Ajker Patrika

তাদের মুখ ভিন্ন কিন্তু মুখশ্রী অভিন্ন

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
তাদের মুখ ভিন্ন কিন্তু মুখশ্রী অভিন্ন

নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প হেরেছেন, কিন্তু হার মানতে রাজি হননি। বলেছিলেন, জোচ্চুরি হয়েছে, তাঁর বিজয়টা ‘চুরি’ (ছিনতাই নয়) করে নেওয়া হয়েছে। এ রকমের আওয়াজ আমাদের দেশেও ওঠে; তবে আমেরিকায় সেটা এমনভাবে আগে কখনো শোনা যায়নি এবং ওই আওয়াজে যত আমেরিকান তাল দিয়েছে, তেমনটাও আগে কখনো দেখা যায়নি। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটা যে নড়বড়ে হয়ে পড়ছে, সেটা বুঝতে অসুবিধা নেই। ধাক্কাগুলো রিপাবলিকানদের দিক থেকেই আসছিল। তাদের ভেতরকার ফ্যাসিবাদী প্রবণতাটা যে হঠাৎ করে এত বড় আকারে দেখা দিয়েছে তা নয়, এটা ভেতরে-ভেতরে বাড়ছিল।

নিক্সন একটা ঝাঁকি দিয়েছিলেন, জর্জ বুশ ইরাকে ওয়েপনস অব মাস ডেস্ট্রাকশন লুকিয়ে রাখা হয়েছে বলে জঘন্য মিথ্যাচার করে মধ্যপ্রাচ্যে দখলদার সৈন্য পাঠিয়ে অঞ্চলটিকে ছারখার করে ছেড়েছেন এবং বুঝিয়ে দিয়েছেন আমেরিকার গণতন্ত্র মিথ্যাকে কীভাবে প্রশ্রয় দেয়। সেই কাজ করার পরেও বুশ ‘আমেরিকান মূল্যবোধে’র সংরক্ষক হিসেবে বীরের মর্যাদা পেয়েছেন এবং তাঁর টিমে কৃষ্ণবর্ণের ‘বড় মাপে’র মানুষ দু-চারজনকে যে দেখা যায়নি এমনও নয়।

বুশের পরে ট্রাম্প এসে ‘আমেরিকাই প্রথম’ আওয়াজ তুলে, নর্তনকুর্দন করে ও ভ্রান্ত পদক্ষেপ নিয়ে ওই দেশকে এমন অধঃপতনে নিয়ে গেছেন, যেখানে তাঁর মতো অতিনিম্ন রুচির ও বিকৃত সংস্কৃতির একজন ব্যবসায়ীও দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হবেন—এমন সম্ভাবনাও তৈরি করতে পেরেছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছেন। ভরসা কিন্তু সেটাই। কিসের? না, ‘গণতান্ত্রিক’ ব্যবস্থাটা টিকে থাকবে ভরসা এমন আশার নয়। বিক্ষুব্ধ মানুষের সংখ্যা বাড়বে শুধু এই আশারই। ব্যবস্থাটা ভাঙবে, ভাঙতে বাধ্য। কারণ পুঁজিবাদ নিজেই ভাঙবে। আমেরিকার মানুষদের সুস্পষ্ট বিভাজন সেই ভাঙনেরই ইশারা তুলে ধরেছে। ভবিষ্যতে সংকটের গভীরতা ও ব্যাপকতা কমবে না, বরং বাড়বে। কত দ্রুত বাড়ে, সেটাই হবে অভিজ্ঞতার বিষয়।

বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আমেরিকার নির্বাচনী গণতন্ত্র নিয়ে মাথা না ঘামালেও বহির্বিশ্বে নির্বাচনী গণতন্ত্রের জন্য মাছের মায়ের কান্না জুড়ে দিয়েছেন। পাশাপাশি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় মরিয়া হয়ে উঠেছেন, তাঁর পূর্বসূরিদের নির্জলা অনুকরণে। বিশ্বের একটি রাষ্ট্রেও আমেরিকা এযাবৎ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে, এর একটিও প্রমাণ নেই। অনুগত ও আজ্ঞাবহ হতে বাধ্য করার ওসব অছিলা মাত্র। সেটা যে না-জানে বা না-বোঝে, সে নিশ্চিত বোকার স্বর্গে বসবাস করছে। গণতন্ত্রের কান্ডারি সেজে বাইডেন গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যাকে মদদ জুগিয়ে যাচ্ছেন। অর্থ, অস্ত্র পাঠিয়ে গাজার গণহত্যায় শামিল হয়েছেন। তাঁর বা তাঁদের মুখে গণতন্ত্র, মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলা প্রতারণা ভিন্ন অন্য কিছু নয়। 

মূল জিনিসটা হচ্ছে ক্ষমতা। আর এখনকার ‘মুক্ত’ বিশ্বে ক্ষমতা সরাসরি যুক্ত বাণিজ্যের সঙ্গে। বাণিজ্য-ব্যাপারে ক্ষমতা নিয়ে পুঁজিবাদীদের মধ্যে দ্বন্দ্বটা আরও হিংস্র আকার ধারণ করবে। ধরা যাক চীন-মার্কিন প্রতিযোগিতার ব্যাপারটা। ভবিষ্যতে এটা যে কেমন ভয়াবহ হয়ে দাঁড়াবে, সেই লক্ষণ এখনই দেখা যাচ্ছে। চীনের নেতৃত্ব ইতিমধ্যেই বিশ্বের বৃহত্তম বাণিজ্য চুক্তিটি সম্পাদিত করেছে। চীন এখন ধেয়ে আসবে, আমেরিকা ও ইউরোপকে ধাক্কা দেবে এবং বাণিজ্যে আধিপত্য নিয়ে লড়াইটা তীব্র হবে। গত শতাব্দীতে পুঁজিবাদীরা দু-দুটি বিশ্বযুদ্ধ বাধিয়ে ছেড়েছে। এর ভুক্তভোগী হয়েছে সারা বিশ্বের মেহনতি মানুষ।

আর এই যে হিংস্র বাণিজ্যযুদ্ধ, এতেও ক্ষতিটা হবে ওই মেহনতিদেরই। পুঁজিবাদীদের ভেতরে ঝগড়া-ফ্যাসাদের কারণে করোনাভাইরাসের আক্রমণের চেয়েও বড় রকমের বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী। সেটা কোন রূপ ধরে আসবে আমরা জানি না; তবে কোন কোন জায়গা থেকে আসবে, সেটা বোঝা যায়। আসবে জলবায়ু পরিবর্তন ও বায়ুদূষণ থেকে, আসবে বৈষম্য থেকে, আসবে বেকারত্ব, অনাহার, মুনাফালিপ্সা, ভোগবাদিতা, হিংস্রতা ইত্যাদি বৃদ্ধির কারণে। আসবে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও ফ্যাসিবাদী শক্তির উত্থান থেকে। ওই শক্তি আবার চাইবে রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যবহার করে, বর্ণ ও ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিয়ে, মানুষের ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ দমন করতে। পুঁজিবাদীরা ‘গণতান্ত্রিক’ নির্বাচনী প্রথাটাকে চালু রাখতে চাইবে, মানুষ ভাববে নির্বাচনের মধ্য দিয়েই পরিবর্তন আসবে।

একেবারেই যে আসবে না, তা-ও হয়তো নয়; কিন্তু সেই পরিবর্তন ওপরকাঠামোর অল্প এলাকারই। লোক বদলাবে, কিন্তু ব্যবস্থা বদলাবে না। অনেক ক্ষেত্রে লোকও বদলাবে না। আর রাষ্ট্রক্ষমতায় যে-ই আসুক, স্বার্থ দেখবে সে ধনীদের; মেহনতিদের নয়। ক্ষমতা ঘোরাঘুরি করতে থাকবে টাকাওয়ালাদের বৃত্তের মধ্যেই। বদলটা হবে মুখোশের, মুখশ্রীটা একই।


নির্বাচন যে কী করতে পারে না-পারে, এর পরিচয় তো আমাদের দেশের ইতিহাসেই লেখা হয়ে রয়েছে। ১৯৪৫-এ বাংলায় প্রায়-বিপ্লবী পরিস্থিতি বিরাজ করছিল, তাকে সামলানোর জন্য যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া হয়েছিল এর মধ্যে সবচেয়ে অধিক কার্যকর হয়েছে নির্বাচন। সেই নির্বাচনে কংগ্রেস ও লীগের মধ্যে বিরোধিতাটা তীব্র হলো, মারাত্মক হয়ে দেখা দিল দাঙ্গা এবং পরিণতিতে ১৯৪৭-এর মর্মান্তিক দেশভাগের ঘটনা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়াল। এরপর ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আবার বিক্ষোভের প্রকাশ ঘটেছিল। তার মোকাবিলা করা হয় ১৯৫৪ সালের নির্বাচন দিয়ে।

নির্বাচনের পরে বিজয়ী যুক্তফ্রন্টের দুই পক্ষের ভেতর ঝগড়া বাধিয়ে দিয়ে পথটা প্রশস্ত করে দেওয়া হয়েছিল সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের জন্য। এল আইয়ুবের সামরিক শাসন। আইয়ুবী শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের পরিণতিতে আইয়ুবেরই দোসর (তবে তাঁর তুলনায় অনেক নিকৃষ্ট) ইয়াহিয়া খানের যে সামরিক শাসন জারি করা হয়, সেই শাসনের কর্তারা নির্বাচন দিয়ে ভেবেছিলেন মানুষকে বিভক্ত করে ক্ষমতায় টিকে থাকা যাবে। নির্বাচনের পরিণামে ঘটেছে গণহত্যা।

ঘটনাপ্রবাহের সারমর্মটা হলো এই, নির্বাচন বিদ্যমান শোষণমূলক ব্যবস্থাকে রক্ষা করার কাজটাই সম্পন্ন করেছে। তাকে বদলাতে চায়নি।
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরও নির্বাচন তো কম দেখলাম না, কিন্তু পরিবর্তন যতটুকু হয়েছে তা নামের এবং ক্ষেত্রবিশেষে পোশাকের। ভেতরে-ভেতরে যা ঘটেছে তা হলো, আমলাতন্ত্রের সাহায্যে দুরন্ত পুঁজিবাদীব্যবস্থার নিরন্তর শক্তি সংগ্রহ। আর অধুনা তো লোকদেখানো ওই পোশাকি পরিবর্তনটুকুও ঘটছে না; যে দল ক্ষমতায় রয়েছে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তারাই রয়ে যাওয়ার বৈধতা অর্জন করছে। তা সেই নির্বাচন যে ধরনেরই হোক না কেন।

গত নির্বাচনের পরে কয়েকটি উপনির্বাচনও হয়েছিল, তাতেও ওই একই ঘটনা। ক্ষমতাসীনেরাই জিতে এসেছে। অতিসম্প্রতি দুটি উপনির্বাচনের নির্ঝঞ্ঝাট সমাপ্তি শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বেশ গর্ব করেই বলেছিলেন, ‘ভোট গণনার ব্যাপারে আমেরিকার উচিত আমাদের কাছ থেকে শিক্ষা নেওয়া; তারা যেখানে চার-পাঁচ দিনেও কেন্দ্রের ফল দিতে পারে না, আমরা সেখানে চার-পাঁচ মিনিটেই কেন্দ্রের ফল জানিয়ে দিয়েছি।’ ইচ্ছা করলে তিনি অবশ্য শিক্ষার জন্য আরও ক্ষেত্র চিহ্নিত করতে পারতেন; যেমন এমনকি একজন ভোটার না এলেও কেমন করে অর্ধেকের বেশি আসনে ক্ষমতাসীনেরা জিতে যায় অথবা মধ্যরাতে, ভোটারের উপস্থিতি ছাড়াই কীভাবে নির্বাচনের কাজ নির্বিঘ্নে সুসম্পন্ন করা সম্ভব হয়, সেই সব বিষয়কে।

ফেসবুকে আজকাল অনেক রকম মন্তব্য আসে। শুনলাম একজন লিখেছে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটাও বলতে পারতেন যে আমেরিকায় যেখানে ভোটের অনেক দিন পরেও ঘোষণা আসে না কোন দল জিতেছে, বাংলাদেশে সেখানে নির্বাচনের পাঁচ বছর আগেই নিশ্চিন্তে বলে দেওয়া সম্ভব কারা জিতবে।
আমেরিকার বেলায় ট্রাম্প অবশ্য আগেই বলে রেখেছিলেন যে নির্বাচনের চূড়ান্ত ফল আদালতে নির্ধারিত হবে। শেষ পর্যন্ত অত দূর গড়াল না। কারণ সর্বোচ্চ আদালতটিকে যদিও তিনি তাঁর দল-মনোনীত বিচারকদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে আগেই ঠিকমতো সাজিয়ে রেখেছিলেন, তবুও মামলা ওই পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া সম্ভব হলো না। স্থানীয় আদালতই তা খারিজ করে দিলেন এবং অন্তত পেনসিলভানিয়ায় কারচুপি হয়েছে বলে সাক্ষী দেওয়ার মতো ডাক বিভাগের যে একজন কর্মচারীকে জোগাড় করা হয়েছিল, তিনিও আমাদের দেশের জজ মিয়াটি হতে রাজি হলেন না। আশ্চর্য ঘটনা আরও আছে। বিরোধী দল নয়; স্বয়ং প্রেসিডেন্টই অভিযোগ এনেছেন যে নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে।

আমাদের জন্য বিস্ময়ের ব্যাপার এটাও, নির্বাচনের দায়িত্বে নিয়োজিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বলেছে, সরকারের দাবি মিথ্যা, কারচুপির একটি ঘটনাও ঘটেনি। ট্রাম্প যদি খাঁটি বাপের বেটা হন, তবে তাঁরাও কিন্তু কম যান না, যা সত্য বলে জানেন তা-ই বলে দিয়েছেন; প্রেসিডেন্টের রাগ-অনুরাগের তোয়াক্কা করেননি।
ট্রাম্প প্রেসিডেন্টের রাষ্ট্রীয় বাসভবনেই সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষণাটা দিয়েছিলেন যে তাঁর বিজয় চুরি হয়ে গেছে।

ঘোষণা দিয়েই তিনি আর কালক্ষেপণ করেননি, দ্রুত সম্মেলন স্থল থেকে প্রস্থান করেছেন। সাংবাদিকদের তিনি হাড়ে হাড়ে চেনেন। তাঁরা যে প্রমাণ দিন, প্রমাণ চাই বলে তেড়ে আসবেন তা তিনি বিলক্ষণ জানতেন। তাই নিজেকে তাঁদের নাগালের ভেতরেই রাখেননি, নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়েছেন। তাতে অবশ্য প্রেসিডেন্ট সাহেবের শেষ রক্ষাটা হয়নি। ওই সাংবাদিকেরা বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছেন যে প্রেসিডেন্ট সাহেব যা বলেছেন, তার কোনো প্রমাণ তিনি হাজির করেননি। যেসব টেলিভিশন চ্যানেল সরাসরি সংবাদ সম্মেলনে তাঁর ঘোষণাটি প্রচার করছিল, তাদের মধ্যে তিনটি মধ্যপথেই ক্যামেরা গুটিয়ে ফেলেছে, ভাবখানা এমন যে এতটা মিথ্যাচার ক্যামেরাও সইবে না।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ইরানের পতন হলে, এরপরই রাশিয়া—অভিমত রুশ বিশ্লেষকদের

সাবেক সিইসি নূরুল হুদার গলায় ‘জুতার মালা’ দিয়ে পুলিশে সোপর্দ

ইসরায়েলে ২০ লাখ রুশভাষীর বাস, রাশিয়াকে তাঁদের কথা ভাবতে হয়: পুতিন

হরমুজ প্রণালিতে প্রবেশ করে ইউটার্ন নিল দুটি জাহাজ

লাইভ-২ (২৩ জুন, ২০২৫): ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলা, হরমুজ প্রণালী বন্ধের হুঁশিয়ারি, জাতিসংঘে জরুরি বৈঠক

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত