Ajker Patrika

অনন্য সাহসী এক নারী

নুসরাত জাহান শুচি, সাংবাদিক
অনন্য সাহসী  এক নারী

একসময় আমাদের দেশের শুধু নয়, ভারতবর্ষের চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী মুসলিম নারীরা জানতেন না যে তাঁদের ঘরের বাইরে পৃথিবী বলে কিছু আছে। বিশাল এই পৃথিবীর আকাশ-বাতাস, চাঁদ-তারা, মেঠোপথ, নদী-নালা, পাহাড়, সমুদ্র, দেশের সীমানা ছাড়িয়ে গড়ে ওঠা মহাদেশ এবং বরফে ঢাকা আটলান্টিক, যার কোনোটাই তাঁদের দেখার সুযোগ ছিল না। এমনকি নারীদের কেউ কেউ খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে পাখির ওড়াও দেখেননি, তাঁদের কল্পনা কখনো দিগন্ত ছুঁতে পারেনি। অন্দরমহলেই যাঁদের জন্ম, সেখানেই বেড়ে ওঠা। কেবল মৃত্যুর পরেই তাঁদের দেহ অন্দরমহল থেকে বের হতে পারত।

এ রকম অবস্থায় যখন ভারতীয় নারীরা অসহনীয় অবস্থায় নিপতিত, সেই সময়ে নারী জাগরণের অগ্রদূত হয়ে বেগম রোকেয়ার জন্ম। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর, রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে।

জমিদারবাড়িতে তাঁর জন্ম। তিনি শৈশবে দেখেছেন মাত্র কয়েকটি টাকার জন্য কন্যাসন্তান বিক্রি করতে। নারীরাও যে মানুষ সেই সময়ে তিনি তা অনুভব করেছিলেন। স্বভাবতই তিনি ছিলেন কিছুটা আলাদা।

পিতা জহিরুদ্দীন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের একজন শিক্ষিত জমিদার হলেও মেয়ের শিক্ষার বিষয়ে ছিলেন রক্ষণশীল।
কিন্তু পড়াশোনার নিষেধাজ্ঞা বেগম রোকেয়াকে দমাতে পারেনি। তাঁর সাহিত্যপ্রেমী বড় দুই ভাই মোহাম্মদ ইব্রাহীম আবুল আসাদ সাবের, খলিলুর রহমান আবু যায়গাম সাবের ও বোন কামরুন্নেসার কাছে আরবি, ফারসি, ইংরেজি, উর্দু ভাষাই আয়ত্ত করেননি; বরং শিক্ষালাভ, সাহিত্যচর্চা ও মূল্যবোধও গড়ে তুলেছেন।

১৯৯৮ সালে বিহারের ভাগলপুরের উর্দুভাষী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে রোকেয়ার বিয়ে হয়। তিনি ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। সমাজসচেতন, কুসংস্কারমুক্ত, প্রগতিশীল, উদার ও মুক্তমনের অধিকারী স্বামীর উৎসাহ ও সহযোগিতায় তিনি কেবল ইংরেজি ভাষায়ই দক্ষতা অর্জন করেননি; বরং তাঁর সাহিত্য প্রতিভার উন্মেষ ঘটে। এ সময় রোকেয়া দেশি-বিদেশি লেখকদের রচনার সঙ্গে নিবিড়ভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পান।

১৯০২ সালে তাঁর ‘পিপাসা’ গল্প কলকাতার ‘নবপ্রভা’ পত্রিকায় ছাপা হয়। এর মাধ্যমেই সাহিত্যিক হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে। এরপর ১৯০৫ সালে ইংরেজি রচনা ‘সুলতানার স্বপ্ন’ প্রকাশিত হয়। ছোটগল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, বিজ্ঞান কল্পকাহিনি, রম্যরচনাও তিনি লিখেছেন। তাঁর রচনায় স্থান পেয়েছে বিজ্ঞানবোধ, যুক্তিবাদিতা। তিনি মতিচূর প্রবন্ধগ্রন্থে নারীদের পিছিয়ে থাকার কারণ হিসেবে শিক্ষার অভাবকে দায়ী করেছেন। নারী-পুরুষের সমকক্ষতার যুক্তি দিয়ে নারীদের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জনের আহ্বান জানান। এ ছাড়া পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনীতে তিনি অবরোধ প্রথার বিরোধিতা করেছেন।

১৯০৯ সালে তাঁর স্বামী সাখাওয়াত হোসেন মারা যান। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি নারীশিক্ষা বিস্তার ও সমাজসেবায় ব্রতী হন। গড়ে তোলেন ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’। শুধু স্কুল পরিচালনা ও সাহিত্যচর্চাই নয়, পাশাপাশি তিনি সাংগঠনিক ও সামাজিক কাজকর্মে জড়িত ছিলেন। ১৯১৬ সালে মুসলিম নারীদের সংগঠন ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৩০ সালে বাংলা ভাষার পক্ষে বঙ্গীয় মুসলিম সম্মেলনে জোরালো বক্তব্য দেন। এটি ছিল সেই সময়ের দুঃসাহসিক কাজের অন্যতম।

‘সুলতানার স্বপ্ন’ অবলম্বনে স্প্যানিশ নির্মাতা ইসাবেল হারগুয়েরা তৈরি করেছেন ‘এল সুয়েনো দে লা সুলতানা’ নামের অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র। প্রতিবছর জাতীয়ভাবে বেগম রোকেয়া দিবস পালন করা হয়। বিশিষ্ট নারীদের অর্জনের জন্য বেগম রোকেয়া পদক প্রদান করা হয়। ২০০৪ সালে বিবিসি বাংলার ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’ জরিপে বেগম রোকেয়া ষষ্ঠ নির্বাচিত হয়েছিলেন। মৃত্যুর আগমুহূর্তে তিনি ‘নারীর অধিকার’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখছিলেন।

অনন্য সাহসী এই নারী ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর নাম স্মরণীয় করে রাখতে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের আবাসনের জন্য তাঁর নামে হলের নামকরণ করা হয়েছে।

অনন্যসাধারণ এই নারীর জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

কথিত গোয়েন্দা এনায়েতকে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানান এক পুলিশ কর্মকর্তা, প্রাডো গাড়িও দেন তাঁকে

৯ পুলিশ পরিদর্শক বাধ্যতামূলক অবসরে

গণবিক্ষোভ আতঙ্কে মোদি সরকার, ১৯৭৪-পরবর্তী সব আন্দোলন নিয়ে গবেষণার নির্দেশ

‎ডিভোর্সের পরও জোর করে রাতযাপন, বর্তমান স্বামীকে নিয়ে প্রাক্তন স্বামীকে হত্যা ‎

হতাশায় শেষ হচ্ছে ইলিশের মৌসুম, আসছে নিষেধাজ্ঞা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত