Ajker Patrika

শান্তি ও ন্যায়ের আলোকবর্তিকা মহানবী (সা.)

নাঈমুল হাসান তানযীম 
নবী মুহাম্মদ (সা.)। ছবি: সংগৃহীত
নবী মুহাম্মদ (সা.)। ছবি: সংগৃহীত

আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.)। তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ মানব, সর্বশেষ নবী ও রাসুল। তাঁর পবিত্র জীবনে নবী-রাসুলদের যাবতীয় মহৎ গুণাবলির সমাবেশ ঘটেছিল। তিনি ছিলেন সত্যবাদিতা, আমানতদারিতা, কল্যাণকামিতা ও ন্যায়পরায়ণতার প্রোজ্জ্বল উদাহরণ। ছিলেন ঐশীগ্রন্থ পবিত্র কোরআনের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি যেন। সাহাবায়ে কেরাম উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রা.)-কে রাসুলের চরিত্র সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, ‘পুরো কোরআনই ছিল তাঁর চরিত্র।’ অর্থাৎ তিনি ছিলেন কোরআনে কারিমের বাস্তব নমুনা। (আদাবুল মুফরাদ: ৩০৮)

তিনি এমন এক সময়ে পৃথিবীতে আগমন করেছিলেন যে সময়টা ছিল মানবেতিহাসের সবচেয়ে ঘৃণ্যতম, বর্বরোচিত, কুসংস্কার আর অন্ধকারাচ্ছন্ন। ছিল গোত্রে গোত্রে কৌলীন্য, হানাহানি। তুচ্ছ বিষয়ে রক্তপাত ঘটার মতো ঘটনা ঘটত অহরহ। যুদ্ধ বিগ্রহ লেগেই থাকত সব সময়। তাঁর পবিত্র পরশে সে সমাজ ও সমাজের মানুষেরা আমূল পাল্টে গেছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কল্যাণ ও ন্যায় ইনসাফভিত্তিক আদর্শিক সমাজ। তাঁর আদর্শের কথা তো স্বয়ং আল্লাহ তাআলা বলে দিলেন এভাবে, ‘নিশ্চয়ই আপনি সচ্চরিত্রের মহান আদর্শের ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত।’ (সুরা কলম: ৪)

রাসুল (সা.)-কে শান্তি ও কল্যাণের জন্য বিশ্ববাসীর রহমত আখ্যায়িত করে কোরআনে কারিমে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি আপনাকে বিশ্বজগতের প্রতি রহমতরূপেই প্রেরণ করেছি।’ (সুরা আম্বিয়া: ১০৭)

আদর্শ সমাজ গঠন ও বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য রাসুল (সা.)-এর আদর্শ সর্বকালের সবার জন্য অনুকরণীয়। তিনি যে পদ্ধতি অবলম্বন করে একটি ভঙ্গুর সমাজব্যবস্থার সংস্কার করেছিলেন, সবদিক দিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন উন্নতি অগ্রগতির শীর্ষ চূড়ায়—আজকের এই অস্থিতিশীল সমাজও চাইলে সেই পথ-পদ্ধতি অনুকরণের মাধ্যমে পৌঁছাতে পারে তেমন উচ্চতায়। রাসুল (সা.) আদর্শ সমাজ গঠনে যেভাবে ভূমিকা রেখেছিলেন, যে পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করেছিলেন তার কিঞ্চিৎ আলোচনা তুলে ধরা হলো:

হিলফুল ফুজুলে যোগদান

রাসুল (সা.) নবুওয়াত লাভের আগ থেকেই ছিলেন সকলের বিশ্বস্ত, আস্থাভাজন। মানুষেরা তাঁকে ভালোবেসে দিয়েছিল ‘আল-আমিন’ উপাধি। সমাজে তখন জুলুম, অনাচার, পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধ বিগ্রহ, হিংসা কোন্দল লেগেই থাকত। সমাজের এহেন দুরবস্থা তাঁর কিশোর মনকে আহত করে। সে সময় তিনি যোগদান করলেন ‘হিলফুল ফুজুল’ নামের শান্তিসংঘে। পরিপূর্ণ দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে চুক্তিবদ্ধ হন অন্য সবার সঙ্গে। নবুওয়াত-পরবর্তী জীবনে এই চুক্তির কথা স্মরণ করে তিনি বলতেন, ‘এই চুক্তির বিনিময়ে কেউ যদি আমাকে লাল রঙের উট দিতে সম্মত হতো, তবু আমি চুক্তি পরিহার করতাম না।’ (মুসনাদ আহমাদ: ১৬৫৫)

নবুওয়াত-পরবর্তী সময়ে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তিনি বিভিন্ন পদ্ধতি ও কর্মপন্থা অবলম্বন করেছিলেন। তার মধ্য থেকে কয়েকটি এই:

একাত্মবাদের দিকে আহ্বান

মানুষের একমাত্র সফলতা আল্লাহ ও রাসুলকে মনেপ্রাণে মানা এবং বিশ্বাস করার মধ্যেই নিহিত। তাই তিনি মানুষকে আহ্বান করলেন, ‘হে লোকসকল, তোমরা বলো, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই তাহলে সফলকাম হবে।’ (মাজমাউজ জাওয়ায়েদ: ৬ / ২৪)। রাসুলের এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে যারা ইমান এনেছিল তাঁরা সফলকাম হয়েছিল। যারা আনেনি তারা হয়েছে বিফল।

নারীর যথাযথ মর্যাদা দান

জাহেলিয়াতের সে যুগে নারীরা ছিল অবহেলিত, নিগৃহীত, কেবলই ভোগ্যপণ্য। তাদের ছিল না বিন্দুমাত্র মর্যাদা, সম্মান। রাসুল (সা.) ফিরিয়ে দিলেন তাদের প্রাপ্য অধিকার ও মর্যাদা। ঘোষণা করলেন, ‘যে ব্যক্তিকে কন্যাসন্তান লালন-পালনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এবং সে ধৈর্যের সঙ্গে তা সম্পাদন করেছে, সেই কন্যাসন্তান তার জন্য জাহান্নামে যাওয়া থেকে প্রতিবন্ধক হবে।’ (জামে তিরমিজি: ১৯১৩)

দাসদাসীর সঙ্গে সদাচরণ

তৎকালীন সমাজে গোলাম বাদীর প্রচলন ছিল। মনিবেরা তাদের সঙ্গে যাচ্ছেতাই আচরণ করত। কেমন যেন মানুষই ভাবত না। রাসুল (সা.) তাদের এই অমানবিক আচরণ থেকে বারণ করলেন। তাদের মৌলিক অধিকার প্রদানে নির্দেশ দিলেন—‘তারা তোমাদের ভাই, আল্লাহ তাদের তোমাদের অধীন করেছেন। সুতরাং যার অধীনে তার ভাই রয়েছে তার উচিত সে নিজে যা খায় তাকেও তা-ই খেতে দেওয়া, নিজে যা পরিধান করে তাকেও তা-ই পরতে দেওয়া এবং তার অসাধ্য কোনো কাজ তার ওপর না চাপানো। আর যদি এমন কোনো কষ্টসাধ্য কাজের ভার তাকে দেওয়া হয় তাহলে সে যেন তাকে সাহায্য করে।’ (সুনানে আবু দাউদ: ৫১৫৮)

মদ জুয়া নিষিদ্ধকরণ

তখনকার সময়ে মদপান ছিল সকলের প্রিয় পানীয়। পারতপক্ষে অতি সামান্য উপকার ছাড়া মদপানে ক্ষতিই বেশি। কারণ, মানুষ যখন নেশাগ্রস্ত হয় তখন অজান্তে অনেক কিছু ঘটিয়ে ফেলে। আল্লাহ তাআলা রাসুলের ওপর বিধান নাজিল করলেন, ‘তারা আপনাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বলুন, উভয়ের মধ্যে আছে মহাপাপ ও মানুষের জন্য উপকার। কিন্তু তাদের পাপ উপকার অপেক্ষা বেশি।’ (সুরা বাকারা: ২১৯)

তেমনিভাবে জুয়া থেকেও নিষেধ করেন। কারণ, তা অনিশ্চয়তা, লোভ এবং অনৈক্য সৃষ্টির মাধ্যম।

জাকাতের বিধান প্রবর্তন

দারিদ্র্য বিমোচন এবং অর্থনৈতিক দৈন্যদশা দূর করে সমাজের সাধারণ অসহায় দুস্থ মানুষদের দিকে তাকিয়ে রাসুলের ওপর আল্লাহ তাআলা অবতীর্ণ করলেন জাকাতের বিধান। কোরআনের ভাষ্য, ‘তোমরা নামাজ কায়েম করো এবং জাকাত দাও’ (সুরা বাকারা: ৪৩)

পরস্পরের ভেতর শান্তি চুক্তি

ইসলামের অমিয় বাণী বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়তে থাকল। মানুষ ইসলামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে দলে দলে আশ্রয় নিচ্ছিল শাশ্বত এ দ্বীনের ছায়াতলে। সেই সঙ্গে বাড়ছিল ইসলামের শত্রু কাফের মুশরিকদের সংখ্যা। তারা ইসলামের নাম-নিশানাকে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে নানা ষড়যন্ত্র আঁটছিল। রাসুল (সা.) অত্যন্ত সুকৌশলে তাদের দমন করেছেন। প্রথমে শান্তির প্রস্তাব পেশ করেছেন, তা মেনে নিলে তাদের সঙ্গে আর কোনো যুদ্ধ, বিশৃঙ্খলা হতো না। আর যারা অমান্য করত, পেশিশক্তির দাপট দেখিয়ে যুদ্ধকেই বেছে নিত তাদের সঙ্গে একমাত্র ফয়সালা হতো তলোয়ারই। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সন্ধিচুক্তির মাধ্যমে সমাধান হয়ে যেত।

মদিনা সনদ

মদিনায় হিজরতের পর রাসুল (সা.) জাতীয় নিরাপত্তা এবং পারস্পরিক সহাবস্থান নিশ্চিত করতে প্রবর্তন করলেন ‘মদিনা সনদ’। সেসময় যেহেতু একই সমাজে মুসলিম এবং কাফের মুশরিকেরা বসবাস করত তাই উভয় পক্ষের মধ্যেই শান্তি এবং সন্ধিচুক্তি থাকত। কেউ কারও ক্ষতি করার চেষ্টা করত না। যারা এরূপ করত তাদের পরিণাম হতো খারাপ। আল্লাহ তাআলা কোরআনে কারিমে উল্লেখ করেছেন, ‘দ্বীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদের স্বদেশ থেকে বহিষ্কার করেনি, তাদের সঙ্গে মহানুভবতা প্রদর্শন ও ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদের নিষেধ করেন না। আল্লাহ ন্যায়পরায়ণদের ভালোবাসেন।’ (সুরা মুমতাহিনা: ৮)

সবিশেষ ইসলামের সত্য বাণী দ্রুতই পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। সত্যান্বেষী মানুষেরা দলে দলে আশ্রয় নিতে থাকে ইসলামের পতাকাতলে। অন্ধকার বিদূরিত হয়ে জ্বলে ওঠে সত্যের আলো। সমাজ থেকে দূর হয়ে যায় যাবতীয় পাপ, অন্যায় আর অসাধুতা। রাসুলের সংস্পর্শ লাভে একসময়ের পাষণ্ড, নির্দয় মানুষগুলোও পরিণত হয় সোনার মানুষে।

ইসলামের এই অগ্রযাত্রা কেবল সম্ভব হয়েছে রাসুল (সা.)-এর সদাচরণ, মানবিকতা আর ইনসাফি মনোভাবের ফলেই। এমনকি অমুসলিম দার্শনিকেরাও তা অকপটে স্বীকার করেছেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত