জাহীদ রেজা নূর
আসন্ন নির্বাচন নিয়ে লিখতে ইচ্ছে করে না স্রেফ এই কারণে যে, লাউ আর কদুর গল্পটাই সেখানে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করছে। ক্ষমতায় থাকা দলটি দুর্নীতিবাজ, আর ক্ষমতার বাইরের দলটির সাফসুতরো অবয়ব—এ রকম ভাবলে খুবই ভুল হবে। মূলত ক্ষমতার কাছে গেলে দলগুলোর সাংগঠনিক দিকটি ক্রমেই বিলুপ্ত হতে থাকে। পুরো দলটাই তখন সরকার হয়ে যায়। আর তখন সরকারি টাকাপয়সার হিসাব-নিকাশের সঙ্গে দলের নেতারা এতটাই একাত্ম হয়ে যান যে তৃণমূল পর্যায়ের নেতারা তখন হয়ে ওঠেন অপাঙ্ক্তেয়। দল আর সরকারে কোনো ভেদাভেদ থাকে না।
ক্ষমতায় আসা দলের নেতাদের সম্পদের হিসাব নেওয়া হলে যদি তাঁদের সম্পত্তি অস্বাভাবিক রকম স্ফীত হয়ে উঠেছে বলে মনে হয়, তাহলে জানবেন, এখন পর্যন্ত এই স্ফীতি নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা হয়নি। এমপি-মন্ত্রী হলে একটা বিশেষ ভিআইপি সুবিধার আওতায় ব্যক্তিগত অর্থনীতির চাকা প্রবল বেগে কীভাবে ঘুরতে থাকে, সে কথা বোধকরি প্রাপ্তবয়স্ক বেশির ভাগ মানুষই জানেন। এই ‘বুঝদার’ মানুষেরা তক্কে তক্কে থাকেন। তাঁদের মধ্যে যাঁরা চালাক, তাঁরা ঝোপ বুঝে কোপ মারেন, সুযোগমতো দল বদলান। কোন দিকে হাওয়া বইছে, সেটা বুঝে নিয়ে নিজেদের শরীর সেদিকে ভাসিয়ে দেন। দিনের পর দিন সেটাই তো দেখা যাচ্ছে।
২. একদলীয় শাসনব্যবস্থার সংকট নিয়ে ১৯৯৬ সালের শুরুতে একটি উপসম্পাদকীয় লিখেছিলাম দৈনিক সংবাদে। তখন কেবল সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ফিরেছি। লেনিন কীভাবে পর্যুদস্ত হলেন রাশিয়ায়, আমার দেখা সেই অভিজ্ঞতার আলোকেই লেখাটা তৈরি করা হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নে কাটানো সময়টিতেই আমরা বুঝতে পারতাম, একদলীয় শাসনব্যবস্থায় আসলে গণতন্ত্র খুব দ্রুত লোপ পায়। মুখে গণতন্ত্রের কথা বলা হলেও সেটা আসলে একদলীয় শাসনই (গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা বা ডেমোক্রেটিক সেন্ট্রালিজম আসলে সোনার পাথর বাটি)। আদতে গণতন্ত্রের সঙ্গে একদলীয় শাসনব্যবস্থার সহাবস্থানের সুযোগ নেই।
যখন একটি দল বছরের পর বছর ক্ষমতায় থাকে, তখন নেতৃত্ব আটকে যায় এক ঘেরাটোপে। মূল নেতার চারপাশে তোষামোদকারীদের একটা বলয় সৃষ্টি হয়। তাঁরা মূল নেতাকে খুশি করার জন্য সত্য-মিথ্যা মিলে এমন এক জগাখিচুড়ি বয়ান তৈরি করেন, যা বাস্তবতার প্রতিনিধিত্ব করে না। তখনই মূল নেতা জনগণের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে থাকেন।
প্রকৃত সৎ ও ত্যাগী রাজনীতিবিদেরা তখন দৃশ্যপট থেকে উধাও হয়ে যান। ভুঁইফোড় সুবিধাবাদীরা তখন লকলকে জিহ্বা বের করে সবকিছু চেটেপুটে খাওয়ার প্রতিযোগিতায় মত্ত হন। মূল নেতার সদিচ্ছা থাকলেও তখন তিনি আশপাশে যাঁদের পান, তাঁদের বেশির ভাগই আখের গুছিয়ে নেওয়ার সৈনিক। তিনি বিশ্বাস করে কোনো প্রকল্প তাঁদের হাতে দেওয়ার কিছুদিন পরই দেখতে পান, যাঁকে বিশ্বাস করেছিলেন, তিনিই আখের গুছিয়ে নিয়েছেন। যে যায় লঙ্কায়, সে-ই হয় রাবণ।
আমাদের দেশে সেনাশাসনের সময় আমরা স্বৈরশাসন দেখেছি। খুবই দুঃখজনক ব্যাপার হলো, গণতন্ত্রের কথা বলছি যখন, তখনো তা ঘুরেফিরে স্বৈরশাসনের কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে। বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করলে দেখি, যে ভাবনা থেকে গণতন্ত্রকে আলিঙ্গন করেছিল একসময় অনেক দেশ, সে ভাবনাটি ক্রমেই রুগ্ণ হয়ে গেছে। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য, ভোট কেনার জন্য কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার শ্রাদ্ধ হচ্ছে; অর্থাৎ ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব’ স্লোগানটি আসলে তার মূল্য হারাচ্ছে।
সারা পৃথিবীতেই গণতন্ত্রের লড়াইয়ে অনেক খাদ এসে মিশেছে। প্রধানমন্ত্রী-শাসিত এবং রাষ্ট্রপতি-শাসিত গণতান্ত্রিক দুই সরকার পদ্ধতির সবচেয়ে প্রসিদ্ধ দুই দেশ ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের দিকে তাকালেও আমরা দেখতে পাই, পুঁজির সঙ্গে সেখানেও রাজনীতির গাঢ় সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। সততা ও জনগণের সেবা সে দেশগুলোতেও মুখ্য নয়; বরং যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় টিকে থাকা বা ক্ষমতায় আসাটাই জরুরি ব্যাপার। সেই পথটিতে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অবলম্বন করা বুঝি আর জরুরি নয়।
বাংলাদেশ নবীন দেশ। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বারবার এ দেশে হোঁচট খেয়েছে। সবচেয়ে যা ভয়াবহ তা হলো, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নির্বিঘ্নে চলার জন্য যে পারস্পরিক সম্মানবোধ থাকা দরকার, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তার বড্ড অভাব। দেশ পরিচালনার জন্য নির্বাচনের আগে যে রাজনৈতিক ইশতেহার বা কর্মসূচি তৈরি করা হয়, ক্ষমতায় এলে তার বাস্তবায়নে অনীহা দেখা যায়। মূলত নির্বাচন ঘিরেই সাধারণ জনগণের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পর্ক তৈরি হয়। নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর সাধারণ জনগণ তাদের সাধারণ জীবনযাত্রাই অব্যাহত রাখে এবং অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে, তাতে তারা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে বড় কোনো ইতিবাচক পরিবর্তনের মতো কিছু প্রত্যাশা করে না।
তবে, এ সময় একধরনের মানুষের সৃষ্টি হয়, যারা সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ঢুকে যায় এবং প্রকল্পের খরচ বাড়িয়ে দেওয়ার এক জাদুকরী ক্ষমতার অধিকারী হয়ে যায়। এই ‘টাকার মেশিন’দের যারা তৈরি করেন এবং যারা এই টাকার মেশিনে পরিণত হয়, আসল যুদ্ধটা তাদের সঙ্গেই। কিন্তু সেই যুদ্ধ করতে হলে যে ঐক্য ও একাগ্রতা দরকার, তার দেখা পাওয়া যায় না। রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যেই এই টাকার মেশিনদের জন্য রক্ষাকবচ থেকে যায়, নইলে একটা হাওয়া ভবন তৈরি হয় না, ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকা লোপাট হয় না, ভিনদেশে অর্থ পাচার হয় না, ঋণখেলাপির সংস্কৃতি গড়ে ওঠে না।
৩. তাই অকপটে স্বীকার করে নেওয়া ভালো, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে দেশটি গড়তে চাওয়া হয়েছিল, সেই দেশটা গড়ে ওঠেনি; বরং নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকারগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। গালভরা বুলি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকারকে হৃদয়ে প্রথিত করা যায় না। অঙ্গীকারকে হৃদয়ে প্রথিত করতে হয় কাজ দিয়ে। সেই কাজের জায়গাটাই কলুষিত হতে হতে এখন আখের গোছানোর মস্ত এক কলঙ্কজনক ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। এ জন্য ক্ষমতালিপ্সু সেনা কর্মকর্তা, সরকারি আমলা, রাজনীতিবিদ তো দায়ী বটেই, তথাকথিত সুশীলেরাও এই অরাজকতার মধ্যে ঘোলা পানিতে মৎস্য শিকার করতে পারছেন। আমাদের সংস্কৃতি অঙ্গনটার দিকে তাকালেও এ রকম সুবিধাভোগী কোটিপতির দেখা মিলবে।
তাই যুদ্ধটা আসলে কোথায়, সেটা তো বুঝতে হবে আগে। নইলে এক দলের জায়গায় অন্য দলের জয়গান গাইলে তা শুধু ক্ষমতার পালাবদলই ঘটাবে, ইতিবাচক কোনো পরিবর্তন আনবে না।
৪. রাষ্ট্র গঠনের জন্য একটি ভূখণ্ড, সংস্কৃতি, অর্থনীতির প্রয়োজন রয়েছে। যেকোনো রাষ্ট্রের জন্যই তা প্রযোজ্য। রাষ্ট্র গঠনে এর চেয়েও বড় যে দুটি উপাদান রয়েছে, সেগুলো হলো জনগণ আর আদর্শ।
আমরা এই জনগণ আর আদর্শের জায়গাটাকে ক্রমাগত অবহেলা করেছি। আমরা ক্ষণে ক্ষণে আমাদের ‘কিবলা’ পরিবর্তন করেছি।আমরা কখনো গণতন্ত্রের কথা বলেছি, সমাজতন্ত্রের কথা বলেছি, ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেছি, কখনো সেগুলোকে অগ্রাহ্য করে আইয়ুব-ইয়াহিয়া স্টাইলে সেনাশাসনের দিকে গিয়েছি। আমরা কখনো মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের কথা বলেছি, কখনো ফিরে গিয়েছি মিনি পাকিস্তানে। পাকিস্তানি নেতা ভুট্টোর সঙ্গে পরামর্শ করে, ভুট্টোর টাকায় সদ্য স্বাধীন দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করেছি। মুক্তিযুদ্ধের মর্ম উপলব্ধি করিনি। আর তাই মুক্তিযুদ্ধকে হৃদয়ে ধারণ না করায় মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জয় বাংলা স্লোগান হয়ে পড়েছে গালভরা বুলি।
যিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্লোগান দিচ্ছেন, তাঁর রাজনৈতিক চরিত্রের মধ্যে কোনো ভেজাল দেখা গেলে সাধারণ মানুষ সেই মানুষটিকেই শুধু ‘ভুয়া’ বলে মনে করে না; বরং সেই চেতনার ওপর থেকেও বিশ্বাস হারাচ্ছে। বিভিন্ন সময় আমাদের দেশের ক্ষমতায় থাকা বিভিন্ন দল যে আদর্শের কথা জনগণকে শুনিয়েছে, সেই আদর্শের সঙ্গে নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনের মিল ছিল খুব কম। তাই তাঁদের আদর্শের অধঃপতনে জনগণ হতাশ হয়েছে এবং কারও ওপর বিশ্বাস রাখতে পারছে না।
আর যে দলগুলো ক্ষমতায় আসেনি কখনো, সে রকম বামপন্থী আর ডানপন্থী দলগুলোর ভেতরের খবর যখন বের হয়ে এসেছে, তখন তাদের ওপরও আস্থা রাখার মতো কোনো ভরসা পায়নি জনগণ। জনগণের সামনে তাই বেছে নেওয়ার মতো কোনো ‘আদর্শ’ কি আর আছে? যুদ্ধটা আসলে এখানেও।
৫. দেশটা আসলে কী? রূপক অর্থে বললে দেশটা হলো একটি ভূখণ্ডে বসবাসকারী মানুষের স্বপ্ন বাস্তবায়নের স্থল। দেশের মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যুদ্ধ। অথচ আমরা দেশের মানুষকে অগ্রাহ্য করে নিজেদের আখের গোছানোর কাজটাকেই ‘মহৎ’ কর্মে রূপান্তরিত করার প্রক্রিয়াকে রাজনীতি নাম দিয়েছি। যুদ্ধটা আসলে এখানেই।
যিনি হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে ফসল ফলাচ্ছেন, দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার জন্য জীবন বাজি রেখেছেন, যিনি কারখানায় কাজ করে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের একজন নিবেদিত সংগ্রামী হিসেবে প্রত্যয়ী হয়েছেন, তাঁদের অবদানের কথা ভুলে গিয়ে শুধু গালভরা বুলিতে রাজনীতিবিদেরা যদি রাজনীতির মাঠ কাঁপাতে চান, তাহলে তা জনগণের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তব রূপ দিতে পারে না। আমাদের যুদ্ধটা আসলে এখানেও।
সবচেয়ে বড় সংকট হলো, আমরা নানা ধরনের আমলাতন্ত্র, পুঁজিপতি নামের গিলে খাওয়া সংস্কৃতির ধারকদের তুলে ধরেছি আদর্শ হিসেবে, সেখানে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছে শিক্ষা। শিক্ষা ও শিক্ষককে মর্যাদা দিইনি আমরা। তাই অর্থের উল্লম্ফনে বেচারা গণতন্ত্রের নাভিশ্বাস উঠছে। যুদ্ধটা আসলে সেখানেও।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
আসন্ন নির্বাচন নিয়ে লিখতে ইচ্ছে করে না স্রেফ এই কারণে যে, লাউ আর কদুর গল্পটাই সেখানে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করছে। ক্ষমতায় থাকা দলটি দুর্নীতিবাজ, আর ক্ষমতার বাইরের দলটির সাফসুতরো অবয়ব—এ রকম ভাবলে খুবই ভুল হবে। মূলত ক্ষমতার কাছে গেলে দলগুলোর সাংগঠনিক দিকটি ক্রমেই বিলুপ্ত হতে থাকে। পুরো দলটাই তখন সরকার হয়ে যায়। আর তখন সরকারি টাকাপয়সার হিসাব-নিকাশের সঙ্গে দলের নেতারা এতটাই একাত্ম হয়ে যান যে তৃণমূল পর্যায়ের নেতারা তখন হয়ে ওঠেন অপাঙ্ক্তেয়। দল আর সরকারে কোনো ভেদাভেদ থাকে না।
ক্ষমতায় আসা দলের নেতাদের সম্পদের হিসাব নেওয়া হলে যদি তাঁদের সম্পত্তি অস্বাভাবিক রকম স্ফীত হয়ে উঠেছে বলে মনে হয়, তাহলে জানবেন, এখন পর্যন্ত এই স্ফীতি নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা হয়নি। এমপি-মন্ত্রী হলে একটা বিশেষ ভিআইপি সুবিধার আওতায় ব্যক্তিগত অর্থনীতির চাকা প্রবল বেগে কীভাবে ঘুরতে থাকে, সে কথা বোধকরি প্রাপ্তবয়স্ক বেশির ভাগ মানুষই জানেন। এই ‘বুঝদার’ মানুষেরা তক্কে তক্কে থাকেন। তাঁদের মধ্যে যাঁরা চালাক, তাঁরা ঝোপ বুঝে কোপ মারেন, সুযোগমতো দল বদলান। কোন দিকে হাওয়া বইছে, সেটা বুঝে নিয়ে নিজেদের শরীর সেদিকে ভাসিয়ে দেন। দিনের পর দিন সেটাই তো দেখা যাচ্ছে।
২. একদলীয় শাসনব্যবস্থার সংকট নিয়ে ১৯৯৬ সালের শুরুতে একটি উপসম্পাদকীয় লিখেছিলাম দৈনিক সংবাদে। তখন কেবল সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ফিরেছি। লেনিন কীভাবে পর্যুদস্ত হলেন রাশিয়ায়, আমার দেখা সেই অভিজ্ঞতার আলোকেই লেখাটা তৈরি করা হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নে কাটানো সময়টিতেই আমরা বুঝতে পারতাম, একদলীয় শাসনব্যবস্থায় আসলে গণতন্ত্র খুব দ্রুত লোপ পায়। মুখে গণতন্ত্রের কথা বলা হলেও সেটা আসলে একদলীয় শাসনই (গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা বা ডেমোক্রেটিক সেন্ট্রালিজম আসলে সোনার পাথর বাটি)। আদতে গণতন্ত্রের সঙ্গে একদলীয় শাসনব্যবস্থার সহাবস্থানের সুযোগ নেই।
যখন একটি দল বছরের পর বছর ক্ষমতায় থাকে, তখন নেতৃত্ব আটকে যায় এক ঘেরাটোপে। মূল নেতার চারপাশে তোষামোদকারীদের একটা বলয় সৃষ্টি হয়। তাঁরা মূল নেতাকে খুশি করার জন্য সত্য-মিথ্যা মিলে এমন এক জগাখিচুড়ি বয়ান তৈরি করেন, যা বাস্তবতার প্রতিনিধিত্ব করে না। তখনই মূল নেতা জনগণের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে থাকেন।
প্রকৃত সৎ ও ত্যাগী রাজনীতিবিদেরা তখন দৃশ্যপট থেকে উধাও হয়ে যান। ভুঁইফোড় সুবিধাবাদীরা তখন লকলকে জিহ্বা বের করে সবকিছু চেটেপুটে খাওয়ার প্রতিযোগিতায় মত্ত হন। মূল নেতার সদিচ্ছা থাকলেও তখন তিনি আশপাশে যাঁদের পান, তাঁদের বেশির ভাগই আখের গুছিয়ে নেওয়ার সৈনিক। তিনি বিশ্বাস করে কোনো প্রকল্প তাঁদের হাতে দেওয়ার কিছুদিন পরই দেখতে পান, যাঁকে বিশ্বাস করেছিলেন, তিনিই আখের গুছিয়ে নিয়েছেন। যে যায় লঙ্কায়, সে-ই হয় রাবণ।
আমাদের দেশে সেনাশাসনের সময় আমরা স্বৈরশাসন দেখেছি। খুবই দুঃখজনক ব্যাপার হলো, গণতন্ত্রের কথা বলছি যখন, তখনো তা ঘুরেফিরে স্বৈরশাসনের কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে। বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করলে দেখি, যে ভাবনা থেকে গণতন্ত্রকে আলিঙ্গন করেছিল একসময় অনেক দেশ, সে ভাবনাটি ক্রমেই রুগ্ণ হয়ে গেছে। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য, ভোট কেনার জন্য কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার শ্রাদ্ধ হচ্ছে; অর্থাৎ ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব’ স্লোগানটি আসলে তার মূল্য হারাচ্ছে।
সারা পৃথিবীতেই গণতন্ত্রের লড়াইয়ে অনেক খাদ এসে মিশেছে। প্রধানমন্ত্রী-শাসিত এবং রাষ্ট্রপতি-শাসিত গণতান্ত্রিক দুই সরকার পদ্ধতির সবচেয়ে প্রসিদ্ধ দুই দেশ ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের দিকে তাকালেও আমরা দেখতে পাই, পুঁজির সঙ্গে সেখানেও রাজনীতির গাঢ় সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। সততা ও জনগণের সেবা সে দেশগুলোতেও মুখ্য নয়; বরং যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় টিকে থাকা বা ক্ষমতায় আসাটাই জরুরি ব্যাপার। সেই পথটিতে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অবলম্বন করা বুঝি আর জরুরি নয়।
বাংলাদেশ নবীন দেশ। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বারবার এ দেশে হোঁচট খেয়েছে। সবচেয়ে যা ভয়াবহ তা হলো, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নির্বিঘ্নে চলার জন্য যে পারস্পরিক সম্মানবোধ থাকা দরকার, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তার বড্ড অভাব। দেশ পরিচালনার জন্য নির্বাচনের আগে যে রাজনৈতিক ইশতেহার বা কর্মসূচি তৈরি করা হয়, ক্ষমতায় এলে তার বাস্তবায়নে অনীহা দেখা যায়। মূলত নির্বাচন ঘিরেই সাধারণ জনগণের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পর্ক তৈরি হয়। নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর সাধারণ জনগণ তাদের সাধারণ জীবনযাত্রাই অব্যাহত রাখে এবং অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে, তাতে তারা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে বড় কোনো ইতিবাচক পরিবর্তনের মতো কিছু প্রত্যাশা করে না।
তবে, এ সময় একধরনের মানুষের সৃষ্টি হয়, যারা সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ঢুকে যায় এবং প্রকল্পের খরচ বাড়িয়ে দেওয়ার এক জাদুকরী ক্ষমতার অধিকারী হয়ে যায়। এই ‘টাকার মেশিন’দের যারা তৈরি করেন এবং যারা এই টাকার মেশিনে পরিণত হয়, আসল যুদ্ধটা তাদের সঙ্গেই। কিন্তু সেই যুদ্ধ করতে হলে যে ঐক্য ও একাগ্রতা দরকার, তার দেখা পাওয়া যায় না। রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যেই এই টাকার মেশিনদের জন্য রক্ষাকবচ থেকে যায়, নইলে একটা হাওয়া ভবন তৈরি হয় না, ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকা লোপাট হয় না, ভিনদেশে অর্থ পাচার হয় না, ঋণখেলাপির সংস্কৃতি গড়ে ওঠে না।
৩. তাই অকপটে স্বীকার করে নেওয়া ভালো, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে দেশটি গড়তে চাওয়া হয়েছিল, সেই দেশটা গড়ে ওঠেনি; বরং নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকারগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। গালভরা বুলি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকারকে হৃদয়ে প্রথিত করা যায় না। অঙ্গীকারকে হৃদয়ে প্রথিত করতে হয় কাজ দিয়ে। সেই কাজের জায়গাটাই কলুষিত হতে হতে এখন আখের গোছানোর মস্ত এক কলঙ্কজনক ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। এ জন্য ক্ষমতালিপ্সু সেনা কর্মকর্তা, সরকারি আমলা, রাজনীতিবিদ তো দায়ী বটেই, তথাকথিত সুশীলেরাও এই অরাজকতার মধ্যে ঘোলা পানিতে মৎস্য শিকার করতে পারছেন। আমাদের সংস্কৃতি অঙ্গনটার দিকে তাকালেও এ রকম সুবিধাভোগী কোটিপতির দেখা মিলবে।
তাই যুদ্ধটা আসলে কোথায়, সেটা তো বুঝতে হবে আগে। নইলে এক দলের জায়গায় অন্য দলের জয়গান গাইলে তা শুধু ক্ষমতার পালাবদলই ঘটাবে, ইতিবাচক কোনো পরিবর্তন আনবে না।
৪. রাষ্ট্র গঠনের জন্য একটি ভূখণ্ড, সংস্কৃতি, অর্থনীতির প্রয়োজন রয়েছে। যেকোনো রাষ্ট্রের জন্যই তা প্রযোজ্য। রাষ্ট্র গঠনে এর চেয়েও বড় যে দুটি উপাদান রয়েছে, সেগুলো হলো জনগণ আর আদর্শ।
আমরা এই জনগণ আর আদর্শের জায়গাটাকে ক্রমাগত অবহেলা করেছি। আমরা ক্ষণে ক্ষণে আমাদের ‘কিবলা’ পরিবর্তন করেছি।আমরা কখনো গণতন্ত্রের কথা বলেছি, সমাজতন্ত্রের কথা বলেছি, ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেছি, কখনো সেগুলোকে অগ্রাহ্য করে আইয়ুব-ইয়াহিয়া স্টাইলে সেনাশাসনের দিকে গিয়েছি। আমরা কখনো মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের কথা বলেছি, কখনো ফিরে গিয়েছি মিনি পাকিস্তানে। পাকিস্তানি নেতা ভুট্টোর সঙ্গে পরামর্শ করে, ভুট্টোর টাকায় সদ্য স্বাধীন দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করেছি। মুক্তিযুদ্ধের মর্ম উপলব্ধি করিনি। আর তাই মুক্তিযুদ্ধকে হৃদয়ে ধারণ না করায় মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জয় বাংলা স্লোগান হয়ে পড়েছে গালভরা বুলি।
যিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্লোগান দিচ্ছেন, তাঁর রাজনৈতিক চরিত্রের মধ্যে কোনো ভেজাল দেখা গেলে সাধারণ মানুষ সেই মানুষটিকেই শুধু ‘ভুয়া’ বলে মনে করে না; বরং সেই চেতনার ওপর থেকেও বিশ্বাস হারাচ্ছে। বিভিন্ন সময় আমাদের দেশের ক্ষমতায় থাকা বিভিন্ন দল যে আদর্শের কথা জনগণকে শুনিয়েছে, সেই আদর্শের সঙ্গে নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনের মিল ছিল খুব কম। তাই তাঁদের আদর্শের অধঃপতনে জনগণ হতাশ হয়েছে এবং কারও ওপর বিশ্বাস রাখতে পারছে না।
আর যে দলগুলো ক্ষমতায় আসেনি কখনো, সে রকম বামপন্থী আর ডানপন্থী দলগুলোর ভেতরের খবর যখন বের হয়ে এসেছে, তখন তাদের ওপরও আস্থা রাখার মতো কোনো ভরসা পায়নি জনগণ। জনগণের সামনে তাই বেছে নেওয়ার মতো কোনো ‘আদর্শ’ কি আর আছে? যুদ্ধটা আসলে এখানেও।
৫. দেশটা আসলে কী? রূপক অর্থে বললে দেশটা হলো একটি ভূখণ্ডে বসবাসকারী মানুষের স্বপ্ন বাস্তবায়নের স্থল। দেশের মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যুদ্ধ। অথচ আমরা দেশের মানুষকে অগ্রাহ্য করে নিজেদের আখের গোছানোর কাজটাকেই ‘মহৎ’ কর্মে রূপান্তরিত করার প্রক্রিয়াকে রাজনীতি নাম দিয়েছি। যুদ্ধটা আসলে এখানেই।
যিনি হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে ফসল ফলাচ্ছেন, দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার জন্য জীবন বাজি রেখেছেন, যিনি কারখানায় কাজ করে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের একজন নিবেদিত সংগ্রামী হিসেবে প্রত্যয়ী হয়েছেন, তাঁদের অবদানের কথা ভুলে গিয়ে শুধু গালভরা বুলিতে রাজনীতিবিদেরা যদি রাজনীতির মাঠ কাঁপাতে চান, তাহলে তা জনগণের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তব রূপ দিতে পারে না। আমাদের যুদ্ধটা আসলে এখানেও।
সবচেয়ে বড় সংকট হলো, আমরা নানা ধরনের আমলাতন্ত্র, পুঁজিপতি নামের গিলে খাওয়া সংস্কৃতির ধারকদের তুলে ধরেছি আদর্শ হিসেবে, সেখানে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছে শিক্ষা। শিক্ষা ও শিক্ষককে মর্যাদা দিইনি আমরা। তাই অর্থের উল্লম্ফনে বেচারা গণতন্ত্রের নাভিশ্বাস উঠছে। যুদ্ধটা আসলে সেখানেও।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
‘দুই দিন আগেই বাড়ি থেকে পাথরঘাটায় চলে এসেছি। এখন পুরোনো জাল সেলাই করছি। এক সপ্তাহের বাজারও করে এনেছি। আজ বিকেলে সাগর মোহনায় যাব, গভীর রাত থেকে জাল ফেলব।’ কথাগুলো বলছিলেন বরগুনা সদরের বাইনচটকী এলাকার জেলে হোসেন আলী। গতকাল বুধবার সকালে বরগুনার পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে কথা হয় তাঁর...
১২ জুন ২০২৫ভারতের স্থলবন্দর নিষেধাজ্ঞার পর সীমান্তে আটকে থাকা তৈরি পোশাক, খাদ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের ট্রাকগুলো ফেরত আনছেন রপ্তানিকারকেরা। তবে যেসব ট্রাক বন্দরে ঢুকে গিয়েছিল, সেগুলো ভারতে প্রবেশ করানোর চেষ্টা চলছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসব ট্রাক ঢুকতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে।
১৯ মে ২০২৫আধুনিক যুগের সবচেয়ে বিস্ময়কর প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারগুলোর একটি হচ্ছে গৌতম বুদ্ধের দেহাবশেষের সঙ্গে সম্পর্কিত ঐতিহাসিক রত্নসম্ভার। গতকাল বুধবার হংকংয়ে বিখ্যাত আর্ট নিলাম কোম্পানি সাদাবি’স-এর এক নিলামে এগুলো তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
০৮ মে ২০২৫পাকিস্তানে ভারতের হামলার সমালোচনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। চীনও এই হামলাকে ‘দুঃখজনক’ বলে অভিহিত করেছে। উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘও। উত্তেজনা যেন আরও না বাড়ে, সে জন্য দুই পক্ষকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশ। এদিকে ভারতের অবস্থানকে সমর্থন করেছে...
০৮ মে ২০২৫