন। এই ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছিলেন আহাহাসহ আরও কয়েকজন। ব্যবসাটি ছিল কাপড় ও টিনের। তখন গাধার পিঠে চড়িয়ে মালামাল এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নেওয়া হতো। তখন ছিল বিনিময় প্রথার যুগ। অর্থাৎ, মুদ্রার বদলে সে যুগে পণ্যের মূল্য হিসেবে অন্য একটি পণ্য বিনিময়ই ছিল দস্তুর। আহাহার ব্যবসাটি ছিল বেশ লাভজনক। কিন্তু আহাহাকে তাঁর প্রাপ্য লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। তাঁর আপন ভাই বুযাযু তাঁর এই ক্ষতিটি করেছিলেন।

অ্যাসেরীয় সভ্যতায় তখন কিউনিফর্ম পদ্ধতিতে লেখা হতো। কাদামাটির স্লেটে কাঠি দিয়ে আহাহা তাঁর সঙ্গে অবিচারের ঘটনাটি তাঁর আরেক ভাই আসুর মুতাপ্পিলের কাছে লিখে জানান। এ জন্য আহাহা তাঁর ভাই মুতাপ্পিলের কাছে সাহায্য চান।

চিঠিতে আহাহা লেখেন, ‘ব্যবসায় বিনিয়োগ করা রৌপ্য আমার শেষ সম্বল। এই রৌপ্য পাওয়া না গেলে আমি নিঃস্ব হয়ে যাব।’ এ বিষয়ে ভাই মুতাপ্পিলকে যথাযথ ও দ্রুত পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ জানান তিনি।

কাদামাটির স্লেট সংবলিত চিঠিআহাহা আশা করেন চিঠির ফলে তিনি তাঁর প্রাপ্য লভ্যাংশ ফিরে পাবেন এবং পরে ব্যবসায়ীদের কাফেলা ফিরে এলে ভাই মুতাপ্পিল এর সমাধান দেবেন। আরেকটি কাদামাটির স্লেটে কাঠি দিয়ে লেখা চিঠিতে আহাহা লেখেন, ‘এখনই সময় আমার সাহায্যে এগিয়ে আসার। আমাকে অর্থনৈতিক দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দেওয়ার।’

২৩ হাজার কাদামাটির স্লেট সংবলিত চিঠির মধ্য থেকে আহাহার ঐতিহাসিক চিঠিটি পাওয়া যায়। এটি প্রমাণ করে আহাহা ছিলেন ইতিহাসের প্রথম নারী ব্যবসায়ী। গত কয়েক দশক ধরে তুরস্কের কানেশ শহরে ব্যবসায়ীদের বাড়ির ধ্বংসাবশেষ খনন করতে করতে এসব কাদামাটির স্লেট সংবলিত চিঠি পাওয়া যায়।

চিঠিগুলোর মাধ্যমে জানা যায়, সে সময় আসুর শহরের যেসব ব্যবসায়ী স্থায়ীভাবে কানেশে বসবাস শুরু করেছিলেন, তাঁরা কানেশ থেকে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। সে সময়ের পরিবহনব্যবস্থায় আসুর থেকে কানেশের দূরত্ব ছিল ছয় সপ্তাহের। সে সময় নারীরা সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতেন। পুরুষদের সঙ্গে সমানতালে কাজ করতেন। ওই সময়েই মূলত ইতিহাসে প্রথম নারী ব্যবসায়ী, নারী ব্যাংকার, নারী বিনিয়োগকারীর আবির্ভাব ঘটে।

কানেশের সেই চিঠির স্তূপগুলো থেকে বিভিন্ন চুক্তি ও আদালতের রায় সম্পর্কেও জানা যায়। খ্রিষ্টপূর্ব ১৯০০-১৮৫০ সময়ে অ্যাসেরীয় সভ্যতায় ব্যবসা ও নতুন নতুন আবিষ্কার বিস্তৃত হয় ও উন্নতি লাভ করে। অ্যাসেরীয়রা ব্যবসা বিনিয়োগের নতুন নতুন পথ উদ্ভাবন করে। সে সময় নারীদের অগ্রযাত্রার একটি চিত্রও চিঠিগুলোর মাধ্যমে ফুটে ওঠে, যেখানে নতুন আবিষ্কার, ব্যবসায় শুধুমাত্র পুরুষই নয়, নারীদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা রয়েছে।

বিভিন্ন নথি থেকে জানা যায়, এসব নারীর স্বামীরা যখন ব্যবসার কাজে বাড়ির বাইরে অবস্থান করতেন, তখন তাঁরা বাড়িতে বসেই ব্যবসার দেখাশোনা করতেন। এভাবে তাঁরা নিজেরা সম্পদশালী হওয়ার পাশাপাশি ব্যক্তিগত জীবনে শক্তিশালী হয়ে ওঠেন।

ফ্রান্সের ন্যাশনাল সেন্টার ফর সায়েন্টিফিক রিসার্চের (সিএনআরএস) জ্যেষ্ঠ গবেষক এবং ‘উইমেন অব আসুর অ্যান্ড কানেশ’ বইয়ের লেখক সিসিল মিশেল জানান, ৩০০টি চিঠি ও অন্যান্য নথি থেকে সেই সময়ের নারীদের জয়যাত্রা ও বর্ণিল সময় সম্পর্কে জানা যায়। এ ছাড়া সেখানে উঠে আসে নারীদের সংগ্রামের বিভিন্ন গল্প। চিঠিগুলো তেমন বড় ছিল না। এগুলো ছিল ছোট ছোট চিঠি, যা হাতের তালুতে রেখেই পড়া যাচ্ছিল। ক্ষুদ্র হলেও এই চিঠির লেখাগুলো থেকে সেই সময়ের অনেক গুরুত্বপূর্ণ গল্প উঠে এসেছে। প্রথম নারী ব্যবসায়ীর গল্পটি পুরো অ্যাসেরীয় ব্যবসায়ী কমিউনিটির গল্পগুলোর সঙ্গে একসঙ্গেই ছিল। চিঠিতে উঠে আসে, অ্যাসেরীয়রা ব্যবসায় অনেক সফল ছিল। তাদের ব্যবসায়ী কাফেলা ৩০০ গাধা নিয়ে পার্বত্য পথে ছুটে চলত। গাধার পিঠে বিভিন্ন পণ্যের কাঁচামাল ও বিলাসবহুল পণ্য বহন করা হতো। এ ছাড়া চিঠিও বহন করা হতো।

অ্যাসেরীয় ব্যবসায়ীরা যে পথ দিয়ে তাঁদের ব্যবসায়িক কাফেলা নিয়ে ছুটে বেড়াতেন, তা ছিল সব দিক থেকেই আন্তর্জাতিক। এই বাণিজ্যপথের কেন্দ্র ছিল এশিয়ার কেন্দ্রে। ধারণা করা হয় প্রাচীন সিল্করুটের অংশ ছিল এটি। আফগানিস্তান থেকে লাপিস-লাজুলি, পাকিস্তান থেকে কার্নেলিয়ান, ইরান পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এটি।

তুরস্কের কানেশ শহরনেদারল্যান্ডসের লিডেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাসেরীয় সভ্যতা বিষয়ক গবেষক জেরিট ডার্কসেন কাজ করছেন কানেশ চিঠি নিয়ে। তাঁর ভাষ্যমতে, বিদেশি ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন টেক্সটাইল পণ্য দক্ষিণ ইরাকের ব্যাবিলোনিয়া থেকে আসুরে নিয়ে আসতেন। অ্যাসেরীয়দের কাছে সেগুলো বিক্রি করা হতো স্বর্ণ ও রৌপ্যের বিনিময়ে।

অ্যাসেরীয় নারীরা কাপড়ের কেনাবেচা ঘরে বসেই পরিচালনা করতেন। তাঁরা নিজে উপার্জনের প্রতি অনেক আগ্রহী ছিলেন। বিদেশের বিভিন্ন নতুন ফ্যাশন-স্টাইল নিয়েও তাঁরা সচেতন ছিলেন। ব্যবসায়ী হিসেবে দক্ষ এসব নারীদের অনেকেই স্বামীর সঙ্গে যৌথভাবে ব্যবসা করতেন।

চিঠি থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরে বিবিসিতে প্রকাশিত লেখায় সোফি হার্ডচ জানান, সে সময় নারীরা তাদের স্বামী ও ভাইদের কোনো কথা বা উপদেশ দিতে কুণ্ঠাবোধ করতেন না। তাঁরা ছিলেন সাহসী ও দক্ষ। অন্য একটি চিঠিতে জানা যায়, এক নারী তাঁর ভাইকে চিঠিতে লিখেছেন, ‘লোভী হয়ো না, আমাকে ধ্বংস করো না।’

পারিবারিক কাঠামোও ছিল অনেকটা উদার। সোফি জানাচ্ছেন, সে সময় আসুর ও কানেশে স্বামী-স্ত্রী যে কেউ চাইলে বিবাহ বিচ্ছেদ করতে পারতেন। তবে একই সময়ে ব্যবিলিয়নার চিত্র ছিল ভিন্ন। সেখানে নারীদের ডিভোর্স দেওয়ার অধিকার ছিল না।

অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হওয়ায় তখনকার নারীদের ব্যক্তিগত জীবন বেশ উন্নত ছিল। সে সময় নারীরা বিয়ের সময় শর্ত জুড়ে দিতেন, পুরুষেরা দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করতে পারবে না এবং ভ্রমণে গেলে স্ত্রীকে অবশ্যই সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, ইরাম-আসুরের মেয়ে সুহকানাকে বিয়ে করেছিলেন আসুর-মালেক। বিয়ের শর্ত ছিল—আসুর-মালিক যেখানেই যাবেন, তাঁকে তাঁর সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে। একই সঙ্গে আসুর-মালেক কনেশের অন্য কোনো নারীকে বিয়ে করতে পারবে না।

কিন্তু সময় সব সময় এক রকম যায় না। আসুর-কানেশের ক্ষেত্রেও যায়নি। সময়ের সঙ্গে কিছু ক্ষেত্রে আসুর-কানেশের ব্যবসায়িক প্রতিপত্তি কিছুটা হ্রাস পেয়েছিল। অন্য শহর তখন বাণিজ্য, সৃজনশীলতা এবং সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের স্থান হিসেবে গড়ে ওঠে।

কিন্তু অ্যাসেরীয় সে সভ্যতায় নারীদের যে অবস্থানের নিদর্শন পাওয়া গেছে, তা ইতিহাসে অনন্য স্থান দখল করেছে। আগুনে ধ্বংস হওয়া পরিত্যক্ত বাড়ি থেকে হাজার বছর পর উদ্ধার হওয়া চিঠিগুলো তখনকার নারীদের অগ্রযাত্রার সাক্ষী দিচ্ছে। এই চিঠি থেকে উঠে আসা নারীদের গল্পগুলো কোনো রানির গল্প ছিল না। বরং এটি ছিল শ্রমজীবী নারীদের গল্প, যাঁরা নিজেদের পরিশ্রম দিয়ে নিজেদের নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়।

মেসোপটেমিয়ার শহরগুলোতেও নারীদের লেখা চিঠি পাওয়া গেছে। তবে সেগুলো সংখ্যায় এত বেশি নয়। সেখানে তেমন তথ্যও পাওয়া যায়নি। কানেশই ব্যতিক্রম।

বিবিসি থেকে অনুবাদ: আমিনুল ইসলাম নাবিল

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

যুবককে আটক করা নিয়ে বিজিবি ও এলাকাবাসীর পাল্টাপাল্টি দাবি

‘তেলের ক্রেতা’ হিসেবে ভারতকে আর পাবে না রাশিয়া, জানালেন ডোনাল্ড ট্রাম্প

শাস্তি পাচ্ছেন বিটিআরসির মহাপরিচালকসহ ৩০ জনের বেশি কর্মকর্তা

বরখাস্ত সৈনিককে অস্ত্র দিয়েছেন বিএনপি নেতা, অডিও নিয়ে তোলপাড়

ভূমি অফিসের কাণ্ড: এসি ল্যান্ড দপ্তরের নামে দেড় কোটি টাকা আদায়

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত