Ajker Patrika

ওরাও বুঝতে পারে, আমরা পারি না

মৃত্যুঞ্জয় রায়
আপডেট : ১১ আগস্ট ২০২৩, ০৮: ৪২
ওরাও বুঝতে পারে, আমরা পারি না

দক্ষিণ ইউরোপের আল্পস ও অ্যাপেনিনেসে প্রায় সব লম্বা হুলের গুবরে পোকারা পাহাড়ের চূড়ার দিকে রওনা দিয়েছে। ওরা আর ওদের আগের জায়গায় থাকতে চাইছে না। শুধু ওরাই নয়, কমলা পাখাওয়ালা বাদামি একধরনের প্রজাপতি দল বেঁধে উঠছে পাহাড়ের ওপরে। এসব প্রজাপতি তাদের আদিনিবাস ও দল ছেড়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় এখন তাদের বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

সাম্প্রতিক কালে একদল গবেষক পোকামাকড়ের চলাচলের ওপর গবেষণা করে এ তথ্য পেয়েছেন। কারণ হিসেবে তাঁরা যা জেনেছেন, তা আমাদের জন্য বেশ বিস্ময়কর ও উদ্বেগজনক। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ার কারণে জীববৈচিত্র্যের জীবন ও গতিবিধির ওপর পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। বাস্তুতন্ত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কীটপতঙ্গ শুধু উত্তর-দক্ষিণ বা পূর্ব-পশ্চিমে নয়, সোজা উঠছে ওপরের দিকে, পাহাড়ের চূড়ায়—যদি একটু ঠান্ডা পাওয়া যায়!

সব প্রাণী বিশ্বের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় প্রথমে তারা তাদের বাসস্থানে থিতু হওয়ার জন্য খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করছে, এমনকি মানুষও। অথবা যেখানে তারা ভালো থাকতে পারে, সেই সব স্থানে চলে যাচ্ছে। আল্পস ও অ্যাপেনিনেস পাহাড়ের প্রায় অর্ধেকের বেশি পতঙ্গ ওপরের দিকে সরে যাচ্ছে। শুধু পাহাড় নয়, সমতল ও জলজ পোকারাও জলবায়ুর এই পরিবর্তন টের পাচ্ছে। তাই তারাও ছুটছে এদিক-সেদিক, নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে।

পোকাদের ইন্দ্রিয়ানুভূতি কি মানুষের চেয়েও প্রখর? হয়তো তাই। তা না হলে একদল পিঁপড়ে তো রাতের বেলায় তাদের মাটির নিচের বাসাতেই দিব্যি ঘুমাচ্ছিল। হঠাৎ কী এমন হলো যে সেগুলো বাইরে বেরিয়ে এল? মাটির ওপরে তারা নতুন নিরাপদ স্থানে দ্রুত নতুন একটা বাসা বানিয়ে ফেলল? আর তাদের বাসায় ঢোকার পথটার চারপাশে এমনভাবে ঢিবি তৈরি করে বন্ধ করে দিল, যাতে তার ভেতরে কোনো পানি ঢুকতে না পারে।

পিঁপড়েদের এই অদ্ভুত কাণ্ডের পরপরই সেখানে ঘটে গেল স্বল্পমাত্রার একটা ভূমিকম্প। সুনামির সংকেতও পিঁপড়েরা টের পায়, আর সুনামি আসার আগে তারা মাটির খুব গভীরে দ্রুত সুড়ঙ্গ তৈরি করে সেখানে নিরাপদে সবাই মিলে চলে যায়। মাটির ৪০ মিটার গভীর পর্যন্ত যেতেও পিঁপড়েদের সে সময় কোনো আপত্তি থাকে না। আর একটা বিষয় তাদের মধ্যে দেখা যায়, শত বিপদেও পিঁপড়েরা দলছুট হয় না, কেউ কাউকে ছেড়ে যায় না।

পিঁপড়েদের মতো কেন্নো, কাঠবিড়ালি, সাপ, ইঁদুর এবং মাটিতে বসবাসকারী আরও কিছু প্রাণী ভূমিকম্পের আগাম আভাস বুঝতে পারে। তেমনই এক ঘটনার সাক্ষী হয়েছিল ১৯৭৬ সালে চীনে ৭.৮ মাত্রার তাংশেন ভূমিকম্পের সময়। যুক্তরাষ্ট্রের গ্লোবাল সার্ভের এক রিপোর্টে দেখা যায়, সেই ভূমিকম্পের আগে এসব প্রাণী সাগরের উপকূলে প্রচুর পরিমাণে জড়ো হয়েছিল। এমনকি সেই ভূমিকম্পের আগে মৌমাছিরা তাদের চাক ছেড়ে চলে গিয়েছিল এবং তিংবো বন্দরে থাকা যানবাহন ও অয়েল ট্যাংকারগুলো প্রজাপতি, ঘাসফড়িং, ড্রাগন ফড়িং, উরচুঙ্গা ও ঝিঁঝি পোকায় ভরে গিয়েছিল। ভূমিকম্পের আতঙ্ক তাদের এতটাই ভাবিয়ে তুলেছিল যে অনবরত যে ঝিঁঝি পোকাদের ডাকে কান ঝালাপালা হয়ে যায়, তারাও ডাকতে ভুলে গিয়েছিল।

পোকামাকড়ের এসব আচরণ দেখে কিছু মানুষের কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতার সঞ্চয় হয়। সেই অভিজ্ঞতা বলে দেয়, সামনে কী ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসতে যাচ্ছে। দক্ষিণ আন্দামানের এক জেলে তার সেরকমের এক অভিজ্ঞতার কথা বলেছিলেন, ‘যখন দেখবেন কেঁচোরা মাটির ওপরে উঠে আসছে, উঁই পোকারা ভেজা মাটিতে গর্ত খোঁড়া শুরু করেছে, শামুকগুলো গাছে চড়তে শুরু করেছে, পোকামাকড়গুলো অস্থির হয়ে ছোটাছুটি করছে, পিঁপড়েরা দল বেঁধে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে চলেছে, সাপগুলো শীতনিদ্রা ভেঙে গর্ত ছেড়ে ওপরে উঠে আসছে, তখন বুঝবেন জলোচ্ছ্বাস বা সুনামি আসছে।’ ২০০৪ সালে সুনামি আসার আগে প্রাণীদের মধ্যে এরূপ বিচিত্র আচরণ লক্ষ করা গিয়েছিল। ২০০১ সালে গুজরাটে ভুজ ভূমিকম্পের আগে ময়ূরদের অস্বাভাবিক ওড়াউড়ি, কুকুরের অবিরাম ডেকে যাওয়া, বিশ্রামহীনতাও সেই দুর্যোগের পূর্বাভাস দিয়েছিল।

পোকামাকড়ের জীবন খুব ছোট বলে তাদের বেলায় এই পরিবর্তন বেশ দ্রুত ঘটছে, তা চোখেও পড়ছে গবেষকদের। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ার কারণে কীটপতঙ্গের দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানানো আমাদের জন্য উদ্বেগের। ওদের এসব আচরণের মাধ্যমে স্পষ্টত ফুটে উঠেছে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা কত দ্রুত বাড়ছে, আর কত দ্রুত আমরা নিজ বাসভূমে পরবাসী অথবা উদ্বাস্তু হব। যুক্তরাজ্যের ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেন হিল পোকামাকড়ের গবেষণায় বহু বছর ব্যয় করেছেন। তাঁর কথা হলো, ‘পাহাড়ের জলবায়ু পরিবর্তন বুঝতে হলে কয়েক মিটার ওপরে গেলেই চলবে, কিন্তু সমতলের জলবায়ু পরিবর্তন বুঝতে হলে কয়েক কিলোমিটার যেতে হবে। আমরা সেসব না বুঝলেও পোকারা বোঝে, তাই তারা তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে সমতলে না গিয়ে ছুটছে পাহাড়ের ওপরের দিকে। এই ইঙ্গিত আমাদের সতর্ক করার জন্য যথেষ্ট। এভাবে পোকামাকড়গুলো যদি নিরাপদ বাস্তুস্থানের খোঁজে তাদের বাসস্থান ছেড়ে চলে যায়, তাহলে সেসব পোকামাকড়ের প্রজনন, বৃদ্ধি ও বিকাশেও আসবে নানা পরিবর্তন। এতে সেসব পোকামাকড়ের বংশরক্ষা কঠিন হবে।

আমাদের বেঁচে থাকার তাতে অসুবিধা কী? পোকামাকড় বড্ড জ্বালায়, ওসব আপদ না থাকাই ভালো। ওরা আমাদের ফসল খেয়ে নেয়, বছরে বিশ্বে পোকার কারণে উৎপাদিত ফসলের ক্ষতি হয় প্রায় ১৫-২০ শতাংশ। আর এসব পোকা মারতে বিষাক্ত যেসব কীটনাশক উৎপাদন করা হচ্ছে, তাতেও আমাদের পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। এসব রাসায়নিক দ্রব্য উৎপাদনের জন্য কারখানাগুলো সচল রাখায় বিপুল পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে নিঃসারিত হচ্ছে। তাতেও বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বাড়ছে। আর এসব কীটনাশক প্রয়োগের ফলে পৃথিবীর বাতাস ও পরিবেশ দূষিত হচ্ছে, জলজ প্রাণীরা মরে যাচ্ছে, গাছে আর আগের মতো ফুল ফুটছে না।

কিন্তু পোকারা না থাকলে এই পৃথিবীতে যে মানুষও থাকবে না! আইনস্টাইন এ নিয়ে একটা ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘পৃথিবীতে যদি মৌমাছি না থাকে, তাহলে মানুষ বড়জোর চার বছর বাঁচবে।’ মৌমাছির মতো অনেক পতঙ্গ রয়েছে, যারা ফসলের পরাগায়ন ঘটায়। পোকা ছাড়া বাতাসেও পরাগায়ন ঘটে। পরাগায়ন না ঘটলে ফসলের দানা হবে না, ফল হবে না, বিচি হবে না। তাহলে সেসব উদ্ভিদের বিনাশ বা বিলুপ্তি যেমন ঘনিয়ে আসবে, তেমনি মানুষও ভুগবে মহা খাদ্যসংকটে। একদিকে প্রয়োজনীয় গাছগাছড়ার বিলুপ্তি, অন্যদিকে গাছ থাকলেও সেগুলোতে ফলন না হওয়া—দুটোই আমাদের জন্য দুশ্চিন্তার। এ তো বহুকাল আগে মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইনের করা পূর্বাভাস। একালের বিজ্ঞানীরা এখনো ঠিক ঠাহর করতে পারছেন না যে, এই পরিবর্তনের ফলে আরও কী কী বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।

এটা সত্য, সব পোকার বেলায় তাদের স্থানচ্যুতি একইভাবে হচ্ছে না, পরিবর্তনের প্রভাবও একরকম হচ্ছে না। পোকাদেরও এসব ঠান্ডা বা গরম সহ্য করার একটা সীমারেখা আছে। পৃথিবীর ওপরে বায়ুমণ্ডলে বা পাহাড়ের ওপরে একেক স্তরের তাপমাত্রা একেক রকম। তাই পোকারা যে তাপমাত্রায় ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারবে, বংশবৃদ্ধি করতে পারবে, খেতে পারবে, সেই স্তরেই থিতু হবে।

কিন্তু সমস্যাটা অন্য জায়গায়। ওরা বাঁচার আশায় যেখানে যাচ্ছে, সেখানে সেসব পোকার আহার ঠিকমতো জুটবে তো? কেননা, প্রতিটি পোকার খাদ্য আলাদা। সেসব খাদ্যের জোগানদাতা মূলত উদ্ভিদ। আবার কিছু পোকা আছে, যাদের অন্য পোকার ওপর জীবন ধারণ করতে হয়। সব মিলিয়ে পোকাদের এই স্থানচ্যুতি বৈশ্বিক খাদ্যশৃঙ্খলে এক বিশৃঙ্খলার ইঙ্গিত দিচ্ছে। পৃথিবীসুদ্ধ মানুষ ও প্রাণীরা এখন প্রাকৃতিক নানা বিপর্যয়ের মুখোমুখি। জলবায়ু পরিবর্তন পৃথিবীতে ঘটছে, অতীতেও ঘটেছে, ভবিষ্যতেও ঘটবে।

এই পরিবর্তন রোধ করার সাধ্য মানুষের নেই। কিন্তু সেই পরিবর্তনকে বিলম্বিত তো করতে পারি, সেসব পরিবর্তন যেসব কারণে হচ্ছে, সে কাজগুলো কমাতে বা বন্ধ করতে পারি, পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারি। আজ বিশ্বব্যাপী যত সংকট, তার মূলে রয়েছে আমাদের অতিরিক্ত বিলাসী জীবন যাপনের ইচ্ছা। প্রকৃতি সব সময়ই উদার এবং সব সমস্যার সমাধান প্রকৃতিতেই নিহিত। সে কথা আনা ফ্রাংকও স্বীকার করে গেছেন, বলেছেন, ‘আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সব সমস্যার সমাধান প্রকৃতিতেই রয়েছে।’

মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও লেখক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

পাকিস্তানে কীভাবে হামলা চালাতে পারে ভারত, ইতিহাস যা বলছে

জনবল-সরঞ্জাম বেশি হলেও সমরশক্তিতে ভারত কি পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে

প্রবাসীর রেমিট্যান্সের অর্থ আত্মসাৎ, নারী ব্যাংক কর্মকর্তা কারাগারে

ইতিহাস গড়ে পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদে আইএসআইপ্রধান

ভারতের সঙ্গে সংঘাতে পাকিস্তানের ভাগ্যনিয়ন্তা সেনাপ্রধান জেনারেল মুনির

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত