Ajker Patrika

ফ্লোরা হল্যান্ড ফুল-বাণিজ্যের রাজ্য

শাইখ সিরাজ
ফ্লোরা হল্যান্ড ফুল-বাণিজ্যের রাজ্য

আমাদের দেশে ক্রমেই বড় হচ্ছে ফুলের বাজার। বাড়ছে ফুলের চাষ। ফুল-বাণিজ্য নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছেন অনেক শিল্পোদ্যোক্তাও। ২০১৫ সালে নেদারল্যান্ডসের ফুল-বাণিজ্য সম্পর্কে জানতে সেখানকার সবচেয়ে বড় অকশন সেন্টারে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল।

নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টারডাম থেকে ১৩ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে আলসমিয়ের। সারা পৃথিবীতে যাঁরা বড় পরিসরে ফুলের চাষ করেন, তাঁদের কাছে পরিচিত এক ক্ষেত্র। ফুল-বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত মানুষের কাছে এক স্বপ্নক্ষেত্র। ফুলের এক অন্য রকম রাজ্য ফ্লোরা হল্যান্ড। ফুলের অন্যতম বৃহৎ অকশন সেন্টার।সারা বিশ্বে যে জায়গা থেকে ফুল রপ্তানি হয়। সামনাসামনি এ রকম একটি অকশন দেখা এক অন্য রকম অভিজ্ঞতা। মনে পড়ে চীনের কুনমিংয়ের কথা। ২০০৭ সালের কথা। কী সুবিশাল ছিল অকশন মার্কেট। সেবারে রাতে অকশনে গিয়েছিলাম। ওদের অকশনটা হয় রাতেই। আর ফ্লোরা হল্যান্ডে সকালেই শুরু। একদম সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৬টা পর্যন্ত চলে। ফ্লোরা হল্যান্ডের অভ্যর্থনায় পৌঁছে দেখলাম ফুলের ছবিসংবলিত কার্ড, রঙিন পুতুল। আমাদের ডাচ সঙ্গী হেলেন রুহি এবং হানেকে ভান হুফ। আর ফ্লোরা হল্যান্ডের পক্ষ থেকে গাইড হিসেবে এলেন নাতাশা। বিশেষ জুতা পরতে হলো। লোহার পাত বসানো জুতার মাথায়, যাতে অকশন ফ্লোরে, ফুল বহনকারী ছোট ছোট কার্ট দুর্ঘটনাবশত পায়ের ওপর দিয়ে গেলেও আঘাত না লাগে। ছোট অভ্যর্থনা পেরিয়ে ভেতরে গেলেই বিশাল কর্মযজ্ঞ। দোতলা থেকে নিচে তাকালে মনে হতে পারে অবাস্তব বা স্বপ্নের জগতে এসে পড়েছি। শত শত ফুলের ট্রলি নিয়ে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে ফ্লোরে। দৃশ্যটি ওপর থেকে দেখে মনে হচ্ছিল ভিডিও গেমসের একটি পর্দা, যেখানে অসংখ্য গাড়ি ছুটছে।

এক কিলোমিটার লম্বা সেফটি ব্রিজ ধরে মূল অকশন রুমের দিকে এগিয়ে গেলে চোখে পড়ল নিচে সারি সারি কার্টে ফুল এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে নেওয়া হচ্ছে।অসাধারণ কর্মযজ্ঞ। অবশেষে পৌঁছালাম অকশন রুমে। যেখানে সবাই ডিজিটালি কানেকটেড পুরো বিশ্বের সঙ্গে। একটি ক্লকের মাধ্যমে অকশন চলছে। তবে নাতাশা জানিয়েছিল এখানে যে ৩০০ জন বিডার আছেন, তাঁদের সবাইকে অন্তত বছরখানেক সময় ব্যয় করে শিখতে হয়েছে এই নিখুঁত হিসাব-নিকাশ। এ ছাড়া ফ্লোরা হল্যান্ডে আছে স্মল অকশন রুম। একই সঙ্গে বাসা থেকে বসেও বিড করতে পারেন, এমন বিডার যাঁরা, সবাই স্মার্টকার্ড হোল্ডার। পুরো বিশ্বে ফ্লোরা হল্যান্ড হলো প্ল্যান্ট এবং ফুলের অন্যতম বৃহৎ ট্রেডিং সেন্টার।

মনে পড়ছে জাপানের কথা। ২০০৪ সাল। জাপানের রাজধানী টোকিওতে পৃথিবীর বৃহৎ গাড়ির অকশন দেখেছি। যেখানে অকশন হলে শত শত বিডার কম্পিউটারে অংশ নিচ্ছেন নিলামে। বিষয়টা বেশ রোমাঞ্চকর। চীনের কুনমিংয়ের ফুল অকশন কেন্দ্রও আয়তনে বেশ বড়, কিন্তু ফ্লোরা হল্যান্ডের তুলনায় তা একেবারে ছোট। ফ্লোরা হল্যান্ডের অকশনটির ইতিহাস শত বছরের পুরোনো। ফুল উৎপাদকেরা সবাই সমবায়ের আওতাধীন এবং তাঁদের অর্থেই চলে এই আন্তর্জাতিক অকশন। ৯৯ শতাংশ ফুলচাষি হল্যান্ডের। নাতাশা বলছিল, প্রতিদিন ২ কোটি ১০ লাখ ফুল বিকিকিনি হয় এখানে। আর বছর শেষে ফুল-বাণিজ্যের অঙ্কটি বেশ বড়। ৪০০ কোটি ৩০ লাখ ইউরো। বাংলাদেশি টাকায় যা প্রায় ৩৬ হাজার কোটি। কম্পিউটার স্ক্রিনে, ল্যাপটপে, মোবাইলে মানুষ ফুল দেখে সরাসরি। আর তখনই নিলাম করে এবং প্রযুক্তি ঠিক করে দেয় কত দামে কে কিনতে পারছে ফুল। কীভাবে এবং কবেই বা শিপিং হবে ফুল; সব তথ্য ও গবেষণাই আছে এখানে।

বাংলাদেশের দিকে একটু দৃষ্টি দিই। বাংলাদেশের ফুল-বাণিজ্যে কার্ট ফ্লাওয়ারের যে চল আমরা এখন দেখি বাজারে, তা আমাদের কৃষকদের অবদান। নিজস্ব মেধা, মনন আর বুদ্ধি খাটিয়ে তাঁরা এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। তবে এর পেছনে একজন মানুষের অবদান ছিল। এই মুহূর্তে আমার মনে পড়ছে বেলজিয়ান উন্নয়নকর্মী জন পল পেরিনের কথা। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ইউরোপিয়ান কার্ট ফ্লাওয়ার যেমন ক্রিসেনথিমাম, জারবেরা, কার্নেশান, টিউলিপ, এ ফুলগুলো যার হাত ধরে চাষ এবং পরে সম্প্রসারিত হয়, তার প্রধান কারিগর পেরিন। আনন্দ-বিনোদনে, নানা উৎসব আয়োজনে ফুল দেওয়ার রেওয়াজ আছে বিশ্বব্যাপী।

বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। বিশেষ দিন, উৎসবকে কেন্দ্র করে বাণিজ্যটা একেবারে কম নয়। বেশির ভাগ ফুল চলে আসে ঢাকায়। বছর চারেক আগে বাংলাদেশে নিযুক্ত আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনাকে নিয়ে গিয়েছিলাম বাংলাদেশে ফুলের স্বর্গরাজ্য যশোরের গদখালীতে। গণমাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে তুলে ধরছি বাংলাদেশের ফুল উৎপাদন ও বাণিজ্যের প্রেক্ষাপট। বারবার যে কথা বলেছি গ্রিনহাউস, স্টোরেজ এবং উন্নত প্রযুক্তি—আমাদের ফুল উৎপাদন ও বাণিজ্যের সঙ্গে এখন একটু একটু করে যুক্ত হচ্ছে এসব।

নেদারল্যান্ডসের ফুল-বাণিজ্য এত বড় হওয়ার পেছনে শুধু চাষিরাই নন, প্রযুক্তি এবং প্রশিক্ষণের একটা বিশাল অবদান রয়েছে। নইলে ফুল নিয়ে এত বড় বাণিজ্য-বিপ্লব ঘটত না সেখানে। ভাবতেই অবাক লাগে আমাদের ফুলচাষি গদখালীর শের আলী সেই নেদারল্যান্ডস ঘুরতে গিয়েছিলেন বহু আগে। তিনি সেখান থেকে ফিরে শুধু সহজাত জ্ঞান আর যা দেখেছেন তাই দিয়ে বানিয়ে ফেললেন স্থানীয় প্রযুক্তির গ্রিনহাউস। তা বিশ্বমানের এবং শতভাগ সঠিক পদ্ধতিতে নির্মিত।

গোটা গ্রামে এখন শের আলীর প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে। কাজ চালানোর জন্য শের আলীর ওই গ্রিনহাউস অনেক দামি। সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি সহযোগিতায় পরীক্ষামূলক গ্রিনহাউসে ফুল চাষ করার সুযোগ পেয়েছেন কয়েকজন কৃষক। সরকারের পক্ষ থেকে এসব গুরুত্বপূর্ণ কৃষি বাণিজ্যিক খাতের প্রতি নজর দেওয়া উচিত। তাহলে ফুল আমদানি করার বদলে আমরা রপ্তানির একটা বড় জায়গা দখল করে নিতে পারব বলে বিশ্বাস এবং আন্তর্জাতিক মানে ফুলের বাণিজ্যকে প্রসারিত করার সুযোগও সৃষ্টি হবে।

ফ্লোরা হল্যান্ডে ফিরে আসা যাক। চারদিকে এক বর্গকিলোমিটার জায়গা। ৩০টি অকশনের এন্ট্রি পয়েন্টে ফুলভর্তি কনটেইনার লরি দাঁড়িয়ে আছে। ডিজিটাল ব্যবস্থাটি আসার আগে অতীতে একটা পুল টেবিলে ফুল রাখা হতো আর বিডাররা হাতে তুলে নিত ফুল। এরপর শুরু হতো বিকিকিনি। ওপর থেকে আমরা নেমে এলাম ফ্লোরে। এখানে এসেই বোঝা গেল মজবুত জুতা পরার কারণটি কী। ফুল নিয়ে চলমান স্বয়ংক্রিয় এই ট্রলিগুলোর ফাঁকে খুব সাবধানে পার হতে হয় পথ।

কার্টগুলো এত দ্রুত এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে যে কোনো সময় পায়ে আঘাতের শঙ্কা নয় শুধু, রীতিমতো জীবন বিপন্ন হওয়ার ঝুঁকিও থেকে যায়। সারি সারি কার্ট বা চলমান ট্রলিতে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চলে যাচ্ছে ফুল। যেখান দিয়ে ফুলগুলো নিয়ে যাচ্ছে, সে জায়গাটি তারা বলছে হাইওয়ে। বেশ বিপজ্জনক জায়গা। সতর্কতার ঘাটতি হলেই বিপদ নিশ্চিত। হাজার হাজার কার্ট চলে ভেতরে। ফ্লোরে কাজ করছেন ১৩ হাজার শ্রমিক। এখানে কুলিং এরিয়াটি বিশাল। ৪৫ হাজার স্কয়ার মিটার। ফ্লোর টিম ম্যানেজার ইয়োর্গেন স্লোবের সঙ্গে পরিচয় হলো। তিনি ১৯ বছর ধরে কাজ করছেন ফ্লোরা হল্যান্ডে। বললেন, আগে দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফে কাজ করতেন। সেখানেও দায়িত্ব ছিল ডিস্ট্রিবিউশন চ্যানেলে। সেই অভিজ্ঞতাই তাঁকে এখানে চাকরি মিলিয়েছে। ইয়োর্গেনের অধীনে ৪৬০ জন শ্রমিক কাজ করছেন। ৩০০ কন্ট্রাক্টে আর বাকি ১৬০ জন এজেন্সি থেকে হায়ার করা।

মজার বিষয়, এখানে ফুলের ভাস-লাইফ বা খেত থেকে সংগ্রহের পর তা সতেজ থাকার সময় পরীক্ষা করা হয়। দেখা হয় কত দিন ফুল টিকতে পারে। কিউ আর কোডও রয়েছে, যেখানে একটি ফুলের জীবন-ইতিহাসের সব তথ্য আছে। কেউ যদি বলে কোনো ফুল তার চার দিন পর দরকার, তখন দেখা হয় সেই ফুল আদৌ চার দিন টিকবে কি না। সে অনুযায়ী অর্ডার রাখা হয়। ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাখা হয় ফুল। সব মিলিয়ে বিশাল এক কর্মযজ্ঞ। আজ যদি উগান্ডা থেকে অর্ডার আসে তা ঘণ্টা চারেকের মধ্যে নিশ্চিত পৌঁছাবে। এ রকম একেকটি দেশের জন্য একেক সময় ঠিক করা আছে।

নেদারল্যান্ডসের ফুল-বাণিজ্যের ইতিহাস অনেক পুরোনো। আলসমিয়ের এলাকায় অবস্থিত ফুলের এই নিলাম কেন্দ্র বা অকশন হাউসও ছাড়িয়ে গেছে ১০০ বছরের ইতিহাস। কিন্তু দিনের পর দিন এখানে বাণিজ্যের প্রসার ঘটেই চলেছে। বাংলাদেশের চাষিদের কাছে ফ্লোরা হল্যান্ডের বিশাল এই কর্মযজ্ঞ সবচেয়ে আশান্বিত হওয়ার মতো বিষয় হতে পারে। আমাদের দেশে বহু উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছেন। যদি সঠিক প্রযুক্তি এবং প্রশিক্ষণ তাঁরা পান, তাহলে বর্তমান অবস্থা পাল্টে যাবে দারুণভাবে। উন্নয়ন নিশ্চিত করতে তাই চাই সঠিক পরিকল্পনা আর প্রযুক্তির সমন্বয়।

লেখক: পরিচালক ও বার্তাপ্রধান চ্যানেল আই

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত