Ajker Patrika

পাকিস্তানে নির্বাচন-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ

মালিহা লোধি
আপডেট : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৭: ৫১
পাকিস্তানে নির্বাচন-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ

পাকিস্তানে ৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফল একই সঙ্গে চমকপ্রদ ও বিপর্যয়কর। সাম্প্রতিক বছরগুলোর রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে এ নির্বাচনটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই নির্বাচন দেশটিকে এখন মেরুকরণ ও অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দিয়েছে।

এই নির্বাচন নিয়ে নিষ্প্রভ প্রচার সত্ত্বেও ভোটাররা নিরুৎসাহিত হননি; বরং ধারণার চেয়ে বেশিসংখ্যক ভোটার ভোটকেন্দ্রে গেছেন। এটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় তাঁদের অংশগ্রহণের সুস্পষ্ট প্রমাণ, যা বলে দিচ্ছে ভোটাররা মনে করেন তাঁদের ভোটের গুরুত্ব আছে। নির্বাচনের ফলাফল আগেই নির্ধারিত হয়ে গেছে—এমন ধারণাকে ভুল প্রমাণ করেছে ভোটারদের উপস্থিতি। ফলাফল প্রকাশের পর স্পষ্ট হয়ে গেল যে যাঁরা এমনটা ধারণা করেছিলেন, তাঁরা ভোটারদের আচরণ ও মনের কথা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন।

পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের ফল ঘোষণায় অযৌক্তিকভাবে দেরি করে নিজেদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। ফলাফল দ্রুত ঘোষণার জন্য উন্নত ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে দাবি করা হলেও অতিরিক্ত সময়ক্ষেপণের কারণে তীব্র সমালোচনা হয়েছে। পাশাপাশি ভোটে কারচুপির অভিযোগ উঠেছে। ভোটের দিন দেশজুড়ে ইন্টারনেট পরিষেবা ও মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ রাখায় এই বিতর্ক আরও বেড়েছে এবং তা নির্বাচন কমিশন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে যথার্থ সমালোচনার মুখে ফেলে দিয়েছে। পিটিআইয়ের নেতারা দাবি করেছেন, এর ফলে তাঁদের জেতা আসনগুলো হারে পরিণত হয়েছে। কয়েকটি পশ্চিমা দেশ নির্বাচনে অনিয়মের তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে।

এই নির্বাচনে ভোটাররা বিভক্ত রায় দিয়েছেন এবং পার্লামেন্টে কোনো দলই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির ২৬৫টি আসনের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, ইমরান খানের পিটিআই-সমর্থিত প্রার্থীরা সবচেয়ে বেশি আসনে জিতেছেন। এর পরেই আছে পিএমএল-এন ও পিপিপি। পিটিআই-সমর্থিত প্রার্থীরা খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রাদেশিক পরিষদে জয়ী হয়েছেন। পাঞ্জাবেও তাঁদের অবস্থান বেশ শক্ত।

পিএমএল-এন প্রধানত পাঞ্জাবে জিতেছে। অন্যদিকে পিপিপি তাদের চিরাচরিত শক্ত দুর্গ সিন্ধু ধরে রেখেছে। বেলুচিস্তানে কিছু আসনেও জিতেছে তারা।

নিষেধাজ্ঞা, নির্বাচনী প্রতীক প্রত্যাখ্যান এবং প্রায় সব শীর্ষ নেতা কারাগারে থাকা সত্ত্বেও পিটিআইয়ের এই ফলাফল প্রমাণ করে, তাদের প্রতি সমর্থকদের সহানুভূতি এবং ভোট দেওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় অবস্থান তাদের প্রার্থীদের বিজয়ী করেছে।

পিএমএল-এন ও পিটিআই উভয় দলের নেতারা নিজেদের বিজয়ী ঘোষণা করেছেন এবং জাতীয় পরিষদে নিজেদের একক, সবচেয়ে বড় দল বা জোট বলে দাবি করেছেন। তবে, কেউই সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেননি, ফলে কোনো দলই এককভাবে সরকার গঠন করতে পারবে না। এটি সরকার গঠনের কাজকে কঠিন করে তুলেছে। এ জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেমন দর-কষাকষি চলবে, তেমনি দলবদলের খেলা শুরু হতে পারে। তবে এটি পাকিস্তানের জন্য নতুন কিছু নয়। দেশটিতে দীর্ঘদিন ধরে জোট সরকার ছিল এবং এই জোটের যুগ শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই।

নির্বাচনপূর্ব জোট নিয়েই পিএমএল-এন সরকার গঠনে এগিয়ে থাকলেও, কত দ্রুত তারা সফল হবে, সেটাই প্রশ্ন। ইস্তেহকাম-ই-পাকিস্তান পার্টি ও জেএফআইয়ের খারাপ ফল তাদের কাজকে আরও জটিল করে তুলছে। অন্যদিকে পিটিআই-সমর্থিত বিজয়ীদের এক থাকাটা কঠিন হবে। কারণ তাদের ওপর পিএমএল-এন নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ দেওয়ার চাপ বাড়বে।

পিপিপি আগে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সঙ্গে জোট বাঁধার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল, কিন্তু সংখ্যা বলছে যে তারা সম্ভবত কোনো শক্তিশালী জোট গড়ে তুলতে পারবে না। এদিকে নওয়াজ শরিফ যে পিএমএল-এন-পিপিপি জোট গঠনে মরিয়া, সেখানে দুই দলের মধ্যে দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্বের যেকোনোভাবে মীমাংসা জরুরি। সাম্প্রতিক বক্তৃতায় নওয়াজ শরিফ ‘স্বতন্ত্রদের’ সঙ্গেও জোট করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।

নির্বাচনে জয়ী সাধারণ আসনের সংখ্যা অনুপাতে ৭০টি সংরক্ষিত আসন বণ্টন করা হয়। রাজনৈতিক দল হিসেবে স্বীকৃতি না পাওয়ায় পিটিআই এই আসনগুলো থেকে বঞ্চিত হবে। ফলে সংরক্ষিত নারী ও সংখ্যালঘুদের আসনগুলো অন্য দলের মধ্যে বণ্টন করা হবে, যা তাদের সংখ্যাকে ‘কৃত্রিমভাবে’ বাড়িয়ে দেবে। এটি একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে।

যারাই ক্ষমতায় আসুক, তাদের একাধিক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো অর্থনীতি, যা এখনো সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে। মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়িয়েছে, যা নির্বাচনেও প্রভাব ফেলেছে। গত আগস্ট পর্যন্ত পিডিএম সরকারের দুর্বল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা নওয়াজের দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হওয়ার পেছনে আংশিকভাবে দায়ী।

আগামী সরকারকে দ্রুত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে একটি নতুন, দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা করতে হবে। কারণ ঠেকা দিয়ে চলার বিষয়টি মার্চেই শেষ হয়ে যাবে। আগামী বছরগুলোতে পাকিস্তানের বিপুল পরিমাণ বিদেশি ঋণ পরিশোধের জন্য এ আলোচনা খুবই জরুরি।

কিন্তু দুর্বল জোট সরকার অর্থনৈতিক সংস্কারের ব্যাপক সম্ভাবনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এই সংস্কার পাকিস্তানকে টেকসই প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগের পথে নিয়ে যেতে অতীব জরুরি। পরবর্তী সরকার যদি সংখ্যালঘু হয় এবং বিভিন্ন দলের সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকে, তাহলে কি তারা দেশকে অর্থনৈতিক সংকট থেকে উদ্ধার করতে কঠোর ও রাজনৈতিকভাবে কষ্টসাধ্য সিদ্ধান্ত নিতে পারবে?

নির্বাচনের পর শেয়ারবাজারে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারের দরপতন এবং পাকিস্তানের সরকারি ডলার বন্ডের দুর্বল হওয়াটা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও তাৎপর্যপূর্ণ অর্থনৈতিক সংস্কারের সম্ভাবনা নিয়ে অনিশ্চয়তারই প্রতিফলন।

রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জও এ ক্ষেত্রে কম নয়। সরকারকে জাতীয় পরিষদে শক্তিশালী বিরোধী দলের মুখোমুখি হতে হবে। ফলে আইন প্রণয়নের কাজ কঠিন হয়ে উঠবে। সঙ্গে সঙ্গে উত্তপ্ত পার্লামেন্ট পরিচালনার কাজও করতে হবে। এ ছাড়া দেশ এখন এতটাই বিভক্ত, নির্বাচন যে মেরুকরণকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে, তার প্রভাব নতুন সরকারের ওপর পড়বে।

প্রাদেশিক পরিষদগুলোয় নির্বাচনের ফলাফলে আঞ্চলিকতার ধারা কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য আরেকটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিচ্ছে। সিন্ধুতে পিপিপি, খাইবার পাখতুনখাওয়ায় পিটিআই এবং পাঞ্জাবে পিএমএল-এন সরকার গঠন করলে, চারটি প্রদেশের মধ্যে তিনটিই হবে ভিন্ন ভিন্ন দল দ্বারা পরিচালিত। আর দলগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে হওয়ায় কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দেশ পরিচালনা আরও কঠিন হবে।

পাকিস্তানের পরবর্তী সরকারকে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সাবলীল ও স্থিতিশীল সম্পর্ক গড়ে তোলার চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করতে হবে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সামরিক ক্ষেত্র, শাসন, এমনকি অর্থনৈতিক ও বিনিয়োগ বিষয়েও তাদের ভূমিকা বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকার ও সামরিক বাহিনীর মধ্যে সম্পর্ক কেমন হবে, তা জোট সরকারের টিকে থাকার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে কাজ করবে।

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনবে—এমন প্রত্যাশা নিয়ে মানুষ যে নির্বাচনের অপেক্ষায় ছিল, অবশেষে সেই নির্বাচন অসংখ্য অনিশ্চয়তা ও বৈধতার প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। দেশে এখন স্থিতিশীলতার ভীষণ প্রয়োজন, যা কেবল ক্ষত সারিয়ে তোলার মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব। ভোটাররা স্থিতিশীলতা অর্জনের সবচেয়ে ভালো পথ হিসেবে গণতন্ত্রকেই দেখেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, দেশের নেতারা কি নিজেদের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে জনগণের স্বার্থে গণতন্ত্রকে কাজে লাগানোর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারবেন?

মালিহা লোধি,যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জাতিসংঘে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত

(পাকিস্তানের ডন পত্রিকায় প্রকাশিত লেখাটি ইংরেজি থেকে অনূদিত)

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত