Ajker Patrika

বিদায়, কমরেড রনো

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম
বিদায়, কমরেড রনো

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের এক প্রবাদপুরুষ হায়দার আকবর খান রনোর জীবনাবসান ঘটেছে, ১১ মে রাতে। তিনি অসুস্থ অবস্থায় একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। করোনার সময় থেকে তিনি শারীরিকভাবে কষ্ট পাচ্ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটল। কমরেড হায়দার আকবর খান রনোর মতো সজ্জন, লক্ষ্যের প্রতি অবিচল, নিষ্ঠাবান বিপ্লবীর মৃত্যুতে যে শূন্যতা তৈরি হলো, তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়।

রনো ১৯৪২ সালের ৩১ আগস্ট কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মাতা কানিজ ফাতেমা মোহসিনা ও পিতা হাতেম আলী খান। মা-বাবার আনুকূল্য পেয়েই তিনি জড়িয়ে পড়েছিলেন রাজনীতিতে। তাঁর একমাত্র ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনীতিবিদ প্রয়াত হায়দার আনোয়ার খান জুনো। হায়দার আকবর খান রনো একাধারে মাঠে-ময়দানের সংগ্রামী রাজনৈতিক নেতা, একাত্তরের রণাঙ্গনের সৈনিক, তাত্ত্বিক ও লেখক।

রনো ছিলেন একজন মেধাবী ছাত্র। ১৯৫৮ সালে ঢাকার সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুল থেকে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মেধাতালিকায় ১২তম স্থান অধিকার করে ম্যাট্রিক পাস করেন। নটর ডেম কলেজ থেকে আইএসসি পাস করে ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে ভর্তি হন। তবে কারাবাসের কারণে তিনি অনার্স কোর্স সম্পন্ন করতে পারেননি। জেলখানায় বসে পরীক্ষা দিয়ে তিনি এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন। পরে হাইকোর্টের সনদও লাভ করেছিলেন, কিন্তু কোনো দিন আইন পেশায় যাননি। তিনি ছিলেন সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক কর্মী।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবেই ১৯৬১ সালে তিনি তদানীন্তন গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সভ্যপদ লাভ করেন। পরবর্তী দীর্ঘ জীবনে তিনি কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে, বিভিন্ন বাঁক ও মোড়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। একই সঙ্গে ক্ল্যাসিক্যাল মার্ক্সবাদী সাহিত্য পাঠ করেছেন এবং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তাত্ত্বিক অবদান রেখেছেন।

১৯৬৯ সালেই তিনি এ দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা হিসেবে পরিগণিত হন। ১৯৬৯ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক। ২০১০ সালে রাজনৈতিক মতবিরোধের কারণে তিনি ওয়ার্কার্স পার্টি পরিত্যাগ করে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন। তখন থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত তিনি সিপিবির প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে সক্রিয় ছিলেন। মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি ছিলেন পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা।

১৯৬২ সালের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে তিনি ছিলেন অন্যতম নেতা। তিনিই প্রথম সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বক্তব্য রেখেছিলেন (১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬২)। ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন তদানীন্তন সর্ববৃহৎ ছাত্রসংগঠন অবিভক্ত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক। ছাত্রজীবন শেষে তিনি শ্রমিক আন্দোলনে যোগদান করেন এবং টঙ্গী অঞ্চলে শ্রমিক বস্তিতে বাস করে গড়ে তোলেন এক নতুন ধারার সংগ্রামী শ্রমিক আন্দোলন। ১৯৭০ সালে তিনি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ শ্রমিক সংগঠন পূর্ব বাংলা শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানেও তিনি ছিলেন অন্যতম সংগঠক।

কমরেড রনো ছিলেন একাত্তরের রণাঙ্গনের সৈনিক। রনো ও তাঁর সহযোদ্ধাদের নেতৃত্বে গঠিত কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি দেশের অভ্যন্তরে ১৪টি আধামুক্ত ঘাঁটি গড়ে তুলেছিল। রনো এই সব ঘাঁটি অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন এবং রাজনৈতিক নির্দেশনা দিতেন। এই সংগঠনের প্রায় ৩০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা এই অঞ্চলগুলোয় সশস্ত্র যুদ্ধ করেছিলেন এবং শহীদ হয়েছিলেন শতাধিক।

রনো ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা এবং ১৯৯০ সালের গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম রূপকার।হায়দার আকবর খান রনো চারবার কারাবরণ করেছেন, সাতবার হুলিয়ার কারণে তাঁকে আত্মগোপনে যেতে হয়েছে। ১৯৬৩ সালে শেখ মুজিব ও হায়দার খান রনো কেন্দ্রীয় কারাগারের একই সেলে বন্দী ছিলেন। আইয়ুব আমল ও এরশাদ আমল—এই দুই আমল মিলিয়ে তাঁর বাসায় মিলিটারি ও পুলিশ রেড করেছে অর্ধশতাধিকবার।

রনোর একমাত্র কন্যার নাম রানা সুলতানা। দুই নাতি; নাম—অরিত্র ও অন্তিক। সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি তিনি মার্ক্সবাদ, রাজনীতি, ইতিহাস, দর্শন, অর্থনীতি, সাহিত্য ও বিজ্ঞান (পদার্থবিদ্যা) সংক্রান্ত বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন ও অসংখ্য প্রবন্ধ লিখেছেন। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে তিনি নিয়মিত কলাম লিখতেন।

২৪ বছর বয়সে তিনি প্রথম যে বইটি লেখেন তার নাম ‘সাম্রাজ্যবাদের রূপরেখা’। এ বইটিই ছিল পাকিস্তান আমলে মার্ক্সীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সাম্রাজ্যবাদসংক্রান্ত বিশ্লেষণমূলক প্রথম তাত্ত্বিক গ্রন্থ। তাঁর মোট গ্রন্থের সংখ্যা ২৫। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য: এক. শতাব্দী পেরিয়ে (২০০৫ সালে বর্ষসেরা বই হিসেবে প্রথম আলোর পুরস্কার লাভ করে), দুই. ফরাসি বিপ্লব থেকে অক্টোবর বিপ্লব, তিন. পুঁজিবাদের মৃত্যুঘণ্টা, চার. সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের সত্তর বছর, পাঁচ. মার্ক্সবাদের প্রথম পাঠ, ছয়. মার্ক্সীয় অর্থনীতি, সাত. গ্রাম শহরের গরিব মানুষ জোট বাঁধো, আট. মার্ক্সবাদ ও সশস্ত্র সংগ্রাম, নয়. কোয়ান্টাম জগৎ-কিছু বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক প্রশ্ন (বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত), দশ. রবীন্দ্রনাথ শ্রেণি দৃষ্টিকোণ থেকে, এগারো. মানুষের কবি রবীন্দ্রনাথ (বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত), বারো. বাংলা সাহিত্যে প্রগতির ধারা (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড), তেরো. পলাশী থেকে মুক্তিযুদ্ধ (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড), চৌদ্দ. স্তালিন প্রসঙ্গে (পুস্তিকা), পনেরো. অক্টোবর বিপ্লবের তাৎপর্য ও বর্তমান প্রেক্ষাপট (পুস্তিকা)। এ ছাড়া তিনি কয়েকটি বই সম্পাদনা করেছেন। এর মধ্যে অন্যতম: এক. মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীরা, 
দুই. নারী ও নারীমুক্তি২০২২ সালে তিনি বাংলা একাডেমি কর্তৃক সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। কমরেড হায়দার আকবর খান রনোর প্রতি জানাই বিপ্লবী সালাম ও শ্রদ্ধা।

লেখক: সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মেঘমল্লারের জবাবের পর ডাকসু ও বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে যা লিখলেন শশী থারুর

সবচেয়ে সুখী দেশ ফিনল্যান্ডে স্থায়ী বসবাসের আবেদন করবেন যেভাবে

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই দুই উপদেষ্টার পদত্যাগ চাইলেন ফখরুল

শ্বশুরবাড়ি যাওয়া হলো না জাবি শিক্ষক মৌমিতার

অনিয়মের অভিযোগ এনে জাকসু নির্বাচন কমিশন সদস্যের পদত্যাগ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত