Ajker Patrika

বইমেলা ও লেখকের স্বার্থ

চিররঞ্জন সরকার
আপডেট : ১০ মার্চ ২০২২, ১০: ২৭
বইমেলা ও লেখকের স্বার্থ

বাংলা একাডেমি আয়োজিত একুশের বইমেলা এখন বাঙালির জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। এত দীর্ঘ সময়ব্যাপী বইমেলা পৃথিবীর আর কোথাও হয় বলে মনে হয় না। বাংলাদেশের এ মেলা এখন সবার কাছেই এক ঈর্ষণীয় ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে।

কিন্তু ঘাড় গুঁজে মোবাইলে মগ্ন এই সমাজ কতটুকু পড়ে সাহিত্য, দর্শন, সমাজ-বিজ্ঞান? অবশ্য যাঁরা মনে করেন ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া কিংবা মোবাইল ফোনই আমাদের পাঠাভ্যাস ধ্বংসের জন্য দায়ী, তাঁরা বোধ হয় পুরোটা ঠিক ভাবছেন না। ইন্টারনেট দুনিয়ায় আত্মসমর্পণের আগে থেকেই মানুষের বই পড়ার অভ্যাস কমছে। টিভিসহ বিভিন্ন আধুনিক বিনোদনমাধ্যম আমাদের পড়ার অভ্যাসে ফাটল ধরিয়েছে।

তারপরও এখনো বই বিক্রি হয়। বইয়ের দোকানে, অনলাইনে, বইমেলায় বই বিক্রির পরিমাণ একেবারে কম নয়। কিন্তু বই ‘কেনা’ মানেই কি ‘পড়া’? স্টিফেন হকিংয়ের ১৯৮৮ সালের বই ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ পৃথিবীজুড়ে হয়েছে ‘বেস্ট সেলার’। ৩৫টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে, বিক্রি হয়েছে এক কোটির বেশি কপি। আবার এই বইটিকেই বলা হয় ‘সর্বকালের সবচেয়ে না-পড়া বই’। টমাস পিকেটির ‘ক্যাপিটাল ইন দ্য টোয়েন্টি-ফার্স্ট সেঞ্চুরি’ নামের বইটির কথাও বলা যায়। এটিও একটি বেস্ট সেলার বই। কিন্তু ‘লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক জরিপ মতে, এটিও অপঠিত বইয়ের তালিকায় শীর্ষে আছে।

তার মানে মানুষ বই কিনলেই পড়ে না। তবে এখন দুনিয়াব্যাপী বই প্রকাশক ও বিক্রেতাদের মূল উদ্বেগটা বই ‘পড়া’ নিয়ে নয়; বরং বই ‘কেনা’ নিয়ে। বইসংক্রান্ত যেকোনো আলোচনায় যে বিষয়টা বাদ পড়ে যায় তা হলো, লেখক। বইমেলায়ও লেখকের বঞ্চনার বিষয়টি কখনো চোখে পড়ে না।

বইমেলার মূল প্রাণ হচ্ছে বই। বইয়ের লিখন, প্রকাশনা, বিপণন ও বিক্রয় নিয়ে এ মেলা জমে ওঠে। আর বইয়ের রচয়িতা হচ্ছেন লেখক। তাঁরাই প্রকাশকদের মাধ্যমে বইমেলায় বই জোগান। তাঁদের লেখা বই প্রকাশকেরা প্রকাশ করে স্টল সাজান। সেদিক দিয়ে বিচার করে বলা যায়, লেখকেরাই হলেন বইমেলার মূল কারিগর। তাঁরাই বইমেলার মূল প্রাণভোমরা। অথচ বাণিজ্যিক দিক থেকে দেখলে বইমেলায় সবচেয়ে বেশি প্রতারিত হন লেখকেরা। মুখে স্বীকার না করলেও প্রকাশকেরা কিন্তু আর্থিক দিক থেকে ঠিকই লাভবান হন।

একজন লেখককে একটি বই লেখার জন্য প্রচুর শ্রম দিতে হয়। হাজার হাজার ঘণ্টা শ্রম দিয়ে একটি বই লেখার পর তিনি যখন প্রকাশকের দ্বারস্থ হন, তখন তিনি প্রাপ্য সম্মানটুকুও পান না। রাজধানীর বাইরের লেখকেরা যত মেধাবীই হোন না কেন এবং তাঁরা যত ভালো ও মৌলিক গ্রন্থই রচনা করুন না কেন, প্রকাশকদের কাছে তাঁদের ভাত নেই। লেখকের সঙ্গে যেভাবে চুক্তিপত্র করা দরকার, অনেক প্রকাশকই তা করেন না। যেভাবে তাঁদের বিক্রয়লব্ধ অর্থ থেকে মুনাফা প্রদান করার কথা, তা দেন না। পরিবর্তে এমন একটা ভাব দেখান যে তাঁর বই বাজারে খুব একটা চলবে না। প্রকাশক যেন অনুগ্রহ করে তাঁর বই ছাপছেন। তারপর সেই বই বিক্রি হলেও প্রকৃত বিক্রয় সংখ্যা তাঁকে বলা হয় না। এ ব্যাপারে প্রকাশকদের সততা প্রশ্নবিদ্ধ। হয়তো দেখা গেল একুশে মেলায় গ্রামের একজন গুণী লেখকের বই ৫০০ কপি বিক্রি হলো; কিন্তু প্রকাশক তাঁকে হিসাব দিলেন ১৯ কপির। আবার সেই ১৯ কপির রয়্যালটিও তাঁকে ঠিকমতো দেওয়া হয় না। এমন অসহায় পরিস্থিতিতে লেখকেরা প্রকাশিত বইয়ের মলাটের ওপর তাঁর নিজের নাম দেখেই খুশি! অথচ লেখকের শ্রমের ফসল বিক্রি করে আর্থিক সুবিধাটি ভোগ করেন প্রকাশকেরা। প্রকাশকদের মধ্যে যে সৎ প্রকাশক একেবারেই নেই−এমন নয়। তবে তাঁদের সংখ্যা খুবই কম।

নামীদামি লেখকের বেলায় কিন্তু এমনটি হয় না। প্রকাশকেরা তাঁদের ঠিকই সম্মানী দেন। তাঁদের সঙ্গে লিখিত চুক্তিনামা সই করেন। সেখানে হয়তো উল্লেখ থাকে, লেখককে ১২ বা ১৫ শতাংশ রয়্যালটি দেওয়া হবে। যদিও এ ক্ষেত্রে কতটা সততার সঙ্গে হিসাব-নিকাশ করা হয়, সে বিষয়ে প্রশ্ন আছে।

বই প্রকাশ করতে হলে আমাদের দেশে কোনো না কোনো প্রকাশকের সঙ্গে পরিচয় বা খাতির থাকতে হবে। তা না থাকলে কেউকেটা গোছের কাউকে ধরতে হবে, যাঁর সঙ্গে প্রকাশকের খাতির আছে। তিনি বলে দিলে হয়তো প্রকাশক মহোদয় রাজি হন। এ ক্ষেত্রে প্রকাশকেরা শুরুতেই শর্ত দিয়ে দেন যে তাঁকে অন্তত দুই শ বই নগদে কিনে নিতে হবে। হোমরাচোমরা কিংবা সেলিব্রেটি না হলে কোনো প্রকাশকই বই ছাপতে চান না। যাঁর বই ছাপলে লাভ হবে, কেবল তাঁর বই-ই প্রকাশকেরা ছাপেন বা ছাপতে আগ্রহী হন! এ ব্যাপারে প্রকাশকদের বক্তব্য, ‘১৪০-১৬০ পৃষ্ঠার একটা বই দুই শ কপি ছাপতে ৪০-৫০ হাজার টাকা ব্যয় হয়। প্রতিষ্ঠিত লেখক ছাড়া এ ধরনের বই ৫-১০ কপিও বিক্রি হয় না। এই বাস্তবতায় আমরা নতুন লেখকের বই ছাপব কীভাবে?’ প্রকাশকদের কথার মধ্যে অবশ্যই যুক্তি আছে। হাজার হাজার টাকা গচ্চা দিয়ে কেন একজন প্রকাশক বই ছাপতে যাবেন? বইয়ের পাঠক নেই বলে ভালো বই বের হয় না, ভালো বই নেই বলে পাঠকেরা পড়েন না, দুর্বল বিপণনের জন্য বাণিজ্য হয় না, বাণিজ্যে মন্দা বলেই বই-পণ্যের মান নিচু, আবার নিচু মানের পণ্য বলেই বাণিজ্যও দুর্বল−এই বৃত্তেই আছে বাংলা বই।

এত অবহেলা, অসম্মান, বঞ্চনার মধ্যেও লেখকেরা কীভাবে নতুন বই রচনা করে যাচ্ছেন, এটা একটা বিস্ময় বটে। কোনো কোনো লেখক বলেন, তাঁরা মনের আনন্দে লেখেন। নতুন সৃষ্টির আনন্দ নিয়ে বেঁচে থাকেন বলে লেখেন। তা হয়তো ঠিক। কিন্তু লেখকদের জন্য কেবল শুকনো আনন্দ নিয়ে বেঁচে থাকা কঠিন। এখন পেশাদারির যুগ। লেখকদের প্রাপ্য অধিকার দেওয়া দরকার। সরকারের তরফ থেকে বা বাংলা একাডেমির এ ব্যাপারে কোনো ভাবনা-চিন্তা কিংবা উদ্যোগ আছে বলে মনে হয় না। প্রতিবছর বইমেলায় কোটি কোটি টাকার বই বিক্রি হয়। ঘাম আর রক্ত ঝরানো এই অর্থের কত অংশ লেখকের আর কত অংশ প্রকাশকের পকেটে যায়, তা নিয়ে সরকার বা বাংলা একাডেমির কোনো গবেষণা বা হিসাব-নিকাশ আছে বলে মনে হয় না।

তারা সংখ্যাতত্ত্বে বিশ্বাসী হয়ে কেবল কৃতিত্ব আর বাহ্বা নিতে ব্যস্ত। বইমেলা চলাকালে একেক দিন বাংলা একাডেমি থেকে বলা হয়, আজ ৩০২টি নতুন বই মেলায় এসেছে, আজ এসেছে ৪০৫টি নতুন বই। মেলা শেষে দাবি করা হয়, গত বছরের চেয়ে এবার অনেক বেশি বই প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, এসব বইয়ের কত অংশ মানসম্পন্ন আর কত অংশ মানহীন—তার হিসাব কেউ করেন না।

কিছু কিছু প্রকাশক আছেন, যাঁরা দুই-পাঁচ শ বই কিনে নেওয়ার শর্তে কিংবা লেখকদের কাছ থেকে নগদ টাকা নিয়ে নিম্ন মানের বই ছাপেন! কিছু ডলার ছাড়লেই প্রবাসী লেখকদের বই প্রকাশে প্রকাশকেরা আগ্রহী হয়ে ওঠেন−এমনটাও বিরল নয়। আসলে প্রকাশনাজগতে পেশাদারির পরিবর্তে চলছে এক চরম নৈরাজ্য। তারপরও যে কিছু ভালো বই বেরোচ্ছে, সেটাই বিস্ময়ের।

লেখকদের কল্যাণে, লেখকদের স্বার্থে কোনো উদ্যোগ যদি গ্রহণ করা না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে ভালো বই প্রকাশ আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টরা কি কিছু ভাববেন?

পুনশ্চ: অনেকে এ কথাও বলেন যে বইয়ের পাঠকই কমে যাচ্ছে, তার আবার লেখক! যদি তা-ই হয়, তবে পাঠক বাড়ানোর উদ্যোগও নিতে হবে। কিন্তু লেখকের স্বার্থকে উপেক্ষা করা চলবে না।

লেখক:  চিররঞ্জন সরকার, গবেষক ও কলামিস্ট 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

নিজের প্রস্রাব পান করে ‘আশিকি’ অভিনেত্রী অনু আগারওয়াল বললেন, ‘আহা অমৃত’

মে. জে. ফজলুরের সেভেন সিস্টার্স দখলের মন্তব্য সমর্থন করে না সরকার: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে স্টারলিংকের প্রস্তাবিত কার্যক্রমের বিস্তারিত চায় ভারত

নির্দেশনা মানেননি পাইলট, মদিনা-ঢাকা ফ্লাইটকে নামতে হলো সিলেটে

গায়ে কেরোসিন ঢেলে কলেজছাত্রীর আত্মহনন, পলাতক ইমাম গ্রেপ্তার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত