Ajker Patrika

সংকটকালে অর্থমন্ত্রীর ‘স্মার্ট’ বাজেট

ফারুক মেহেদী ও আবু সাইম, ঢাকা
আপডেট : ০১ জুন ২০২৩, ১৬: ৩৩
সংকটকালে অর্থমন্ত্রীর ‘স্মার্ট’ বাজেট

জিনিসপত্রের লাগামহীন দামে দরিদ্র ও মধ্যবিত্তের পকেট প্রায় ফাঁকা। রপ্তানি ও রেমিট্যান্সে মন্দায় তীব্র হয়েছে ডলার সংকট, টান পড়েছে রিজার্ভে। জ্বালানির দাম পরিশোধে হিমশিম অবস্থায় গ্যাস-সংকটে ধুঁকছে বিদ্যুৎ খাত। আমদানি কড়াকড়িতে চাপে পড়েছে পণ্য উৎপাদনও। দেশের সার্বিক অর্থনীতির এমন সংকটকালে আবারও দৃশ্যপটে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এক বছর আগে বাজেটে দেখানো স্বপ্ন ফিকে হয়ে মানুষে-মানুষে যখন চাপা শোরগোল আর হতাশার দীর্ঘশ্বাস, ঠিক তখনই আবারও আশাজাগানিয়া ফিরিস্তির ব্রিফকেস হাতে জাতীয় সংসদে ফিরছেন তিনি। ‘উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় দেড় দশক পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অভিমুখে’ স্লোগানে আজ নতুন অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করবেন অর্থমন্ত্রী।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য অর্থমন্ত্রী যে বাজেট নিয়ে আসছেন, তার আকার ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। বিশাল খরচের এই ‘স্মার্ট’ বাজেটের অর্থ সংস্থানে সরকারের রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ লাখ কোটি টাকা। মানুষের ওপর করের বোঝা চাপিয়ে এই টাকা আদায় করবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এ লক্ষ্য অর্জন করতে পারলেও থেকে যাবে বড় অঙ্কের বাজেট ঘাটতি।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, অর্থমন্ত্রী এবারও জিডিপির ৫ দশমিক ২ শতাংশ ঘাটতি বাজেট দেবেন। যেখানে আইএমএফের শর্ত আর চাপের মুখেও ২ লাখ ২ হাজার কোটি টাকার বড় ভর্তুকির ব্যবস্থা রেখেছেন। তিনি নির্বাচনী বছরে সরকারের হাজারো উন্নয়ন কর্মকাণ্ড আর মেগা প্রকল্পে ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা খরচের অঙ্কের হিসাব মেলানো বরাদ্দের কথা জানাবেন। নতুন অর্থবছরে দেশের অর্থনীতি চাঙা হবে, বিনিয়োগ আর কর্মসংস্থানে ভর করে জিডিপি প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৭ শতাংশে পৌঁছে যাবে, পণ্যসামগ্রীর দাম সহনীয় হয়ে মূল্যস্ফীতির পারদ ৬ শতাংশের ঘরে নামবে—বাজেট বক্তৃতায় এসব আশার বাণী শোনাবেন অর্থমন্ত্রী।

তবে বিশ্লেষকেরা ভাবছেন তার উল্টো। তাঁরা মনে করেন, দুর্বল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে বাজার ব্যবস্থাপনা দুর্বল। বিশ্ববাজারের সঙ্গে দাম সমন্বয় হচ্ছে না। আবার বাজারে অতিমুনাফা চক্র সক্রিয়। এসব বিষয়ে ব্যবস্থা না নিলে নতুন অর্থবছরেও নিত্যপণ্যের দামে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কমবে না।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, বর্তমান পরিস্থিতির পেছনে বড় কারণ বৈদেশিক মুদ্রার সংকট। ডলারের অভাবে আমদানি কমছে। রাজস্ব ঘাটতির এটাই প্রধান কারণ। ডলার সংকট ঠিক না হলে বাজেটের লক্ষ্য অর্জনে ঝুঁকি রয়েছে। বেসরকারি ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের ওপর প্রভাব পড়বে। ডলার সংকটে ব্যক্তি বিনিয়োগও বাড়ছে না। আবার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে দুই কূল হারাতে হবে—প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য পূরণ হবে না, মূল্যস্ফীতিও বাড়বে। এখনই মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি। আরও বাড়লে আগুনে ঘি ঢালার মতো হবে।

বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, নির্বাচনের বছরে মানুষকে কর-রাজস্বে ছাড় দেওয়ার রীতি থাকলেও আসছে বাজেটে যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি কঠোর থাকবে এনবিআর। ঘরে ঘরে এজেন্ট পাঠিয়ে করদাতা খুঁজে বের করার মিশন চালু হবে। বড় বাজেটের রাজস্ব জোগাতে যাঁর করযোগ্য কোনো আয় নেই, তাঁকেও দুই হাজার টাকা কর দিতে বাধ্য করা হতে পারে। সময়মতো রিটার্ন না দিলে দ্বিগুণ হারে জরিমানা দিতে হতে পারে। টিস্যু থেকে গ্যাস সিলিন্ডার, কোমল পানীয় থেকে সিগারেটের জন্য দিতে হবে আগের চেয়ে বেশি কর। কেউ নতুন মোবাইল ফোন কিনবে বা উড়োজাহাজে ঘুরতে যাবে, তাকেও ২০ থেকে ৫০ শতাংশ বেশি কর দিতে হবে। নির্মাণকাজের জন্য রড, সিমেন্ট, ইট কিনলে দিতে হবে বেশি ভ্যাট। বাড়ি-ফ্ল্যাট বিক্রি করলে দ্বিগুণ গেইন ট্যাক্স দেওয়া লাগবে। একটির বদলে দুটি গাড়ির মালিক হলে কার্বন কর নামে নতুন ধরনের কর দিতে হবে। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে যে করের সুবিধা পাওয়ার কথা, সেটিও কমিয়ে দেওয়া হতে পারে। এভাবে নির্বাচনের বছরে কর-রাজস্বের হার বাড়িয়ে এবং নতুন নতুন ক্ষেত্রকে করের আওতাভুক্ত করে কর আদায় বাড়ানোর মতো অপ্রিয় চেষ্টার ঝুঁকি নেবেন অর্থমন্ত্রী।

নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক দামের কঠিন সময়ে এনবিআরের পুরো সক্ষমতা কাজে লাগিয়েও বাজেটের পুরো খরচের টাকা তুলতে পারবেন না অর্থমন্ত্রী। ফলে আয়ের চেয়ে খরচ বেশি হবে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। এই ঘাটতির টাকা তিনি নেবেন ধার করে। এর মধ্যে দেশের ব্যাংকব্যবস্থা, সঞ্চয়পত্র ও অন্যান্য খাত থেকে ধার করবেন ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। আর বৈদেশিক উৎস থেকে নেবেন ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। এভাবে প্রতিবছর ঋণ করার কারণে সরকারের ওপর ঋণ ও সুদ পরিশোধের চাপ বাড়বে। নতুন অর্থবছরেও অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ৮৩ হাজার কোটি টাকা।

বৈদেশিক ঋণের সুদ ১২ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা দেওয়ার পাশাপাশি আগের ঋণের আসল শোধ করতে হবে ২৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাজেটের খরচ মেটাতে সুদ দিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ করলে বেসরকারি খাতের ঋণ পাওয়ার সুযোগ কমে যাবে। এতে বিনিয়োগ কমে গিয়ে কর্মসংস্থান নেতিবাচক হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হবে। মানুষের চাকরি বা কাজের সুযোগ কমবে। আবার সরকার খরচ মেটাতে নতুন টাকা ছাপিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার করলে সেটা মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা আরও কঠিন করে তুলবে।

গবেষণা সংস্থা সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান এ বিষয়ে আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ এখন নিম্নমুখী। এই অবস্থায় সরকার বেসরকারি ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিলে তা এই বিনিয়োগে আরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আবার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে তা মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিতে পারে। কিন্তু সরকারকে বাধ্য হয়েই ঋণ নিতে হবে; কারণ, আমাদের রাজস্ব আদায়ে গতি নেই, মনে হয় আমরা উল্টো পথে হাঁটছি। রাজস্ব বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে পরিচালন ব্যয়ের ক্ষেত্রে সরকারকে আরও সতর্ক হতে হবে। যেখান সম্ভব ব্যয় কমাতে হবে, যাতে ঘাটতি কম হয়, কম ঋণ নিতে হয়।’

বাজেট ২০২৩-২৪ সম্পর্কিত খবর আরও পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

পেহেলগাম হামলা: ধরা খেয়ে গেল মোদির কাশ্মীর ন্যারেটিভ

বিবাহিতদের পুলিশ ক্যাডারে সুপারিশ না করার প্রস্তাব

ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা: বিমানবাহিনীকে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিতে বললেন প্রধান উপদেষ্টা

সারজিসের সামনেই বগুড়ায় এনসিপি ও বৈষম্যবিরোধীদের মধ্যে হাতাহাতি-সংঘর্ষ

‘ঘুষের জন্য’ ৯১টি ফাইল আটকে রাখেন মাউশির ডিডি: দুদক

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত