Ajker Patrika

প্রতিবেশীদের বিক্ষোভের ঢেউ কি ভারতে আছড়ে পড়বে, ছক কষছে বিরোধীরা

কলকাতা প্রতিনিধি  
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ছবি: পিটিআই
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ছবি: পিটিআই

দক্ষিণ এশিয়ার সাম্প্রতিক ইতিহাস সাক্ষী, জনগণের ক্ষোভ যখন রাস্তায় নেমে আসে, তখন ক্ষমতার আসন কেঁপে ওঠে। বাংলাদেশে দীর্ঘ আন্দোলনের ঢেউ সরকারকে চ্যালেঞ্জ করেছে, নেপালে জনতার বিক্ষোভে রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রকট হয়েছে, শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক ধসের মুখে রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। এবার সেই জন-অসন্তোষের ছায়া ভারতীয় ভূখণ্ডেও ঘনীভূত হচ্ছে।

ভিন্ন ভিন্ন রাজ্যে নানা ইস্যুকে কেন্দ্র করে যে আন্দোলন ও বিক্ষোভ দেখা দিচ্ছে, তা বিরোধীদের নতুন করে শক্তি জোগাচ্ছে, আবার সাধারণ মানুষের ক্ষোভকেও সংগঠিত করছে। সব মিলিয়ে স্পষ্ট, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরকারের সামনে চাপ ক্রমশ বেড়েই চলেছে।

সবচেয়ে বড় সংকট হিসেবে উঠে এসেছে মণিপুর। গত দুই বছরের সহিংসতা প্রাণ কেড়ে নিয়েছে আড়াই শতাধিক মানুষের, বাস্তুচ্যুত হয়েছে ৬০ হাজারের বেশি নাগরিক। দীর্ঘ অচলাবস্থা কাটাতে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে চলছে রাষ্ট্রপতির শাসন। এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধীরা। তাঁদের দাবি, সমস্যার নিরপেক্ষ সমাধানে ব্যর্থতা শুধু মণিপুর নয়, গোটা দেশের ঐক্যকেই বিপন্ন করছে। সংসদে দাঁড়িয়ে রাহুল গান্ধী অভিযোগ করেছেন, মোদি সরকার মানবিক সংকটে পাশে না দাঁড়িয়ে কেবল ভোটব্যাংক খুঁজছে। প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর কথায়, যদি একজন প্রধানমন্ত্রীও মানুষের চোখের পানি মুছতে না পারেন, তবে সেই সরকার জনগণের নয়, বরং দলের। কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে সরাসরি কেন্দ্রকে আক্রমণ করে বলেন, উন্নয়নের নামে বড় বড় প্রকল্পের উদ্বোধন সম্ভব হলেও রক্তাক্ত মণিপুরবাসীর জন্য সরকারের সহানুভূতি নেই।

বিজেপিবিরোধী নেত্রীদের কণ্ঠেও শোনা যাচ্ছে একই সুর। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগ করেছেন, উত্তর-পূর্ব থেকে শুরু করে বিহার পর্যন্ত বিজেপি গণতন্ত্রের কণ্ঠ রোধ করছে। তাঁর বক্তব্য, ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে বাংলাভাষীদের বাংলাদেশি বলে হেনস্তা করা হচ্ছে, যা সংবিধানের চরম লঙ্ঘন। এর মধ্যে বিশেষ ভোটার তালিকা সংশোধনী প্রক্রিয়া বা এসআইআর নিয়ে নতুন করে উত্তাল হয়েছে দেশ। বিরোধীরা দাবি করছেন, এটি আসলে ভোট চুরির বৈধ পথ। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী সাফ জানিয়েছেন, এটি গণতন্ত্রের জন্য হুমকি এবং প্রতিটি আসনে লড়াই হবে। সর্বভারতীয় মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিনের (এআইএমআইএম) নেতা আসাদউদ্দিন ওয়েইসিও আক্রমণাত্মক মন্তব্য করে বলেছেন, এই সরকার পরিকল্পিতভাবে মুসলমান, দলিত, উত্তর-পূর্বের মানুষ ও বাংলাভাষীদের হেনস্তা করছে। আজ প্রতিবাদ না করলে আগামী দিনে কেউ নিরাপদ থাকবে না।

দক্ষিণ ভারতের রাজনৈতিক আবহাওয়াও বিজেপির জন্য অস্বস্তিকর। জনপ্রিয় অভিনেতা ও নবগঠিত দল টিভিকের (তামিলাগা ভেটরি কাজাগম) নেতা থালাপতি বিজয় প্রকাশ্যে বলেছেন, চোল ঐতিহ্যের নামে নাটক মঞ্চস্থ করে বিজেপি ভোট চাচ্ছে। কিজহাদি খননকে উপেক্ষা করে ইতিহাস গোপন করার অভিযোগও তোলেন তিনি। তাঁর দলের স্পষ্ট ঘোষণা, বিজেপির সঙ্গে কোনো সমঝোতা সম্ভব নয়। কারণ, বিজেপি বিভাজনের রাজনীতি করে, যা দক্ষিণ ভারতের চেতনার পরিপন্থী। প্রসঙ্গত, তামিলনাড়ুর ইতিহাসে কিজহাদি খনন খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ।

২০২৬ সালের তামিলনাড়ু বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে সম্প্রতি মাদুরাইয়ের পারাপাথিতে নিজ দলের দ্বিতীয় রাজ্য সম্মেলনে বক্তব্য দেন অভিনেতা বিজয়। এ সময় তিনি কিছু রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও প্রতীকী বার্তা দেন। বিজয় বলেন, ‘আমাদের একমাত্র আদর্শগত শত্রু হলো বিজেপি। আর আমাদের রাজনৈতিক শত্রু হলো ডিএমকে (দ্রাবিড় মুনেত্র কাজাগাম)। টিভিকে এমন কোনো দল নয়, যারা কাউকে ভয় পায় বা কোনো আন্ডারগ্রাউন্ড মাফিয়া ব্যবসা চালায়। পুরো তামিলনাড়ুর শক্তি আমাদের সঙ্গে আছে। চলুন, আমরা ফ্যাসিবাদী বিজেপি ও বিষাক্ত ডিএমকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করি।’

এদিকে বিরোধী ইন্ডিয়া জোট বিভিন্ন ইস্যুকে কেন্দ্র করে রাস্তায় নেমেছে। সংসদের ভেতরে-বাইরে সমবেত কণ্ঠে মোদি সরকারকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করছে। গ্রামগঞ্জে সভা থেকে শুরু করে শহরের পথে পথে মিছিলের ডাক দিচ্ছে। অন্যদিকে সুপ্রিম কোর্টও বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রায়ে কেন্দ্রকে চাপে ফেলেছেন। বিশেষ করে, বিহারের স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন (এসআইআর) প্রসঙ্গে আদালত স্পষ্ট জানিয়েছেন, যথাযথ সুযোগ না দিয়ে নাগরিকের নাম বাদ দেওয়া যাবে না। বিরোধীরা এটিকে নিজেদের জয়ের হাতিয়ার হিসেবে দেখছে। একই সঙ্গে ওয়াক্ফ আইন নিয়ে আদালতের কঠোর মন্তব্য বিজেপির ওপর নতুন চাপ তৈরি করেছে।

আসামে এখনো জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) ও নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) নিয়ে অস্থিরতা বিদ্যমান। বিশেষত বাংলাভাষী মানুষের মধ্যে ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা তীব্র। তাদের আশঙ্কা, নাগরিকত্বের প্রশ্নে আবারও বঞ্চিত হতে হবে। ছাত্রসংগঠন, মানবাধিকারকর্মী, সাধারণ মানুষ বারবার রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানাচ্ছে।

সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে এটা স্পষ্ট হয়, দেশের উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম সর্বত্র ক্ষোভের স্রোত জমা হচ্ছে। মানুষ যেমন কর্মসংস্থানের অভাব, অর্থনৈতিক সংকট ও মূল্যবৃদ্ধিতে ক্লান্ত, তেমনই মণিপুরের সহিংসতা কিংবা ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ পড়ার আশঙ্কায় ক্ষুব্ধ। বিরোধীরা এই ক্ষোভকে রাজনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করছে। রাহুল গান্ধী, প্রিয়াঙ্কা, খাড়গে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, ওয়েইসি কিংবা দক্ষিণ ভারতের নতুন প্রজন্মের নেতারা সবাই মিলে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে যে চিত্র তুলে ধরছেন, তাতে বোঝা যাচ্ছে—ভারতও আর দক্ষিণ এশিয়ার বিক্ষোভ তরঙ্গ থেকে মুক্ত নয়।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ৭৫তম জন্মদিনের প্রাক্কালে একাধিক উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন করে শান্তি বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, উন্নয়নই সব সমস্যার সমাধান। তবে বিরোধীরা বলছেন, বাস্তবে এই সরকার চাপে। দেশের নানা প্রান্তে বিক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়ছে। মানুষ রাস্তায় নামছে, সংবিধানের অধিকারের প্রশ্নে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। তাই মোদি সরকারের সামনে সতর্কবার্তা স্পষ্ট—গণ-অসন্তোষকে উপেক্ষা করলে আগামী দিনে এর প্রতিফলন দেখা যাবে ভোটের বাক্সে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত