ওয়ারেছা খানম প্রীতি
আমি একটি কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি—একটি দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল এবং চর্চার পরিবেশ সেই দেশের অধিবাসীদের উন্নত মনন তৈরি করে। মহান স্বাধীনতার আগপর্যন্ত একটা মিশ্র সমাজব্যবস্থা আমাদের সাংস্কৃতিক স্থিতিকে নড়বড়ে করেছে। আমাদের সামনে সুনির্দিষ্ট কোনো রূপরেখা নেই, সেটা হোক সামাজিক, পারিবারিক কিংবা আচরণগত সৌন্দর্যের। উপরন্তু অন্যকে অধীনস্থ রাখার মানসিকতা রক্তে বহন করে চলেছে বৃহত্তর বাঙালি সমাজ।
কয়েক দিন আগে স্বনামধন্য একটি ব্যাংকের করপোরেট অফিসে গিয়েছিলাম। বন্ধু সেখানকার ডিএমডি। কথা বলার একপর্যায়ে তিনি তাঁর এক সহকর্মীকে দেখিয়ে বললেন, ‘উনি এখানকার সিনিয়র একটি পদে আছেন, বেতনও ভালো। কিন্তু সম্প্রতি চাকরি ছাড়বেন বলে রেজিগনেশন লেটার দিয়েছেন।’ বললাম, ‘অন্য কোথাও ভালো সুযোগ পেয়েছেন নিশ্চয়ই?’ এরপর বন্ধুটি যা জানালেন তাতে পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম, এখনো নারী তার নিজের ক্যারিয়ার ও যাপনের নানা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিকে সবার আগে মূল্যায়ন করে। ব্যাংকার সেই নারীর স্বামী চান না তাঁর স্ত্রী চাকরি করুক। কারণ, এ মুহূর্তে তাঁর নিজের কোনো চাকরি নেই। বিষয়টি তাঁর পুরুষতান্ত্রিক আত্মগরিমায় ভীষণভাবে আঘাত করছে। সুতরাং স্ত্রীকে বিয়ে টেকাতে হলে চাকরি ছাড়তে হবে।
ঠিক এই জায়গায় আসুন, আমরা আরেক দলকে কল্পনা করি, যারা চাকরি করছে না। যাদের সম্বন্ধে আমাদের ধারণা হলো, তারা খুব স্বাধীনভাবে কাজ করছে। সেই নারী উদ্যোক্তাদের অবস্থান আদতে কতটা স্বাধীন ও স্বাচ্ছন্দ্যের? যেহেতু ‘হার ই-ট্রেড’ নামে নারী উদ্যোক্তাদের একটা নেটওয়ার্কিং সাইট পরিচালনা করি, সেই সুবাদে প্রতিনিয়ত আমাকে কিছু অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। প্রায়ই কিছু নারীকে বলতে শুনি, স্বামী কিংবা শ্বশুরকুল তাঁকে পর্যাপ্ত স্বাধীনতা দিয়েছে বলেই তিনি ঘরে বসে কাজ করতে পারছেন। এ জন্য এই দল নিজেকে ভীষণ সৌভাগ্যবান মনে করেন। এ ধরনের মানসিকতা লালন করেন বলেই হয়তো ব্যবসায়ী হিসেবে কয়েক বছরের ক্যারিয়ার থাকলেও, এমনকি ব্যবসা ‘গ্রোথ লেভেলে’ যাওয়ার পরও বিপুলসংখ্যক নারী উদ্যোক্তা স্বামীর কর্ম ও কর্মক্ষেত্রের অবস্থানকে প্রাধান্য দিয়ে নিজের ব্যবসানীতি নির্ধারণ করেন। একই কার্যকারণে স্বামীকে দেশের বাইরে থাকার প্রয়োজন পড়লে উদ্যোক্তা নারীটি নিজের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা গুটিয়ে নির্দ্বিধায় স্বামীর সঙ্গে দেশের বাইরে চলে যান।
নিজের অর্জনকে হালকা করে দেখা এবং অনায়াসে সেটাকে বিসর্জন দেওয়াটা হয়তো এই উপমহাদেশীয় নারীদের সামাজিক শিক্ষা। অবধারিত ভেবে কেউ এটাকে আমলে না নিলেও বিষয়টা নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা। আমি বলব, ব্যবসায় দক্ষতা উন্নয়নের কোর্স যাঁরা ডিজাইন করেন, তাঁরা কোর্সের অন্তত একটা অংশ নারী অধিকার বিষয়ের ওপরে রাখতে পারেন। নইলে ব্যবসায় দক্ষতা অর্জন করা এই নারীরা নিজের স্বাধীনতা ও অধিকার অন্যের হাওলায় ছেড়ে দিয়ে তৃপ্তি অনুভব করে উচ্চারণ করতেই থাকবেন—তাঁকে পরিবার অনেক স্বাধীনতা দেয়!
অস্তিত্বের সংকট নিয়ে আর যা-ই হোক ব্যবসা হয় না। এবার আসি নারী উদ্যোক্তাদের প্রাথমিক কিছু চ্যালেঞ্জের বিষয়ে। একেবারে প্রথম বাধাটা আসে ব্যবসার জন্য প্রয়োজনীয় আইনগত কাগজপত্র তৈরির ক্ষেত্রে। এফ-কমার্স ও ই-কমার্স বিজনেসে অফিস থাকবে না, এটা স্বাভাবিক ভাবা উচিত। অধিকাংশ নারী ঘরে বসেই কার্যক্রম পরিচালনা করেন। অথচ ট্রেড লাইসেন্সে বাণিজ্যিক এলাকায় অবস্থিত নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ঠিকানা বাধ্যতামূলকভাবে দেখাতে হয়। ট্রেড লাইসেন্সবিষয়ক কোনো সমাধান সরকার না দেওয়ায় নারী উদ্যোক্তারা ঝামেলা এড়িয়ে ফেসবুক পেজভিত্তিক ব্যবসা করতেই স্বচ্ছন্দবোধ করেন। একটা মিথ্যা যেমন আরও দশটি মিথ্যার জন্ম দিতে থাকে, ঠিক তেমনি ট্রেড লাইসেন্স না করায় বিভিন্ন সুবিধা থেকে বঞ্চিত এবং নানা ক্ষেত্রে অসহযোগিতার সম্মুখীন হতে থাকেন নারী উদ্যোক্তারা। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ব্যাংক ও ফিন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউটের কোনো রকম ঋণসুবিধা না পাওয়া এবং দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণগুলোতে সুযোগ না পাওয়া।
বাকি চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে আছে ট্রেড লাইসেন্স রিভিউর উচ্চতর ফি, বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজে আবেদনে তথ্যের ঘাটতি, বন্ধকি ছাড়া ঋণসুবিধা না পাওয়া, টিন ও ভ্যাটবিষয়ক জ্ঞানের অভাব, সারা দেশে উইমেন চেম্বার অব কমার্সের অকার্যকারিতা, কার্যকরী মার্কেটিং ও ব্র্যান্ডিংবিষয়ক জ্ঞানের অভাব, আঞ্চলিক কার্গো সুবিধা না থাকা ইত্যাদি।
এসব বাধাবিপত্তি, পারিবারিক অসহযোগিতা, সঠিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাব সত্ত্বেও নারীরা কিন্তু ব্যবসাবিমুখ হননি। সংখ্যায় কম হলেও বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে এমন একটা অকিঞ্চিৎকর ও পুরুষের আগ্রাসনের জায়গায় নারীর পা ফেলাটাই অনেক বড় ব্যাপার। আশার কথা হলো, এই সংখ্যা উত্তরোত্তর বাড়ছে।
আসুন, এবার নারীদের ব্যবসায়িক পথপরিক্রমার কিছু পরিসংখ্যান দেখে নিই। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ৮ মিলিয়ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে নারী মালিকানাধীন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা মাত্র ৭ দশমিক ২ শতাংশ। এগুলোর মধ্যে বড় শিল্পের সঙ্গে যুক্ত আছেন ৫৪ দশমিক ৯২ শতাংশ নারী। ২৬ দশমিক ৪৯ শতাংশ মাঝারি শিল্পের সঙ্গে, ১৯ দশমিক ৫৩ শতাংশ ছোট শিল্পের সঙ্গে এবং ১৮ দশমিক ৯৯ শতাংশ নারী ক্ষুদ্র শিল্পের সঙ্গে জড়িত।
‘হোলসেল অ্যান্ড রিটেইল ট্রেড সার্ভে-২০২০’ শীর্ষক আরেকটি জরিপ পরিচালনা করেছে বিবিএস। সরকারের কোনো না কোনো মাধ্যমে নিবন্ধন রয়েছে শুধু—এমন উদ্যোক্তাদের তথ্যই সেখানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে নিবন্ধিত খুচরা ও পাইকারি প্রতিষ্ঠান ছিল ২৫ লাখ ৪০ হাজার ৮৯৭টি। এসব প্রতিষ্ঠানে পুরুষ উদ্যোক্তা ছিলেন ১ কোটি ৩৯ লাখ ১ হাজার ৫৬৪ জন, আর নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা ২ লাখ ৩ হাজার ১৮৯ জন। ২০০৯-১০ অর্থবছরে নারী উদ্যোক্তা ছিলেন ৮৯ হাজার ৮৪৮ জন। এই সংখ্যা ২০০২-০৩ অর্থবছরে ছিল মাত্র ২১ হাজার ৮৬৭ জন। অর্থাৎ, দুই দশকে নারী উদ্যোক্তা বেড়েছে ৯২৯ শতাংশ!
বিশ্বব্যাংক গ্রুপের ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) তথ্যমতে, দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পোদ্যোক্তার সংখ্যা প্রায় ২৪ লাখ। এ ছাড়া ভেনচার ক্যাপিটাল রিসার্চ ডেটাবেইস পিচবুক থেকে প্রকাশিত সর্বশেষ পরিসংখ্যান-২০১৯-এর তথ্যমতে, পৃথিবীর মাত্র ২ শতাংশ নারীর কাছে তাঁদের ব্যবসা পরিচালনার মূলধন থাকে।
যেখানে পুরো পৃথিবী দিচ্ছে প্রতি ১০০ জনে দুজন উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার পরিসংখ্যান, সেখানে বাংলাদেশের চিত্রটি আশার আলো দেখায়। নারী উদ্যোক্তা তৈরিতে বিশ্বের অন্য অনেক দেশের তুলনায় এগিয়ে আছে বাংলাদেশ।
২০১৭ সাল। মাস্টারকার্ড ইনডেক্স অব উইমেন অন্ট্রাপ্রেনরস-এর জরিপে একটি তথ্য উঠে আসে। সেখানে বলা হয়, বাংলাদেশে যত উদ্যোক্তা আছেন, তাঁদের প্রায় ৩২ জন নারী। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিকদের মধ্যে নারীর সংখ্যা বিবেচনায় ৫৪টি স্বল্প আয়ের দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অবস্থান করছে ৬ নম্বরে। উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে উঠতে একজন নারীর যে সুবিধাগুলো পাওয়া জরুরি, সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জরুরি হলো আর্থিক সহায়তাপ্রাপ্তি ও সহজে ব্যবসা করার পরিবেশ। এ দুই সুবিধাপ্রাপ্তিতে এমআইডব্লিউই সূচকে ১০০-তে বাংলাদেশের স্কোর ৩২। এত কম সুযোগ-সুবিধা পেয়েও বাংলাদেশের নারীরা কেন এত বেশি হারে উদ্যোক্তা হচ্ছেন—এমন প্রশ্নের উত্তরে জরিপে বলা হয়েছে, পরিবার ও নিজেদের আর্থিক চাহিদা পূরণের জন্যই এ দেশের নারীরা উদ্যোক্তা হচ্ছেন।
এবার কিছু সুখের কথা বলি। করোনার দুই বছরে পৃথিবীর প্রেক্ষাপট একেবারে পাল্টে গেছে। একইভাবে পাল্টেছে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতও। এ সময় পারিবারিক ও আর্থিক সংকট পাড়ি দিতে লাখ লাখ নারী যুক্ত হয়েছেন অনলাইন ব্যবসায়। মূলত এসব নারী ফেসবুক প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে নিয়মিত আয়ের মাধ্যমে পরিবারে স্বাচ্ছন্দ্য এনেছেন। সম্প্রতি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে অসংখ্য প্রতারণা হওয়ায় এফ-কমার্স ও ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের জন্য সরকার ইউনিক বিজনেস আইডি চালু করেছে। এতে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়কেই সহজে ট্র্যাক করা যাবে এবং যেকোনো পক্ষ থেকে প্রতারণা হলে উভয়কেই জবাবদিহির আওতায় আনা সম্ভব হবে। সরকারি-বেসরকারি অনেক খাত দাতা সংস্থাগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়ে নারী উদ্যোক্তাদের দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি আইনগত তথ্য দিচ্ছে, স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিজনেস-টু-বিজনেস ম্যাচমেকিং করছে, দেশি-বিদেশি করপোরেট বায়ারদের সঙ্গে উদ্যোক্তাদের যোগাযোগ স্থাপন, দেশে ও দেশের বাইরের বিভিন্ন এক্সপোতে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিচ্ছে, ছোট-বড় গ্র্যান্টের জন্য তথ্যসমৃদ্ধ করা থেকে পিচিং প্রশিক্ষণ দেওয়া পর্যন্ত নানা ধরনের সেবা দিচ্ছে। এ পর্যন্ত অসংখ্য নারী উদ্যোক্তা স্টার্টআপ পিচিংয়ের মাধ্যমে দেশি-বিদেশি গ্র্যান্ট পেয়েছেন।
নারী উদ্যোক্তাদের অনেক আশাহত হওয়ার মতো ঘটনা যেমন আছে, ঠিক তেমনি আছে ভরসার জায়গাও। নারীদের ভরসার জায়গাগুলো আরও প্রসারিত হোক। দেশের জিডিপির উত্তরণ ঘটুক কর্মঠ ও মেধাবী নারী উদ্যোক্তাদের হাত ধরে।
লেখক: প্রেসিডেন্ট, হার ই-ট্রেড
আমি একটি কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি—একটি দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল এবং চর্চার পরিবেশ সেই দেশের অধিবাসীদের উন্নত মনন তৈরি করে। মহান স্বাধীনতার আগপর্যন্ত একটা মিশ্র সমাজব্যবস্থা আমাদের সাংস্কৃতিক স্থিতিকে নড়বড়ে করেছে। আমাদের সামনে সুনির্দিষ্ট কোনো রূপরেখা নেই, সেটা হোক সামাজিক, পারিবারিক কিংবা আচরণগত সৌন্দর্যের। উপরন্তু অন্যকে অধীনস্থ রাখার মানসিকতা রক্তে বহন করে চলেছে বৃহত্তর বাঙালি সমাজ।
কয়েক দিন আগে স্বনামধন্য একটি ব্যাংকের করপোরেট অফিসে গিয়েছিলাম। বন্ধু সেখানকার ডিএমডি। কথা বলার একপর্যায়ে তিনি তাঁর এক সহকর্মীকে দেখিয়ে বললেন, ‘উনি এখানকার সিনিয়র একটি পদে আছেন, বেতনও ভালো। কিন্তু সম্প্রতি চাকরি ছাড়বেন বলে রেজিগনেশন লেটার দিয়েছেন।’ বললাম, ‘অন্য কোথাও ভালো সুযোগ পেয়েছেন নিশ্চয়ই?’ এরপর বন্ধুটি যা জানালেন তাতে পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম, এখনো নারী তার নিজের ক্যারিয়ার ও যাপনের নানা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিকে সবার আগে মূল্যায়ন করে। ব্যাংকার সেই নারীর স্বামী চান না তাঁর স্ত্রী চাকরি করুক। কারণ, এ মুহূর্তে তাঁর নিজের কোনো চাকরি নেই। বিষয়টি তাঁর পুরুষতান্ত্রিক আত্মগরিমায় ভীষণভাবে আঘাত করছে। সুতরাং স্ত্রীকে বিয়ে টেকাতে হলে চাকরি ছাড়তে হবে।
ঠিক এই জায়গায় আসুন, আমরা আরেক দলকে কল্পনা করি, যারা চাকরি করছে না। যাদের সম্বন্ধে আমাদের ধারণা হলো, তারা খুব স্বাধীনভাবে কাজ করছে। সেই নারী উদ্যোক্তাদের অবস্থান আদতে কতটা স্বাধীন ও স্বাচ্ছন্দ্যের? যেহেতু ‘হার ই-ট্রেড’ নামে নারী উদ্যোক্তাদের একটা নেটওয়ার্কিং সাইট পরিচালনা করি, সেই সুবাদে প্রতিনিয়ত আমাকে কিছু অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। প্রায়ই কিছু নারীকে বলতে শুনি, স্বামী কিংবা শ্বশুরকুল তাঁকে পর্যাপ্ত স্বাধীনতা দিয়েছে বলেই তিনি ঘরে বসে কাজ করতে পারছেন। এ জন্য এই দল নিজেকে ভীষণ সৌভাগ্যবান মনে করেন। এ ধরনের মানসিকতা লালন করেন বলেই হয়তো ব্যবসায়ী হিসেবে কয়েক বছরের ক্যারিয়ার থাকলেও, এমনকি ব্যবসা ‘গ্রোথ লেভেলে’ যাওয়ার পরও বিপুলসংখ্যক নারী উদ্যোক্তা স্বামীর কর্ম ও কর্মক্ষেত্রের অবস্থানকে প্রাধান্য দিয়ে নিজের ব্যবসানীতি নির্ধারণ করেন। একই কার্যকারণে স্বামীকে দেশের বাইরে থাকার প্রয়োজন পড়লে উদ্যোক্তা নারীটি নিজের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা গুটিয়ে নির্দ্বিধায় স্বামীর সঙ্গে দেশের বাইরে চলে যান।
নিজের অর্জনকে হালকা করে দেখা এবং অনায়াসে সেটাকে বিসর্জন দেওয়াটা হয়তো এই উপমহাদেশীয় নারীদের সামাজিক শিক্ষা। অবধারিত ভেবে কেউ এটাকে আমলে না নিলেও বিষয়টা নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা। আমি বলব, ব্যবসায় দক্ষতা উন্নয়নের কোর্স যাঁরা ডিজাইন করেন, তাঁরা কোর্সের অন্তত একটা অংশ নারী অধিকার বিষয়ের ওপরে রাখতে পারেন। নইলে ব্যবসায় দক্ষতা অর্জন করা এই নারীরা নিজের স্বাধীনতা ও অধিকার অন্যের হাওলায় ছেড়ে দিয়ে তৃপ্তি অনুভব করে উচ্চারণ করতেই থাকবেন—তাঁকে পরিবার অনেক স্বাধীনতা দেয়!
অস্তিত্বের সংকট নিয়ে আর যা-ই হোক ব্যবসা হয় না। এবার আসি নারী উদ্যোক্তাদের প্রাথমিক কিছু চ্যালেঞ্জের বিষয়ে। একেবারে প্রথম বাধাটা আসে ব্যবসার জন্য প্রয়োজনীয় আইনগত কাগজপত্র তৈরির ক্ষেত্রে। এফ-কমার্স ও ই-কমার্স বিজনেসে অফিস থাকবে না, এটা স্বাভাবিক ভাবা উচিত। অধিকাংশ নারী ঘরে বসেই কার্যক্রম পরিচালনা করেন। অথচ ট্রেড লাইসেন্সে বাণিজ্যিক এলাকায় অবস্থিত নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ঠিকানা বাধ্যতামূলকভাবে দেখাতে হয়। ট্রেড লাইসেন্সবিষয়ক কোনো সমাধান সরকার না দেওয়ায় নারী উদ্যোক্তারা ঝামেলা এড়িয়ে ফেসবুক পেজভিত্তিক ব্যবসা করতেই স্বচ্ছন্দবোধ করেন। একটা মিথ্যা যেমন আরও দশটি মিথ্যার জন্ম দিতে থাকে, ঠিক তেমনি ট্রেড লাইসেন্স না করায় বিভিন্ন সুবিধা থেকে বঞ্চিত এবং নানা ক্ষেত্রে অসহযোগিতার সম্মুখীন হতে থাকেন নারী উদ্যোক্তারা। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ব্যাংক ও ফিন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউটের কোনো রকম ঋণসুবিধা না পাওয়া এবং দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণগুলোতে সুযোগ না পাওয়া।
বাকি চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে আছে ট্রেড লাইসেন্স রিভিউর উচ্চতর ফি, বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজে আবেদনে তথ্যের ঘাটতি, বন্ধকি ছাড়া ঋণসুবিধা না পাওয়া, টিন ও ভ্যাটবিষয়ক জ্ঞানের অভাব, সারা দেশে উইমেন চেম্বার অব কমার্সের অকার্যকারিতা, কার্যকরী মার্কেটিং ও ব্র্যান্ডিংবিষয়ক জ্ঞানের অভাব, আঞ্চলিক কার্গো সুবিধা না থাকা ইত্যাদি।
এসব বাধাবিপত্তি, পারিবারিক অসহযোগিতা, সঠিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাব সত্ত্বেও নারীরা কিন্তু ব্যবসাবিমুখ হননি। সংখ্যায় কম হলেও বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে এমন একটা অকিঞ্চিৎকর ও পুরুষের আগ্রাসনের জায়গায় নারীর পা ফেলাটাই অনেক বড় ব্যাপার। আশার কথা হলো, এই সংখ্যা উত্তরোত্তর বাড়ছে।
আসুন, এবার নারীদের ব্যবসায়িক পথপরিক্রমার কিছু পরিসংখ্যান দেখে নিই। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ৮ মিলিয়ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে নারী মালিকানাধীন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা মাত্র ৭ দশমিক ২ শতাংশ। এগুলোর মধ্যে বড় শিল্পের সঙ্গে যুক্ত আছেন ৫৪ দশমিক ৯২ শতাংশ নারী। ২৬ দশমিক ৪৯ শতাংশ মাঝারি শিল্পের সঙ্গে, ১৯ দশমিক ৫৩ শতাংশ ছোট শিল্পের সঙ্গে এবং ১৮ দশমিক ৯৯ শতাংশ নারী ক্ষুদ্র শিল্পের সঙ্গে জড়িত।
‘হোলসেল অ্যান্ড রিটেইল ট্রেড সার্ভে-২০২০’ শীর্ষক আরেকটি জরিপ পরিচালনা করেছে বিবিএস। সরকারের কোনো না কোনো মাধ্যমে নিবন্ধন রয়েছে শুধু—এমন উদ্যোক্তাদের তথ্যই সেখানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে নিবন্ধিত খুচরা ও পাইকারি প্রতিষ্ঠান ছিল ২৫ লাখ ৪০ হাজার ৮৯৭টি। এসব প্রতিষ্ঠানে পুরুষ উদ্যোক্তা ছিলেন ১ কোটি ৩৯ লাখ ১ হাজার ৫৬৪ জন, আর নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা ২ লাখ ৩ হাজার ১৮৯ জন। ২০০৯-১০ অর্থবছরে নারী উদ্যোক্তা ছিলেন ৮৯ হাজার ৮৪৮ জন। এই সংখ্যা ২০০২-০৩ অর্থবছরে ছিল মাত্র ২১ হাজার ৮৬৭ জন। অর্থাৎ, দুই দশকে নারী উদ্যোক্তা বেড়েছে ৯২৯ শতাংশ!
বিশ্বব্যাংক গ্রুপের ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) তথ্যমতে, দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পোদ্যোক্তার সংখ্যা প্রায় ২৪ লাখ। এ ছাড়া ভেনচার ক্যাপিটাল রিসার্চ ডেটাবেইস পিচবুক থেকে প্রকাশিত সর্বশেষ পরিসংখ্যান-২০১৯-এর তথ্যমতে, পৃথিবীর মাত্র ২ শতাংশ নারীর কাছে তাঁদের ব্যবসা পরিচালনার মূলধন থাকে।
যেখানে পুরো পৃথিবী দিচ্ছে প্রতি ১০০ জনে দুজন উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার পরিসংখ্যান, সেখানে বাংলাদেশের চিত্রটি আশার আলো দেখায়। নারী উদ্যোক্তা তৈরিতে বিশ্বের অন্য অনেক দেশের তুলনায় এগিয়ে আছে বাংলাদেশ।
২০১৭ সাল। মাস্টারকার্ড ইনডেক্স অব উইমেন অন্ট্রাপ্রেনরস-এর জরিপে একটি তথ্য উঠে আসে। সেখানে বলা হয়, বাংলাদেশে যত উদ্যোক্তা আছেন, তাঁদের প্রায় ৩২ জন নারী। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিকদের মধ্যে নারীর সংখ্যা বিবেচনায় ৫৪টি স্বল্প আয়ের দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অবস্থান করছে ৬ নম্বরে। উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে উঠতে একজন নারীর যে সুবিধাগুলো পাওয়া জরুরি, সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জরুরি হলো আর্থিক সহায়তাপ্রাপ্তি ও সহজে ব্যবসা করার পরিবেশ। এ দুই সুবিধাপ্রাপ্তিতে এমআইডব্লিউই সূচকে ১০০-তে বাংলাদেশের স্কোর ৩২। এত কম সুযোগ-সুবিধা পেয়েও বাংলাদেশের নারীরা কেন এত বেশি হারে উদ্যোক্তা হচ্ছেন—এমন প্রশ্নের উত্তরে জরিপে বলা হয়েছে, পরিবার ও নিজেদের আর্থিক চাহিদা পূরণের জন্যই এ দেশের নারীরা উদ্যোক্তা হচ্ছেন।
এবার কিছু সুখের কথা বলি। করোনার দুই বছরে পৃথিবীর প্রেক্ষাপট একেবারে পাল্টে গেছে। একইভাবে পাল্টেছে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতও। এ সময় পারিবারিক ও আর্থিক সংকট পাড়ি দিতে লাখ লাখ নারী যুক্ত হয়েছেন অনলাইন ব্যবসায়। মূলত এসব নারী ফেসবুক প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে নিয়মিত আয়ের মাধ্যমে পরিবারে স্বাচ্ছন্দ্য এনেছেন। সম্প্রতি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে অসংখ্য প্রতারণা হওয়ায় এফ-কমার্স ও ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের জন্য সরকার ইউনিক বিজনেস আইডি চালু করেছে। এতে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়কেই সহজে ট্র্যাক করা যাবে এবং যেকোনো পক্ষ থেকে প্রতারণা হলে উভয়কেই জবাবদিহির আওতায় আনা সম্ভব হবে। সরকারি-বেসরকারি অনেক খাত দাতা সংস্থাগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়ে নারী উদ্যোক্তাদের দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি আইনগত তথ্য দিচ্ছে, স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিজনেস-টু-বিজনেস ম্যাচমেকিং করছে, দেশি-বিদেশি করপোরেট বায়ারদের সঙ্গে উদ্যোক্তাদের যোগাযোগ স্থাপন, দেশে ও দেশের বাইরের বিভিন্ন এক্সপোতে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিচ্ছে, ছোট-বড় গ্র্যান্টের জন্য তথ্যসমৃদ্ধ করা থেকে পিচিং প্রশিক্ষণ দেওয়া পর্যন্ত নানা ধরনের সেবা দিচ্ছে। এ পর্যন্ত অসংখ্য নারী উদ্যোক্তা স্টার্টআপ পিচিংয়ের মাধ্যমে দেশি-বিদেশি গ্র্যান্ট পেয়েছেন।
নারী উদ্যোক্তাদের অনেক আশাহত হওয়ার মতো ঘটনা যেমন আছে, ঠিক তেমনি আছে ভরসার জায়গাও। নারীদের ভরসার জায়গাগুলো আরও প্রসারিত হোক। দেশের জিডিপির উত্তরণ ঘটুক কর্মঠ ও মেধাবী নারী উদ্যোক্তাদের হাত ধরে।
লেখক: প্রেসিডেন্ট, হার ই-ট্রেড
আধুনিক যুগের সবচেয়ে বিস্ময়কর প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারগুলোর একটি হচ্ছে গৌতম বুদ্ধের দেহাবশেষের সঙ্গে সম্পর্কিত ঐতিহাসিক রত্নসম্ভার। গতকাল বুধবার হংকংয়ে বিখ্যাত আর্ট নিলাম কোম্পানি সাদাবি’স-এর এক নিলামে এগুলো তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
৫ দিন আগেপাকিস্তানে ভারতের হামলার সমালোচনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। চীনও এই হামলাকে ‘দুঃখজনক’ বলে অভিহিত করেছে। উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘও। উত্তেজনা যেন আরও না বাড়ে, সে জন্য দুই পক্ষকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশ। এদিকে ভারতের অবস্থানকে সমর্থন করেছে...
৫ দিন আগেভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলা নিয়ে দুই চিরবৈরী প্রতিবেশীর মধ্যে উত্তেজনার পারদ ক্রমেই চড়ছিল। তা তুঙ্গে উঠল এবার পাকিস্তানের ভূখণ্ডে ভারতের ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামের ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান হামলা দিয়ে। পাশাপাশি সীমান্তেও দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলি হয়েছে...
৫ দিন আগেঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা এলাকায় যাত্রীবাহী বাসে ডাকাতি বেড়েই চলছে। এ কারণে চালক ও যাত্রীদের কাছে আতঙ্কের নাম হয়ে উঠছে এই সড়ক। ডাকাতির শিকার বেশি হচ্ছেন প্রবাসফেরত লোকজন। ডাকাতেরা অস্ত্র ঠেকিয়ে লুট করে নিচ্ছে সর্বস্ব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়েও ঘটছে ডাকাতির ঘটনা।
০২ মার্চ ২০২৫