Ajker Patrika

উত্তর গাজায় দুর্ভিক্ষ আসন্ন

মাহমুদ শালাবি
উত্তর গাজায় দুর্ভিক্ষ আসন্ন

উত্তর গাজায় খাবারের তীব্র অভাব দেখা দিয়েছে। সেখানে আসলেই কোনো খাবার নেই। মানুষ বেঁচে থাকার জন্য পশুখাদ্য বা পাখির খাদ্য খেতে বাধ্য হচ্ছে। কেউ কেউ শুধু ঘাস খেয়ে জীবনধারণ করছে। সেখানকার চিকিৎসকেরা কয়েক মাস ধরে সতর্ক করে আসছেন যে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর পাঁচ মাসব্যাপী বোমাবর্ষণ এবং গাজা অবরোধ শেষ হবে ক্ষুধা ও অনাহারে।

১৮ মার্চ জাতিসংঘ সমর্থিত ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্ল্যাসিফিকেশন জানিয়েছে, দুর্ভিক্ষ ‘আসন্ন’ এবং আগামী দুই মাসের মধ্যে উত্তর গাজায় তা দেখা দেবে। গাজাজুড়ে জনসংখ্যার অর্ধেক এখন ক্ষুধার বিপর্যয়কর মাত্রার মুখোমুখি। গত নভেম্বরে যা রিপোর্ট করা হয়েছিল, এই সংখ্যা তার প্রায় দ্বিগুণ। শিশুরা ইতিমধ্যেই অপুষ্টি ও পানিশূন্যতায় মারা যাচ্ছে। 

এদিকে, ইসরায়েলি সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজরদারির মধ্যেও ত্রাণসহায়তা বহনকারী গাড়ি সীমান্ত পার হয়ে গাজায় প্রবেশের সময় বাধা দিচ্ছে। যে সামান্য পরিমাণ সহায়তা প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়, তা মানুষের কাছে পৌঁছাতে বাধা দিচ্ছে, বিশেষ করে উত্তরে। অথবা বিশৃঙ্খলভাবে বিতরণ করা হচ্ছে, ফলে লোকেরা ত্রাণ পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। যে যেভাবে পারছে, কাড়াকাড়ি করে ত্রাণ নিচ্ছে।

এটি আমার সম্প্রদায়ের মর্যাদা কেড়ে নিচ্ছে এবং সবচেয়ে দুর্বলদের কোনো সাহায্যই দেওয়া হচ্ছে না। শত শত মানুষ পরিবারের জন্য খাদ্য পাওয়ার চেষ্টায় তাদের জীবন দিয়ে দিয়েছে।

জাতিসংঘ সতর্ক করেছে, গাজার জনগণের পুষ্টির অবস্থা এমনভাবে হ্রাস পেয়েছে, যার নজির বিশ্বে আর নেই। অথচ জগতের বাকিরা তাদের জন্য কিছুই করছে না।

আমি যখন জাবালিয়া শরণার্থীশিবিরের একসময়ের ব্যস্ত বাজারে যাই, তখন আর কোনো স্টল বা বিক্রি করার মতো খাবার থাকে না। চাল, ডাল এবং মটরশুঁটি সব উধাও হয়ে গেছে, কেবল মসলা এবং অত্যন্ত ব্যয়বহুল বাদাম রাখা আছে। এমনকি আমরা আমাদের বাচ্চাদের যে ছোট ছোট নাশতা দিতাম তা অসম্ভব বিলাসবহুল হয়ে উঠেছে। এখন প্রচুর দাম সেই সব খাবারের। 

আমার সঙ্গে বেশ কিছু লোকের দেখা হয়েছে, যাঁরা দিনে মাত্র এক কাপ কফি খেয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছেন। যে খাবার তাঁরা খেতে পারতেন তা আর খাচ্ছেন না তাঁদের ক্ষুধার্ত সন্তানদের জন্য। গাজায় আমার পরিচিত প্রত্যেক ব্যক্তির ওজন কমেছে, গড়ে ১০ থেকে ৩০ কেজি পর্যন্ত। আমার এবং আমার বাচ্চাদের ওজনও কমে গেছে; আমার সহকর্মীরা অবাক হয়ে যান যখন তাঁরা ছবিতে দেখেন যে আমার ওজন কতটা কমেছে।

আমি সম্প্রতি একজন ব্যক্তিকে তাঁর দুই সন্তানকে কয়েকটি চিপস দিতে দেখেছি এবং আমার মনে আছে, তিনি বলেছিলেন যে তোমরা তোমাদের অংশগুলো ঠিকভাবে গুনে নাও, কারণ আমার কাছে কিছুই আর অবশিষ্ট নেই এবং এটি তোমাদের সারা দিনের খাবার। এমনকি শিশুরা তাদের প্লেট, খালি পাত্র ও চামচ নিয়ে রাস্তায় বেরোতে শুরু করেছে এবং চিৎকার করে বলছে যে তারা খেতে চায়।

উত্তর গাজার হাসপাতালগুলোতে আমার সহকর্মীরা আমাকে বলেছেন যে তাঁরা সম্প্রতি কোনো খাবারই জোগাড় করতে পারেননি এবং কেবল খেজুর এবং বন্য গাছ দিয়ে তৈরি স্যুপের মতো তরল খাবার খাচ্ছেন। স্বাস্থ্যসেবাকর্মীরা ক্লান্ত এবং তাঁদের রোগীদের চিকিৎসার জন্য ২৪ ঘণ্টা ৭ দিন কাজ করার সময় প্রচণ্ড শারীরিক দুর্বলতায় ভুগছেন। কামাল আদওয়ান হাসপাতালের শিশুরোগ বিভাগের প্রধান হুসাম আবু সাফিয়া বলেন, প্রতিদিন প্রায় ২৫ থেকে ৩০টি শিশুকে ভর্তি করা হচ্ছে, যাদের অর্ধেকই পানিশূন্যতা ও অনাহারে ভুগছে।

আমার এটা বলাটা ভুল হবে না যে ইসরায়েলি সরকার গাজার অনাহারকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। এটি সম্পূর্ণরূপে প্রতিরোধযোগ্য মানব-সৃষ্ট সংকট এবং এখনই এর অবসান ঘটানো যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং অন্যান্য দেশের ভাসা-ভাসা সাহায্য, যেমন বিমান থেকে খাবার ফেলা এবং অস্থায়ী সমুদ্রবন্দর নির্মাণ—এই দুর্ভিক্ষের অবসানের সমাধান নয়। প্রতিবেশীরা আমাকে বলেছে যে বিমান থেকে ফেলা খাবার দুই বা তিন দিনের জন্য মাত্র দুই বা তিনজনের জন্য যথেষ্ট।

গাজার দখলদার শক্তি হিসেবে সেখানকার জনগণ যাতে খাদ্য ও চিকিৎসাসেবা পায় তা নিশ্চিত করা ইসরায়েলের আইনি দায়িত্ব। এই বাধ্যবাধকতা পূরণের জন্য, ইসরায়েলকে অবিলম্বে গাজার ওপর থেকে অবরোধ সম্পূর্ণভাবে তুলে নিতে হবে, সব স্থলপথ পুনরায় খুলতে হবে এবং সহায়তা ও সহায়তাকর্মীদের জন্য নিরবচ্ছিন্ন প্রবেশাধিকারের অনুমতি দিতে হবে। 

একটি সম্পূর্ণ মানব-সৃষ্ট ট্র্যাজেডি চলছে, যা বিশ্ব দেখছে। যদি অবিলম্বে গাজায় খাবার না দেওয়া হয়, আমি আশঙ্কা করছি যে সবচেয়ে খারাপ ঘটনা ঘটবে এবং আরও বেশিসংখ্যক মানুষ অনাহারে মারা যাবে। ইসরায়েলকে এখনই ক্রসিংগুলো খুলে দিতে হবে। 

মাহমুদ শালাবি, সিনিয়র প্রোগ্রাম ডাইরেক্টর, মেডিকেল এইড ফর প্যালেস্টিনিয়ানস, গাজা 

(দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত লেখাটি ইংরেজি থেকে অনূদিত)

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত