Ajker Patrika

হারিছ চৌধুরীর মৃত্যুর প্রমাণ পায়নি সিআইডি

শাহরিয়ার হাসান, ঢাকা
আপডেট : ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৩: ৫৬
হারিছ চৌধুরীর মৃত্যুর প্রমাণ পায়নি সিআইডি

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব ও বিএনপির প্রভাবশালী নেতা হারিছ চৌধুরী বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন, তা এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ বা সিআইডি। তবে তিনি যে গত ১৪ বছর দেশে ছিলেন না সে ব্যাপারে কিছুটা নিশ্চিত হতে পেরেছেন তদন্তকারী কর্মকর্তারা। তাঁদের ধারণা, শুরু থেকেই হারিছ চৌধুরীর অবস্থান যুক্তরাজ্যেই ছিল। গত পাঁচ-সাত বছরে তাঁর পাসপোর্ট ব্যবহার করে কেউ দেশে প্রবেশ করেননি। তা ছাড়া, ঢাকায় বা যুক্তরাজ্যে তাঁর মৃত্যুর বিষয়টি কোনো স্বজন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানাতে পারেননি।

তাহলে হঠাৎ এই নেতার মৃত্যুর গুঞ্জন কেন? সিআইডির কর্মকর্তারা বলছেন, ইন্টারপোলের রেড নোটিশ বাতিলের জন্য এমন মৃত্যুর সংবাদ ছড়ানো হতে পারে। তবে পুলিশ সদর দপ্তরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি) বলছে, নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ঝুলতেই থাকবে হারিছের বিরুদ্ধে সেই রেড নোটিশ। জানতে চাইলে সিআইডির সিরিয়াস ক্রাইমের বিশেষ পুলিশ সুপার সাইদুর রহমান খান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘হারিছ চৌধুরী যে মারা গেছেন এখন পর্যন্ত বিষয়টি আমরা নিশ্চিত হতে পারিনি। যেহেতু তাঁর কোনো খোঁজ আগেও ছিল না, তাই তাঁর বেঁচে থাকা বা মারা যাওয়া কোনো সম্ভাবনাকেই আমরা আমলে নিচ্ছি না।’

তবে সিআইডির তদন্ত-সংশ্লিষ্ট পদস্থ আরেক কর্মকর্তা বলেছেন, গত বছরের ৫ অক্টোবর হারিছ চৌধুরীর ভাই এমরান হোসেন চৌধুরী ওরফে সেলিম চৌধুরী মারা গেছেন। তাঁকে সিলেটে তাঁদের পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। সেটাকে ধরেই হারিজ চৌধুরীর মৃত্যুর সংবাদ ছড়ানো হয়ে থাকতে পারে বলে তাঁরা ধারণা করছেন।

২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এলে আত্মগোপনে চলে যান বিএনপির নেতা হারিছ চৌধুরী। এর পর থেকে তাঁকে ধরিয়ে দিতে ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারি করা হয়। ১৪ বছর ধরে এই নোটিশ ঝুললেও তাঁর অবস্থানের বিষয়ে নিশ্চিত হতে না পারায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা যায়নি।

চলতি বছরের ১১ জানুয়ারি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হারিছ চৌধুরী মারা গেছেন বলে তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়। তাঁর মেয়ে সামিরা তানজিন চৌধুরীকে উদ্ধৃত করে গণমাধ্যম এ খবর প্রকাশ করে। এই খবরের সত্যতা নিশ্চিত করতে গত ১৯ জানুয়ারি পুলিশ সদর দপ্তর থেকে সিআইডিকে চিঠি দেওয়া হয়। ২৫ জানুয়ারি এ বিষয়ে তদন্তের দায়িত্ব নেয় সিআইডির সিরিয়াস ক্রাইম বিভাগ।

তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইন্টারপোলের রেড নোটিশ বাতিলের জন্য হারিছ চৌধুরীর পরিবার মৃত্যুর সংবাদ ছড়াচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখছেন তাঁরা। কেননা, হারিছ চৌধুরীর পরিবারের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে দুই ধরনের বক্তব্য দেওয়া হয়েছে। তাঁর চাচাতো ভাইয়ের দাবি তিনি যুক্তরাজ্যে মারা গেছেন আর মেয়ের ফেসবুক স্ট্যাটাসে দাবি, ঢাকাতেই মারা গেছেন তাঁর বাবা। তবে সেই আইডি এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না।

যুক্তরাজ্যে রয়েছেন হারিছ চৌধুরীর স্ত্রী জোসনা আরা চৌধুরী, ছেলে নায়েম শাফি চৌধুরী ও মেয়ে সামিরা তানজিন চৌধুরী। সিআইডির কর্মকর্তারা তাঁদের সঙ্গে এখনো যোগাযোগ করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু সফল না হওয়ায় তদন্ত নিয়ে কিছুটা অন্ধকারে রয়েছেন।

এদিকে এখনো ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটে হারিছের নামে রেড নোটিশ ঝুলছে। বিভিন্ন অপরাধে পলাতক বাংলাদেশের রেড নোটিশধারী ৪৯ জনের মধ্যে হারিছের নাম ও ছবি রয়েছে ১৩ নম্বরে। সেখানে তাঁর নাম চৌধুরী আবুল হারিছ লেখা। এতে তাঁর জন্মতারিখ থেকে শুরু করে জন্মস্থান, জাতীয়তা, উচ্চতা, ওজন, চুল ও চোখের রংসহ শারীরিক বিবরণ রয়েছে। রেড নোটিশে তাঁর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে হত্যাকাণ্ডের কথা উল্লেখ রয়েছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোর (এনসিবি) এআইজি মহিউল ইসলাম গতকাল বুধবার আজকের পত্রিকাকে বলেন, গত এক মাসে এমন কোনো প্রমাণ হাতে আসেনি, যেটা দিয়ে প্রমাণ হয় হারিজ চৌধুরী মারা গেছেন। এমন তথ্য পাওয়া যায়নি, যেটা প্রমাণ করে তিনি ঢাকায় ছিলেন। পুলিশের কাছে কয়েকটি হাসপাতালের নাম এসেছিল। বলা হয়েছিল সেখানে তিনি দীর্ঘদিন ছিলেন আর সেখান থেকে মারা গেছেন। কিন্তু সেগুলো তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোনো আলামত মেলেনি। তিনি আরও বলেন, তাঁর বেঁচে থাকা বা মারা যাওয়ার ওপর ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটে রেড নোটিশ থাকা না থাকা নির্ভর করছে। তবে কোনো কিছু সুনিশ্চিত না হয়ে রেড নোটিশ তোলা হবে না বলে জানান তিনি।

অন্যদিকে আজকের পত্রিকার কানাইঘাট (সিলেট) প্রতিনিধি জানিয়েছেন, কানাইঘাট উপজেলার ৩ নম্বর দিঘির পাড় পূর্ব ইউনিয়নের দর্পনগর চৌধুরী বাড়ি হলো হারিছ চৌধুরীর গ্রামের বাড়ি। বাড়িতে এখন তাঁর ছোট ভাই কামাল চৌধুরী বাস করেন। হারিছ চৌধুরীরা পাঁচ ভাই। বড় ভাই আবদুল মুকিত চৌধুরী থাকেন ইরানে। আর ছোট ভাই আবুল হাসনাত চৌধুরী ও এমরান হোসেন সেলিম চৌধুরী মারা গেছেন।

ভাইয়ের মৃত্যুর বিষয়ে জানতে চাইলে কামাল চৌধুরী বলেন, ২০০৭ সালে দেশে জরুরি অবস্থা জারির পর থেকে বড় ভাই হারিছ চৌধুরীর সঙ্গে কখনো, কোনো দিন দেখা হয়নি। বর্তমানে তিনি জীবিত না মৃত—এ বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। তবে দুই-তিন মাস আগে চাচাতো ভাই আশিক চৌধুরীর কাছে ফোন এসেছিল তাঁর ভাই মারা গেছেন। এরপর আর কিছুই জানেন না।

কানাইঘাট উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান হারিছ চৌধুরীর চাচাতো ভাই আশিক চৌধুরী বলেন, হারিছ চৌধুরী লন্ডনে বসবাস করতেন। আর তিনি অসুস্থ হয়ে লন্ডনেই মারা গেছেন বলে হারিছ চৌধুরীর মেয়ে সামিরা তানজিন চৌধুরী প্রায় ৪ মাস আগে তাঁকে ফোনে জানিয়েছিলেন। তবে সেটা তিনি শতভাগ নিশ্চিত নন।

হারিছ চৌধুরীর সিলেটের পরিবারের সদস্যরা বলছেন, এসব খবরের পর সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা নিয়মিত তাঁদের বাড়িতে আসছেন। তাঁদের বাড়িঘর, পারিবারিক কবরস্থানসহ নানা জায়গায় চষে বেড়াচ্ছেন। তবে তাঁরাও এ বিষয়ে পরিষ্কার করে তাঁদের কিছু বলতে পারেননি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত