মোনায়েম সরকার
বিচ্ছিন্নতাবাদী শিখ নেতা হারদীপ সিং নিজ্জারের হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারত-কানাডার বন্ধুত্বের সম্পর্কে যে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে, তার পরিণতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে—তা নিয়ে শুরু হয়েছে জল্পনা-কল্পনা। দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কেরও অবনতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে পুরো বিষয়টি নির্ভর করবে বৃহৎ শক্তি হিসেবে পরিচিত দেশগুলোর অবস্থানের ওপর। কোনো দেশই হুটহাট করে সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো দেশের পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান নেবে বলে মনে হচ্ছে না।
খালিস্তান ইস্যুটি ভারতের জন্য স্পর্শকাতর। ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যে মোট জনগোষ্ঠীর ৫৮ শতাংশ শিখ এবং ৩৯ শতাংশ হিন্দু। আশি ও নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে খালিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন জোরদার হয়। ওই সময় হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়। এই মুহূর্তে এই আন্দোলন নিয়ে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ভারতের বাইরে বসবাসরত অভিবাসীরা।
কানাডায় অভিবাসী সম্প্রদায়ের অন্যতম বৃহৎ অংশ ভারতীয় বংশোদ্ভূত। এই সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। এর মধ্যে ৭ লাখ ৭০ হাজার শিখধর্মানুসারী। কানাডার মোট জনসংখ্যা ৪ কোটি। পাঞ্জাবের বাইরে সবচেয়ে বেশি শিখ বসবাস করে কানাডায়।
হারদীপ সিং নিজ্জার ১৯৭৭ সালে ভারতের পাঞ্জাবের জলন্ধর থেকে কানাডায় যান। গত ১৮ জুন সন্ধ্যায় কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়ার সারে শহরে এক শিখমন্দির গুরুদুয়ারার গাড়ি পার্কিংয়ে তাঁকে গুলি করে হত্যা করে দুজন মুখোশ পরিহিত বন্দুকধারী। সে সময় নিজ্জার গাড়ির ভেতরে ছিলেন।
নিজ্জারের মৃত্যুর কয়েক মাস পরও কানাডার ভেতরে এবং বাইরে এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিক্ষোভ হয়েছে। কানাডার টরন্টো ছাড়াও লন্ডন, মেলবোর্ন, সান ফ্রান্সিসকোর মতো শহরে জুলাই মাসে বিক্ষোভ মিছিল করেছে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। তাদের অভিযোগ, ভারত সরকার এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী।
ভারতের উত্তরাঞ্চল ও পাকিস্তানের কিছু অংশ নিয়ে স্বাধীন শিখরাষ্ট্র খালিস্তান গঠনের পক্ষে ছিলেন হারদীপ সিং নিজ্জার। ভারতের অভিযোগ, নিজ্জার ছিলেন সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘খালিস্তানি টাইগার ফোর্স’ ও ভারতে নিষিদ্ধ ‘শিখস ফর জাস্টিস’-এর কানাডা শাখার নেতা। তিনি ভারতে বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসবাদী হামলাও চালিয়েছেন। যদিও নিজ্জার সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। ভারত তাঁকে ‘ওয়ান্টেড’ সন্ত্রাসী ঘোষণা করে এবং দেশে ফেরত আনতে আগ্রহী ছিল।
ওয়ার্ল্ড শিখ অর্গানাইজেশন বলছে, গত গ্রীষ্মে কানাডার গোয়েন্দা সংস্থাকে নিজ্জার জানিয়েছিলেন, তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। স্বাধীন শিখ রাষ্ট্রের ইস্যুতে ব্রিটিশ কলম্বিয়ার সারেতে সেপ্টেম্বরে তিনি একটি গণভোটের আয়োজন করতে যাচ্ছিলেন। স্বাধীন খালিস্তান গঠনের প্রশ্নে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় এ ধরনের গণভোট আয়োজন করা হচ্ছিল। গত বছর কানাডার অন্টারিও প্রদেশের ব্র্যাম্পটন শহরে এ রকম একটি গণভোটের আয়োজন করা হয়। ব্র্যাম্পটনে শিখ জনসংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার।
ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের পর কানাডা হচ্ছে দ্বিতীয় দেশ, যেখানে শিখ সম্প্রদায়ের বসবাস সবচেয়ে বেশি। স্বাভাবিক কারণেই সে দেশের রাজনীতিতে শিখ সম্প্রদায়ের প্রভাব যথেষ্ট। এই সম্প্রদায়ের মধ্যে খালিস্তানিদের প্রভাব এবং তা মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ও তাঁর দল কঠোর নয় বলে ভারত অনেক দিন ধরেই অভিযোগ করে আসছে।
এবার পাল্টা অভিযোগ এনেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো। সম্প্রতি কানাডার পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউস অব কমন্সে ট্রুডো অভিযোগ করেন, হারদীপ সিংকে খুনের পেছনে ভারতীয় এজেন্টদের যুক্ত থাকার নির্দিষ্ট প্রমাণ তাঁর সরকারের কাছে রয়েছে। ট্রুডো বলেছেন, ‘কানাডার মাটিতে একজন কানাডীয় নাগরিককে হত্যার সঙ্গে বিদেশি সরকারের জড়িত থাকার বিষয়টি আমাদের সার্বভৌমত্বের অগ্রহণযোগ্য লঙ্ঘন।’
ট্রুডোর ওই অভিযোগের পরই কানাডায় অবস্থানরত এক ভারতীয় কূটনীতিককে বহিষ্কারের কথা জানান দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেলানিয়া জোলি। তিনি বলেন, কানাডা পবন কুমার রাই নামের ভারতীয় এক কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে। তিনি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিটিক্যাল উইংয়ের (র) প্রধান ছিলেন।
এর অল্প সময় পরই ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিবৃতি দিয়ে বলে, কানাডার প্রধানমন্ত্রী সে দেশের পার্লামেন্টে যা বলেছেন, তা ‘অবাস্তব ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’। ভারতে নিযুক্ত কানাডার হাইকমিশনার ক্যামেরুন ম্যাককে তলব করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তাঁকে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগ শুধু অসত্যই নয়, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রেও ক্ষতিকর। সে দেশের এক শীর্ষ কূটনীতিককে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্তের কথাও হাইকমিশনারকে জানিয়ে দেওয়া হয়।
ভারতের মন্ত্রণালয় বিবৃতি দিয়ে জানায়, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে পাঁচ দিনের মধ্যে ভারত ছেড়ে চলে যেতে বলা হয়েছে। ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কানাডার কূটনীতিকের অযথা হস্তক্ষেপ উদ্বেগজনক। তাদের ভারতবিরোধিতা বরদাশত করা যায় না।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে আরও বলা হয়, এ ধরনের অপ্রমাণিত অভিযোগের মূল লক্ষ্য খালিস্তানি চরমপন্থী ও সন্ত্রাসবাদীদের দিক থেকে চোখ ফেরানো। এই জঙ্গিদের কানাডা আশ্রয় দিয়েছে। তারা ভারতের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। অথচ কানাডা সরকার নিষ্ক্রিয়। বিষয়টি যথেষ্ট উদ্বেগের।
ভারত-কানাডা সম্পর্কের শীতলতার বিষয়টি স্পষ্ট বোঝা গেছে জি২০ শীর্ষ সম্মেলনের আসরে। ট্রুডো দিল্লি আসার আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে কাঠামোগত দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। ভারত সেই বৈঠকে রাজি হয়নি। মোদি ও ট্রুডো সম্মেলনের অবসরে সামান্য কিছু সময়ের জন্য কথা বলেছেন। সেখানেও খালিস্তানিদের প্রতি নরম মনোভাব দেখানোয় ট্রুডোর প্রতি উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন মোদি।
মোদি বলেছিলেন, কানাডায় ভারতীয় হাইকমিশনে একাধিকবার খালিস্তানিরা হামলা চালিয়েছে। তা সত্ত্বেও কানাডার সরকার কারও বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়নি। মোদি ভারতের অসন্তোষ ও অখুশির কথা স্পষ্ট করে জানিয়ে বলেছেন, ভারতের আশা, কানাডা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াইয়ে শামিল হবে।
সেই বৈঠকের পর সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের জবাবে ট্রুডো বলেন, কানাডায় সবার চেতনা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দেখানোর অধিকার আছে। যে অধিকারকে কানাডা বিশেষ গুরুত্ব দেয়, তা কখনো খর্ব করা যায় না। তবে সরকার হিংসা ও ঘৃণা বরদাশত করে না। ট্রুডো এ কথা জানাতে ভোলেননি যে হাতে গোনা কয়েকজনের অপকর্মের দায় একটা গোটা সম্প্রদায়ের ওপর চাপানো যায় না।
বর্তমান অবস্থায় দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে। অথচ ২০১০ সাল থেকেই ভারত ও কানাডার মধ্যে বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছে।
গত বছর আনুষ্ঠানিকভাবে এই আলোচনা আবার শুরু হয়। মাত্র তিন মাস আগে দুই দেশই জানিয়েছিল, চলতি বছরের মধ্যেই মুক্তবাণিজ্য নিয়ে একটি চুক্তি করতে চায়।
কিন্তু আকস্মিকভাবেই এ-সংক্রান্ত আলোচনা বন্ধ করে দিয়েছে কানাডা। ভারত-কানাডা বিভিন্ন পণ্যের ক্ষেত্রে পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। ২০২২ সালে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য হয়েছে ৮০০ কোটি ডলার (প্রায় ৬৬ হাজার ৬৩২ কোটি টাকা)। শুধু পারস্পরিক রপ্তানিই হয় প্রায় অর্ধেক, ৪০০ কোটি ডলার। এই ভরসাই অবাধ বাণিজ্যের আশা জাগিয়ে রাখছে। তা ছাড়া, ভূরাজনৈতিক দাবার বোর্ডে ভারত এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। ভারত শুধু একটি ক্রমবর্ধমান শক্তিই নয়, তারা বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। পশ্চিমারা ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে একটি সম্ভাব্য শক্তিশালী প্রতিরক্ষাপ্রাচীর হিসেবে বিবেচনা করে আসছে।
ভারতে অনুষ্ঠিত জি২০ শীর্ষ সম্মেলনে ইউক্রেনের পশ্চিমা মিত্ররা একটি চূড়ান্ত ঘোষণার বিষয়ে সম্মত হয়। তবে ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর জন্য এই ঘোষণাপত্রে রাশিয়ার নাম উল্লেখ করে নিন্দা জানানো হয়নি।
কানাডার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, হারদীপ হত্যার বিষয়টি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের কাছে উত্থাপন করেছেন ট্রুডো।
কানাডার মিত্ররা অটোয়ার প্রতি সতর্কতার সঙ্গে সমর্থন বজায় রেখেছে। ট্রুডো চেয়েছিলেন, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড নিয়ে গঠিত ‘দ্য ফাইভ আইজ’ বা ‘পঞ্চনেত্র জোট’ ভারতীয় আচরণের নিন্দা ও সমালোচনা করুক, যৌথভাবে বিবৃতি দিয়ে ভারতের ওপর প্রভাব বিস্তার করুক। কিন্তু বাকি চার সদস্যদেশের কেউ সেই প্রস্তাবে রাজি হয়নি।
ভারত-কানাডার বিরোধ পশ্চিমা কূটনীতিকদের মধ্যে নানা উদ্বেগ-শঙ্কার জন্ম দিয়েছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ভারত-কানাডা বিরোধে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কোনো একটি পক্ষে অবস্থান নেওয়ার ঝুঁকির দিকটি।
সাম্প্রতিক সময়ে ভারত নিজেকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। এই দেশগুলোকে ‘গ্লোবাল সাউথ’ বৈশ্বিক দক্ষিণ নামেও ডাকা হয়। এর মধ্যে অনেক দেশই ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের নিন্দা জানায়নি।
পশ্চিমা কূটনীতিকেরা কোনোভাবেই চাইবেন না, ভারত-কানাডা বিরোধের জেরে নতুন কোনো আন্তর্জাতিক সংকট তৈরি হোক কিংবা কমনওয়েলথভুক্ত দুটি দেশের বিরোধের জেরে উত্তর বনাম দক্ষিণের একটি লড়াই বেধে যাক বা ট্রান্স-আটলান্টিক শক্তির সঙ্গে উন্নয়নশীল বিশ্বের একটা দ্বন্দ্ব তৈরি হোক। নানা ধরনের বিরোধে জড়িয়ে দেশে দেশে সম্পর্কের যে জটিলতা তৈরি হচ্ছে, তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানুষ। ভারত-কানাডা বিরোধের জেরে নতুন কোনো ক্ষতির মুখোমুখি হতে চাইবে কি কোনো দেশ?
মোনায়েম সরকার, রাজনীতিবিদ, লেখক ও মহাপরিচালক, বিএফডিআর
বিচ্ছিন্নতাবাদী শিখ নেতা হারদীপ সিং নিজ্জারের হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারত-কানাডার বন্ধুত্বের সম্পর্কে যে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে, তার পরিণতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে—তা নিয়ে শুরু হয়েছে জল্পনা-কল্পনা। দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কেরও অবনতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে পুরো বিষয়টি নির্ভর করবে বৃহৎ শক্তি হিসেবে পরিচিত দেশগুলোর অবস্থানের ওপর। কোনো দেশই হুটহাট করে সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো দেশের পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান নেবে বলে মনে হচ্ছে না।
খালিস্তান ইস্যুটি ভারতের জন্য স্পর্শকাতর। ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যে মোট জনগোষ্ঠীর ৫৮ শতাংশ শিখ এবং ৩৯ শতাংশ হিন্দু। আশি ও নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে খালিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন জোরদার হয়। ওই সময় হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়। এই মুহূর্তে এই আন্দোলন নিয়ে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ভারতের বাইরে বসবাসরত অভিবাসীরা।
কানাডায় অভিবাসী সম্প্রদায়ের অন্যতম বৃহৎ অংশ ভারতীয় বংশোদ্ভূত। এই সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। এর মধ্যে ৭ লাখ ৭০ হাজার শিখধর্মানুসারী। কানাডার মোট জনসংখ্যা ৪ কোটি। পাঞ্জাবের বাইরে সবচেয়ে বেশি শিখ বসবাস করে কানাডায়।
হারদীপ সিং নিজ্জার ১৯৭৭ সালে ভারতের পাঞ্জাবের জলন্ধর থেকে কানাডায় যান। গত ১৮ জুন সন্ধ্যায় কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়ার সারে শহরে এক শিখমন্দির গুরুদুয়ারার গাড়ি পার্কিংয়ে তাঁকে গুলি করে হত্যা করে দুজন মুখোশ পরিহিত বন্দুকধারী। সে সময় নিজ্জার গাড়ির ভেতরে ছিলেন।
নিজ্জারের মৃত্যুর কয়েক মাস পরও কানাডার ভেতরে এবং বাইরে এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিক্ষোভ হয়েছে। কানাডার টরন্টো ছাড়াও লন্ডন, মেলবোর্ন, সান ফ্রান্সিসকোর মতো শহরে জুলাই মাসে বিক্ষোভ মিছিল করেছে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। তাদের অভিযোগ, ভারত সরকার এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী।
ভারতের উত্তরাঞ্চল ও পাকিস্তানের কিছু অংশ নিয়ে স্বাধীন শিখরাষ্ট্র খালিস্তান গঠনের পক্ষে ছিলেন হারদীপ সিং নিজ্জার। ভারতের অভিযোগ, নিজ্জার ছিলেন সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘খালিস্তানি টাইগার ফোর্স’ ও ভারতে নিষিদ্ধ ‘শিখস ফর জাস্টিস’-এর কানাডা শাখার নেতা। তিনি ভারতে বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসবাদী হামলাও চালিয়েছেন। যদিও নিজ্জার সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। ভারত তাঁকে ‘ওয়ান্টেড’ সন্ত্রাসী ঘোষণা করে এবং দেশে ফেরত আনতে আগ্রহী ছিল।
ওয়ার্ল্ড শিখ অর্গানাইজেশন বলছে, গত গ্রীষ্মে কানাডার গোয়েন্দা সংস্থাকে নিজ্জার জানিয়েছিলেন, তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। স্বাধীন শিখ রাষ্ট্রের ইস্যুতে ব্রিটিশ কলম্বিয়ার সারেতে সেপ্টেম্বরে তিনি একটি গণভোটের আয়োজন করতে যাচ্ছিলেন। স্বাধীন খালিস্তান গঠনের প্রশ্নে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় এ ধরনের গণভোট আয়োজন করা হচ্ছিল। গত বছর কানাডার অন্টারিও প্রদেশের ব্র্যাম্পটন শহরে এ রকম একটি গণভোটের আয়োজন করা হয়। ব্র্যাম্পটনে শিখ জনসংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার।
ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের পর কানাডা হচ্ছে দ্বিতীয় দেশ, যেখানে শিখ সম্প্রদায়ের বসবাস সবচেয়ে বেশি। স্বাভাবিক কারণেই সে দেশের রাজনীতিতে শিখ সম্প্রদায়ের প্রভাব যথেষ্ট। এই সম্প্রদায়ের মধ্যে খালিস্তানিদের প্রভাব এবং তা মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ও তাঁর দল কঠোর নয় বলে ভারত অনেক দিন ধরেই অভিযোগ করে আসছে।
এবার পাল্টা অভিযোগ এনেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো। সম্প্রতি কানাডার পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউস অব কমন্সে ট্রুডো অভিযোগ করেন, হারদীপ সিংকে খুনের পেছনে ভারতীয় এজেন্টদের যুক্ত থাকার নির্দিষ্ট প্রমাণ তাঁর সরকারের কাছে রয়েছে। ট্রুডো বলেছেন, ‘কানাডার মাটিতে একজন কানাডীয় নাগরিককে হত্যার সঙ্গে বিদেশি সরকারের জড়িত থাকার বিষয়টি আমাদের সার্বভৌমত্বের অগ্রহণযোগ্য লঙ্ঘন।’
ট্রুডোর ওই অভিযোগের পরই কানাডায় অবস্থানরত এক ভারতীয় কূটনীতিককে বহিষ্কারের কথা জানান দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেলানিয়া জোলি। তিনি বলেন, কানাডা পবন কুমার রাই নামের ভারতীয় এক কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে। তিনি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিটিক্যাল উইংয়ের (র) প্রধান ছিলেন।
এর অল্প সময় পরই ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিবৃতি দিয়ে বলে, কানাডার প্রধানমন্ত্রী সে দেশের পার্লামেন্টে যা বলেছেন, তা ‘অবাস্তব ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’। ভারতে নিযুক্ত কানাডার হাইকমিশনার ক্যামেরুন ম্যাককে তলব করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তাঁকে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগ শুধু অসত্যই নয়, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রেও ক্ষতিকর। সে দেশের এক শীর্ষ কূটনীতিককে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্তের কথাও হাইকমিশনারকে জানিয়ে দেওয়া হয়।
ভারতের মন্ত্রণালয় বিবৃতি দিয়ে জানায়, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে পাঁচ দিনের মধ্যে ভারত ছেড়ে চলে যেতে বলা হয়েছে। ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কানাডার কূটনীতিকের অযথা হস্তক্ষেপ উদ্বেগজনক। তাদের ভারতবিরোধিতা বরদাশত করা যায় না।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে আরও বলা হয়, এ ধরনের অপ্রমাণিত অভিযোগের মূল লক্ষ্য খালিস্তানি চরমপন্থী ও সন্ত্রাসবাদীদের দিক থেকে চোখ ফেরানো। এই জঙ্গিদের কানাডা আশ্রয় দিয়েছে। তারা ভারতের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। অথচ কানাডা সরকার নিষ্ক্রিয়। বিষয়টি যথেষ্ট উদ্বেগের।
ভারত-কানাডা সম্পর্কের শীতলতার বিষয়টি স্পষ্ট বোঝা গেছে জি২০ শীর্ষ সম্মেলনের আসরে। ট্রুডো দিল্লি আসার আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে কাঠামোগত দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। ভারত সেই বৈঠকে রাজি হয়নি। মোদি ও ট্রুডো সম্মেলনের অবসরে সামান্য কিছু সময়ের জন্য কথা বলেছেন। সেখানেও খালিস্তানিদের প্রতি নরম মনোভাব দেখানোয় ট্রুডোর প্রতি উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন মোদি।
মোদি বলেছিলেন, কানাডায় ভারতীয় হাইকমিশনে একাধিকবার খালিস্তানিরা হামলা চালিয়েছে। তা সত্ত্বেও কানাডার সরকার কারও বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়নি। মোদি ভারতের অসন্তোষ ও অখুশির কথা স্পষ্ট করে জানিয়ে বলেছেন, ভারতের আশা, কানাডা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াইয়ে শামিল হবে।
সেই বৈঠকের পর সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের জবাবে ট্রুডো বলেন, কানাডায় সবার চেতনা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দেখানোর অধিকার আছে। যে অধিকারকে কানাডা বিশেষ গুরুত্ব দেয়, তা কখনো খর্ব করা যায় না। তবে সরকার হিংসা ও ঘৃণা বরদাশত করে না। ট্রুডো এ কথা জানাতে ভোলেননি যে হাতে গোনা কয়েকজনের অপকর্মের দায় একটা গোটা সম্প্রদায়ের ওপর চাপানো যায় না।
বর্তমান অবস্থায় দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে। অথচ ২০১০ সাল থেকেই ভারত ও কানাডার মধ্যে বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছে।
গত বছর আনুষ্ঠানিকভাবে এই আলোচনা আবার শুরু হয়। মাত্র তিন মাস আগে দুই দেশই জানিয়েছিল, চলতি বছরের মধ্যেই মুক্তবাণিজ্য নিয়ে একটি চুক্তি করতে চায়।
কিন্তু আকস্মিকভাবেই এ-সংক্রান্ত আলোচনা বন্ধ করে দিয়েছে কানাডা। ভারত-কানাডা বিভিন্ন পণ্যের ক্ষেত্রে পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। ২০২২ সালে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য হয়েছে ৮০০ কোটি ডলার (প্রায় ৬৬ হাজার ৬৩২ কোটি টাকা)। শুধু পারস্পরিক রপ্তানিই হয় প্রায় অর্ধেক, ৪০০ কোটি ডলার। এই ভরসাই অবাধ বাণিজ্যের আশা জাগিয়ে রাখছে। তা ছাড়া, ভূরাজনৈতিক দাবার বোর্ডে ভারত এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। ভারত শুধু একটি ক্রমবর্ধমান শক্তিই নয়, তারা বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। পশ্চিমারা ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে একটি সম্ভাব্য শক্তিশালী প্রতিরক্ষাপ্রাচীর হিসেবে বিবেচনা করে আসছে।
ভারতে অনুষ্ঠিত জি২০ শীর্ষ সম্মেলনে ইউক্রেনের পশ্চিমা মিত্ররা একটি চূড়ান্ত ঘোষণার বিষয়ে সম্মত হয়। তবে ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর জন্য এই ঘোষণাপত্রে রাশিয়ার নাম উল্লেখ করে নিন্দা জানানো হয়নি।
কানাডার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, হারদীপ হত্যার বিষয়টি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের কাছে উত্থাপন করেছেন ট্রুডো।
কানাডার মিত্ররা অটোয়ার প্রতি সতর্কতার সঙ্গে সমর্থন বজায় রেখেছে। ট্রুডো চেয়েছিলেন, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড নিয়ে গঠিত ‘দ্য ফাইভ আইজ’ বা ‘পঞ্চনেত্র জোট’ ভারতীয় আচরণের নিন্দা ও সমালোচনা করুক, যৌথভাবে বিবৃতি দিয়ে ভারতের ওপর প্রভাব বিস্তার করুক। কিন্তু বাকি চার সদস্যদেশের কেউ সেই প্রস্তাবে রাজি হয়নি।
ভারত-কানাডার বিরোধ পশ্চিমা কূটনীতিকদের মধ্যে নানা উদ্বেগ-শঙ্কার জন্ম দিয়েছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ভারত-কানাডা বিরোধে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কোনো একটি পক্ষে অবস্থান নেওয়ার ঝুঁকির দিকটি।
সাম্প্রতিক সময়ে ভারত নিজেকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। এই দেশগুলোকে ‘গ্লোবাল সাউথ’ বৈশ্বিক দক্ষিণ নামেও ডাকা হয়। এর মধ্যে অনেক দেশই ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের নিন্দা জানায়নি।
পশ্চিমা কূটনীতিকেরা কোনোভাবেই চাইবেন না, ভারত-কানাডা বিরোধের জেরে নতুন কোনো আন্তর্জাতিক সংকট তৈরি হোক কিংবা কমনওয়েলথভুক্ত দুটি দেশের বিরোধের জেরে উত্তর বনাম দক্ষিণের একটি লড়াই বেধে যাক বা ট্রান্স-আটলান্টিক শক্তির সঙ্গে উন্নয়নশীল বিশ্বের একটা দ্বন্দ্ব তৈরি হোক। নানা ধরনের বিরোধে জড়িয়ে দেশে দেশে সম্পর্কের যে জটিলতা তৈরি হচ্ছে, তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানুষ। ভারত-কানাডা বিরোধের জেরে নতুন কোনো ক্ষতির মুখোমুখি হতে চাইবে কি কোনো দেশ?
মোনায়েম সরকার, রাজনীতিবিদ, লেখক ও মহাপরিচালক, বিএফডিআর
আধুনিক যুগের সবচেয়ে বিস্ময়কর প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারগুলোর একটি হচ্ছে গৌতম বুদ্ধের দেহাবশেষের সঙ্গে সম্পর্কিত ঐতিহাসিক রত্নসম্ভার। গতকাল বুধবার হংকংয়ে বিখ্যাত আর্ট নিলাম কোম্পানি সাদাবি’স-এর এক নিলামে এগুলো তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
৭ দিন আগেপাকিস্তানে ভারতের হামলার সমালোচনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। চীনও এই হামলাকে ‘দুঃখজনক’ বলে অভিহিত করেছে। উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘও। উত্তেজনা যেন আরও না বাড়ে, সে জন্য দুই পক্ষকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশ। এদিকে ভারতের অবস্থানকে সমর্থন করেছে...
৭ দিন আগেভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলা নিয়ে দুই চিরবৈরী প্রতিবেশীর মধ্যে উত্তেজনার পারদ ক্রমেই চড়ছিল। তা তুঙ্গে উঠল এবার পাকিস্তানের ভূখণ্ডে ভারতের ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামের ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান হামলা দিয়ে। পাশাপাশি সীমান্তেও দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলি হয়েছে...
৭ দিন আগেঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা এলাকায় যাত্রীবাহী বাসে ডাকাতি বেড়েই চলছে। এ কারণে চালক ও যাত্রীদের কাছে আতঙ্কের নাম হয়ে উঠছে এই সড়ক। ডাকাতির শিকার বেশি হচ্ছেন প্রবাসফেরত লোকজন। ডাকাতেরা অস্ত্র ঠেকিয়ে লুট করে নিচ্ছে সর্বস্ব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়েও ঘটছে ডাকাতির ঘটনা।
০২ মার্চ ২০২৫