ফারুক মেহেদী, ঢাকা
যুদ্ধ ইউক্রেনে। তার রেশ কয়েক হাজার মাইল দূরে বাংলাদেশকে সরাসরি স্পর্শ না করলেও ক্রমে অস্বস্তি বাড়াচ্ছে। বিশেষ করে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে। কারও সাথে বৈরিতা নয়; সবার সাথে বন্ধুত্ব–এই নীতিতে চলা বাংলাদেশ এখন অনিবার্য অর্থনৈতিক ঝুঁকির মুখোমুখি। যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, গম, ভোজ্যতেল, স্টিলসহ অত্যাবশ্যক পণ্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির উত্তাপ লাগতে শুরু করেছে উদীয়মান অর্থনীতির আমদানিনির্ভর এ দেশে।
এ যুদ্ধে ব্যবসায়িক অংশীদার হিসেবে শুধু রাশিয়া-ইউক্রেনের সঙ্গেই বাংলাদেশের বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা নয়; বরং বিশ্বের অন্য দেশের মতো বাংলাদেশের সামগ্রিক আমদানি-রপ্তানি, অর্থনৈতিক কার্যক্রম নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। বাণিজ্য ঘাটতির বাংলাদেশের সামনে তাই অবধারিত ভাবেই বাড়তি ব্যয়ের বোঝা অপেক্ষা করছে। এমন আশঙ্কা উঠে এসেছে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, রয়টার্স, ট্রেডিং ইকোনমিকসসহ বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা আর বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদদের বিশ্লেষণে।
এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে একদিকে বেকারত্ব বাড়বে অন্যদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। বেকারত্ব বাড়া মানেই প্রবৃদ্ধি কম হওয়া। আসলে এটাই স্ট্যাগফ্ল্যাশন। বাংলাদেশ অবশ্যই এ ঝুঁকিতে রয়েছে। একদিকে পণ্য আমদানিতে দামের দিক থেকে একটা নেতিবাচক প্রভাব আছে। বিশেষ করে, তেল, লোহা, অ্যালুমিনিয়ামের দাম অনেক বেড়ে গেছে। এখন ইউরোপে যদি স্ট্যাগফ্ল্যাশন হয়, তবে আমাদের পোশাকের অর্ডার কমে যাবে।
কারণ তারা তো আমাদের পোশাকের ক্রেতা। ফলে একদিকে খরচ বেড়ে যাওয়া, অন্যদিকে আমাদের পণ্যের বিক্রি কমা বা আমাদের আয় কমে যাওয়া। এ দুটোর কারণেই আমাদের মূল্যস্ফীতি বাড়া এবং প্রবৃদ্ধি কমার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন, দেশেও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ালে বাজার এখন মারাত্মকভাবে বিশৃঙ্খল হতে পারে। তাই সরকার ভর্তুকি দিতে পারে। এ ছাড়া ডলারের হার স্থিতিশীল রাখা এবং আমদানি পণ্যের শুল্ক-কর সমন্বয় করেও দাম সহনীয় রাখার চেষ্টা করতে পারে সরকার। সে ক্ষেত্রে বাজারে যাতে এর সুফল আসে, সেদিকেও নজর রাখতে হবে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, রাশিয়া ইউক্রেনের সাথে বাংলাদেশের কমবেশি প্রায় দু শ কোটি ডলারের দ্বিপক্ষীয় আমদানি–রপ্তানি বাণিজ্য রয়েছে। আন্তর্জাতিক লেনদেনের মাধ্যম সুইফটের নিষেধাজ্ঞার কারণে এবং জাহাজ চলাচল বন্ধ থাকায় এর পুরোটাই এখন ঝুঁকিতে। বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যের তুলনায় এই দুই দেশের সঙ্গে বাণিজ্য অপেক্ষাকৃত কম। তবে রাশিয়া ও ইউক্রেনের তেল, গ্যাস, লোহা, স্টিল, গম, ভুট্টা, ভোজ্যতেল, রাসায়নিক, শিল্পের কাঁচামালসহ বহু পণ্যের সাপ্লাই চেইন বা সরবরাহ ব্যবস্থা হুমকিতে পড়ায়, তা সারা বিশ্বে সংকট তৈরি করছে। বন্দর অচল থাকায় পণ্য পরিবহন বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
অন্য দিকে, বিশ্ববাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ অন্যতম শীর্ষে। উদ্যোক্তাদের আশঙ্কা, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের নিষেধাজ্ঞায় পশ্চিমা দেশগুলোর লোকজন জামা-কাপড়ের খরচ কাটছাঁট করতে পারে। অন্যদিকে যুদ্ধ অব্যাহত থাকলে জাহাজের ভাড়া ও বিমা মাশুল বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে পোশাকের দাম বাড়াবে। ফলে বিক্রি আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এরই মধ্যে নানা নিষেধাজ্ঞায় বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ পোশাক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান এইচঅ্যান্ডএম রাশিয়ায় তাদের দেড় শটির মতো আউটলেট বন্ধ করে দিয়েছে। এইচএন্ডএম মোট পোশাক রপ্তানির অর্ধেকই কেনে বাংলাদেশ থেকে। তাদের চাহিদা কমলে, তারাও অর্ডার কমিয়ে দেবে।
বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ নিট পোশাকের উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান মাইক্রো ফাইবার গ্রুপ। এর অন্যতম বড় ক্রেতা জার্মানি। গ্রুপের পরিচালক ড. কামরুজ্জামান কায়সার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘যুদ্ধের কারণে আমরা রপ্তানিকারকরা একটু হুমকিতে পড়ে গেছি। রাশিয়া-ইউক্রেনে আমাদের সরাসরি রপ্তানি নেই। তবে কান টানলে যেমন মাথা আসে, তেমনি আমাদের রপ্তানিতেও ধাক্কা আসতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘আগামী জুলাইয়ের অর্ডার চূড়ান্ত করতে আমাদের সাথে জার্মানির ক্রেতার বসার কথা। তারা এখন বসছে না। কবে বসবে নিশ্চয়তা নেই। জুন পর্যন্ত আমাদের অর্ডার আছে। এরপরের কোনো আর অর্ডার নেই। তা ছাড়া জাহাজ সংকট তীব্র হচ্ছে। রাশিয়ামুখী জাহাজগুলো বিভিন্ন বন্দরে আটকে রয়েছে। এ নিয়ে আমরা খুব চিন্তিত।’
বিশ্ববাজারের তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে জানা যায়, বিশ্বের পণ্য রপ্তানির পাওয়ার হাউস বলা হয় রাশিয়া আর ইউক্রেনকে। বিশ্বের রপ্তানিযোগ্য ৯৬টি পণ্যের মধ্যে ২৪টি পণ্য রপ্তানিতে এগিয়ে রয়েছে ইউক্রেন। ২০২০ সালে দেশটি প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। ইউক্রেন এ সময়ে বিভিন্ন দানাদার শস্যের পাশাপাশি লোহা ও স্টিল রপ্তানি করেছে। পণ্যগুলো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হতো বলে সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক ছিল। এখন যুদ্ধের কারণে বিশ্বে এ পণ্যের ঘাটতি তৈরি হচ্ছে।
ইউক্রেন লোহা রপ্তানিতে বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম। দেশটি সয়াবিন রপ্তানিতে বিশ্বে নবম বৃহত্তম। সরিষার তেল রপ্তানিতে ১৩তম। এ রকম আরও বেশ কিছু নিত্যপণ্য রপ্তানিতে শীর্ষে রয়েছে ইউক্রেন। ইউক্রেনের শীর্ষ আমদানিকারক দেশ চীন। চীন আবার রাশিয়ার ওপর ভীষণভাবে নির্ভরশীল। আর ‘বিশ্বের কারখানা’ চীন ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার প্রভাব সারা বিশ্বে পড়বে।
ইউক্রেন শুধু রপ্তানি করে না; আমদানিতেও করে। দেশটি ২০২০ সালে প্রায় ৫৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। একই ভাবে ইউক্রেনের মতো রাশিয়ায়ও পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে অচলাবস্থা চলছে। এখানে এক দেশের রপ্তানি অর্থই আরেক দেশের আমদানি। ফলে একদিকে সংকট তৈরি হলে, আরেক দিকে এর তীব্রতা অনুভূত হচ্ছে। এর বহুমুখী প্রভাবে অস্থির হয়ে উঠেছে বিশ্ব বাজার ব্যবস্থা।
গত সোমবার রয়টার্স জানায়, যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম ২০০৮ সালের পর সর্বোচ্চ উচ্চতায় গিয়ে প্রতি ব্যারেল ১৪০ ডলারে ঠেকে। যদিও পরে তা কমে ১২৫ ডলারে নেমে এসেছে। তবে ব্যাংক অব আমেরিকার এক পর্যবেক্ষক এবং সিঙ্গাপুরের ওসিবিসি ব্যাংকের অর্থনীতিবিদ হাউই লী মনে করেন, শিগগির তেলের দাম রেকর্ড ২০০ ডলারে উঠবে। জ্বালানি তেল রপ্তানিতে বিশ্বে সৌদি আরবের সঙ্গে নেতৃত্ব দিচ্ছে রাশিয়া। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এ পণ্যটি অন্য সব কিছুর দামে অস্থিরতা তৈরি করছে। ইউরোপের ৪০ শতাংশ গ্যাস সরবরাহ করে থাকে রাশিয়া ও ইউক্রেন। এখন গ্যাসের বিকল্প উৎস খুঁজতে মরিয়া ইউরোপ। তারা কাতারকে প্রস্তাব দিয়েছে গ্যাস সরবরাহের। কাতার এখনো তাদের কোনো আশ্বাস দেয়নি। কাতারও স্বাভাবিকভাবে সরবরাহ সংকটের সুযোগে দাম বাড়িয়ে দিতে পারে। কাতার থেকে বাংলাদেশও এলএনজি আমদানি করছে। ফলে গ্যাসের বাড়তি দাম এসে পড়তে পারে বাংলাদেশের ঘাড়ে। বাংলাদেশে এরই মধ্যে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে বেসরকারি খাতের সিলিন্ডার গ্যাসের দাম বেড়েছে কয়েক দফা। যা সরাসরি ভোক্তার ওপরে পড়ছে।
বাংলাদেশের বিশ্লেষকেরা বলছেন, জ্বালানি তেলের বর্তমান দামই বাংলাদেশের সহ্য করার সক্ষমতা কম। এর আগে ৭৫–৮০ ডলার ওঠার পরই সরকার লোকসান কমাতে দাম সমন্বয় করতে বাধ্য হয়েছে। এ দাম ছাড়িয়ে যাওয়ার পর প্রতিদিন গড়ে ১৯ কোটি টাকা করে লোকসান গুনছে সরকার। এর মধ্যেই বিশ্ববাজারে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে দাম। নতুন দাম সরকার সমন্বয় করবে কিনা এখনো জানা যায়নি। যদি না করে তাহলে বিপুল অঙ্কের টাকা সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে। এতে করোনায় ধুঁকতে থাকা ‘দুর্বল’ রাজস্ব আয়ের অর্থনীতিতে সরকারের ধার বেড়ে যাবে।
আর সরকার ভর্তুকি না দিলে জ্বালানি তেলের দাম বাড়বে। সে ক্ষেত্রে পরিবহন খরচসহ নিত্যপণ্যের দামে রীতিমতো আগুন লেগে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ম তামিম বলেন, ‘যেহেতু আমরা জ্বালানি আমদানি করছি, তাই আমাদের অর্থনীতিতে আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্য ঝুঁকি আর সরবরাহ ঝুঁকি নিতে হয়। তবে এটা ঠিক যে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি হলে তার পরিপ্রেক্ষিতে মূল্যস্ফীতি হয়। দেশে জ্বালানি তেলের দাম একদফা বৃদ্ধির কারণে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। আমার মনে হয়, স্বল্পকালীন সময়ে সরকার ভর্তুকি দিয়ে দাম সমন্বয় করতে পারবে। কিন্তু যদি দীর্ঘ মেয়াদে এ অবস্থা চলতে থাকে তখন কিন্তু সরকারের পক্ষে মূল্যবৃদ্ধি করা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।’
গবেষণা বলছে, শুধু জ্বালানি তেলই নয়; বাড়ছে গমের দামও। গত শুক্রবার পর্যন্ত মাত্র চার দিনের ব্যবধানে বিশ্ববাজারে প্রতি টন গম ৩৪০ ডলার থেকে বেড়ে ৪৯৫ ডলারে উঠেছে। বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ গম রপ্তানিকারক দেশ রাশিয়া ও ইউক্রেনে যুদ্ধের কারণে গমের সরবরাহে সংকট তৈরি হয়েছে। চট্টগ্রাম কাস্টমস বলছে, গত অর্থবছরে এই বন্দর দিয়ে প্রায় সাড়ে ৫৪ লাখ টন গম আমদানি হয়েছে। এর ৪১ শতাংশই এসেছে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। যুদ্ধের কারণে এই ৪১ শতাংশ গম অন্য দেশ থেকে বাড়তি দামে আমদানি করতে হবে বাংলাদেশকে।
বাংলাদেশ অন্যতম লোহা আমদানিকারক দেশ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে এর দাম ছিল প্রতি টন ৫৭০ ডলার। গত রোববার বিশ্ববাজারে এর দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৬৫০ ডলারে। দেশের বাজারে গত সপ্তাহে এর দাম টন প্রতি ৫ হাজার টাকা বেড়ে ৮৩ থেকে ৮৫ হাজার টাকা হয়েছে।
আইএমএফ বলছে, যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ব ‘ভয়ংকর’ অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়বে। আইএমএফ একে চূড়ান্ত অস্বাভাবিক অনিশ্চয়তা বলে অভিহিত করেছে।
যুদ্ধ ইউক্রেনে। তার রেশ কয়েক হাজার মাইল দূরে বাংলাদেশকে সরাসরি স্পর্শ না করলেও ক্রমে অস্বস্তি বাড়াচ্ছে। বিশেষ করে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে। কারও সাথে বৈরিতা নয়; সবার সাথে বন্ধুত্ব–এই নীতিতে চলা বাংলাদেশ এখন অনিবার্য অর্থনৈতিক ঝুঁকির মুখোমুখি। যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, গম, ভোজ্যতেল, স্টিলসহ অত্যাবশ্যক পণ্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির উত্তাপ লাগতে শুরু করেছে উদীয়মান অর্থনীতির আমদানিনির্ভর এ দেশে।
এ যুদ্ধে ব্যবসায়িক অংশীদার হিসেবে শুধু রাশিয়া-ইউক্রেনের সঙ্গেই বাংলাদেশের বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা নয়; বরং বিশ্বের অন্য দেশের মতো বাংলাদেশের সামগ্রিক আমদানি-রপ্তানি, অর্থনৈতিক কার্যক্রম নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। বাণিজ্য ঘাটতির বাংলাদেশের সামনে তাই অবধারিত ভাবেই বাড়তি ব্যয়ের বোঝা অপেক্ষা করছে। এমন আশঙ্কা উঠে এসেছে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, রয়টার্স, ট্রেডিং ইকোনমিকসসহ বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা আর বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদদের বিশ্লেষণে।
এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে একদিকে বেকারত্ব বাড়বে অন্যদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। বেকারত্ব বাড়া মানেই প্রবৃদ্ধি কম হওয়া। আসলে এটাই স্ট্যাগফ্ল্যাশন। বাংলাদেশ অবশ্যই এ ঝুঁকিতে রয়েছে। একদিকে পণ্য আমদানিতে দামের দিক থেকে একটা নেতিবাচক প্রভাব আছে। বিশেষ করে, তেল, লোহা, অ্যালুমিনিয়ামের দাম অনেক বেড়ে গেছে। এখন ইউরোপে যদি স্ট্যাগফ্ল্যাশন হয়, তবে আমাদের পোশাকের অর্ডার কমে যাবে।
কারণ তারা তো আমাদের পোশাকের ক্রেতা। ফলে একদিকে খরচ বেড়ে যাওয়া, অন্যদিকে আমাদের পণ্যের বিক্রি কমা বা আমাদের আয় কমে যাওয়া। এ দুটোর কারণেই আমাদের মূল্যস্ফীতি বাড়া এবং প্রবৃদ্ধি কমার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন, দেশেও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ালে বাজার এখন মারাত্মকভাবে বিশৃঙ্খল হতে পারে। তাই সরকার ভর্তুকি দিতে পারে। এ ছাড়া ডলারের হার স্থিতিশীল রাখা এবং আমদানি পণ্যের শুল্ক-কর সমন্বয় করেও দাম সহনীয় রাখার চেষ্টা করতে পারে সরকার। সে ক্ষেত্রে বাজারে যাতে এর সুফল আসে, সেদিকেও নজর রাখতে হবে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, রাশিয়া ইউক্রেনের সাথে বাংলাদেশের কমবেশি প্রায় দু শ কোটি ডলারের দ্বিপক্ষীয় আমদানি–রপ্তানি বাণিজ্য রয়েছে। আন্তর্জাতিক লেনদেনের মাধ্যম সুইফটের নিষেধাজ্ঞার কারণে এবং জাহাজ চলাচল বন্ধ থাকায় এর পুরোটাই এখন ঝুঁকিতে। বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যের তুলনায় এই দুই দেশের সঙ্গে বাণিজ্য অপেক্ষাকৃত কম। তবে রাশিয়া ও ইউক্রেনের তেল, গ্যাস, লোহা, স্টিল, গম, ভুট্টা, ভোজ্যতেল, রাসায়নিক, শিল্পের কাঁচামালসহ বহু পণ্যের সাপ্লাই চেইন বা সরবরাহ ব্যবস্থা হুমকিতে পড়ায়, তা সারা বিশ্বে সংকট তৈরি করছে। বন্দর অচল থাকায় পণ্য পরিবহন বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
অন্য দিকে, বিশ্ববাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ অন্যতম শীর্ষে। উদ্যোক্তাদের আশঙ্কা, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের নিষেধাজ্ঞায় পশ্চিমা দেশগুলোর লোকজন জামা-কাপড়ের খরচ কাটছাঁট করতে পারে। অন্যদিকে যুদ্ধ অব্যাহত থাকলে জাহাজের ভাড়া ও বিমা মাশুল বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে পোশাকের দাম বাড়াবে। ফলে বিক্রি আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এরই মধ্যে নানা নিষেধাজ্ঞায় বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ পোশাক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান এইচঅ্যান্ডএম রাশিয়ায় তাদের দেড় শটির মতো আউটলেট বন্ধ করে দিয়েছে। এইচএন্ডএম মোট পোশাক রপ্তানির অর্ধেকই কেনে বাংলাদেশ থেকে। তাদের চাহিদা কমলে, তারাও অর্ডার কমিয়ে দেবে।
বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ নিট পোশাকের উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান মাইক্রো ফাইবার গ্রুপ। এর অন্যতম বড় ক্রেতা জার্মানি। গ্রুপের পরিচালক ড. কামরুজ্জামান কায়সার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘যুদ্ধের কারণে আমরা রপ্তানিকারকরা একটু হুমকিতে পড়ে গেছি। রাশিয়া-ইউক্রেনে আমাদের সরাসরি রপ্তানি নেই। তবে কান টানলে যেমন মাথা আসে, তেমনি আমাদের রপ্তানিতেও ধাক্কা আসতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘আগামী জুলাইয়ের অর্ডার চূড়ান্ত করতে আমাদের সাথে জার্মানির ক্রেতার বসার কথা। তারা এখন বসছে না। কবে বসবে নিশ্চয়তা নেই। জুন পর্যন্ত আমাদের অর্ডার আছে। এরপরের কোনো আর অর্ডার নেই। তা ছাড়া জাহাজ সংকট তীব্র হচ্ছে। রাশিয়ামুখী জাহাজগুলো বিভিন্ন বন্দরে আটকে রয়েছে। এ নিয়ে আমরা খুব চিন্তিত।’
বিশ্ববাজারের তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে জানা যায়, বিশ্বের পণ্য রপ্তানির পাওয়ার হাউস বলা হয় রাশিয়া আর ইউক্রেনকে। বিশ্বের রপ্তানিযোগ্য ৯৬টি পণ্যের মধ্যে ২৪টি পণ্য রপ্তানিতে এগিয়ে রয়েছে ইউক্রেন। ২০২০ সালে দেশটি প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। ইউক্রেন এ সময়ে বিভিন্ন দানাদার শস্যের পাশাপাশি লোহা ও স্টিল রপ্তানি করেছে। পণ্যগুলো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হতো বলে সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক ছিল। এখন যুদ্ধের কারণে বিশ্বে এ পণ্যের ঘাটতি তৈরি হচ্ছে।
ইউক্রেন লোহা রপ্তানিতে বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম। দেশটি সয়াবিন রপ্তানিতে বিশ্বে নবম বৃহত্তম। সরিষার তেল রপ্তানিতে ১৩তম। এ রকম আরও বেশ কিছু নিত্যপণ্য রপ্তানিতে শীর্ষে রয়েছে ইউক্রেন। ইউক্রেনের শীর্ষ আমদানিকারক দেশ চীন। চীন আবার রাশিয়ার ওপর ভীষণভাবে নির্ভরশীল। আর ‘বিশ্বের কারখানা’ চীন ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার প্রভাব সারা বিশ্বে পড়বে।
ইউক্রেন শুধু রপ্তানি করে না; আমদানিতেও করে। দেশটি ২০২০ সালে প্রায় ৫৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। একই ভাবে ইউক্রেনের মতো রাশিয়ায়ও পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে অচলাবস্থা চলছে। এখানে এক দেশের রপ্তানি অর্থই আরেক দেশের আমদানি। ফলে একদিকে সংকট তৈরি হলে, আরেক দিকে এর তীব্রতা অনুভূত হচ্ছে। এর বহুমুখী প্রভাবে অস্থির হয়ে উঠেছে বিশ্ব বাজার ব্যবস্থা।
গত সোমবার রয়টার্স জানায়, যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম ২০০৮ সালের পর সর্বোচ্চ উচ্চতায় গিয়ে প্রতি ব্যারেল ১৪০ ডলারে ঠেকে। যদিও পরে তা কমে ১২৫ ডলারে নেমে এসেছে। তবে ব্যাংক অব আমেরিকার এক পর্যবেক্ষক এবং সিঙ্গাপুরের ওসিবিসি ব্যাংকের অর্থনীতিবিদ হাউই লী মনে করেন, শিগগির তেলের দাম রেকর্ড ২০০ ডলারে উঠবে। জ্বালানি তেল রপ্তানিতে বিশ্বে সৌদি আরবের সঙ্গে নেতৃত্ব দিচ্ছে রাশিয়া। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এ পণ্যটি অন্য সব কিছুর দামে অস্থিরতা তৈরি করছে। ইউরোপের ৪০ শতাংশ গ্যাস সরবরাহ করে থাকে রাশিয়া ও ইউক্রেন। এখন গ্যাসের বিকল্প উৎস খুঁজতে মরিয়া ইউরোপ। তারা কাতারকে প্রস্তাব দিয়েছে গ্যাস সরবরাহের। কাতার এখনো তাদের কোনো আশ্বাস দেয়নি। কাতারও স্বাভাবিকভাবে সরবরাহ সংকটের সুযোগে দাম বাড়িয়ে দিতে পারে। কাতার থেকে বাংলাদেশও এলএনজি আমদানি করছে। ফলে গ্যাসের বাড়তি দাম এসে পড়তে পারে বাংলাদেশের ঘাড়ে। বাংলাদেশে এরই মধ্যে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে বেসরকারি খাতের সিলিন্ডার গ্যাসের দাম বেড়েছে কয়েক দফা। যা সরাসরি ভোক্তার ওপরে পড়ছে।
বাংলাদেশের বিশ্লেষকেরা বলছেন, জ্বালানি তেলের বর্তমান দামই বাংলাদেশের সহ্য করার সক্ষমতা কম। এর আগে ৭৫–৮০ ডলার ওঠার পরই সরকার লোকসান কমাতে দাম সমন্বয় করতে বাধ্য হয়েছে। এ দাম ছাড়িয়ে যাওয়ার পর প্রতিদিন গড়ে ১৯ কোটি টাকা করে লোকসান গুনছে সরকার। এর মধ্যেই বিশ্ববাজারে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে দাম। নতুন দাম সরকার সমন্বয় করবে কিনা এখনো জানা যায়নি। যদি না করে তাহলে বিপুল অঙ্কের টাকা সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে। এতে করোনায় ধুঁকতে থাকা ‘দুর্বল’ রাজস্ব আয়ের অর্থনীতিতে সরকারের ধার বেড়ে যাবে।
আর সরকার ভর্তুকি না দিলে জ্বালানি তেলের দাম বাড়বে। সে ক্ষেত্রে পরিবহন খরচসহ নিত্যপণ্যের দামে রীতিমতো আগুন লেগে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ম তামিম বলেন, ‘যেহেতু আমরা জ্বালানি আমদানি করছি, তাই আমাদের অর্থনীতিতে আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্য ঝুঁকি আর সরবরাহ ঝুঁকি নিতে হয়। তবে এটা ঠিক যে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি হলে তার পরিপ্রেক্ষিতে মূল্যস্ফীতি হয়। দেশে জ্বালানি তেলের দাম একদফা বৃদ্ধির কারণে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। আমার মনে হয়, স্বল্পকালীন সময়ে সরকার ভর্তুকি দিয়ে দাম সমন্বয় করতে পারবে। কিন্তু যদি দীর্ঘ মেয়াদে এ অবস্থা চলতে থাকে তখন কিন্তু সরকারের পক্ষে মূল্যবৃদ্ধি করা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।’
গবেষণা বলছে, শুধু জ্বালানি তেলই নয়; বাড়ছে গমের দামও। গত শুক্রবার পর্যন্ত মাত্র চার দিনের ব্যবধানে বিশ্ববাজারে প্রতি টন গম ৩৪০ ডলার থেকে বেড়ে ৪৯৫ ডলারে উঠেছে। বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ গম রপ্তানিকারক দেশ রাশিয়া ও ইউক্রেনে যুদ্ধের কারণে গমের সরবরাহে সংকট তৈরি হয়েছে। চট্টগ্রাম কাস্টমস বলছে, গত অর্থবছরে এই বন্দর দিয়ে প্রায় সাড়ে ৫৪ লাখ টন গম আমদানি হয়েছে। এর ৪১ শতাংশই এসেছে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। যুদ্ধের কারণে এই ৪১ শতাংশ গম অন্য দেশ থেকে বাড়তি দামে আমদানি করতে হবে বাংলাদেশকে।
বাংলাদেশ অন্যতম লোহা আমদানিকারক দেশ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে এর দাম ছিল প্রতি টন ৫৭০ ডলার। গত রোববার বিশ্ববাজারে এর দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৬৫০ ডলারে। দেশের বাজারে গত সপ্তাহে এর দাম টন প্রতি ৫ হাজার টাকা বেড়ে ৮৩ থেকে ৮৫ হাজার টাকা হয়েছে।
আইএমএফ বলছে, যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ব ‘ভয়ংকর’ অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়বে। আইএমএফ একে চূড়ান্ত অস্বাভাবিক অনিশ্চয়তা বলে অভিহিত করেছে।
‘দুই দিন আগেই বাড়ি থেকে পাথরঘাটায় চলে এসেছি। এখন পুরোনো জাল সেলাই করছি। এক সপ্তাহের বাজারও করে এনেছি। আজ বিকেলে সাগর মোহনায় যাব, গভীর রাত থেকে জাল ফেলব।’ কথাগুলো বলছিলেন বরগুনা সদরের বাইনচটকী এলাকার জেলে হোসেন আলী। গতকাল বুধবার সকালে বরগুনার পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে কথা হয় তাঁর...
১২ জুন ২০২৫ভারতের স্থলবন্দর নিষেধাজ্ঞার পর সীমান্তে আটকে থাকা তৈরি পোশাক, খাদ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের ট্রাকগুলো ফেরত আনছেন রপ্তানিকারকেরা। তবে যেসব ট্রাক বন্দরে ঢুকে গিয়েছিল, সেগুলো ভারতে প্রবেশ করানোর চেষ্টা চলছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসব ট্রাক ঢুকতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে।
১৯ মে ২০২৫আধুনিক যুগের সবচেয়ে বিস্ময়কর প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারগুলোর একটি হচ্ছে গৌতম বুদ্ধের দেহাবশেষের সঙ্গে সম্পর্কিত ঐতিহাসিক রত্নসম্ভার। গতকাল বুধবার হংকংয়ে বিখ্যাত আর্ট নিলাম কোম্পানি সাদাবি’স-এর এক নিলামে এগুলো তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
০৮ মে ২০২৫পাকিস্তানে ভারতের হামলার সমালোচনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। চীনও এই হামলাকে ‘দুঃখজনক’ বলে অভিহিত করেছে। উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘও। উত্তেজনা যেন আরও না বাড়ে, সে জন্য দুই পক্ষকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশ। এদিকে ভারতের অবস্থানকে সমর্থন করেছে...
০৮ মে ২০২৫