Ajker Patrika

রোগ সারাতে শিশুর জিন সিকুয়েন্স বদলে দিলেন চিকিৎসকেরা, খুলছে চিকিৎসার নতুন দ্বার

অনলাইন ডেস্ক
জন্মের পর মুলডুনের ধরা পড়ে বিরল ও প্রাণঘাতী এক জেনেটিক রোগ। ছবি: চিলড্রেনস হসপিটাল অব ফিলাডেলফিয়া
জন্মের পর মুলডুনের ধরা পড়ে বিরল ও প্রাণঘাতী এক জেনেটিক রোগ। ছবি: চিলড্রেনস হসপিটাল অব ফিলাডেলফিয়া

বিশ্বে প্রথমবারের মতো এক শিশুকে দেওয়া হলো ব্যক্তিনিদির্ষ্ট জিন এডিটিং চিকিৎসা। যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যের ‘চিলড্রেনস হসপিটাল অব ফিলাডেলফিয়া’য় কে জে মুলডুন নামের ১০ মাস বয়সী শিশুকে এই চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে শিশুটি সুস্থ রয়েছে এবং ধীরে ধীরে তার স্বাস্থ্যের উন্নতি হচ্ছে।

জন্মের পর মুলডুনের ধরা পড়ে বিরল ও প্রাণঘাতী এক জেনেটিক রোগ। শিশুটির শরীরে কার্বাময়েল ফসফেট সিনথেটেজ ১ (সিপিএস-১) নামের একটি গুরুত্বপূর্ণ এনজাইম তৈরিতে সমস্যা হচ্ছিল। বাবা-মায়ের কাছ থেকে দুটি মিউটেশন পেয়েছিল মুলডন, যার ফলে প্রোটিন ভাঙার সময় উৎপন্ন হওয়া নাইট্রোজেনযুক্ত যৌগ প্রক্রিয়াজাত করতে পারত না তার শরীর। তাই তার রক্তে অ্যামোনিয়া জমে যেত, যা মস্তিষ্কের জন্য বিষাক্তকর।

ফিলাডেলফিয়ার চিলড্রেনস হসপিটালের শিশু চিকিৎসক রেবেকা আহরেন্স-নিকলাস বলেন, ‘আমরা এখনই এটাকে “সারিয়ে তোলা” বলতে পারি না। এটা এখনো অনেক প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। সময়ের সঙ্গে আমরা আরও শিখছি।’

মুলডুনের জন্য এই বিশেষ চিকিৎসা তৈরি করতে আন্তর্জাতিকভাবে গবেষকেরা, যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি সংস্থা ও কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে কাজ করে। মাত্র ছয় মাসেই তারা এই জিন সম্পাদনার ওষুধ তৈরি করতে সক্ষম হয়। এই চিকিৎসা কেজের শরীরের একদম নির্দিষ্ট জিনের ত্রুটি অনুযায়ী বানানো হয়েছে, তাই এই ওষুধ অন্য কারও কাজে লাগবে না।

চিকিৎসা পদ্ধতিতে ব্যবহার করা হয়েছে ‘বেস এডিটিং’ নামের একটি উন্নত ক্রিস্পার (ক্লাস্টার্ড রেগুলারলি শর্ট প্লেইনডর্মিক রিপিটস) পদ্ধতি, যা ডিএনএতে সূক্ষ্ম পরিবর্তন আনতে সক্ষম। এই পদ্ধতির মাধ্যমে কেজের মিউটেশন সংশোধন করার চেষ্টা করা হয়।

উল্লেখ্য, ক্রিস্পার একটি জৈব প্রযুক্তি, যা বিজ্ঞানীদের নির্দিষ্ট জিন বা ডিএনএর অংশ কেটে, বদলে বা ঠিক করে দিতে সাহায্য করে। এটি জীবের জিনগত উপাদানে সূক্ষ্ম ও নির্ভুল পরিবর্তন আনার সুযোগ দেয়।

গত ১৫ মে নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে প্রকাশিত নিবন্ধে বলা হয়, এই ওষুধ শুধু মুলডুনের জেনেটিক কোড অনুসারে তৈরি করা হয়েছে এবং এটি আর কোনো রোগীর জন্য ব্যবহারযোগ্য হবে না।

তবু এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগ জিন সম্পাদনা প্রযুক্তির মাধ্যমে অতি দুর্লভ জেনেটিক রোগের চিকিৎসায় নতুন আশা জাগিয়েছে। ভারতের বেঙ্গালুরুর নারায়ণ নেত্রালয় আই হসপিটালের জিন থেরাপি গবেষক আরকাসুভ্র ঘোষ বলেন, ‘সব ধরনের জিন ও কোষের থেরাপির জন্য এটাই ভবিষ্যৎ। এটা নিঃসন্দেহে খুব উত্তেজনাপূর্ণ অগ্রগতি।’

এর আগেও সিকল সেল অ্যানিমিয়ার মতো বিভিন্ন রোগের চিকিৎসার জন্য ক্রিস্প পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। তবে সে সব থেরাপি ছিল বহু রোগীর জন্য তৈরি, যেখানে মিউটেশন ভিন্ন হলেও লক্ষণ এক। অথচ মুলডুনের জন্য তৈরি থেরাপিটি ছিল একান্তই তার জন্য তৈরি, তার জেনেটিক কোড অনুযায়ী।

সিপিএস-১ ঘাটতির সবচেয়ে কার্যকর চিকিৎসা হলো লিভার ট্রান্সপ্লান্ট। তবে মুলডুন সেই বয়সে পৌঁছায়নি, যেখানে এই অস্ত্রোপচার সম্ভব। এর মধ্যে প্রতিটি দিন ছিল মৃত্যুর বা মস্তিষ্কের স্থায়ী ক্ষতির ঝুঁকি। কেননা, এই রোগে আক্রান্ত অর্ধেক শিশুই লিভার প্রতিস্থাপনের আগেই মারা যায়।

এই সময় আরেন্স-নিকলাস ও তার সহকর্মীরা নতুন একটি সম্ভাবনার কথা ভাবলেন। তারা আগে থেকেই একটি জিন সম্পাদনার পদ্ধতি ‘বেস এডিটিং’ নিয়ে কাজ করছিলেন, যা ডিএনএর একটি নির্দিষ্ট অক্ষর পরিবর্তন করতে পারে। এভাবেই তারা দ্রুত ও নিরাপদে একটি ব্যক্তির জন্য নির্দিষ্ট থেরাপি তৈরি করতে পারবে কি না, তা যাচাই করছিলেন।

মুলডুনের বাবা-মায়ের সম্মতিতে শুরু হলো একটি বিশাল উদ্যোগ। গবেষকেরা বেছে নিলেন সবচেয়ে কার্যকর বেস-এডিটিং পদ্ধতি এবং তা পরীক্ষা করলেন ইঁদুর ও বানরের ওপর। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের প্রযুক্তি ও উপকরণ দান করল। মার্কিন খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ) দ্রুততার সঙ্গে ওষুধটির মূল্যায়ন সম্পন্ন করল। এভাবে মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই মুলডুন পেয়ে গেল প্রথম ডোজ।

ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের গ্রেট অরমন্ড স্ট্রিট ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথের শিশু চিকিৎসক ওয়াসিম কাসিম বলেন, এই ঘটনাকে ‘অবিশ্বাস্য একটি অর্জন’ বলে আখ্যা করেন।

প্রথম ডোজের পর মুলডুন বয়স অনুযায়ী প্রোটিন খেতে পারছিল, তবে তখনো ওষুধের মাধ্যমে অ্যামোনিয়ার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হতো। দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার পর ওষুধের মাত্রা কমানো গেলেও পুরোপুরি ছাড়ানো সম্ভব হয়নি।

পরবর্তীতে তাকে দেওয়া হলো তৃতীয় ও শেষ ডোজ। এখন ধীরে ধীরে তার ওষুধের মাত্রা কমানো হচ্ছে, জানালেন আরেন্স-নিকলাস।

এ ধরনের একক রোগীর জন্য তৈরি থেরাপি সবার জন্য কতটা ব্যবহারযোগ্য তা এখনো স্পষ্ট নয়। কারণ, অনেক রোগীর জন্য তৈরি জিন থেরাপিও অনেক ব্যয়বহুল।

তবে চিকিৎসকেরা বলছেন, এই ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি বিস্তৃতভাবে প্রয়োগ করা অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং চ্যালেঞ্জিং। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, এটি ভবিষ্যতের জিন ও কোষ থেরাপির পথ দেখাতে পারে।

কেজের মা নিকোল মুলডুন বলেন, ‘সেদিন হসপিটাল রুমে ঢুকে দেখি সে নিজের হাতে বসে আছে। আমরা ভাবতেই পারিনি এমনটা কোনো দিন সম্ভব হবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত