Ajker Patrika

বই পোড়ানো বনাম বই পড়ানো

সেলিম জাহান, অর্থনীতিবিদ
বই পোড়ানো বনাম বই পড়ানো

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে গণ-অভ্যুত্থানের পরবর্তীকালে একটি বিষয় নিয়ে বিতর্কের জন্ম হয়েছে। বিতর্কটি একজন লেখকের বই পোড়ানো নিয়ে—সত্যিকার অর্থে একজন লেখকের বই পোড়ানো নিয়ে কর্মসূচি পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে!

বই পোড়ানো নিয়ে শুরুতেই তিনটে কথা বলি। প্রথমত, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখেছি বইয়ের লেখকের ভিত্তিতে নয়; বরং বইয়ের বিষয়বস্তুর ভিত্তিতেই বই পোড়ানো হয়েছে। যেমন কোনো প্রখ্যাত ব্যক্তিকে অবমাননা করা হয়েছে কোনো বইয়ে; কিংবা কোনো বইয়ে কোনো গোষ্ঠীর ধর্মানুভূতিতে আঘাত করা হয়েছে; অথবা পাঠকের বিচারে বইটির বিষয়বস্তু অশ্লীল বলে মনে হয়েছে, অতএব উপর্যুক্ত বইটি পোড়ানো হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, বইয়ের ক্ষেত্রে বই পোড়ানোর পরিবর্তে আরও দুটো বিপর্যয় বিভিন্ন সময় ঘটেছে সমাজে। যেমন কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাষ্ট্র নানা কারণে কোনো কোনো বইকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাঠক এবং জনগণ নানা কারণে অনেক বইকে বর্জন করেছে। এখানেও কারণ নানাবিধ।

তৃতীয়ত, বই পোড়ানো, বই নিষিদ্ধকরণ অথবা বই বর্জন—এই সব কর্মকাণ্ডে জনবিভক্তি দেখা গেছে। কেউ কেউ এগুলোকে সমর্থন করেছেন, কেউ কেউ এর বিরোধিতাও করেছেন।

বই পোড়ানোর যে কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে, এর একটি পরিপ্রেক্ষিত আছে। সাম্প্রতিক গণ-অভ্যুত্থানের সময়ে একজন লেখকের একটি বিরূপ মন্তব্যের কারণে তিনি নানাজন কর্তৃক ধিক্কৃত হন এবং সেই সঙ্গে প্রকাশক এবং পাঠক কর্তৃক বর্জিত হন। সেই ঘটনার ধারাবাহিকতাতেই তাঁর বই পোড়ানোর কর্মসূচির ডাক দেওয়া হয়েছে। বলা দরকার, এ বই পোড়ানোর ডাক তাঁর কোনো বিশেষ একটি বইকে লক্ষ্য করে নয়, সম্ভবত সেটা তাঁর সব বইয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

প্রশ্ন হচ্ছে, তাঁর বই বর্জনের পর সেই বই পোড়ানোটা কি যৌক্তিক? লেখককে ধিক্কার জানানো, তাঁকে পরিত্যাগ করা, তাঁকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য তাঁকে এবং তাঁর সৃষ্টিকে বর্জন করাই কি যথেষ্ট ছিল না? বর্জনের মাধ্যমে, ধিক্কার জানানোর মাধ্যমে, বিক্ষোভের মাধ্যমেই তো তাঁকে সর্বতোভাবে প্রত্যাখ্যানের বাণীটি আমরা বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছি। তারপর বই পোড়ানোটি একটি ধ্বংসাত্মক কাজ হয়ে যায় না? 
আমরা অবশ্য এটা বলতেই পারি, আমাদের ইচ্ছে হলে বই আমরা পোড়াতে পারি। সেই অধিকার আমাদের আছে। আমি আইনজ্ঞ নই।

তবু মনে হয়, কথা হয়তো মিথ্যে নয়। বই পোড়ানোর আইনগত অধিকার আমাদের থাকতে পারে, তবে নিশ্চিতভাবে সেই আইনগত অধিকার আমাদের নিজস্ব ক্রীত বইয়ের মধ্যেই সীমিত। কারণ আমার কেনা বই আমার নিজস্ব সম্পত্তি।

কিন্তু তার চেয়েও বড় প্রশ্ন—বই পোড়ানোর নৈতিক অধিকার কি আমাদের আছে? এই যে বই পুড়িয়ে আমরা বায়ুদূষণ সৃষ্টি করছি, পরিবেশ নষ্ট করছি, সেই নৈতিকতার দায় কি আমরা যাঁরা বই পোড়াচ্ছি, তাদের নয়? তেমনিভাবে, পুস্তক জ্ঞান-সম্পদও তো বটে। জ্ঞান-সম্পদ বিনষ্ট করা তো নৈতিকভাবে অনুচিত। একজন লেখকের প্রতি আমাদের বিক্ষোভ থাকতেই পারে, তাঁকে আমরা ধিক্কার জানাতে পারি, কিন্তু তাঁর বই পোড়ানোটা নীতিগতভাবে সমর্থনযোগ্য নয়।

তাই একটু যদি ভাবি, বই পোড়ানো নয়; বরং বই পড়ানোতেই আমাদের মনোযোগ নিবদ্ধ করা উচিত! আজকের নব্য প্রযুক্তির যুগে বই পড়ানো আর বই পড়া ক্রমেই কমে আসছে। আমাদের পড়া এখন অনেকটা যান্ত্রিক উপায়েই। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির যুগে জলজ্যান্ত বইয়ের জায়গা নেই। প্রয়োজন কি স্পর্শ, গন্ধ বা হস্তস্থিততার? পড়া হলেই হলো।

আসলে বই পড়ার মজা তো শুধু পড়াতেই নয়। পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বইয়ের স্পর্শ, গন্ধ, হাতের মধ্যে ধরা। পৃষ্ঠা ধরে চলে যাওয়া যায় সামনে-পেছনে অনায়াসেই। পাতার খস খস শব্দ কানে ঝংকার তোলে। ছাপার অক্ষরের সারি কেমন যেন নেশা ধরিয়ে দেয়। হস্তস্থিত জিনিসটি কেমন যেন আপন মনে হয়।

বই পড়ানোতে ফিরে আসে আরও বহু কিছু। বইয়ের উপভোগ্য হাজার গুণে ফেরত আসে, যখন বইটি আরেকজনকে পড়ানো হয়, আরেকজনের সঙ্গে সহভাগ করে নেওয়া হয়। সেই প্রক্রিয়া থেকে জন্ম নেয় কত আলোচনা, কত সুখস্মৃতি, কত তর্ক-বিতর্ক। বই পোড়ানোতে মানুষ ক্ষুদ্র হয়, বই পড়ানোতে মানুষ ঋদ্ধ হয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত