Ajker Patrika

রাঘববোয়ালের রোষেই চাকরি হারিয়েছি

জমির উদ্দিন
আপডেট : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১০: ৫৫
রাঘববোয়ালের রোষেই চাকরি হারিয়েছি

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। তাঁকে চাকরিচ্যুত করা মেনে নিতে পারেননি সংস্থার অনেক কর্মী। এর প্রতিবাদে গত বৃহস্পতিবার ২১টি জেলায় মানববন্ধন হয়েছে। মানববন্ধন হয়েছে ঢাকায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সামনেও। শরীফ উদ্দিন এখন নিরাপদ স্থানে অবস্থান করছেন। সেখান থেকে গতকাল কথা বলেন আজকের পত্রিকার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক জমির উদ্দিন

আজকের পত্রিকা: আপনার চাকরিচ্যুতির প্রতিবাদে অনেক সহকর্মী প্রতিবাদ করেছেন। তাঁরা বলেছেন, আপনি দক্ষ ও পরিশ্রমী কর্মকর্তা। আপনাকে অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। আপনি নিজে কী মনে করেন, কেন আপনাকে চাকরিচ্যুত করা হলো?
শরীফ উদ্দিন: কক্সবাজারের ঘটনা তো আছেই। এর পাশাপাশি কর্ণফুলী গ্যাসের সংযোগ ও অনিয়ম নিয়ে দুর্নীতির মামলাও করেছি। এক সাবেক এমপিপুত্র এতে জড়িত ছিলেন। তাঁর বাড়ি কর্ণফুলী গ্যাসের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) বাড়ির পাশে। তিনি সন্দেহ করেছেন আমি তাঁর বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করছি। এসব কারণে আমি অনেক প্রভাবশালীর রোষানলে পড়ি।

আজকের পত্রিকা: আপনি কি আগে এসব টের পেয়েছিলেন, কোনো ধরনের হুমকি পেয়েছিলেন?
শরীফ উদ্দিন: কর্ণফুলী গ্যাসের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আইয়ুব খান গত ৩০ জানুয়ারি এক লোক সঙ্গে নিয়ে আমার বাসায় এসে হুমকি দিয়ে যান। বিষয়টি আমি কমিশন ও স্থানীয় প্রশাসনকে জানিয়েছি। ওই সময় তাঁরা বলেছিলেন, আমাকে এক সপ্তাহের মধ্যে চাকরিচ্যুত করবেন। এই হুমকি দেওয়ার পর এক সপ্তাহ নয়, ১৬ দিনের মাথায় আমার চাকরি গেল।

আজকের পত্রিকা: কক্সবাজার থেকে আপনাকে বদলি করা হলো কেন? এর পেছনে কোনো ঘটনা ছিল? 
শরীফ: কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের এনআইডি দেওয়ার চক্রে নির্বাচন কমিশনের জড়িত থাকার বিষয়টি আমার তদন্তে উঠে আসে। চট্টগ্রাম থেকে বদলির পরদিন সর্বশেষ ২০২১ সালের ১৭ জুন যে মামলা করি সেখানে নির্বাচন কমিশনের একজন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে অনেককে আসামি করা হয়। রোহিঙ্গা জালিয়াতির বিষয়টি তদন্তে আসায় অনেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার রোষানলে পড়ি।

আজকের পত্রিকা: কক্সবাজারের কয়েকটি প্রকল্পে দুর্নীতি নিয়েও আপনি তদন্ত করেছিলেন। সে সব তদন্তে আসলে কী পেয়েছিলেন? 
শরীফ: কক্সবাজারে ৭২টি মেগা প্রকল্পের মধ্যে ছয়টি প্রকল্প নিয়ে আমি তদন্ত করেছি। এর মধ্যে একটি হলো কক্সবাজার পৌরসভার পানি শোধনাগার প্রকল্প। ওই প্রকল্পে মূলত লাভবান হয়েছেন কক্সবাজারের মেয়র মুজিব এবং তাঁর পরিবারের লোকজন। কারণ, এই প্রকল্পটি যেখানে হচ্ছে সেখানে হওয়ার কথা ছিল না। বাঁকখালী নদীর উত্তর পাশে প্রকল্পটি হওয়ার কথা ছিল। সেই নির্ধারিত জায়গায় প্রকল্পটি হলে তিন কোটি টাকার মধ্যে কাজ শেষ করা সম্ভব হতো। কিন্তু পরে সেটা বাঁকখালী নদীর দক্ষিণ পাশে নিয়ে যাওয়া হয়। এতে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫ কোটি টাকা। এটা করা হয়েছে ব্যক্তিগত লাভের কথা মাথায় রেখে।

আজকের পত্রিকা: কক্সবাজারের মেয়র মুজিব শুধু একাই এই কাজ করেছেন, না অন্য কেউ এর সঙ্গে ছিল? 
শরীফ: এর সঙ্গে বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী জড়িত ছিলেন। মেয়র হওয়ার পর এই জায়গাগুলো কিনে নেন মুজিব। খুব কম মূল্যে তিনি সেগুলো কিনে নেন। এটা আমার সাংঘর্ষিক বলে মনে হয়েছে। আমার তদন্তে সেটা তুলে ধরেছি। মজার বিষয়, প্রকল্পের এই জায়গাগুলো ছিল জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে। এসি ল্যান্ডের তত্ত্বাবধানে থাকা অবস্থায় জায়গাগুলো মিউটেশন করা হয়। ইজারা নেওয়ার পর মেয়রের শ্যালক মিজানুর রহমান তাঁর নামে আবার নাম জারি করেন। অর্থাৎ সরকার থেকে যে জমি নিলামে নেওয়া হলো, সেটা তাঁর নামে নাম জারি করা হলো। এটি খুবই হাস্যকর।

আজকের পত্রিকা: আপনি বলছেন, তখন থেকেই চক্রটি আপনার পেছনে লেগে ছিল? 
শরীফ: জায়গাগুলোর বিরুদ্ধে ওয়ারিশের মামলা চলমান। মালিক ও ভুক্তভোগীরা হাইকোর্টে একটি রিটও করেছেন। মহামান্য আদালত নিষ্পত্তি করার নির্দেশও দিয়েছেন। আমি তাঁদের টাকাগুলো নো ডেভিট করি। তখন থেকেই তাঁরা আমার বিরুদ্ধে লাগেন। তাঁরা প্রচার করেন, সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প আমি বাধাগ্রস্ত করেছি।

আজকের পত্রিকা: এখন আপনি কি মনে করছেন চাকরিচ্যুত করার পেছনে তাঁরা কলকাটি নেড়েছেন? 
শরীফ: অবশ্যই। তাঁরা আমার ওপর হামলাও করেছেন। ২০২০ সাল থেকে তাঁরা আমার কাজে চাপ সৃষ্টি করতেন। আমি কোনো কিছু পাত্তা না দিয়ে আমার তদন্তকাজ চালিয়ে গেছি। কমিশনে তাঁদের বিরুদ্ধে রিপোর্ট দিয়েছি। এতে তাঁরা ক্ষিপ্ত হয়েছেন। আমি কীভাবে চাকরি করি তা দেখে নেওয়ার হুমকি দিতেন। তাদের চাপ কমিশন পর্যন্ত চলে গেছে। আমার বিশ্বাস, এসব চাপের কারণেই আমাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।

আজকের পত্রিকা: কিন্তু আপনার প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে আপনার বিরুদ্ধে কমিশনে ১৯টি অভিযোগ আছে। এসব কি জানতেন? 
শরীফ: এখন অনেক কিছু বলবে, অনেক কিছুই দেখতে পাবেন। কমিশনে আমার বিরুদ্ধে যাঁরা অভিযোগ দিয়েছেন, তাঁরা সবাই দুর্নীতিবাজ। কেউ আমার মামলার আসামি আর কারও নাম তদন্তে এসেছে। এর বাইরে কেউ নেই। তাঁরা অভিযোগ করতেই পারেন।

আজকের পত্রিকা: কিন্তু দুদক সচিব সাংবাদিকদের বলেছেন, আপনি জব্দ করা ৯৪ লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেননি। নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন। সেটা কি আইন ভঙ্গ করেননি? 
শরীফ: দেখুন, টাকা জব্দ করেছে র‍্যাব এবং একটি গোয়েন্দা সংস্থা। আমি নিজে কোনো টাকা জব্দ করিনি। ২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি টাকাগুলো জব্দ করা হয়। মামলার তদন্তভার পাওয়ার পর ওই বছরের ১৯ মার্চ আমি মামলা করি। দুটি গাড়িতে আলামত, টাকাসহ চট্টগ্রাম দুদক অফিসে নিয়ে আসি। আমি সেই টাকা নিয়ে এসে অফিসের ভল্টে রেখেছি, সেটা আমার অফিস জানে।

আজকের পত্রিকা: বদলি হওয়ার সময় সেই টাকা কী করলেন? 
শরীফ: পটুয়াখালীতে বদলি হওয়ার আগে আলামত ও টাকাসহ তখনকার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে চালানসহ বুঝিয়ে দিয়েছি। আমার কাছে সব ডকুমেন্ট আছে। তাহলে সেই টাকা আমার কাছে থাকল কী করে? আমাদের অফিসের অন্যান্য কর্মকর্তার কাছেও এ ধরনের আলামতের টাকা থাকে। আমরা যখন আদালতে চার্জশিট দিই তখন টাকাগুলো সাবমিট করি। এখানে টাকাগুলো আত্মসাৎ করার কোনো প্রশ্নই উঠে না।

আজকের পত্রিকা: জব্দ করা টাকা কি এভাবে নিজের কাছে রাখা যায়? আইনে কী বলে? 
শরীফ: এই মামলায় মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশনা আছে যে ২০২১ সালের ৩০ জুনের মধ্যে চার্জশিট দিতে হবে। সার্ভেয়ার ওয়াসিমের জামিনের একটি প্রসঙ্গে আদালত এই নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সেই নির্দেশনাকে সামনে রেখে আমি দ্রুত এই মামলায় চার্জশিট দিতে চেষ্টা করি। পরবর্তীকালে যখন তদন্ত করে রিপোর্ট জমা দিই, তাতে আমি উল্লেখ করেছি আমার কাছে থাকা টাকাগুলো চালানমূলে আমি আমার কর্তৃপক্ষের কাছে বুঝিয়ে দিয়েছি। এরপর আমার পরে যিনি তদন্ত কর্মকর্তা নিযুক্ত হয়েছেন, তিনি গত বছরের নভেম্বর অথবা ডিসেম্বরে টাকা জমা দিয়েছেন। এখানে টাকা আত্মসাতের কোনো ঘটনা ঘটেনি।

আজকের পত্রিকা: দুদক থেকে আপনার বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ ছিল, কমিশনের অনুমোদন ছাড়া আপনি বেলায়েত হোসেনের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নো ডেভিট করেন। এটা কি ঠিক? 
শরীফ: দেখুন, সার্ভেয়ার ওয়াসিম হলেন পিবিআই প্রকল্পের প্রথম সুবিধাভোগী। পরে দুর্নীতিতে বেলায়েত হোসেনের নাম আসে। তিনি কিন্তু জমির মালিক না। তাঁর জায়গা পিবিআই প্রকল্পের অনেক দূরে। জাল কাগজপত্র তৈরি করে বেলায়েত টাকা উত্তোলন করেন। আমি তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অনুরোধপত্র দিই। আমি উল্লেখ করেছি, তাঁর টাকাগুলো মানি লন্ডারিংয়ে জড়িত। নো ডেভিট করার জন্য অনুরোধ করি।

আজকের পত্রিকা: এজন্য কি কমিশনের অনুমতি নিয়েছিলেন? 
শরীফ: অবশ্যই এর আগে আমি দুদক কমিশনকে বিষয়টি অবহিত করি এবং অনুমোদন নিই। আমি যেহেতু তদন্ত করেছি, তাই টাকাগুলো যাতে তুলে নিতে না পারে সেজন্য ব্যাংকে অনুরোধপত্র দিয়েছি। সেই টাকাগুলো তো আর আমার পকেটে নেই।

আজকের পত্রিকা: চাকরিচ্যুতির পর এখন আপনি কী করতে চাইছেন? 
শরীফ: দেখুন, আমি মনে করি আমাকে অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। আমি এর প্রতিকার চেয়ে আদালতে যাব। আশা করি আদালত থেকে আমি ন্যায়বিচার পাব। 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত