Ajker Patrika

মার্কিন সহায়তা বন্ধে বিপর্যয়ের মুখে বাংলাদেশের যক্ষ্মা চিকিৎসা ব্যবস্থা

এএফপি, ঢাকা
আপডেট : ০৬ মে ২০২৫, ১৮: ৪৪
ছবি: এএফপি
ছবি: এএফপি

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন হঠাৎ করে ৪৮ মিলিয়ন ডলারের সহায়তা বন্ধ করায় সংকটে পড়েছে বাংলাদেশে যক্ষ্মা প্রতিরোধ কর্মসূচি। স্বাস্থ্যকর্মীরা সতর্ক করে বলেছেন, এতে বহু বছরের পরিশ্রম জলে যেতে পারে এবং বহু প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যু বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

বিদেশি সহায়তায় পরিচালিত চিকিৎসা প্রকল্পের মাধ্যমে জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসা পেয়েছেন এমন একজন শ্রমিক মোহাম্মাদ পারভেজ। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে বার্তা সংস্থা এএফপিকে তিনি বলেন, ‘এক ধরনের জটিল যক্ষ্মায় আক্রান্ত আমি। চিকিৎসকেরা বলেছেন, দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিতে হবে আমাকে।’

চিকিৎসকেরা জানান, এই রোগের চিকিৎসা বেশ জটিল এবং দীর্ঘমেয়াদি। পুরোপুরি সুস্থ হতে রোগীকে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চিকিৎসা নিতে হয়। মার্কিন সহায়তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই চিকিৎসার ভবিষ্যৎ এখন চরম অনিশ্চয়তায়।

এত দিন ইউএসএআইডির অর্থায়নে পরিচালিত হয়ে আসা রাজধানীর একমাত্র বিশেষায়িত যক্ষ্মা হাসপাতালের উপপরিচালক আয়েশা আখতার বলেন, ‘বাংলাদেশ বিশ্বের সাতটি সর্বোচ্চ যক্ষ্মাপ্রবণ দেশের একটি এবং আমাদের লক্ষ্য ২০৩৫ সালের মধ্যে এটি নির্মূল করা। সেই লক্ষ্যে আমরা একটি শক্তিশালী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছিলাম, যা যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডি-এর সহায়তায় পরিচালিত হচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই ইউএসএআইডি তাদের সহায়তা প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে ২০৩৫ সালের মধ্যে যক্ষ্মা নির্মূলের যে লক্ষ্য আমরা হাতে নিয়েছিলাম তা বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়ল।’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০১০ সালে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় ৮১ হাজার মানুষের। ২০২৩ সালে যা নেমে আসে ৪৪ হাজারে। ১৭ কোটির বেশি জনসংখ্যার দেশে এটিকে বেশ বড় অগ্রগতি বলেই অভিহিত করছেন চিকিৎসকেরা। মূলত ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে ছড়ায় এই রোগ। যথাযথ চিকিৎসা পেলে এই রোগ তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না। তবে, চিকিৎসার অভাবে এটি প্রাণঘাতীও হয়ে উঠতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সহায়তা সংস্থা ইউএসএআইডির তহবিল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিশ্বব্যাপী ৮০ শতাংশেরও বেশি মানবিক প্রকল্প স্থগিত হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি)-এর সিনিয়র ম্যানেজার তারিফুল ইসলাম খান জানিয়েছেন, ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ইউএসএআইডি-এর সহায়তায় দেশব্যাপী গণপরীক্ষা চালানো হয়, যাতে এই রোগে আক্রান্তদের শনাক্ত করা সহজ হয়। তিনি বলেন, ‘আমেরিকান জনগণের সহায়তায় আমরা ৫ কোটি ২০ লাখ মানুষকে স্ক্রিনিং করেছি এবং ১ লাখ ৪৮ হাজার যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত করেছি, যার মধ্যে ১৮ হাজার শিশুও রয়েছে। তবে তহবিল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই কার্যক্রম এখন বন্ধ হওয়ার পথে।’

তহবিল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শুধু যক্ষ্মা রোগেরই সংক্রমণ কিংবা এই রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রাণহানির সংখ্যা বেড়েছে ব্যাপারটা এমন নয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাতের প্রায় সবখানেই ইউএসএআইডি কাজ করছিল। ইউএসএআইডির সহায়তায় বাংলাদেশের ২৩ লাখ শিশুকে ডিপথেরিয়া, হাম, পোলিও এবং ধনুষ্টংকারের মতো রোগের টিকা দেওয়া হয়েছিল। আমি টিকাদান কর্মসূচি নিয়েই সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। এই কার্যক্রম ব্যাহত হলে আমরা যে সফলতা অর্জন করেছি, তা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।’

এ ছাড়া, পুষ্টিহীনতায় ভুগছে এমন শিশুদের জন্য ইউএসএআইডির অর্থায়নে বিশেষ পুষ্টিকর খাদ্য তৈরি করেছিলেন বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা। তহবিল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নতুন এই কর্মসূচিও বন্ধ হয়ে যাওয়ার পথে। স্বাস্থ্য উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা এই কর্মসূচি মাত্র শুরু করেছিলাম। শুধু এটিই নয়, অনেক গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ এখন থেমে গেছে।’

এদিকে, ট্রাম্পের শুল্কনীতি নিয়েও বেশ শঙ্কার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। গত ২ এপ্রিল ট্রাম্প বাংলাদেশের ওপর নতুন করে ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেন। পরে ৯০ দিনের জন্য তা স্থগিত করা হয়। কিন্তু সেই স্থগিতাদেশ শেষ হওয়ার সময় ঘনিয়ে আসছে। এমন পরিস্থিতিতে বিকল্প সাহায্যদাতার খোঁজ করছে ঢাকা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম জানিয়েছেন, কিছু আরব দেশ বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর আগ্রহ দেখিয়েছে, পাশাপাশি চীন ও তুরস্কও ওয়াশিংটনের স্থান পূরণের সম্ভাব্য প্রার্থী।

তবে ইতিমধ্যে বড় ক্ষতি হয়ে গেছে। ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার-এর হিসাবে, সহায়তা বন্ধের পর ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। এই সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। বিশেষ করে পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার শিশু সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হবে। ২০১৭ সাল থেকে মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া এই জনগোষ্ঠীর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা ছিল প্রধান ভরসা। এই সহায়তার একটি বড় অংশ জাতিসংঘের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইডও) এবং ইউনিসেফের মাধ্যমে দেওয়া হতো। ডব্লিউএইচও-এর আঞ্চলিক কর্মকর্তা সালমা সুলতানা বলেন, ‘সহায়তা কমে যাওয়ায় কলেরার মতো রোগের অনিয়ন্ত্রিত প্রাদুর্ভাবের ঝুঁকি বাড়ছে।’

জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ)-এর বাংলাদেশ প্রতিনিধি মাসাকি ওয়াতাবে বলেন, সংস্থাটি প্রজনন ও মাতৃস্বাস্থ্যসেবায় কাজ চালিয়ে যাওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। তবে ক্লিনিক বন্ধ হওয়া এবং ধাত্রীদের বেতন বন্ধ থাকায় প্রসবকালীন শিশু ও মাতৃমৃত্যুর ঝুঁকি আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। তিনি বলেন, ‘সহায়তা কমে যাওয়ার কারণে প্রতিরোধযোগ্য মাতৃ ও নবজাতকের মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে গেছে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত