Ajker Patrika

সম্প্রতি বিএনপি: অস্থিরতায় যত কথা

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
সম্প্রতি বিএনপি: অস্থিরতায় যত কথা

৭ জানুয়ারির আগের ঘটনাবলি সবারই জানা। নির্বাচনের পর বিএনপির নেতৃবৃন্দ আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন। যাঁরা কারাবন্দী ছিলেন, তাঁদের প্রায় সবাই জামিনে বের হয়ে এসেছেন। ২৮ অক্টোবরের আগে দলীয় নেতা-কর্মীরা যতটা সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন, ২৮ অক্টোবরের কাণ্ডজ্ঞানহীন উন্মত্ততার কারণে, নির্বাচন বর্জন, প্রতিরোধ ও অগ্নিসংযোগের ধারায় ফিরে যাওয়ার কারণে সরকারের ধরপাকড়ে ছন্নছাড়া হয়ে পড়ে বিএনপি। নির্বাচন বর্জনের আওয়াজ গর্জনেই মিশে গেছে। নির্বাচন যথারীতি হয়েও গেছে। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার সঙ্গে সরকার গঠন করে। বিদেশিরা শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এর ফলে বিএনপির সব কৌশলই মাঠে মারা গেছে। এখন সরকারের বিরুদ্ধে নানা কথা বলা যাবে, কিন্তু আন্দোলন গড়ে তোলা মোটের ওপর প্রায় অসম্ভব। সরকার নির্বাচনী ইশতেহারে যে ১১টি সমস্যা চিহ্নিত করেছে, সেগুলো বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হলে সরকারের বিরুদ্ধে মাঠ উত্তপ্ত করার তেমন কোনো ইস্যু থাকবে না। আপাতত দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও দুর্নীতি সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা গেলে মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠার সুযোগ থাকবে না। এমনিতে বাংলাদেশে রমজান উপলক্ষে দ্রব্যমূল্যের ওঠানামা ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের একটি জনভোগান্তিমূলক কারবার! এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। আগে থেকেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি বিরাজ করছিল। বিদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যসামগ্রীর দাম ডলার-সংকটের কারণে অস্বাভাবিকভাবে ওঠানামা করছিল। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফা ও লাভ করার কারসাজি। ফলে রমজানের আগে-আগে দ্রব্যমূল্য নিয়ে বাজার গরম হয়ে উঠেছিল। সেটি এখন অনেকটাই কমে এসেছে। ঈদে কিছুটা আবার ঝাঁকুনি দেবে, তবে ঈদের পর আবার মোটামুটি স্থিতিশীল পর্যায়ে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।

এ অবস্থায় বিএনপি ও সমমনা কয়েকটি দল দেশে ঈদের পরে আন্দোলন গড়ে তোলার কথা বললেও বাস্তবে তা কতটা সম্ভব হবে তা তখন দেখা যাবে। আপাতত বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে গত আন্দোলন ও নির্বাচন নিয়ে যেসব জিজ্ঞাসা রয়েছে, সেগুলোর উত্তর অনেকেই জানতে চায়, বুঝতে চায়। আবার সামনে উপজেলাসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে বিএনপির সিদ্ধান্ত কী হবে, সেটিও অনেকের জানার আগ্রহ যে রয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দলের নীতিনির্ধারণী সভায় সেই সব প্রশ্নের যুক্তিসংগত জবাব কতটা দেবে, তার ওপর সামনের দিনগুলোতে দলের কার্যক্রমে নেতা-কর্মীদের যুক্ত হওয়া অনেকটাই নির্ভর করবে। আপাতত বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতা বক্তৃতা-বিবৃতিতে যেসব কথা বলছেন, তা নিয়ে দলের ভেতরে ও বাইরে শুভানুধ্যায়ীদের মধ্যে নানা জিজ্ঞাসা এবং হতাশাও তৈরি হয়েছে। বিশেষত দলের মুখপাত্র রুহুল কবির রিজভী ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দিয়ে নিজের চাদর ছুড়ে ফেলার যে কাণ্ড ঘটিয়েছেন, তা নিয়ে দলের ভেতরেই যেমন জিজ্ঞাসা রয়েছে, দলের বাইরে বিএনপির শুভানুধ্যায়ী বিভিন্ন পেশার মানুষের মধ্যে শুধু হতাশাই নয়, ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কাও সৃষ্টি হয়েছে। দলের কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে মুখপাত্র হয়ে রিজভী সাহেব যা করেছেন, তাতে তাঁর ভারতবিরোধিতার মনোবৃত্তির প্রকাশ ছাড়া আর কিছু ভাবা যায় না। দেশের ব্যবসায়ী মহলই শুধু নয়, সাধারণ মানুষও জানে যে ভারত নিকটতম প্রতিবেশী এবং অনেক বড় অর্থনীতির দেশ। বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনৈতিক সম্পর্ক ভারতের সঙ্গে আমাদের জন্য সুবিধাজনক। আমরা ছোট দেশ, কিন্তু জনসংখ্যা অনেক বেশি। সে কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর মধ্যে এমনকি কাঁচা শাক-সবজিও ভারত থেকে আমদানি করে আমাদের চাহিদা পূরণ করতে হয়। বর্তমান দুনিয়ায় নিকটতম কোনো প্রতিবেশীকে বয়কট করার এমন কোনো নজির নেই। তা ছাড়া ভারতের সঙ্গে আমাদের কোনো যুদ্ধবিগ্রহ চলছে না, খারাপ সম্পর্কও বিরাজ করছে না। অনেক পুরোনো বেশ কিছু সমস্যা এরই মধ্যে সমাধানও করা হয়েছে। বাকি যে কটি রয়েছে, সেগুলোও আলোচনার টেবিলে রয়েছে। সুতরাং, ভারতের পণ্য বর্জনের ডাক দিয়ে উভয় দেশের মধ্যে বৈরী সম্পর্ক গড়ে তোলার পরিণতি বাংলাদেশের জন্য খুব একটা সুখের হবে না। উগ্র হঠকারী ছোট ছোট দল বা ব্যক্তির সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে টানাপোড়েন থাকলে তাতে কিছু যায় আসে না। কিন্তু ক্ষমতাপ্রত্যাশী রাজনৈতিক দল যখন এ ধরনের কোনো ডাকে সায় দেয়, তখন সেই দেশের বন্ধুত্ব দলটি কোনোকালেই আসা করতে পারে না। নির্বাচনের আগে বিএনপি সব সময় ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক আছে বলে দাবি করে থাকে, নেতারা নয়াদিল্লি সফর করে সে কথা জানান দিয়ে আসেন। কিন্তু নির্বাচনে হেরে গেলে ভারতকে হারার জন্য দায়ী করে, আবার জয়লাভ করলে উচ্চবাচ্য করে না, ভারতের সঙ্গে বাহ্যিক সম্পর্ক দেখানোর চেষ্টা করে থাকে। ভারতের নীতিনির্ধারকেরা নিশ্চয়ই বিএনপির দ্বৈত আচরণ লক্ষ করতে ভুল করেন না।

স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে দলের মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘রক্তের দামে কেনা বাংলাদেশ কোনো দেশের প্রভুত্ব মানবে না। কোনো দেশ যদি মনে করে আমাদের ওপরে প্রভুত্ব করবে, তাদের জেনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের মানুষ কোনো দিন সেই প্রভুত্ব স্বীকার করেনি। মোগল আমলে করেনি, ব্রিটিশ আমলে করেনি, পাকিস্তান আমলে করেনি, এখনো করবে না।’ বুঝতে কষ্ট হয় না, এমন বক্তব্য তিনি মূলত ভারতকেই উদ্দেশ্য করে বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা অন্য কোনো রাষ্ট্রকে উদ্দেশ্য করে নয়। মির্জা ফখরুল সেদিনের বক্তৃতায় জনগণ, ছাত্র ও তরুণদের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়েছেন। অথচ ড. মঈন খান কিছুদিন আগেই বলেছেন, ‘আমরা ভারতের বন্ধুত্ব চাই, নির্দিষ্ট কোনো দল বা ব্যক্তিকে ভারত সমর্থন করুক সেটা চাই না।’

বিএনপির নেতৃবৃন্দ ভারতকে নিয়ে যেসব কথাবার্তা বলেন, তা কোনো একটি নামসর্বস্ব দলের নেতা-কর্মীরা বললে তেমন গুরুত্ব দেওয়ার কিছু থাকে না। কিন্তু বিএনপির মতো বড় দলের বড় নেতারা যখন ভারতকে উদ্দেশ্য করে এমন সব কথা বলেন, যেগুলো দেশের অভ্যন্তরে ভারতবিরোধিতাকেই উসকে দিতে সাহায্য করে, ভারতের সঙ্গে সেই দলের সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কিংবা আস্থা সৃষ্টির সুযোগ রাখে না, তখন এর দায় কার ওপর বর্তায়? বিএনপি ভারতীয় পণ্য বর্জনের দলীয় কোনো সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না আবার এটিকে সামাজিক আন্দোলনের বিষয় হিসেবে অভিহিত করে সেটিকে সেভাবেই চলতে দেওয়ার পক্ষে যখন মত দেয়, তখন বুঝতে বাকি থাকে না যে এই সামাজিক আন্দোলন বিএনপিরই রাজনৈতিক ‘ঔরসজাত সন্তান’, যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ কয়েক দিন ধরে পণ্য বর্জনের তোড়জোড় চালিয়ে যাচ্ছে। এসব আন্দোলনকারী বিদেশে বসে কিংবা দেশের অভ্যন্তরে থেকে ভারতীয় পণ্য বর্জনের নানা প্রচার-অপপ্রচারে ভাসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। বিএনপির নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, ‘ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক সামাজিক আন্দোলন। এটাকে পার্টিজান করা ঠিক নয়, এতে বিএনপির যুক্ত হওয়ার দরকার নেই। সামাজিক আন্দোলন সাধারণ মানুষের বিবেকবোধের আন্দোলন, এটা এভাবেই চলা উচিত।’

আমীর খসরু মাহমুদ ভালো করেই জানেন, এই সামাজিক আন্দোলন কারা করছে। তার পরও তিনি ভারতীয় পণ্য বর্জনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পক্ষেই মত দিয়েছেন। ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক আদৌ বাংলাদেশের ভোক্তাসাধারণ শুনবে না, মানবেও না। সেটি বোঝা সত্ত্বেও বিএনপির কিছু নেতা তাঁদের মনের ক্ষোভ ও ঘৃণা প্রকাশের জন্য এটিকে জিইয়ে রাখতে চান। ভারতবিরোধিতার মানসিকতা পাকিস্তান কাল থেকে যাঁরা লালন-পালন ও পোষণ করে এসেছেন, তাঁরা বাংলাদেশকালেও তাঁদের উপযুক্ত প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বিএনপিতেই স্থান করে নিয়েছেন। বিএনপি নিজেকে গণতন্ত্রের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে দাবি করে এবং আওয়ামী লীগকে ফ্যাসিস্ট, গণতন্ত্র হত্যাকারী, স্বাধীনতাবিরোধী, ভারতীয় অনুগত ইত্যাদি অভিধায় অভিযুক্ত করে। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে মুসলিম লীগ, অতি ডান ও অতি বামরা একই কথা আওয়ামী লীগ সম্পর্কে বলত। ’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তারা বেশির ভাগই অংশ নেয়নি। কিন্তু কথায় কথায় এখন তারা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের কথা বলে, সেটি তাদের ভাষায় আওয়ামী লীগই ধ্বংস করেছে। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২৫ মার্চ মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে বলেছেন, ‘আজ ২৫ মার্চ কালরাত। আওয়ামী লীগ অস্বীকার করতে পারে, এই দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত চেষ্টা করেছে পাকিস্তানের সঙ্গে একটা দফারফা করার জন্য। যখন ব্যর্থ হয়েছে, তখন আমাদের তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যাঁরা ছিলেন, তাঁরা কেউ দেশে থাকেননি। ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। আর মূল নেতা আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানে চলে গেছেন। পরে জিয়াউর রহমানের ঘোষণার মধ্য দিয়ে মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বলেই ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হয়েছে।’

মির্জা ফখরুল নিজেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি। ২৫ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তিনি যা বলেছেন, তা স্বাধীনতাবিরোধী কারও মনগড়া তথ্য হতে পারে। বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে কতটা বানোয়াট গল্পে পরিণত করেছে, তা মহাসচিবের কথা থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায়। বিএনপি কার্যত সংগঠন, আন্দোলন, নির্বাচন এবং স্বাধীনতা দিবস ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে যেসব প্রশ্নের মুখে পড়ে, সেগুলো এড়িয়ে যাওয়ার জন্যই অন্যের ওপর দায় চাপিয়ে যত সব অস্থিরতার প্রকাশ ঘটায়।

লেখক: অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ফরিদপুরে পালিয়ে যাওয়া আ.লীগ নেতা গ্রেপ্তার, থানার ওসিকে বদলি

আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করায় ভারতের উদ্বেগ

বিদায় বিশ্বের দরিদ্রতম প্রেসিডেন্ট

কাতারের রাজপরিবারের দেওয়া বিলাসবহুল বিমান না নেওয়াটা বোকামি: ট্রাম্প

সৌদি আরবের সঙ্গে ১৪২ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রির চুক্তি করে নিজের রেকর্ড ভাঙল যুক্তরাষ্ট্র

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত