Ajker Patrika

নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মরিয়া ট্রাম্প, বাদ রাখছেন না কোনো চেষ্টাই

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২৬ আগস্ট ২০২৫, ১৮: ১০
নোবেল শান্তি পুরস্কার পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: সংগৃহীত
নোবেল শান্তি পুরস্কার পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: সংগৃহীত

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বহুদিন ধরেই নোবেল শান্তি পুরস্কারের বিষয়ে নিজের আগ্রহ প্রকাশ করে আসছেন। তাঁর ধারণা, এই পুরস্কারের মর্যাদা তাঁকে বিশ্বমঞ্চে এক বিশেষ ও নির্বাচিত ক্লাবের সদস্য করবে। তবে মার্কিন ট্রাম্পের নোবেল জয়, কোনো নির্বাচনের ওপর নয়, নির্ভর করে মাত্র পাঁচজন ব্যক্তির সিদ্ধান্তের ওপর। আর এই ব্যক্তিদের বাছাইয়ে ট্রাম্প সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবেন কি না, তা অনিশ্চিত।

ট্রাম্প তাঁর আগের মেয়াদেও নোবেল পাওয়ার আকুলতা প্রকাশ করেছেন। এই মেয়াদেও তাঁর সেই ধারা অব্যাহত। সাম্প্রতিক সময়ে সেই প্রচেষ্টা আরও তীব্র হয়েছে। তিনি প্রকাশ্যে বলেছেন, ইউক্রেন শান্তিচুক্তি হতে পারে পুরস্কার জয়ের চাবিকাঠি। কিন্তু নোবেল শান্তি পুরস্কার মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে যারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তাদের মধ্যে অন্তত তিনজন প্রকাশ্যে ট্রাম্পের সমালোচনা করেছেন। ফলে তাঁদের সমর্থন পাওয়া সহজ নয়।

নোবেল পাওয়ার প্রচেষ্টায় ট্রাম্প বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতাদের সমর্থন কুড়ানোর চেষ্টা করছেন। এমনকি নরওয়ের অর্থমন্ত্রী ও সাবেক ন্যাটো মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গের সঙ্গেও ব্যক্তিগতভাবে তিনি এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন। স্টলটেনবার্গ ন্যাটো মহাসচিব হিসেবে ট্রাম্পের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। নরওয়েতে ক্ষমতাসীন স্টলটেনবার্গের দল লেবার পার্টির হাতেই নোবেল কমিটিতে সদস্য নিয়োগের ক্ষমতা। ট্রাম্প দাবি করেছেন, তিনি একাধিক সংঘাতের অবসান ঘটিয়েছেন। গত সপ্তাহে তাঁর তালিকায় ছিল ছয়টি যুদ্ধ। তবে শুক্রবার তিনি বললেন, ‘যদি আপনি যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই সেটিকে থামিয়ে দেওয়ার কথা বিবেচনা করেন, তাহলে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ১০ এ।’

তবে ট্রাম্প এটিও স্বীকার করেছেন যে, নোবেল পাওয়ার সম্ভাবনা হয়তো ক্ষীণ। তিনি বলেন, ‘অনেকেই বলে, আমি যা-ই করি না কেন, ওরা আমাকে এটা দেবে না। আমি নিজে এর জন্য রাজনীতি করছি না। তবে অনেকেই করছে। এটা অবশ্যই এক বিশাল সম্মান হবে।’

নোবেল শান্তি পুরস্কারের প্রতি এই আগ্রহই সম্ভবত ট্রাম্পকে ইউক্রেন যুদ্ধ মীমাংসার প্রচেষ্টায় ধরে রেখেছে। বিশেষ করে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সরাসরি আলোচনায় মনোযোগী হচ্ছেন তিনি। কিছু পশ্চিমা কূটনীতিকও মনে করেন, যেহেতু পুতিনের একক নিয়ন্ত্রণেই যুদ্ধ চলছে, তাই সরাসরি আলোচনা বাস্তবসম্মত হতে পারে।

কিন্তু তাঁকে এখনো সংশয়ী কমিটির সদস্যদের মন জয় করতে হবে। কমিটির চেয়ারম্যান ইয়র্গেন ভাটনে ফ্রিডনেস গত ডিসেম্বরে বলেন, ‘গণতান্ত্রিক দেশগুলোতেও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষয় হচ্ছে।’ সেসময় তিনি ট্রাম্পের নাম সরাসরি উল্লেখ করেছিলেন। ফ্রিডনেস বলেন, ‘নির্বাচনী প্রচারণায় ট্রাম্প গণমাধ্যমের ওপর ১০০ বারেরও বেশি মৌখিক হামলা চালিয়েছেন।’ ৪০ বছর বয়সী ফ্রিডনেস পেন নরওয়ের প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। এই সংস্থাটি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা নিয়ে কাজ করে। তিনি লেবার পার্টির মনোনীত সদস্য।

নরওয়ের সাধারণ জনগণের মনোভাবও ট্রাম্প বিরোধী। গত অক্টোবরের এক জরিপে দেখা যায়, বিগত মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের বিপরীতে মাত্র ৭ শতাংশ মানুষ ট্রাম্পকে ভোট দিতেন। নোবেল কমিটির কয়েকজন সদস্যও একই রকম সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

কমিটির আরেক সদস্য ও নরওয়ের সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ক্রিস্টিন ক্লেমেট মে মাসে লিখেছিলেন, ‘মাত্র ১০০ দিনের মাথায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প আমেরিকান গণতন্ত্র ভেঙে ফেলতে শুরু করেছেন। তিনি উদারনৈতিক ও নিয়মভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থা ভেঙে দিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন।’

কমিটির তৃতীয় এক সদস্য ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদেই বহুবার সমালোচনামূলক মন্তব্য করেছিলেন তাঁর বিরুদ্ধে। ২০২০ সালের নির্বাচনের আগের দিন ফেসবুকে পোস্ট করা এক ছবিতে দেখা যায় কমিটির সদস্য গ্রি লারসেন লাল রঙের একটি ক্যাপ পরেছেন, যেখানে লেখা ছিল, ‘মেক হিউম্যান রাইটস গ্রেট অ্যাগেইন।’ ২০১৭ সালে তিনি এক টুইট বার্তায় লিখেছিলেন, ‘ট্রাম্প লাখো মানুষের জীবন ঝুঁকির মুখে ফেলছেন।’ তখন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সাহায্য কমানোর সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছিলেন তিনি।

অবশ্য কমিটির অন্য দুই সদস্যের ট্রাম্প বিরোধী মন্তব্যের স্পষ্ট ইতিহাস নেই। তাঁদের একজন, শিক্ষাবিদ অসলে তোইয়ে। তিনি বাইডেন প্রশাসনের সময় ট্রাম্পের আইনি সংকট নিয়ে সহানুভূতিশীল লেখা লিখেছিলেন। কমিটির কোনো সদস্যই সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেননি। নোবেল ইনস্টিটিউটও এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ট্রাম্পের নোবেল আকাঙ্ক্ষা প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে, চেয়ারম্যান ফ্রিডনেস সরাসরি উত্তর দেননি।

ফ্রিডনেস বলেন, ‘নোবেল শান্তি পুরস্কার কোনো রাষ্ট্রপ্রধানকে দেওয়া হলে তা অনেক সময়েই বিতর্ক তৈরি করে। কারণ, রাষ্ট্রপ্রধান হলে ক্ষমতা থাকে। সেই ক্ষমতা ব্যবহারও করা হয়। যদি কোনো সংঘাত থাকে, তবে প্রায়ই তাঁর হাতে রক্তও লেগে যায়। আবার সেই ক্ষমতা ব্যবহার করে তিনি পরবর্তী সময়ে অনেক কিছু করতে পারেন। ফলে বিষয়টা জটিল হয়ে ওঠে।’

তবে নরওয়ের নোবেল শান্তি পুরস্কার মনোনয়ন কমিটির পাঁচজনের সিদ্ধান্ত যাই হোক না কেন, হোয়াইট হাউসে সফররত অনেক বিশ্বনেতার কাছে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে প্রশংসা করা এবং তাঁকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের যোগ্য বলে ঘোষণা করাটা যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ট্রাম্পের জন্য মনোনয়নপত্র জমা দেন। আবার অনেকে সমালোচনা করেছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার। তিনি ২০০৯ সালে মাত্র কয়েক মাস ক্ষমতায় আসার পরই নোবেল পান। ওবামা নিজেও স্বীকার করেছিলেন, এ সিদ্ধান্ত নিয়ে ‘বেশ বিতর্ক’ হয়েছিল।

ট্রাম্পের নোবেল পাওয়ার পক্ষে উকালতি করে আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ বলেন, ‘যদি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নোবেল শান্তি পুরস্কার না পান, তবে কে পাওয়ার যোগ্য?’ কিছুদিন আগে হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকের সময় এ মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘আমি নোবেল কমিটির ইতিহাসে কিছু অদ্ভুত সিদ্ধান্তের কথা তুলতে চাই না, যেখানে পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল এমন কাউকে, যিনি কিছুই করেননি।’

আলিয়েভের প্রতিপক্ষ, আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনিয়ানও একই কথা বলেন। তিনি ট্রাম্পকে বলেন, ‘আশা করি আপনি আমাদের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে ডাকবেন।’ হাসতে হাসতে ট্রাম্প উত্তর দেন, ‘সামনের সারিতেই থাকবেন। আপনাদের সামনের সারির আসন।’

তবে ট্রাম্পের এই প্রচারণা কেবল হাসি–তামাশায় শেষ হয়নি। গত মাসে তিনি ন্যাটোর মহাসচিব স্টলটেনবার্গের কাছে ফোনে বিষয়টি তুলেছিলেন। আলোচনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ এক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। পরে এক বিবৃতিতে স্টলটেনবার্গ বলেন, ‘আমরা শুল্ক, অর্থনৈতিক সহযোগিতা নিয়ে কথা বলেছি। এটি ছিল নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী জোনাস গার স্টোরের সঙ্গে তাঁর ফোনালাপের প্রস্তুতির অংশ।’ তবে তিনি বিস্তারিত তথ্য দেননি।

নরওয়ের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে স্টলটেনবার্গ নোবেল শান্তি পুরস্কার কমিটির সদস্য নিয়োগে ভূমিকা রেখেছিলেন। তবে একবার নরওয়েজিয়ান সংসদ কমিটিকে নিয়োগ দিলে এর সদস্যরা তাদের কাজের স্বাধীনতাকে কঠোরভাবে রক্ষা করে। তাই এমন চাপ প্রয়োগ তাঁরা ভালো চোখে নাও দেখতে পারেন।

এই বিষয়ে পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট অসলোর পরিচালক নিনা গ্রেগার বলেন, ‘কোনো প্রার্থী এভাবে সরাসরি কথা বলেন, এটা খুব অস্বাভাবিক।’ নিনার প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক শান্তি প্রচেষ্টা নিয়ে গবেষণা করে এবং প্রতিবছর সম্ভাব্য পুরস্কারপ্রাপকদের একটি তালিকা প্রকাশ করে।

ট্রাম্প নোবেল পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে যাদের সমালোচনা করেছেন, তাঁদের মধ্যে সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারও রয়েছেন। তিনি ২০০২ সালে শান্তি পুরস্কার পান। নোবেল জয়ীদের তালিকায় আরও আছেন উড্রো উইলসন ও থিওডোর রুজভেল্ট। সাবেক মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারও এই পুরস্কার পেয়েছেন। তবে কেউই বিতর্ক এড়াতে পারেননি।

চলতি বছর ট্রাম্প যে শান্তি পুরস্কার পাচ্ছেন না, তা প্রায় নিশ্চিত। কারণ মনোনয়নের শেষ তারিখ ছিল জানুয়ারিতে। ২০২৫ সালের শর্টলিস্টে আছেন কাতারের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন আবদুর রহমান আল থানি (গাজায় শান্তি মধ্যস্থতায় ভূমিকার জন্য), জিমি কার্টার প্রতিষ্ঠিত কার্টার সেন্টার এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)। ট্রাম্প নিজে এই আদালতের কর্মকর্তাদের টার্গেট করেছিলেন, কারণ তারা মার্কিন ও ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের তদন্ত করছিলেন।

তবে হয়তো আগামী বছর সুযোগ থাকতে পারে। কিছু নরওয়েজিয়ান এখনো ইউক্রেনে শান্তির দরজা খোলা রাখার চেষ্টা করছেন। নিনা গ্রেগার বলেন, ‘ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করতে ইউরোপীয় নেতাদের একত্রিত করার যে উদ্যোগটি এই সপ্তাহে হয়েছে, তার জন্য আমি ট্রাম্পকে কৃতিত্ব দিই।’ তিনি আরও বলেন, ‘এটা খুব অপ্রচলিত এক উপায়ে শান্তিচুক্তি আনার চেষ্টা। নিয়ম মেনে নয়। কখনো কখনো তা কাজে লাগতে পারে। আমি সেটার কৃতিত্ব তাঁকে দিতে চাই।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত