Ajker Patrika

আকাশটা আমারও

বাসন্তি সাহা
আকাশটা আমারও

স্বামী চুল ধরে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন। রাস্তায় বেরিয়ে উচ্চশিক্ষিত লাবণীর মনে হলো, কোথায় যাব? স্বামী যখন মারা যান, তখন পলির সন্তান হয়নি। বাবার বাড়িতে ফিরে যাওয়ার উপায় ছিল না। কারণ তত দিনে দুই ভাই বাড়ি ভাগ করে নিয়েছেন। স্বামীও কিছু দিয়ে যাননি তাঁকে। শাশুড়ির দয়াদাক্ষিণ্য নিয়ে থাকতে বাধ্য হন। এগুলো আমাদের সমাজের দু-একটা উদাহরণ মাত্র। চারপাশে পায়ের তলায় মাটি নেই—এমন নারীই বেশি। গলা নিচু, আশ্রয় হারানোর ভয়ে কম্পিত আর অপমানের যন্ত্রণা উপশম দুপুরে ভাতঘুমের অবসরে চোখ দুটো মুছে নেওয়া—এই তো তাঁদের নিয়তি!

একজন নারীর বাইরে চাকরি করা বা অন্য কাজ করা কেবল অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতাই দেয় না, তাঁকে দেয় চারপাশের সবকিছুর ওপরে অধিকার, নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা এবং একই সঙ্গে দায়িত্ববোধ। তাই একজন স্বনির্ভর নারী চাইলে মন খারাপকে তুড়ি মেয়ে উড়িয়ে দিতে পারেন। চাইলেই পারেন প্রাণ খুলে হাসতে। আমার প্রিয় রেহানার বিয়ে হয়েছে। বিদেশে চলে যাবে স্বামীর সংসারে। ওর খুশি দেখে আমিও হাসছি। কিন্তু ভেতরে-ভেতরে আমার একটু মন খারাপ। ও হেসেখেলে আনন্দ নিয়ে গুছিয়ে যে চাকরিটা করছিল—সেই আনন্দটা ও কোথায় পাবে! পারবে? সংসার করতে করতে ওর এই ডানা মেলে ওড়ার আকাশটা হারিয়ে ফেলবে না তো!

তপা কাজ করত আমার সঙ্গে। যখনই যা বলেছি, না করেনি। আমি ওকে বলতাম আলাদিনের চেরাগের দৈত্য। তপাকে কখনো মনেই হয়নি ও মেয়ে। ও পারবে না। ওর বিয়ে হয়েছে। বিয়ের শর্তই ছিল চাকরি করতে পারবে না। এখন তপা সংসার করছে। পাশের দোকানে গেলেও সঙ্গে একজনকে নিতে হয়।

নারীর নিজের ইচ্ছা বা স্বাধীনতা কি কেবল আবর্তিত হয় তার পাশের পুরুষ বা স্বামীর ইচ্ছাতেই চলে। নারী বাইরে কাজ করবেন কি না, তা-ও কি তাঁরাই ঠিক করবেন? সেই চিন্তারও পরিবর্তন ও বিবর্তন হয়েছে। হয়তো কিছু মানুষেরও। কিন্তু আজও বেশির ভাগ নারীর স্বনির্ভরতা তাঁর কাজ করতে চাওয়াটা পরিবারের দান। নারীর চিরাচরিত অবয়বের সঙ্গে এখনো অনেক পুরুষ কর্মঠ শক্ত হাতের নারীটিকে মেলাতে চান না। আর এখান থেকেই হয়তো দ্বিধা, দ্বন্দ্ব আর সংকট তৈরি হয়।

নারী সব সময় কেবল প্রয়োজনেই উপার্জন করবেন তা-ও নয়। স্বাভাবিকভাবেই তিনি উপার্জন করবেন। নিজের জীবন চালাবেন। সিদ্ধান্ত নেবেন, নিজের মতো করেই বাঁচবেন। কিন্তু বেশির ভাগ উচ্চশিক্ষিত স্বামীই বলেন, ‘আমি তো তোমাকে স্বাধীনতা দিয়েছি, চাকরি করতে দিয়েছি, উপার্জিত টাকা ইচ্ছেমতো খরচ করার সুযোগ করে দিয়েছি।’ কিন্তু ফাঁকিটা এখানেই; তোমরা কেন ভাবছ সবকিছু তোমাদের দিতে হবে? স্বাধীনতাটা কি স্বাভাবিকভাবেই নারী পান না!

সমাজে যাঁরা সুবিধাবঞ্চিত নারী, যাঁরা বেশির ভাগ বাসাবাড়িতে কাজ করেন, তাঁরা কাজে এসেছেন সন্তানকে খেতে দেবেন বলে। সন্তানকে বাঁচাবেন বলে। এই সব গৃহকর্মীর বেশির ভাগ বাল্যবিবাহের শিকার। স্বামী আবার বিয়ে করেছেন অথবা অসুস্থ, উপার্জনক্ষম নন। তাই সন্তানের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার জন্য তাঁরা ঢাকায় এসে বাসাবাড়িতে কাজ নিয়েছেন। আবার কেউ কেউ গার্মেন্টসশ্রমিক ছিলেন, সন্তান হওয়ার সময় কাজ ছাড়তে হয়েছে। আর ফিরতে পারেননি কাজের জায়গায়। বাসাবাড়িতে কাজ করছেন।
তবে নারী যে কাজ করছেন, তাঁর নিজের উপার্জন কি নিজে ব্যবহার করতে পারছেন? সিদ্ধান্ত নেওয়ার জায়গায় নারী কতটা স্বাধীন! প্রকৃতিপণ্য তৈরি করছেন এমন একজন নারী আমাকে বলেছেন, ‘টাকাটা পুরাই স্বামীর হাতে তুলে দিই। স্বামীকে টাকা না দিলে কাজে আসতে দেবে না। এই টাকায় আমার ছেলেমেয়ের লেখাপড়া হচ্ছে, ছেলেমেয়ে সপ্তাহে দুদিন ডিম খাচ্ছে। আমরা একটু ভালো আছি।’

এর বাইরে দিনরাত যাঁরা ঘরের কাজ করেন, তাঁরা নিজেরাও ভাবেন তাঁরা কিছু করেন না। অন্যরা তো ভাবেই না। স্বামীরাও ফিরে এসে বলেন, কিছু তো করতে হয় না। বুঝবে কী করে!

স্বাভাবিকভাবে পরিবারে একটা মেয়েশিশুকে বড় করা হয় এভাবে। তুমি এটা পারবে না। তুমি এটা করবে না। এমন করলে কেউ ভালো বলে না। মনে হয় মেয়েরা সবকিছু ভালো করার, ভালো থাকার দায়ভার নিয়ে জন্মেছে। শহুরে সমাজের পরিবারগুলোতে এ ধারণা ভেঙে পড়ছে, কিন্তু তারা কজনই বা।

আমি বেগম রোকেয়া নই। তবে তাঁর একজন অনুসারী নিজেকে ভাবি। মেয়ে তুমি নিজের শর্তে বাঁচ। তাই চোখ-কান বুজে লেখাপড়াটা করো। তারপর কাজে মন দাও। নিজের জগৎটাকে এত ছোট কোরো না। চারপাশের সবকিছুকে তুমি উপেক্ষা করতে পারবে কেবল অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হলে। সংসারও করা যায়। বাচ্চাও মানুষ করা যায়। কোনো কিছুই আটকে থাকবে না। কিন্তু দ্বন্দ্ব-বিরোধ মোকাবিলা করতেই হবে। এটা কখনো সমষ্টিগত বা কখনো হবে একার লড়াই।

লেখক: কো-অর্ডিনেটর-রিসার্চ অ্যান্ড ডকুমেন্টেশন দ্বীপ উন্নয়ন সংস্থা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত