Ajker Patrika

পিপিআরসির গবেষণা: ৫৩% পরিবারে দীর্ঘমেয়াদি রোগী

মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ, ঢাকা
আপডেট : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৮: ২১
পিপিআরসির গবেষণা: ৫৩% পরিবারে দীর্ঘমেয়াদি রোগী

দেশের মানুষের দীর্ঘমেয়াদি ও অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার হার ক্রমেই বাড়ছে। প্রতিবছর যত মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, তার দুই-তৃতীয়াংশের বেশি মারা যাচ্ছেন এসব রোগের কারণে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে, দেশের প্রায় ৫৩ শতাংশ পরিবারের অন্তত একজন সদস্য কোনো দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত। বড় রোগের এ বোঝা চিকিৎসার জন্য রোগীর নিজের ব্যয় বাড়িয়ে দিচ্ছে, যাকে বিশেষজ্ঞরা বলেন, আউট-অব-পকেট এক্সপেনডিচার বা ওওপি।

জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা তথা অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলছে এ বিষয়টি।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণায় দেশে দীর্ঘমেয়াদি রোগের পরিস্থিতির এ তথ্য উঠে এসেছে। ‘ইকোনমিক ডায়নামিকস অ্যান্ড মুড অ্যাট হাউসহোল্ড লেভেল ইন মিড ২০২৫’ শীর্ষক এ গবেষণাটি ৮ হাজার ৬৭টি পরিবারের ৩৩ হাজার ২০৭ জন সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে সম্পন্ন করা হয়।

গবেষণায় দেখা গেছে, ৫২ দশমিক ৫ শতাংশ পরিবারের অন্তত একজন দীর্ঘমেয়াদি রোগে (ক্রনিক ডিজিজ) আক্রান্ত রোগী রয়েছেন। কোনো কোনো পরিবারে একাধিক সদস্য এ ধরনের রোগে ভুগছেন। সবচেয়ে বেশি লোক যে দীর্ঘমেয়াদি অসুখে আক্রান্ত, তা হচ্ছে উচ্চ রক্তচাপ। ৩৪ দশমিক ৬ শতাংশ পরিবারের সদস্য এ রোগে ভুগছেন। সংখ্যার হিসাবে এর পরে রয়েছে যথাক্রমে গ্যাস্ট্রিক আলসার (২৬ দশমিক ৫ শতাংশ), ডায়াবেটিস (২৩ শতাংশ), হৃদ্‌রোগ বা হৃদ্‌রোগের জটিলতা (১৫ দশমিক ৭ শতাংশ), চর্মরোগ বা অ্যালার্জি (১১ দশমিক ২ শতাংশ), অ্যাজমা (১০ দশমিক ৪ শতাংশ), হাড়ের সমস্যা অস্টিওপোরোসিস বা ক্যালসিয়াম ঘাটতির রোগ (৯ দশমিক ৭ শতাংশ) চোখের সমস্যা (৭ শতাংশ), বাত বা আর্থ্রাইটিস (৪ দশমিক ৫ শতাংশ) এবং অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদি রোগ (৪ দশমিক ৮ শতাংশ)।

পিপিআরসি বলছে, দীর্ঘমেয়াদি রোগের ক্ষতি শুধু আক্রান্ত ব্যক্তির দুর্ভোগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এর চিকিৎসার ব্যয় পরিবার ও রাষ্ট্রের ওপর প্রভাব ফেলে। দীর্ঘমেয়াদি রোগের বোঝা এবং তার আর্থিক প্রভাব ব্যাপকভাবে অনুভূত একটি সাধারণ সমস্যা। এটি ধনী কিংবা গরিব, শহর বা গ্রামবাসী-নির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষের জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলতে পারে। তাই স্বাস্থ্যনীতি ও সেবা পরিকল্পনায় এর ওপর বিশেষ মনোযোগ দেওয়া জরুরি।

যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের (সিডিসি) সংজ্ঞামতে, যেসব স্বাস্থ্য সমস্যা এক বছর বা তার বেশি স্থায়ী থাকে এবং যার জন্য নিয়মিত চিকিৎসা প্রয়োজন হয়; কিংবা দৈনন্দিন কাজকর্ম সীমিত করতে হয়—তা-ই দীর্ঘমেয়াদি রোগ। ডায়াবেটিস, হৃদ্‌রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, বাতের মতো সাধারণ হয়ে ওঠা রোগ ছাড়া ক্যানসার ও কিডনির অসুখও এর মধ্যে পড়ে। ধূমপান, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যসূচি, শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা ও মদপান—এ চারটি ঝুঁকিপূর্ণ অভ্যাসের কারণে অনেক দীর্ঘমেয়াদি রোগের সৃষ্টি হয়, যেগুলো কি না প্রতিরোধযোগ্য।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) অনুযায়ী, দীর্ঘমেয়াদি রোগের মধ্যে অসংক্রামক রোগ (এনসিডি) এবং সংক্রামক রোগ—দুই ধরনের অসুখই রয়েছে। এর মধ্যে এনসিডি রোগগুলো সাধারণত দীর্ঘস্থায়ী এবং ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়। ডব্লিউএইচওর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে মৃত্যুর প্রধান কারণ হৃদ্‌রোগ বা ক্যানসারের মতো এনসিডি।

পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান ও গবেষণার মুখ্য গবেষক ড. হোসেন জিল্লুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, দেশে কত শতাংশ পরিবারে দীর্ঘমেয়াদি অসুখের রোগী রয়েছেন, তা জানা ছিল না। পিপিআরসির গবেষণায় প্রথমবারের মতো ধারণা পাওয়া গেল যে, দেশের ৫০ শতাংশের বেশি পরিবারে এ রকম রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি রয়েছেন। নিয়মিত ওষুধসহ সার্বিক চিকিৎসার খরচ বেশির ভাগ পরিবারের ওপর বড় ধরনের অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করছে। এই চাপ কমানোর জন্য কার্যকর কোনো সহায়তা নেই।

ড. জিল্লুর রহমান বলেন, সরকারকে দীর্ঘমেয়াদি রোগাক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য ওষুধের খরচ কমাতে নতুন সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির কথা বিবেচনা করা উচিত। এ ছাড়া রোগগুলো প্রতিরোধযোগ্য। তাই যথাযথ প্রতিরোধ কার্যক্রম চালাতে হবে। জনস্বাস্থ্যের এ বড় সমস্যাটিকে কমানোর জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে একত্রে কাজ করতে হবে। পরিবেশ দূষণ, অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার ও জীবনাচার—এসবও এ ধরনের রোগ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ বুলেটিন দেশের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা। গত বছরের জুনে প্রকাশিত ‘হেলথ বুলেটিন ২০২৩’-এ বলা হয়েছে, দেশ এখন সংক্রামক রোগ থেকে অসংক্রামক রোগের দিকে ধাবিত হচ্ছে। অসুস্থতা ও মৃত্যুর প্রধান কারণ হয়ে উঠেছে অসংক্রামক রোগ। বিশেষ করে ডায়াবেটিস, হৃদ্‌রোগ, ক্যানসার এবং দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসতন্ত্রের রোগ ব্যাপকভাবে দেখা যাচ্ছে। দেশে এখন বিভিন্ন রোগে মোট মৃত্যুর ৭০.২৬ শতাংশই ঘটছে অসংক্রামক রোগে। এর মধ্যে হৃদ্‌রোগে ৩৪ শতাংশ, ক্যানসারে ১০ শতাংশ, দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসতন্ত্রের রোগে ৭ শতাংশ, ডায়াবেটিসে ৪ শতাংশ এবং অন্যান্য অসংক্রামক রোগে ১১ শতাংশ মানুষের মৃত্যু ঘটে। অন্যদিকে সংক্রামক রোগে মৃত্যুর হার ২৩ শতাংশ।

দীর্ঘমেয়াদি রোগের অর্থনৈতিক প্রভাবের দুটি দিক তুলে ধরেছেন স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদেরা। তাঁরা বলেছেন, কেউ এসব রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর অসুস্থতা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও আগের মতো অর্থনৈতিক কার্যক্রমে অংশ নিতে পারেন না। এতে করে তাঁদের আয় কমে যায়। পাশাপাশি চিকিৎসার খরচ বেড়ে যাওয়ায় পরিবারের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. শাফিউন নাহিন শিমুল বলেন, দীর্ঘমেয়াদি রোগ দেশের সামগ্রিক দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রভাব ফেলছে। অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে সরকারি পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়। দেশে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় দীর্ঘমেয়াদি রোগও বাড়ছে। যদি সরকারিভাবে সময়মতো যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া যায়, তাহলে এসব রোগ মারাত্মক হয়ে উঠবে না এবং চিকিৎসা ব্যয়ও কম থাকবে।

ডব্লিউএইচওর পরিভাষা অনুযায়ী, স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার জন্য ব্যক্তি বা পরিবার যে অর্থ নিজের পকেট থেকে খরচ করে, তাকে ‘আউট-অব-পকেট’ (ওওপি) ব্যয় বলা হয়। ওওপির হার বেশি হলে তা দারিদ্র্য ও আর্থিক সংকট সৃষ্টি করতে পারে। কারণ এটি অন্যান্য মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যাঘাত ঘটায়। ওওপি ৪০ শতাংশের বেশি হলে তাকে বিপর্যয়কর স্বাস্থ্য ব্যয় বলা হয়। উচ্চ ওওপি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপরও চাপ সৃষ্টি করে।

সরকারের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট জানিয়েছে, বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় (ওওপি) ৬৭ শতাংশ। তবে বিশ্বব্যাংকের হিসাবে এটি ৭৪ শতাংশ। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) তথ্য অনুযায়ী, চিকিৎসার উচ্চ ব্যয়ের কারণে দেশের ১৮ শতাংশ পরিবার বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যে পড়েছে। ২০২২ সালে এ কারণে দেশে ৬১ লাখের বেশি মানুষ দরিদ্র হয়েছেন।

পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট (ইলেক্ট) অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রায় পুরোপুরি চিকিৎসাভিত্তিক (কিউরেটিভ), ততটা প্রতিরোধমূলক নয়। অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ করতে হলে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। এ জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার আইন করা জরুরি, যাতে সরকার এ সেবা দিতে বাধ্য হয়।

আবু জামিল ফয়সাল আরও বলেন, দীর্ঘমেয়াদি ও অসংক্রামক রোগের নিয়ন্ত্রণ এখনো নজরের বাইরে। শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যথেষ্ট নয়, এখানে শিক্ষা, স্বাস্থ্যশিক্ষা, পরিবেশ, খাদ্যাভ্যাস, জীবনাচার এবং বিপজ্জনক রাসায়নিক ও কীটনাশকের অতি ব্যবহার—এসব বিষয় জড়িত। এ জন্য সমন্বিত কার্যক্রম ছাড়া কার্যকর নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত